ফেরারি প্রেম পর্ব ৩৫

ফেরারি প্রেম পর্ব ৩৫
নিশাত জাহান নিশি

“আরামটাই পরে বেরাম হয়ে বের হবে! দেখুন না বাড়িতে যাওয়ার পর ঠিক কী কী হাল হয় আপনার। রূপল কী চিজ তা বাড়ি যাওয়ার পর বুঝবেন।”

রূপলের বিদ্বেষমূলক কথায় কান দিলোনা নীহারিকা। সে তার চ্যালেঞ্জ পুরো করতে তৎপর। এই চ্যালেঞ্জই যে তার সাজা হয়ে দাঁড়াবে এই বিষয়ে যদিও নীহারিকা পূর্ব অবগত তবে এই মুহূর্তে নিজের জেদ এবং দম্ভ বজায় রাখার জন্য সে এরচেয়েও ভয়ঙ্ক চ্যালেঞ্জ নিতে রাজি ছিল! শরীরের অবস্থা বেগতিক খারাপের দিকে অগ্রসর হলেও নীহারিকা ক্রমান্বয়ে আট প্লেট ফুচকা শেষ করল।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

এই পর্যায়ে এসে তার বমি বমি ভাব পেতে শুরু করল। মনে হচ্ছিল যেন ভেতর থেকে সব উল্টে চলে আসবে। অতিরিক্ত ঝালের প্রভাবে চ্যালেঞ্জটা পুরো করতে তার বড্ড বেগ পেতে হচ্ছে! তার খাওয়া প্রতিদিনের নরমাল ফুচকা হলে দশ প্লেট ফুচকা খাওয়া তার জন্যে এক চুটকির ব্যাপার ছিল। জেনে বুঝেই রূপল এই ডেয়ারিং চ্যালেঞ্জটা দিয়েছে! ইচ্ছে করেই নীহারিকার দুর্বল জায়গাতে আঘাত করেছে।

অশ্রুভেজা রক্তিম দু’চোখে নীহারিকা রূপলের দিকে তাকালো। ভ্রু যুগল উঁচিয়ে রূপল মিচকে হেসে নীহারিকার দিকে তাকিয়ে রইল। চোখের ইশারায় বলল,
“কী? ভেতরে যাচ্ছেনা আর? হেল্প করব?”

রূপলের মুখের দিকে তাকিয়ে এমনকি তার বিদ্রুপাত্নক ইশারায় নীহারিকা চেয়েও রূপলের কাছে হার মানতে পারলনা! বরং পূর্বের তুলনায় অপ্রত্যুল জেদ চেপে বসল তার সর্বাঙ্গে। শরীরের বেহাল দশা নিয়েই সে গপাগপ ফুচকাগুলো মুখে ঢুকাতে লাগল। চোখ থেকে অঝরে জল এবং গাঁ থেকে অনবরত ঘাম ঝরলেও নীহারিকা দশ প্লেট ফুচকা খেয়ে তার চ্যালেঞ্জ পুরো করল!

ব্যাপারটায় রীতিমত অবাক হয়ে গেল রূপল! অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে সে নীহারিকার দিকে তাকিয়ে রইল। এই অসম্ভব কাজ তো নীহারিকার পক্ষে সম্ভব করার এক পার্সেন্ট চান্সও ছিলনা! কারণ, ঝাল তো নীহারিকা একদমই খেতে পারেনা। তার প্রেডিকশন অনুযায়ী দুই প্লেট ফুচকা খাওয়াও নীহারিকার জন্য কষ্টদায়ক হয়ে দাঁড়াবে। সেই জায়গায় দশ দশ প্লেট ফুচকা? হাউ ইট’স পসিবল? রূপলের হতবাক মুখের দিকে তাকিয়ে নীহারিকা অস্বস্তিকর অবস্থাতেও ফিক করে হেসে দিলো! নীহারিকার হাসি দেখে রাগে গাঁ পিত্তি জ্বলে গেল রূপলের! সঙ্গে সঙ্গেই সে চেয়ার ঠেলে জায়গা থেকে ওঠে দাড়ালো। মুহূর্তেই ফুচকা আনা ছেলেটিকে ডেকে আনল। আড়ালে নিয়ে গেল তাকে। রাগী গলায় দাঁতে দাঁত চেপে শুধালো,

“ঝাল দিসনি ফুচকাতে? মেয়েটা ফুচকাগুলো শেষ করল কীভাবে?”
ছেলেটি ভীতু গলায় বলল,
“দিয়েছিলাম তো ভাই। আপনি যেভাবে বলেছিলেন সেভাবেই দিয়েছিলাম। তবে আমার মনে হচ্ছে ফুচকাগুলো মেয়েটা এখন কোনো রকম শেষ করলেও পরে হজম করতে তার অসুবিধা হবে!”

ছেলেটিকে যেতে দিলো রূপল। ভেতরে ভেতরে খুশিতে ফেটে পড়ল সে! তবে বাইরে তা প্রকাশ করলনা। পুনরায় ভাবসাব নিয়ে সে নীহারিকার দিকে এগিয়ে গেল। একই জায়গায় শক্ত হয়ে বসে আছে নীহারিকা। ভেতরে ভেতরে তার অবস্থা জটিল হলেও উপরে উপরে সে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করল। নীহারিকার ট্রিক বুঝতে পেরে রূপল ফিচেল হাসল। চেয়ার টেনে নীহারিকার সামনে বসল। চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে বোতলের ছিপি খুলে ভাবশূণ্যভাবে সে নীহারিকার দিকে বোতলটি এগিয়ে দিলো। স্বাভাবিক গলায় বলল,

“এই নিন। পানি খান।”
জায়গা থেকে খানিক নড়েচড়ে বসল নীহারিকা। ভেতরটা তার ফেটে গেলেও সে গলা ঝাকিয়ে বলল,
“নো থ্যাংকস।”
নীহারিকাকে উস্কে দিতে বিন্দুমাত্র ক্ষান্ত হলোনা রূপল! পকেট থেকে একটি টিস্যু বের করে সে নীহারিকার দিকে এগিয়ে দিলো। বেখেয়ালি গলায় বলল,

“টেইক ইট। ঘামটা মুছে নিন।”
রূপলকে যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করল নীহারিকা। গাঁয়ের ওড়না দ্বারা মুখে জমে থাকা ঘামগুলো মুছে নিলো সে! মুখটা অন্যপাশে ঘুরিয়ে গাঁ ছাড়া ভাব নিয়ে বলল,
“লাগবেনা।”

চেয়ারে আরও পাকাপোক্তভাবে হেলান দিয়ে বসল রূপল! সামনের অগোছালো চুলগুলো ঠিক করল সে। নীহারিকার ধরাশায়ী অবস্থা দেখে পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছে সে। মনে ক্ষোভ এবং আনন্দ নিয়ে রূপল দ্রুত গলায় নীহারিকার দিকে প্রশ্ন ছুড়ল,

“তো বলুন? মাঝরাতে আমাকে ঐভাবে হেনস্তা করার কারণ কী? আমি আপনার কোন ক্ষতিটা করেছিলাম?”
বিব্রত হয়ে উঠল নীহারিকা! একই জায়গায় বসে থাকতে পারলনা আর। চট করে সে বসা থেকে ওঠে দাড়ালো। অস্বস্তিকর গলায় রূপলকে বলল,
“আমি বাড়ি যাব।”

“উঁহু! কোথাও যাওয়া হচ্ছেনা আপনার। আগে আমার প্রশ্নের উত্তর চাই।”
রূপলের দিকে ঘুরে দাড়ালো নীহারিকা। প্রখর রাগী দৃষ্টিতে রূপলের দিকে তাকালো সে। খরতর গলায় বলল,
“আমি আপনার কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য নই। আমি বলেছি বাড়ি যাব মানে বাড়িই যাব!”

রূপলকে রাগিয়ে দিয়ে নীহারিকা জায়গা থেকে প্রস্থান নিতেই নীহারিকার সেলফোনটি বেজে উঠল। পার্স থেকে ফোনটি হাতে নিয়ে নীহারিকা স্ক্রীনের দিকে না তাকিয়েই কলটি তুলে ফেলল। দ্রুত গলায় হ্যালো বলে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই নীহারিকা “কে আপনি” বলে চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল! তৎক্ষণাৎ মাটিতে লুটিয়ে পরল! শকড হয়ে রূপল একই জায়গায় বসে রইল। ইদানিং নীহারিকার আচরণ তার কেমন যেন অস্বাভাবিক লাগছে। রহস্যময়ী লাগছে নীহারিকাকে। কী চলছে নীহারিকার ভেতরে তা জানার আগ্রহ তাকে ক্রমাগত গ্রাস করে তুলছিল। ফোনের ঐ পাড়ে কে ছিল তা জানার আগ্রহ রূপলকে উৎকণ্ঠিত করে তুলল।

নীহারিকা সেন্সলেস হয়ে পড়ে যেতেই আশপাশ থেকে মানুষ এসে ভীড় জমিয়ে ফেলল। সবার মধ্যে আতঙ্ক কাজ করতে লাগল। ঘোর থেকে বের হয়ে এসে রূপল দৌড়ে এলো নীহারিকার কাছে। নীহারিকাকে উঠিয়ে তার হাঁটুর উপর রাখল। পেরেশান হয়ে পানি ছিটাতে লাগল নীহারিকার চোখেমুখে।

নীহারিকার গাল দুটিতে চাপড়ও মারতে লাগল। মিনিট কয়েকের মধ্যে নীহারিকার জ্ঞান ফিরে এলো। তবে চোখ খুলেই সে পেটের অস্বস্তি নিয়ে বমি করতে লাগল! মুহূর্তেই সে রূপলকে বমি করে ভাসিয়ে দিলো। ব্যাপারটায় রূপল বিন্দুমাত্র নাক সিটকালো না! বরং নীহারিকাকে স্বস্তি দিতে মরিয়া হয়ে উঠল। নীহারিকার পিঠে হাত বুলাতে লাগল। আরাম পেয়ে নীহারিকা ভেতরের সব উগলে দিতে লাগল।

এই ঝামেলার মধ্যেই একজন লোক ভীড় ঠেলে ফুচকার স্টল থেকে যাওয়ার সময় হঠাৎ রূপলের গাঁয়ে ধাক্কা মেরে গেল! বিরক্ত হয়ে রূপল লোকটির যাওয়ার পথে তাকালো। চোয়াল উঁচিয়ে চিৎকার করে বলল,
“এই কে?”

পিছু ফিরে তাকালো না লোকটি। দ্রুত পায়ে হেটে জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো। এখান থেকে পালিয়ে যেতে পারলেই যেন লোকটি বাঁচে। সেদিকে আর মন দিলোনা রূপল। নীহারিকাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। বমি থামিয়ে নীহারিকা শান্ত হতেই রূপল ঘটনার আকস্মিকতায় নীহারিকাকে কোলে তুলে নিলো! আধমরা শরীর নিয়ে নীহারিকা অর্ধখোলা দৃষ্টিতে রূপলের দিকে তাকিয়ে রইল। শরীরটা তার অসাড় হয়ে আসছে। ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে আসছে। দুনিয়াটা অন্ধকার মনে হচ্ছে। সে তার ভেতরের অবস্থাটা বুঝাতে পারছেনা রূপলকে। মরি মরি অবস্থা তার! এই মুহূর্তে রূপলকে বেশ আপন মনে হতে লাগল নীহারিকার। শরীরের শক্তি হারিয়ে মিনমিনে গলায় সে রূপলকে লক্ষ্য করে বলল,

“আমি আর পারছিনা মিস্টার রূপল! আমি সুস্থ হতে চাই। প্লিজ হেল্প মি।”
নীহারিকার এই রোগা অবস্থা দেখে রূপল নিজেকে অপরাধী ভাবতে লাগল। অপরাধবোধ থেকে সে নীহারিকাকে কোলে তুলে নিতে বাধ্য হয়েছিল! ভাবুক গলায় সে প্রত্যত্তুরে নীহারিকাকে বলল,
“ডোন্ট ওরি নীহারিকা। আপনার কিছু হবেনা। খুব জলদি সুস্থ হয়ে উঠবেন আপনি। প্লিজ ট্রাস্ট মি।”
“আমাকে বাড়ি নিয়ে চলুন প্লিজ।”

গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেল নীহারিকার। ভয়ঙ্কর এক দুঃস্বপ্ন দেখে সে লাফিয়ে উঠল ঘুম থেকে। হাত দ্বারা কান দুটি চেপে ধরে সে চোখ দুটি বুজে ভয়ে ফোঁপাতে লাগল। ড্রিম লাইট জ্বলছিল রুমে। লাইটের মিটমিটে আলোটাও যেন তার কাছে অন্ধকারাচ্ছন্ন মনে হলো। ঘুটঘুটে কালো অন্ধকার মনে হচ্ছিল। গলা থেকে কোনো শব্দই বের হচ্ছিল না তার। কোনো মানুষের ছায়া যেন তার চোখে ভাসতে লাগল।

মানুষটি তার আশেপাশে হাঁটছিল। থেকে থেকে কিছু বিভৎস আওয়াজ তার কানে ভেসে আসতে লাগল। সব মিলিয়ে মোটামুটি ভয়ঙ্কর একটি পরিবেশ বিরাজ করছিল তার আশেপাশে। ভয়ে আঁতকে উঠল নীহারিকা। তাৎক্ষণিক তার সেলফোনটিও বেজে উঠল। একটি আননোন নাম্বার থেকে কল। ক্রমাগত কলটি বেজেই চলছে। বিরক্ত হয়ে নীহারিকা ফোনটি হাতে তুলল। কাঁপা কাঁপা হাতে সে কলটি তুলতেই একটি মেয়েলি গলার ভয়ঙ্কর আওয়াজ তার দু’কানে বিচ্ছিরি ভাবে বাজতে লাগল!

ফেরারি প্রেম পর্ব ৩৪

আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল নীহারিকা। ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে চ্যাচিয়ে বলল,
“আমি তোমার কী ক্ষতি করেছি সবিতা আপু? তুমি কেন এমন করছে আমার সাথে? কেন আমাকে এভাবে ভয় দেখাচ্ছ?”

ফেরারি প্রেম পর্ব ৩৬