ফেরারি প্রেম পর্ব ৬৩

ফেরারি প্রেম পর্ব ৬৩
নিশাত জাহান নিশি

“কী ব্যাপার? কথা কানে যায়না আমার? কতবার করে বলেছি আজ একটু সেজেগুজে থাকতে? শুনেছ আমার কথা?”
বিধ্বস্ত দৃষ্টিতে পিয়াসা তাকিয়ে রইল বিক্ষুব্ধ নিহালের দিকে। হাতটি অতি কঠিনভাবে চেপে ধরে রাখার দরুন ঈষৎ ব্যথার অনুভূতি হচ্ছে পিয়াসার হাতে। তবে নিহাল তা বুঝতে নারাজ। মাথায় রাগ চড়ে গেছে তার। নিরুপায় হয়ে মাথা নুইয়ে পিয়াসা চোখ জোড়া খিঁচে বুজে করে নিলো। ব্যথা লুকিয়ে কলুষিত গলায় বলল,

“আপনাকে তো আমি প্রথমেই বলেছিলাম নিহাল, সাজগোজ করতে আমার এখন ভালো লাগেনা। তাছাড়া আমার সামান্য সাজগোজের জন্য নিশ্চয়ই কোনো শুভ কাজ থেমে থাকবেনা?”
“ঘাড়ত্যাড়ামো করছ? আগের রূপ দেখাচ্ছ আবার? এই তোমার ভালো হওয়ার নমুনা?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মাথা উঁচিয়ে পিয়াসা নিথর দৃষ্টিতে তাকালো রাগী নিহালের দিকে। আজও নিহাল তাকে ভুল বুঝছে? চাপা অভিমান বুঝতে পারছেনা তার? অতীতের সাথে আবার বর্তমানকে গুলিয়ে ফেলছে? তবে কী ভবিষ্যতেও পিয়াসাকে বুঝতে পারবেনা নিহাল? এভাবেই নিরাগভাবে চলতে থাকবে তার সংসার জীবন? মনে আঘাত নিয়ে নিহালের থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো পিয়াসা। নাক টেনে অশ্রুভেজা গলায় বলল,

“দেখি হাতটা ছাড়ুন ব্যথা লাগছে।”
নিহাল তার জেদে অনড়। পিয়াসার হাতটি আরও শক্তভাবে চেপে ধরল সে! দাঁত গিজগিজিয়ে বলল,
“ছাড়বনা। আমার কথা অমান্য করার শাস্তি তোমাকে পেতেই হবে।”

ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলল পিয়াসা। চোখে জল নিয়ে সে ক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে তাকালো জিদ্দি নিহালের দিকে। অবাক হলো নিহাল! দীর্ঘ দেড় বছর পর আজ আবারও পিয়াসা তার দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকালো। আবারও অতীতের বিধ্বংসী রূপে ফিরে এলো। পিয়াসার এই রূপটিই হয়ত এতদিন মিস করছিল নিহাল! সত্যি বলতে, পিয়াসার শান্তশিষ্ট হাবভাবে বিরক্তি এসে গিয়েছিল তার। মাঝে মাঝে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একটু আধটু ঝগড়াঝাঁটি না হলে সবকিছু যেন পানসে লাগে। ঘাড়ের রগ টান টান করে পিয়াসা উত্তেজিত গলায় বলল,

“আর কত শাস্তি দিবেন হুম? আর কত শাস্তি দিবেন আমায়? গত দেড়টা বছর ধরে তো আমাকে প্রতিটা দিন, প্রতিটা মুহূর্তে, প্রতিটা সেকেন্ডে সেকেন্ডে শাস্তি দিয়ে আসছেন! সুখ শান্তি সব কেড়ে নিয়েছেন আমার। এরপরেও আপনার সাধ মিটেনি? এবার কী আমাকে জানে মেরে শান্তি হবেন আপনি?”

তৎক্ষণাৎ পিয়াসার হাতটি ছেড়ে দিলো নিহাল। পিছু ঘুরে দাড়ালো সে। চুল টেনে রাগকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করল। পিয়াসাকে এবার একটু আপন করে নেওয়া উচিৎ তার! কোনো সম্পর্কেই অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি ঠিক নয়। এতে হীতে বিপরীত হতে পারে। রাগে ফোঁস ফোঁস করছিল পিয়াসা! রাগকে কিঞ্চিৎ দমিয়ে নিহাল মলিন মুখে ঘুরে দাড়ালো পিয়াসার দিকে৷ শান্ত সুরে বলল,

“রেডি হয়ে এসো। আমরা একসাথে স্টেজে যাব। নীহাকে হলুদ পড়াব।”
তেজী গলায় পিয়াসা চ্যাচিয়ে বলল,
“এই লোক দেখানো ভালোবাসার কোনো প্রয়োজন নেই আমার! যদি ভালোবাসতে হয় তো মন থেকে বাসুন। না হয় আমায় মুক্তি দিন।”

মুহূর্তেই নিহাল জাপটে ধরল পিয়াসাকে! বুকের মাঝে নিগূঢ়ভাবে মিশিয়ে নিলো তাকে। বহুদিন পর দেহে ও মনে সুখ খুঁজে পেল নিহাল। পিয়াসার সাথে কঠিন হয়ে নিহাল নিজেও ভালো ছিলনা এতগুলো দিন। পিয়াসাকে শায়েস্তা করার জন্য এছাড়া আর কোনো উপায়ও ছিলনা তার হাতে। নিহাল কঠিন হতে পেরেছে বলেই পিয়াসা নিজেকে শুধরাতে পেরেছে। সংসারে মনোযোগী হয়েছে। রূপল ও নীহারিকার ভালোবাসারও সুন্দর একটি পরিণতি ঘটছে। ভালোবাসার আলিঙ্গন পেয়ে রাগ দমে হয়ে এলো পিয়াসার। অশান্ত মন তার মুহূর্তেই শান্ত হয়ে উঠল। দু-হাত দ্বারা জড়িয়ে ধরল সে নিহালকে। অসহায় গলায় কেঁদেকেটে বলল,

“প্লিজ মাফ করে দিন না আমায়। অতীতে যা হয়েছে সব ভুলে যান। আমি নিজেও অনুতপ্ত আমার অতীতের কুকর্মে। এখন তো আমি নিজেকে শুধরে নিয়েছি বলুন? সবার সাথে নিজেকে মানিয়েও নিয়েছি। স্বামী, সংসার সবাইকে বুঝতে শিখেছি। আর একটা সুযোগ কী দেওয়া যায়না আমায়?”
বহুদিন পর পিয়াসাকে কাছে পেয়ে নিহাল যেন ডুবে গেল পিয়াসাকে আপন করে নেওয়ার নেশায়। উত্তেজিত হয়ে সে ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে দিলো পিয়াসার। ঘোরে আচ্ছন্ন গলায় বলল,

“সুযোগ চেয়েছ সুযোগ দিলাম। বিশ্বাস করলাম তুমি নিজেকে শুধরে নিয়েছ। স্বামী, সংসার ও নিজেকে বুঝতে শিখেছ। আমি চাইব তুমি ভবিষ্যতেও এমনই থাকো। অতীতের তুমিতে আর ফিরে না যাও! আমার বিশ্বাসকে মূল্য দাও। আমার ভালোবাসাকে শ্রদ্ধা করো।”
খুশিতে উদ্বেলিত হয়ে উঠল পিয়াসা। সুখের অশ্রু গড়াতে লাগল তার দু-চোখ বেয়ে। নিহালকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল সে। উৎফুল্লিত গলায় বলল,

“তুমি যা চাও তাই হবে নিহাল। আমার ভুলের কারণে আর কখনও তোমার ফেইস লস হবেনা। থ্যাংকস আমাকে আরও একবার সুযোগ দেওয়ার জন্য। তুমি জানো না নিহাল আজ আমি ঠিক কতখানি খুশি হয়েছি। থ্যাংক ইউ সো মাচ নিহাল। থ্যাংক ইউ সো মাচ।”

মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল দুজনে। সমস্ত রাগ, ক্ষোভ, দুঃখ, যন্ত্রণা ভুলে একে অপরকে আপন করে নিলো।নিহালের কথামত পিয়াসা সেজেগুজে তৈরী হয়ে নিলো। পিয়াসাকে দেখে নিহালের চোখ জুড়ালো। দুজনই স্টেজে গিয়ে নীহারিকাকে হলুদ পড়ালো। হলুদ শাড়ি পড়ে হৃদি সেই কখন থেকেই নীহারিকার কোলেই বসেছিল! নড়ছেই না সে নীহারিকার আশপাশ থেকে। দুষ্টু বুড়িকে সবাই আদর করে দিচ্ছে। তার মুখেও সবাই সমান তালে হলুদ মাখিয়ে দিচ্ছে। খিলখিল করে হেসে উঠছে হৃদি। আত্মীয় -স্বজন থেকে শুরু করে পাড়া প্রতিবেশীরা সবাই এক এক করে নীহারিকাকে হলুদ পড়ালো। নাচ-গান, হৈ, হুল্লোড় সব হলো।

তবে নাজনীন বেগম নীহারিকাকে হলুদ পড়াতে এসে কেঁদে দিলেন! ঘটনার আকস্মিকতায় নীহারিকাকে জড়িয়ে ধরলেন তিনি। ভরাট গলায় বললেন,
“আমাকে মাফ করে দিস মা। আমার ভুলের শাস্তি আমার পাগল ছেলেটাকে দিসনা! অতীতে আমার জেদের জন্যই তোদের বিচ্ছেদ হয়েছিল। আমার নোংরা মনমানসিকতার জন্যই আমার ছেলেটা আত্নহননের পথ বেছে নিয়েছিল। আমাকে ছেড়ে, তার গোটা পরিবারকে ছেড়ে, তোকে ছেড়ে অদূর কানাডায় পাড়ি জমিয়েছিল। সবাইকে ছেড়ে গিয়ে কম কষ্ট পায়নি আমার ছেলেটা। ধুঁকে ধুঁকে মরেছে হয়ত। ভবিষ্যতে আর কোনো কষ্ট দিসনা তাকে। আমার ছেলের সুখেই যে আমার সুখ।”

আলতো হেসে নীহারিকাও তার শ্বাশুড়িমাকে জড়িয়ে ধরল। ভরসা যুগালো তার শ্বাশুড়ি মাকে। আশ্বস্ত গলায় বুঝিয়ে বলল,
“আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন আন্টি। আপনার পরে যদি আপনার ছেলেকে কেউ নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসে থাকে তবে তা একমাত্র আপনার হবু পুত্রবধূই হবে! ভালোবাসার মানুষকে কীভাবে যত্নে, আদরে ও গুরুত্বের সাথে আগলে রাখতে হয় তা আমার বেশ ভালোভাবেই জানা আছে আন্টি। আর অতীতে যা হয়েছে সব ভুলে যান। আমিও সব ভুলে গেছি। মানুষ মাত্রই তো ভুল হয় বলুন? তাই সেই ভুলকে মনে রেখে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ খারাপ করার কোনো মানেই হয়না।”

নীহারিকাকে ছেড়ে বসলেন নাজনীন বেগম। আবেগী হাবভাব পাল্টে তিনি আচমকা গম্ভীর ভাব নিয়ে নীহারিকার কান টেনে ধরলেন! বেসুরো গলায় বললেন,
“এই মেয়ে? তুমি এখনও আমাকে আন্টি আন্টি করে ডাকছ? আজ বাদে কাল তুমি আমার ছেলের বউ হবে আর আজও কিনা তুমি আমাকে আন্টি আন্টি করছ?”
নাকমুখ কুঁচকে নিলো নীহারিকা! ব্যগ্র হেসে দুষ্টু গলায় বলল,

“উফফস সরি মা। ভুল হয়ে গেছে। আপনার পাগলা ছেলেটা বোধ হয় আমাকেও পাগলী বানিয়ে দিয়েছে!”
হবু বউ ও শ্বাশুড়ি মায়ের মধ্যে এই দুষ্টু মিষ্টি মুহূর্তটি নিহাল ক্যামেরাবন্দি করে নিলো! নিহালের পাশে দাড়িয়ে পিয়াসা ছবিটির দিকে তাকিয়ে হু হু করে হাসতে লাগল। দূরে দাড়িয়ে চোখে আনন্দ অশ্রু নিয়ে মারজিনা বেগম ও আফজাল হোসেন সব দেখছিলেন! একদিকে নিহাল ও পিয়াসার সুন্দর সম্পর্ক অন্যদিকে নীহারিকা ও তার শ্বাশুড়ি মায়ের মধ্যে খুনসুটি দেখে তারা যেন দুজনই আবেগ আপ্লুত হয়ে উঠলেন। চোখ দুটি তাদের তৃপ্ত হয়ে উঠল। স্বস্তির শ্বাস ফেললেন মারজিনা বেগম। আশাবাদী গলায় বললেন,

“আমার দুই ছেলে মেয়ের সুখে যেন কারো নজর না লাগে। জীবনভর তারা যেন এভাবেই হাসিখুশি থাকে।”
কথাগুলো শেষ করে মারজিনা বেগম আলতো হাসলেন। নিশ্চিন্ত হয়ে আফজাল হোসেনের কাঁধে মাথা রাখলেন। মারজিনা বেগমের বাহু শক্ত করে ধরলেন আফজাল হোসেন। স্বস্তিকর গলায় তিনি বললেন,
“আল্লাহ্’র উপর ভরসা রাখো মারজিনা। ইনশাআল্লাহ্ আমাদের ছেলেমেয়ের খুশিতে কখনও কারো নজর লাগবেনা।”

এরমাঝেই রূপল দুরন্ত ও চনমনে হয়ে যেন কোথা থেকে ধেয়ে এলো! পরিবারের সবাইকে ডেকে এনে একত্রে স্টেজে উঠালো। সেখানে তার চাচা-চাচী থেকে শুরু করে নীহারিকার মা-বাবা, হৃদি, তুলি, দিশা, শাকিল ও সজলও উপস্থিত ছিল। ক্যামেরা ম্যানকে ডেকে এনে তাদের পারিবারিক কতগুলো ছবি তুলল। কিছু ছবিতে রূপল ও নীহারিকা পাশাপাশি ছিল তো কিছু ছবিতে রূপল তার মা-বাবা ও বোনের পাশে ছিল। কিছু ছবিতে তো রূপল হৃদিকে কোলে নিয়ে দাড়িয়ে ছিল।
প্রফুল্লতা ও উচ্ছ্বলতায় রূপল মুরুব্বিদের মুখেও হলুদ পড়াতে শুরু করল। বিনিময়ে মুরুব্বিরাও রূপলের মুখে হলুদ পড়িয়ে দিলো। সবশেষে অশ্রুসজল দু’চোখে মারজিনা বেগম রূপলের কপালে হলুদ পড়িয়ে দিলেন! স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে থাকা রূপলকে তিনি বললেন,

“আমার মেয়েটার খেয়াল রেখো বাবা। সবসময় তাকে এভাবে হাসিখুশিতে মাতিয়ে রেখো। মেয়ের মা হিসেবে তোমার কাছে এতটুকুই আবদার রইল আমার।”
মলিন হাসল রূপল। শান্তনা দিলো তার হবু শ্বাশুড়ি মাকে। আশ্বস্ত গলায় বলল,
“চিন্তা করবেন না আন্টি। শুধু দোয়া করবেন। আপনার মেয়ে এতদিন আপনার কাছে যেভাবে হাসিতে-খুশিতে, আনন্দে, আদরে-যত্নে নিরাপদে ছিল ঠিক তেমনি আমার কাছেও আপনার মেয়ে সেভাবেই থাকবে! কোনো দুঃখ, কষ্ট তাকে ছুঁতে পারবেনা। আর সেই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।”

রূপলের কথায় আশ্বস্ত হলেন মারজিনা বেগম। মৃদু হেসে তিনি রূপলকে মনভরে দোয়া করলেন। নীহারিকার নাকে আলতো হলুদ ছুঁইয়ে দিলো নিহাল। নীহারিকার দিকে তাকালেই নিহাল কেমন যেন আবেগপ্রবণ হয়ে উঠল! চোখ দুটো তার জলে ছলছল করে উঠল। বুকে একধরণের শূণ্যতা কাজ করতে লাগল। নিহালের মনের ভাব বুঝে নীহারিকা টপাটপ চোখের জল ছেড়ে দিলো! জড়িয়ে ধরল তার ভাইকে। কান্না সিক্ত গলায় বলল,
“তোমাদের খুব মিস করব ভাইয়া!”

চোখের জল ধরে রাখতে পারলনা নিহাল! টুপ করে চোখ থেকে দু-ফোঁটা জল গড়িয়ে পরল তার। হাজার চেষ্টা করেও নিজের আবেগকে সংযত করতে পারলনা নিহাল। ভরাট গলায় বলল,
“আমরাও তোকে অনেক মিস করব।

নিহাল ও নীহারিকার আবেগঘন মুহূর্ত দেখে রূপল নিজেও বিষণ্ন হয়ে উঠল। পাশ থেকে রূপল এসে নিহালকে শান্তনা দিলো। ঘটনার আকস্মিকতায় নিহালকে জড়িয়ে ধরে রূপল মলিন স্বরে বলল,
“আপসেট হওয়ার কিছু নেই জিজু। আপনি যেমন আমার বোনকে আদরে, যত্নে, ভালোবাসায় মুড়িয়ে রেখেছেন ঠিক তেমনি আমিও আপনার বোনকে সেভাবেই যত্নে, আদরে ও ভালোবাসায় মুড়িয়ে রাখব। মনকে শক্ত করুন জিজু। আপনি দুর্বল হয়ে পরলে তো আমার নীহুও দুর্বল হয়ে পরবে। আর আমি চাইবনা আমার নীহু এই শুভ মুহূর্তে কাঁদুক! আর এই দিক থেকে আমি খুব স্ট্রিক্ট!”

“আই ট্রাস্ট ইউ রূপল। আই নো, আমার বোন অনেক যত্নে ও ভালোবাসায় থাকবে তোমার কাছে। বিলিভ মি এই নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। কিন্তু তাকে আমরা খুব মিস করব রূপল! ভাবতেই বুকটা কেমন কেঁপে উঠছে যে কাল থেকে আমার বোনটা আমাদের পর করে চলে যাবে!”

“আরে ধ্যাত জিজু। এটা কোনো ব্যাপার হলো? আপনার এবং আপনাদের যখনই নীহুর কথা মনে পরবে চলে যাবেন আমাদের বাড়িতে। প্রয়োজনে নীহুও মাঝেমধ্যে চলে আসবে। এখন প্লিজ কান্নাকাটি থামান৷ সময়টাকে এঞ্জয় করুন।”
ব্যথীত নিহালকে ছেড়ে দাড়ালো রূপল। উচ্চশব্দে সজল ও শাকিলকে ডেকে বলল,
“এই মিউজিক লাগা তো!”

রূপলের আশকারা পেয়ে সজল ও শাকিল উড়াধুরা মিউজিক লাগিয়ে দিলো। রূপলের রঙ ঢঙ দেখে পাশ থেকে নীহারিকা কান্না মুখেও গিজগিজিয়ে উঠল! বেহায়াপনা দেখে গাঁ জ্বলছে তার। মনে মনে রূপলকে বকাঝকা করে বলল,
“বেশারাম কাহিকা! মনে রঙ লেগেছে এই লোকের। নিজের বিয়েতে নিজেই নাচানাচি করছে! দেখছে সবার মন খারাপ তবুও তার খুশি ধরছেনা। এরজন্যই চেয়েছিলাম বিয়ে অবধি লোকটাকে দেবদাস বানিয়ে রাখতে!”

নীহারিকাকে যেন পাত্তা দেওয়ার সময় নেই রূপলের! ডোন্ট কেয়ার ভাব তার। রূপলের এটেনশন না পেয়ে নীহারিকা ক্ষণে ক্ষণে তেতে উঠছে! রূপলকে একা পেলে গর্দান নিবে তার! হৃদি, তুলি, দিশা, সজল ও শাকিলও রূপলের সাথে ধেই ধেই করে নাচছে! স্টেজ পুরো মাতিয়ে রেখেছে তারা। অবশ্য পরে নিহাল ও পিয়াসাও বাদ পরেনি। তাদেরও টেনে এনে নাচানো হয়েছে। সবশেষে রূপল জোরাজোরি করে নীহারিকার সাথে একটু আধটু নাচের স্টেপ তুলেছে। বেচারা রূপল এখন ভয়ে আছে। নীহারিকার রাগী মুখশ্রী তার বুক কাঁপিয়ে দিচ্ছে!

গভীর রাত। বাড়ির ছাদে পা ঝুলিয়ে বসে আছে নীহারিকা ও রূপল। হলুদের সাজ এখনও দুজনের গাঁয়ে। পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে দুজনের মধ্যেই। বড্ড মায়াবী জোছনা ভরা রাত আজ! চাঁদ যে তার সমস্ত আলো নিংড়ে দিচ্ছে ধরণীতে। সেই সাথে বইছে উত্তাল হাওয়া। শীতলতায় নিবিষ্ট চারিপাশ। দমকা হাওয়ার তালে ভেসে আসছে বেলি ফুলের সুমিষ্ট ঘ্রাণ। যেন রূপকথার কোনো জগতে বসে আছে রূপল ও নীহারিকা৷ এই মুহূর্তে নীরবতা ভাঙতে মোটেও ইচ্ছে করছেনা নীহারিকার। কেবল নিরিবিলি এই মনোরম পরিবেশটিকে উপভোগ করতে চাইছে। তবে নীহারিকার এহেন মৌনতা রূপলের একদমই সহ্য হচ্ছেনা। রীতিমত উসখুস করছে সে। অতঃপর অধৈর্য্য হয়ে রূপল অন্যপাশে মুখ ফিরিয়ে নিলো। গলা ঝাঁকিয়ে বলল,

“এভাবে চুপচাপ না থেকে আমার সাথে একটু কথা বললেও তো পারো। একটু আমার দিকে তাকাতে পারো। আমার কাঁধে মাথা রেখে জোছনা বিলাস করতে পারো।”

নিশ্চুপ নীহারিকা। মৃগ্ধিত দৃষ্টিতে কেবল মায়াবি চাঁদের দিকে তাকিয়ে রইল। বিরক্তবোধ করল রূপল। মাথা ঘুরিয়ে সে স্তব্ধ নীহারিকার দিকে তাকালো। নীহারিকার নির্বাকতায় সে প্রচণ্ড চটে গেল। জোর করে নীহারিকার মাথাটা তার কাঁধের উপর রাখল! ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে নীহারিকা তাজ্জব দৃষ্টিতে রূপলের দিকে তাকালো। দু’হাতে শক্ত করে নীহারিকাকে চেপে ধরল রূপল। নীহারিকার নির্বোধ মুখের দিকে তাকিয়ে ফিচেল হাসল! নীহারিকার নাকে নাক ঘঁষে নিমজ্জিত গলায় বলল,

“এইবার ঠিক আছে।”
মুহূর্তেই গাঁ ঝারা দিয়ে ওঠে গেল নীহারিকা! নিরবিচ্ছিন্ন অবস্থা থেকে সে সক্রিয় হয়ে উঠল। হতভম্ব হয়ে বসে থাকা রূপলকে শুধিয়ে বলল,
“এখন আমার এক মিনিট নীরবতাও সহ্য হয়না তাইনা? তাহলে ফেলে আসা এক একটা বছর কীভাবে ছিলেন আপনি? তখন আমার কথা একবারও মনে পরেনি আপনার? মাথায় আসেনি তখন ফোন করে তার একটু খোঁজ খবর নিই?”

তৎক্ষণাৎ মাথা নুইয়ে নিলো রূপল। কথার পিঠে কথা বলার ভাষা নেই তার। অতিরিক্ত রাগ, জেদ, অভিমান তাকে আজ চুপ থাকতে বাধ্য করল। তার ভালোবাসাও এখন নীহারিকার কাছে নিছক মূল্যহীন হয়ে গেল! মনমরা হয়ে গেল রূপল। বিষণ্নতায় মুর্ছা গেল। রূপলের অসহায়ত্ব ও অপরাধবোধ বুঝতে পারল নীহারিকা। তাই রূপলের মন ভালো করার চেষ্টা করল সে। কাছে এসে হুট করে রূপলের কাঁধে মাথা রাখল! দু’হাত দ্বারা সন্তপর্ণে রূপলকে জড়িয়ে ধরল। গম্ভীর রূপলের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বলল,

“বলুন আর কখনও আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবেন না? যতই রাগ হোক, অভিমান হোক, জেদ হোক সব পরিস্থিতিতেই আমার পাশে থাকবেন? বলুন?”
সরু দৃষ্টিতে রূপল প্রশ্নবিদ্ধ নীহারিকার দিকে তাকালো। নির্বাক গলায় প্রত্যত্তুরে বলল,
“মৃত্যু ব্যতীত আর কোনো পরিস্থিতি-ই আমার জেদের কাছে আমার ভালোবাসাকে হার মানাতে পারবেনা নীহু! আমি আমার ভুল থেকে উচিৎ শিক্ষা পেয়েছি। আর এই শিক্ষাটি আমার আজীবন মনে থাকবে। আমি বিশ্বাস করি নীহু, ভবিষ্যতে আর কখনও কোনো অভিযোগ উঠবেনা আমার উপরে। আকাশের ঐ দুর্লভ চাঁদের মতই আমার ভালোবাসাও দুর্লভ হয়ে থাকবে! কোনো আচড় পড়তে দিবনা আমি আমার ভালোবাসায়।”

মৃদু হেসে নীহারিকা রূপলের দিকে তাকালো। নীহারিকার হাসিতে রূপলও হেসে উঠল। দুজন দুজনকে শক্ত করে আলিঙ্গন করল। নীহারিকা হঠাৎ ব্যগ্র গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,
“বিয়ারগুলো কোথায় রাখছেন?”
হকচকিয়ে উঠল রূপল! বিয়ারের খবর নীহারিকা কীভাবে জানল? আমতা আমতা গলায় রূপল প্রশ্ন ছুড়ল,

“মানে?”
“মানে বিয়ারের বোতলগুলো কোথায় রেখেছেন?”
“এক সেকেন্ড এক সেকেন্ড, তুমি কীভাবে জানলে আমি বিয়ার খেয়েছি?”
“স্টুপিট কোথাকার। মুখ থেকে গন্ধ আসছে!”
জিভ কাটল রূপল! ভীতু গলায় বলল,
“ব্যাচালর পার্টি ছিল তাই!”
“এখানে তো ভয় পাওয়ার কিছু নেই তাইনা? আমিও একটু টেস্ট করতে চাইছিলাম তাই জানতে চাওয়া!”
“হোয়াট?”

“আরে এত অবাক হওয়ার কী আছে? আমারও তো ইচ্ছে করেনা তাইনা? একটু ছাইপাঁশ খেয়ে সেলিব্রেশন করতে!”
“তুমি এসব গিলে সহ্য করতে পারবেনা নীহু। খামোখা প্যারা দিও না তো।”
মন খারাপ করে নিলো নীহারিকা। রূপলের কাঁধ থেকে মাথা উঠিয়ে নিলো! অন্যপাশ ফিরে গোমড়া মুখে বলল,
“ওহ্। আমার আবদারটা রাখবেন না তাইতো? বিয়ের আগের দিন রাতেও আমাকে হার্ট করবেন?”
“আরে আচ্ছা মুসিবত তো। বললাম তো তুমি এসব খেয়ে হজম করতে পারবেনা। এগুলো খেয়ে অভ্যাস থাকতে হয়। তাছাড়া কাল দেখা যাবে এসব খেয়ে তুমি বিয়েটাই করতে পারবেনা!”

“আপনি খাওয়াবেন কিনা বলুন? না হয় আমি কিন্তু এক্ষুণি শাকিল ও সজলকে বলব আমার জন্য বিয়ারের ব্যবস্থা করতে!”
কপাল চাপরাতে লাগল রূপল। এই কোন বিপাকে ফেঁসে গেল সে? বিয়ের কনে কী বিয়ার খাবে? বহু বুঝানোর পরেও একরোঁখা নীহারিকাকে বুঝানো গেলনা। শেষমেশ রূপল বাধ্য হলো নিচতলার স্টোর রুম থেকে একটি অর্ধ খাওয়া বিয়ারের বোতল আনতে! দাঁত কপাটি বের করে নীহারিকা এক ঢোঁক বিয়ার মুখে নিতেই বমি করে সব উগলে দিলো! ইচ্ছে করে সে রূপলকে ভাসিয়ে দিলো! রেগেমেগে রূপল নীহারিকার গালে কামড় বসিয়ে দিলো! কোলে তুলে নীহারিকাকে তার রুমে শুইয়ে দিয়ে এলো।

ফেরারি প্রেম পর্ব ৬২

অবশেষে সেই শুভক্ষণ এলো! বিয়ের সাজে পরিপূর্ণ সজ্জিত নীহারিকা। সুদূর কানাডা থেকে রূপল নীহারিকার জন্য বিয়ের লাল লেহেঙ্গা হতে শুরু করে স্বর্ণ গহনাও নিয়ে এসেছিল! মনে মনেই তার জানা ছিল বিধাতা তার ভাগ্যে নীহারিকাকেই লিখে রেখেছে। রূপলের আনা সব সাজ সরঞ্জাম পড়েই নীহারিকা আজ লাল টুকটুকে বউ সেজেছে।

ফেরারি প্রেম পর্ব ৬৪