অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী সিজন ২ পর্ব ১৭

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী সিজন ২ পর্ব ১৭
জিন্নাত চৌধুরী হাবিবা

বুকের ভেতর গুড়ুক গুড়ুম বজ্রপাত। বর্ষা নামলো আয়োজন করে। দূরের কারেন্টের তারে বসে আছে নাম না জানা একটি পাখি। সকাল সকাল চায়ের কাপে ঠোঁট ভিজিয়ে ক্ষীণ চোখে পাখিটি পর্যবেক্ষণ করছে মিঠু। পাশে আরও একটি পাখি হলে মন্দ হতো না। তার ঘরের পাশাপাশি জীবনটা অন্তত গোছানো হতো। সে বাইরে থেকে বেপরোয়া হয়ে ফিরলেই কেউ একজন ধমকের সুরে তাকে শাসিয়ে যাবে। নিজ দায়িত্বে সবটা ঠিক করে দিয়ে একটু পরই নরম গলায় ডেকে উঠবে,

“খাবার দিয়েছি, খেতে আসো।”
মিঠু আপনমনে হাসলো। এই পাখিটি সুহা হলে বেশ হয়।
অরু মিঠুকে নাস্তা করতে ডাকতে এসেছে। তাকে মিটিমিটি হাসতে দেখে দরজায় পিঠ লাগিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। জহুরী চোখে পর্যবেক্ষণ করলেও বেশিক্ষণ এভাবে দাঁড়াতে পারলোনা। তার পূর্বেই মিঠুর চোখে ধরা পড়ে গেল। সন্দিহান গলায় মিঠু জিজ্ঞেস করলো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“কী চাই?”
অরু দুষ্টু হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে মিঠুর চারপাশে ঘুরে বেড়ালো। ভুরু কুঁচকে নিলো মিঠু।
“এই অ*স*ভ্য, এমন করছিস কেন?”
অরু হাসি আরও প্রশস্ত করে বলল,
“বড়ো অ*স*ভ্য কী ঘটিয়ে বসে আছে, সেটাই জানতে এসেছি।”
মিঠু সাবধানী গলায় বলল,

“সবাই কি তোর মতো না-কি?”
অরু চোখ পিটপিট করে ঢং করে বলল,
“বলো বলো, হেল্প পাবে। আমার আবার দয়ার শরীর।”
“তুই হলি ঘষেটি বেগম। ষ*ড়*ষ*ন্ত্রে*র উৎপত্তিটাই তো তোর কাছ থেকে। তোকে বিশ্বাস করা আর পানি চিবিয়ে খাওয়া সমান কথা।”

“আরে ঘষেটি বেগম কখনো মীর জাফরের সাথে বে*ঈ*মা*নী করে না। বলো, কথা দিচ্ছি মীর জাফরকে জিতিয়ে ছাড়বো।”
“তুই ঘষেটি বেগম হলেও আমি বরাবরই আলাভোলা সিরাজ উদ-দৌলা ছিলাম। প্রতিনিয়ত তোর ষ*ড়*য*ন্ত্রে*র শি*কা*র হয়ে এসেছি। খবরদার আমাকে মীর জাফর বানানোর চেষ্টা করবি না!”
“এত বড়ো মি*থ্যা অপ*বাদ! মীর জাফরের বংশধর।”
মিঠু ব্যঙ্গ হেসে বলল,

“ওই বংশধরে তুই নিজেও আছিস।”
অরু সূঁচালো চোখে তাকিয়ে রইলো। পরক্ষণেই বলল,
“আমার বংশ আলাদা।”
“গরিবের কথা একদিন হলেও ফলে। আগে বিশ্বাস করিসনি। এখন এসে বিশ্বাস করছিস? ছোটোবেলায় যখন বলতাম তোকে ড্রেন থেকে তুলে এনেছি, তখন তো খুব দেমাক দেখিয়ে বাবার কাছে বিচার দিতি।”

“এত কথা বলে আমাকে ভুলিয়ে দিতে পারবে না। বলো, কোন ফুল পছন্দ করে প্রজাপতির মতো উড়ছো?”
মিঠু ভাবলেশহীন বলল,
“তোকে কেন বলবো?”
“তুমি কি ভেবেছো, আমি অনুমতি না দিলে তোমার ফুল নিয়ে বাড়িতে ঢুকতে পারবে?”
“আপদ বিদায় করে দেওয়ার পরও নি*র্ল*জ্জে*র মতো এই বাড়িতে কী? যা এখান থেকে।”

“আমাদের মপটা খুঁজে পাচ্ছি না। ফ্লোর নোংরা হয়ে আছে। তোমাকে মপ হিসেবে ব্যবহার করলে কেমন হয়?”
“তুই অলওয়েজ কামের বেডি। লুকটাও কামের বেডির মতো। এখন চিন্তাটাও কামের বেডির মতো করছিস, অ*স*ভ্য।”
দুজনের কথা কা*টা*কা*টি*র মাঝে রামি এসে উপস্থিত হলো।
“কীরে, কী নিয়ে ঝগড়া করছিস দুজন?”
রামিকে দেখতে পেয়েই মিঠু চ*টে গেল।

“আপদ তোর ঘাড়ে উঠিয়ে দিয়েছি। তবুও আমার ঘরে কী করে আসে? এই চিড়িয়াখানার জ*ন্তু*টা*কে আজই বন্দি কর। দুনিয়ার মানুষগুলোকে জ্বালিয়ে খেল।”
রামি মিঠুর সাথ দিলো। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উদাসী গলায় বলল,
“আমার জীবনটাকে কি আর শান্তি দিলো? ঘাড়ে তো উঠিয়ে দিলি। প্রতিনিয়ত আমাকে আ*ক্র*ম*ণ করতে আসে।”
অরু দুজনের কথা শুনে ফুঁসে উঠছে। কোমরে দু’হাতে রেখে নাকের পাটা ফুলিয়ে গাল ফুলিয়ে তাকিয়ে রইলো। রামি ভয়কাতুরে গলায় মিঠুর উদ্দেশ্যে বলল,

“দেখ্, দেখ্, কা*ল*না*গি*ন কেমন ফোঁস ফোঁস করছে।”
অরু বালিশ হাতে নিয়ে এলোপাতাড়ি দুজনকে মা*র*লো। রামি আলতো হাতে অরুর গালে চ*ড় বসাতেই অরুর হাত থেমে গেল। রামির কানে বজ্রপাতের শব্দ হলো যেন! ঘুরে ঘুরে স্ক্রিনে অরু আর মিঠুর মুখটাই দেখাচ্ছে। যেন সে ম*হা*পা*প করে বসে আছে। মিঠু, রামির পেটে কয়েকটা ঘু*ষি বসিয়ে গালে চ*ড় বসালো।
“শা*লা, আমার বোনের গালে হাত তুললি কেন?”

অরু পাশ থেকে আরেকটা বালিশ নিয়ে মা*র*ছে রামিকে।
রামি অবলার মতো হা করে বসে রইলো। দুই ভাই-বোন তাকে তুলোধুনো করে যাচ্ছে। একটু আগে দল তার ভারী ছিল। এখন মিঠু দল পরিবর্তন করে ফেললো? অরু ক্লান্ত হয়ে পানির গ্লাস হাতে নিয়ে দেখলো পানি নেই। তাই বেরিয়ে এলো। মিঠু ধপ করে রামির পাশে শুয়ে পড়লো। প্রফুল্লচিত্তে বলল,

“চিল ম্যান। অরুর দলে নাম না লিখালে যে আমাকেও আর কতক্ষণ পি*টি*য়ে প্লেট বানিয়ে দিতো।”
রামি ঘৃণা ভরা চোখে তাকিয়ে বলল,
“ছিঃ! বন্ধু নামের ক*ল*ঙ্ক।”
মিঠু হাসতে হাসতে বলল,

“কোন জায়গায় ক*ল*ঙ্ক, পরে দেখিয়ে দিস। আগে আমার ফোন?”
“সেটাই দিতে এসেছি। কিন্তু এখন আর দেব না। ভাই-বোন দুইটাই চি*টা*র। ”
মিঠু বলল,
“তুই কী ভেবেছিস? ফোন না দিয়ে এখান থেকে বের হতে পারবি?”
দু’জনের মাঝে আবারও ফোন নিয়ে ধস্তাধস্তি লেগে গেল। ডাইনিং থেকে অরু ডেকে উঠলো।
“দুই ব*ল*দ খেতে আসো।”

সামনেই ইলেকশন। ইদানীং কাজের চাপে সুহার সাথে দেখা করার সময় পায় না মিঠু। আজ অরুকে নিয়ে বের হলো। শুক্রবার ছুটির দিন। সুহার বাসার সামনে এসেই গাড়ি থামলো। মিঠু ফোন কানে চেপে সুহার জানালার দিকে তাকালো। দু-বারের মাঝে সুহা ফোন ধরলো।
“কী সমস্যা?”
“নিচে আসুন। আপনার বাড়ির লোক এসেছে।”
সুহা চমকে উঠলো। তার বাড়ির লোক মানে? মামা এসেছেন? বুক ধড়ফড় করছে। আতঙ্কিত গলায় শুধালো,

“বাড়ির লোক মানে?”
“সেটা নিচে আসলেই দেখতে পাবেন।”
ওড়না মাথায় দিয়ে দুরুদুরু বুক নিয়ে নিচে নেমে এলো সুহা। ঢোক গিলে তাকাতেই দেখলো ইবতেসামের পাশে একটা মিষ্টি চেহারার মেয়ে দেখা যাচ্ছে। তার পরিবারের কেউ নেই। মেয়েটাকে এর আগেও ইবতেসামের সাথে সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখেছিল সুহা। প্রশ্নাত্মক চোখে তাকাতেই মিঠু বলল,
“আমার বোন। আপনার কাছে থাকুক কিছুক্ষণ। আমি এসে নিয়ে যাবো।”
অরু একগাল হেসে শুধালো,

“কেমন আছো ফুল?”
সুহা স্তব্ধ হলো। মেয়েটির মতোই মিষ্টি মেয়েটির কথা। এইটুকুতেই তার মনে ধরে গেল মিষ্টি মেয়েটিকে। সুহা নিজেও হাসলো। বলল,
“ভালো। তুমি কেমন আছো মিষ্টি পরী?”
অরু গোমড়া মুখে বলল,
“তুমি আমায় পরী ডাকছো? কিন্তু পঁচা মিঠু আমায় অ*স*ভ্য, চিড়িয়াখানার বা*ন্দ*র ডাকে। অরু একটা নির্ভেজাল মিষ্টি মেয়ে। এটা সে বুঝতেই চায়না!”

সুহা মিঠুকে চিনলোনা। বলল,
“তোমার নাম অরু?”
“হুম। আর তোমার নাম ভাইয়া বলেছে আমায়, সুহা।”
সুহা মিষ্টি হেসে অরুকে নিয়ে বাসায় আসলো। গল্পগুজব করতে করতে কাটিয়ে দিল বেশখানিকটা সময়। অরুর জন্য কফি বানাতে গিয়ে সুহা জিজ্ঞেস করলো,
“চিনি কতটুকু দেব?”

“মিঠুর জন্য যতটুকু দাও, আমিও ততটুকুই খাই।”
সুহা কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
“বারবার মিঠু বলছো। আচ্ছা, এই মিঠু আবার কে গো?”
অরুর চোখ চড়কগাছ। বলল,
“মিঠুকে চেন না?”
সুহা নিচের ঠোঁট ফুলিয়ে না বোধক মাথা নাড়ালো।
অরু শুধালো,

“ইবতেসামকে চেনো?”
“হ্যাঁ, তোমার ভাইয়া।”
“ভাইয়াকে বাসায় মিঠু নামেই ডাকে সবাই।”
“ওহ্। কিন্তু তোমার ভাই কতটুকু চিনি খায় আমি তো জানি না।”
অরু অবাক হয়ে বলল,
“তুমি কোনদিন ভাইয়ার জন্য কফি বানাওনি?”
সুহা চোখ জোড়া ক্ষীণ করে বলল,
“না। আমাদের মাঝে সম্পর্ক অতটা মজবুত নয়।”

“কেমন মজবুত, সে আমি জেনে গিয়েছি। ভাইয়া বাসায় বসে তোমার কথা ভেবে মুচকি হাসে। আজ আমার কাছে ধরা পড়ে বাধ্য হয়ে তোমার সঙ্গে দেখা করাতে নিয়ে এসেছে।”
সুহা কথা বাড়ালো না। অরুকে নিজের মতো করে ভাবতে দিল। দুপুরের রান্নাটাও দুজনে মিলে করলো। অরু মেয়েটা ভীষণ মিশুক। কত সহজেই তাকে আপন করে নিয়েছে। অনেক বছর পর কাজিনদের সাথে কাটানো সময়ের স্বাদ পেল যেন।

বিকেলে মিঠু এসে অরুকে নিয়ে গেল। মন খা*রা*প হয়ে গেল সুহার। কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। কী যেন ভেবে আজ নিজ থেকেই মিঠুকে কল দিল। মিঠু যেন চমকে গেল। ভাবলো ভুলবশত কল এসেছে। সে প্রথমবারেই রিসিভ করলো না। দ্বিতীয়বার আর কোন কল এলোনা। এবার মিঠুর মনটা ছটফট করে উঠলো। কেন রিসিভ করলোনা? পরক্ষণে নিজেই কল ব্যাক করলো। সুহা চুপ করে আছে। মিঠু কোমল স্বরে ডাকলো।

“সুহা, কল দিয়েছেন?”
আড়ষ্টতা নিয়ে জবাব দিলো,
“হুম।”
“কিছু বলবেন?”
সুহা উসখুস করে বলল,
“না, তেমন কিছু না। অরুকে আবার নিয়ে আসবেন।”
মিঠু চোখ বুজে বলল,

“আপনি চলে আসুন না ওর কাছে! আমারও সুবিধা হয়।”
সুহা কথা কাটানোর জন্য বলল,“আমি ফোন রাখছি।”
“বাবাকে আপনার কথা বলে দিয়েছি, সুহা।”
সুহা আকস্মিক কথা শুনে মৃদু চেঁচিয়ে উঠলো,
“কী?”
“হ্যাঁ, বলেছি বিয়ে করিয়ে দিতে।”

“আপনি বিয়ে করুন, যা ইচ্ছে করুন। কিন্তু আমার নাম কেন বলবেন?”
“বলিনি তো। তবে শীঘ্রই বলবো। হতে পারে আজ।”
“দোহাই লাগে আপনার। এমন কিছুই করবেন না।”
মিঠু বলল,

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী সিজন ২ পর্ব ১৬

“ঠিক আছে, বলবোনা। আপনি বিনিময়ে কী দেবেন আমায়?”
“আপনি কী চান?”
“আপনাকে চাই।”
সুহা হাল ছেড়ে দিল। ফোঁস করে তার নিঃশ্বাস ছাড়ার শব্দ পেয়ে হাসলো মিঠু। মন্থর স্বরে বলল,
“আপনাকে হারানোর বিনিময়ে আমি আপনাকেই চাই। বলুন, দেবেন কি-না? তবে আমি আপনার শর্ত মানতে রাজি আছি।”

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী সিজন ২ পর্ব ১৮