অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী সিজন ২ পর্ব ৩৯

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী সিজন ২ পর্ব ৩৯
জিন্নাত চৌধুরী হাবিবা

দশটা বাজতেই সবাই খেতে বসলো। তরী এসে দাঁড়ালো মিঠুর দরজার সামনে। জড়তা নিয়ে একবার নক করলো। এখন তো আর মিঠু একা নেই।
প্রথমবারেই সাড়া দিল মিঠু।
“কে?”

“খাওয়ার সময় হয়েছে মিঠু। আমি কি এখন খাবার পাঠিয়ে দেব। না-কি পরে খাবি?”
দরজা খুলে দিল মিঠু। বলল,“নিচে আসছি আমরা।”
“নিচে যেতে হবে না। ওখানে সবার সামনে হয়তো ঠিকমতো খেতে পারবে না সুহা। আমি বরং খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি।”
“ঠিক আছে।”
তরী খাবার আনতে চলে গেল। মিঠু দরজা ছেড়ে ভেতরে ঢুকলো। সুহার উদ্দেশ্যে বলল,“চেঞ্জ করে নিন। আপু খাবার নিয়ে আসছে।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

সুহা একটা সুতি শাড়ি নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো। মেকআপ তোলা সহ অনেকটা সময় লাগলো তার। বের হয়েই দেখলো মিঠু খাবার সামনে নিয়ে বসে আছে। সুহাকে দেখতেই বলল,“বসে পড়।”
কথাটি বুঝতে সুহার বেগ পেতে হলো। নিশ্চিত হওয়ার জন্য আরেকবার শুনতে চাইলো।
“হুঁ?”
“খেয়ে নাও, খাবার ঠান্ডা হলে খেতে ভালোলাগবে না।”

সুহা এবার নিশ্চিত হলো। না, মিঠু জেনে-বুঝেই সম্বোধনটাকে ঘনিষ্ঠ করেছে। মনে মনে বরং খুশিই হলো সে। এখনো যদি আপনি আজ্ঞে করে, তবে লোকে কী বলবে? চুপচাপ মিঠুর সামনে বসে পড়লো। সুহা খাচ্ছে কম, খাবারে হাত নাড়াচাড়া করছে বেশি। মিঠু সুহার দিকে না তাকিয়েই বলল,“ঠিকভাবে খাও। ওখানে সবার সামনে ঠিকঠাক খেতে পারবে না বলেই আপু ঘরে খাবার পাঠিয়ে দিয়েছে।”

সুহা মৃদু আওয়াজে বলল,“খাচ্ছি তো।”
মিঠুর খাওয়া দ্রুত হয়ে গেল। এঁটো প্লেট হাতে তুলে বের হতে গিয়ে থেমে গেল। সুহার দিকে তাকিয়ে বলল,“তুমি ধীরেসুস্থে খাওয়া শেষ করো। আমি একটু বাইরে থেকে আসছি।”
“এখন বাইরে কী করবেন?”
খাওয়া থামিয়ে প্রশ্ন করলো সুহা।
মিঠু বলল,“রামির বাসায় যাচ্ছি। বেশিক্ষণ লাগবে না।”
“ঠিক আছে।”

মিঠু বেরিয়ে গেল। রান্নাঘরে প্লেট রেখে চলে গেল রামির বাসায়। অরু, রামির জন্যেও ফুল দিয়ে ঘর সাজানো হলো, ঠিক মিঠুর ঘরের মতোই।
ইরা অরুকে বসিয়ে দিয়ে বাইরে বের হলো। রামি মায়ের ঘর থেকে বের হলো। ও বাসা থেকে দেরি করে আসার জন্য কয়েকটা কড়া কথা শুনতে হলো তাকে। সাধারণ দিন হলে অরু এখন ওই বাসায় থেকে গেলেও কিছু বলতেন না আয়েশা সুলতানা। বিয়ের দিন, বাসা ভর্তি মেহমান। আর নতুন বউ বাসায় নেই। ব্যাপারটা কেমন দেখায়? রামি চোখ বন্ধ করে মায়ের কথা হজম করে নিলো। তাকে যে পেয়েছে, সে-ই জিতেছে। মা, বউ, ভাই, বন্ধু সবাই জিতেছে। মাঝেমধ্যে মনে হয় তার বাচ্চারাও তাকে বাবা হিসেবে পেয়ে জিতবে। সবাই তাকে উলোটপালোট করে বলে যায়, আর সে চোখ বন্ধ করে শুনে যায়। বউ থেকে শুরু করে ভাই, বন্ধু সবাই তাকে প্যারায় রাখতে ভালোবাসে। বেচারা মুখ বুজে সব সহ্য করে নেয়। ইরা এসে ডেকে নিলো তাকে।

“চল্ অরু একা বসে আছে।”
রামি এগিয়ে গিয়ে নিজের দরজার সামনে মিঠুকে দেখে থমকে দাঁড়ালো। এখন তার উলটো ছুট দিতে ইচ্ছে করছে। ইরা হাত টেনে সামনে এগিয়ে বলল,“কীরে চল্।”
রামি সরু চোখে মিঠুকে পর্যবেক্ষণ করে শুধালো,“এটা এখানে কেন? বাসর ঘরে না দিয়ে আসলাম?”

ততক্ষণে ইরা তাকে দরজা পর্যন্ত টে*নে নিয়ে গিয়েছে। তাকে দেখেই মিঠু ফিচেল হাসলো। রামি কাউকে পরোয়া না করে দরজা ধরে ভেতরে ঢুকতে নিলেই পেছন থেকে কলার চেপে ধরলো মিঠু। রামি ঘাড় কাঁত করে পেছন ঘুরতেই মিঠু দু-আঙ্গুলের ইশারায় বোঝালো ‘টাকা দিয়ে তারপর যাবি’।
“ছিঃ! তুই অরুর বড়োভাই হয়ে, ছিঃ! ভাবতেই আমার লজ্জা হচ্ছে।”
রামি এমন মুখভঙ্গি করলো যেন সে লজ্জায় ম*রে যাচ্ছে। মিঠুও কম যায় না। বলল,“অরু কে? আমি তো এসেছি বন্ধুর কাছে। চুপচাপ দ্বিগুণ টাকা বের কর।”

রামির চোখ ছানাবড়া। সে আঁতকে ওঠা গলায় বলল,“আমি কি এমনি এমনি তোদের ডা**কা**ত বলি? উচিত শব্দে উচিত বাক্য সাজিয়ে উচিত জবাব দেওয়ার জন্য আমার নাম ইতিহাসের পাতায় ওঠা উচিত। যেখানে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে আমার নাম। কিন্তু আফসোস, আজ পর্যন্ত আমার মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির গুরুত্বপূর্ণ ইন্টারভিউ নিতে কোন সাংবাদিক এলো না। বড়োই আশ্চর্যের কথা! তাঁদের আর কী বলবো? বাঙালি জাতি মানেই ভালোর কদর জানেনা।”
“তোর লেকচার শুনতে আসিনি। দ্রুত আমার পাওনা বুঝিয়ে দে।”

“টাকা কি গাছে ধরে না-কি? আমি এখন এতটাকা কোথায় পাবো?”
“তখন আমার উপর মায়াদয়া হয়নি? ঠিকই তো নিজের বউ নিয়ে গিয়ে আমার পকেট মে*রে*ছি*স। তাছাড়া বউকে তো যা চেয়েছিল, তাই কিনে দিলি। তখন তো টাকার কমতি দেখিনি! আমার বেলা এসেই তুই ফকির হয়ে গিয়েছিস?”
রামি তর্কে হেরে গিয়ে পকেটে হাত ঢুকালো। মিঠুকে পকেট দেখিয়ে বলল,“আমার পকেট ফুটো হয়ে গিয়েছে। এক টাকাও অবশিষ্ট নেই। যার পকেট ফুটো, তার মতো গরিব আর এই দুনিয়ায় আছে? আমি এখন কোত্থেকে তোকে টাকা দেব বল?”
“তাহলে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাক।”

রামি ক্রুর হেসে বলল,“আমাকে পাহারা দিতে হলে তো তোকেও আজ রাত বউ ছাড়া কাটাতে হবে। তুই পারলে আমিও আজ বাইরে থাকতে রাজি।”
সূঁচালো চোখে তাকিয়ে রইলো মিঠু। কিছুক্ষণ নিরব থেকেই অরুকে ডেকে উঠলো। ভেতর থেকেই জবাব দিলো অরু। মিঠু রামির দিকে তাকিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে হাসলো। অরুকে বলল,“একটু বেরিয়ে আয় তো।”
রামি মাথা খাটিয়ে মিঠুর পরিকল্পনা বোঝার চেষ্টা করছে। মেশিন ঘুরছে না। হ্যাং হয়ে একজায়গায় থেমে রইলো। অরু ধীর পায়ে বেরিয়ে এলো। মিঠু বলল,“রামি তোর হাজবেন্ড, এছাড়া ওর সাথে তোর আরেকটি সম্পর্ক আছে। বলতো সেটা কী?”
অরু ভেবে বলল,“আপুর দেবর, তাহলে আমাদের বেয়াই।”

“তোর ব্রেইন খুব ভালো, আমার বোন বলে কথা। বউয়ের চ্যাপ্টার ক্লোজ কর। বেয়ান হিসেবে রামির বাসরঘরের গেট ধরা টাকা তোর পাওনা। পাওনা কিনা বল?”
অরু এক পায়ে খাড়া হয়ে বলল,“অবশ্যই।”
রামি হতাশার নিঃশ্বাস ছেড়ে দরজা ঠে*লে ভেতরে ঢুকে গেল। দরজা চাপানোর আগে মুখ বাড়িয়ে বলল,“তোরা ভাই-বোন বাইরে থেকে সারারাত চো*র পাহারা দে। আমি ঘুমাচ্ছি, আল্লাহ হাফেজ।”

অরু চোখ রাঙিয়ে তাকালো মিঠুর দিকে। কটমট করে বলল,“আমাকে যে বের করে আনলে, এবার আমি ঘুমাবো কোথায়? ওই ব্যাটাতো অ*ভ*দ্র*র মতো বউ বাইরে রেখে নিজে ঘরে ঢুকে বসে আছে।”
মিঠু ব্যঙ্গ করে বলল,“আমাকে যে বের করে আনলে, তুই তো টাকার জন্য নেচেছিলি। টাকা না লাগলে তুই ঘরে গিয়ে বসে থাকতি, আমি তোকে আটকে রেখেছি? এত নাটকবাজ কীভাবে হলি? আমার নাকের ডগা দিয়ে এতবড়ো একটা বা*ট*পা*র বড়ো হলো, অথচ কিছুই করতে পারলাম না আমি! জাতি আমাকে ধি*ক্কা*র জানাবে।”

রামি অধৈর্য হয়ে দরজা ফাঁক করে দেখলো দু’ভাইবোন কী করছে৷ ওদের ঝ*গ*ড়া করতে দেখে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। দশ হাজার টাকা মিঠুর হাতে দিয়ে বলল,“আর নেই। এবার যা।”
“বাকিটাকা মাফ করে দিলাম।” বলে মিঠু চলে যেতে নিতেই তার হাত চেপে ধরলো অরু। তার পথ আটকে বলল,“আমার ভাগ কোথায়?”

“তোর কীসের ভাগ? এতক্ষণ না আমার উপর দো*ষ চাপাচ্ছিলি? পথ ছাড়!” বলে ঝাড়ি দিল অরুকে।
অরু সরলো না। ত্যাড়ামো করে বলল,“আমার অর্ধেক দিয়ে যাও।”
রামি পেছন থেকে অরুর হাত টে*নে ধরে বলল,“তোকে আমি দেব ভাই, এবার ঘরে চল।”
অরু রামিকে ঝাড়ি দিয়ে বলল,“এ্যাই, কে তোমার ভাই? বুদ্ধিসুদ্ধি খেয়ে বসে আছো না-কি?” পা*গ*ল হয়ে বউকে ভাই বলো?”

“তোরা ভাই-বোন যা শুরু করেছিস, কোন মানুষ সুস্থ থাকবে? আমি যে এখনো বাড়িছাড়া হইনি, এতেই তোর আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করা উচিত।”
দুজনকে রেখে মিঠু কে*টে পড়েছে। অরু পেছনে তাকিয়ে দেখলো মিঠু নেই। কোমরে হাত রেখে রামির দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। যেন সব দোষ রামির। রামি বোকার মতো চেয়ে থেকে প্রশ্ন করলো,“আমি আবার কী করলাম?”
অরু নিজের চশমা খুলে রামির চোখে লাগিয়ে দিয়ে বলল,“ভালো করে দেখ, খালি চোখে তো দেখতে পাওনা। দেখ চলে গিয়েছে তোমার পরাণের বন্ধু।”

রামি ঝট করে চশমা খুলে ফেললো। মাথা ঘুরে উঠছে তার।
“বে*য়া*দ*ব, এক্ষুণি তো অন্ধ হয়ে যেতাম আমি।”
বলে রুমে ঢুকে গেল রামি। অরু ভাবলো রামি হয়তো ভীষণ ক্ষে*পে আছে তার উপর। পা টিপে সেও রুমে ঢুকলো। দরজা আটকে দাঁড়াতেই রামি গম্ভীরমুখে বলল,“সালাম দিচ্ছিস না কেন বে*য়া*দ*ব। এটাও শিখিয়ে দিতে হবে?”

অরু সালাম দিতেই সালামের উত্তর দিলো রামি। অরুর বিচলিত মুখশ্রী দেখে মিটিমিটি হাসলো সে। একটা ছোট্ট বক্স হাতে নিয়ে খুললো। সেখান থেকে একটা ব্রেসলেট বের করে অরুর হাত টে*নে পরিয়ে দিয়ে বলল,“পছন্দ হয়েছে?”
অরু মুগ্ধ হয়ে তাকালো। প্রিয় মানুষের দেওয়া উপহার যেমনই হোক, সেটা বরাবরই সবার প্রিয় হয়ে থাকে। অরুর যে পছন্দ হয়েছে সেটা তার চোখেমুখের উচ্ছ্বাস দেখেই বোঝা যাচ্ছে। বাইরে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি এবার ঝুমঝুমিয়ে নামলো।
যা ঠান্ডার পরিমাণ আরো বাড়িয়ে দিলো। অরু বাইরে তাকিয়ে বলল,“বৃষ্টি হচ্ছে।”

রামি মিটিমিটি হেসে বলল,“রোমান্টিক ওয়েদার। বৃষ্টিও জানে আজ আমাদের বাসর রাত।”
অরু দু-কদম পিছিয়ে বলল,“দূরে থাকো, সুস্থ থাকো। একজন ভবিষ্যৎ ডাক্তার হয়ে আমার কর্তব্য হলো সাধারণ জনগণকে সচেতন রাখা।”
রামি হেসে বলল,“অজু করে আয়। এরপর তোকে ডাক্তারি পড়ানোর দায়িত্বটা আমি নিচ্ছি।”

মিঠুর অপেক্ষায় বসে রইলো সুহা। সারাদিনই তার বসায় কেটেছে। উঠে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। কিছুক্ষণ যেতেই নিচে চোখ গেল। মিঠু আসছে। সুহা বারান্দা ছেড়ে ঘরে আবার এসে দাঁড়ালো। মিঠু ঘরে ঢুকে ইচ্ছে করেই বলল,“ঘুমাও নি?”
সুহা মৃদুস্বরে বলল,“না।”
মিঠু ঠোঁট প্রশস্ত করে বলল,“কেন? আমার জন্য অপেক্ষা করলে বুঝি?”
বিপাকে পড়লো সুহা। উসখুস করছে। কী বলবে তৎক্ষনাৎ মাথায় এলো না। মিঠু বলল,“চল, আগে রবের নিকট শুকরিয়া আদায় করি।”

এতে অনেকটা স্বাভাবিক হলো সুহা। মিঠুর কথায় সম্মতি জানালো।
রবের নিকট শুকরিয়া জানিয়ে মিঠু জায়নামাজ ভাঁজ করে রেখে দিলো। অতঃপর সুহার ললাটে গভীর চুম্বন করে বলল,“একজন ভালো স্বামী হওয়ার পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ। তোমার কাছ থেকে উত্তম সার্টিফিকেট পাওয়া হবে আমার সৌভাগ্য।”

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী সিজন ২ পর্ব ৩৮

সুহা স্বচ্ছ হাসলো। তার দু’চোখে হাজারও রঙিন স্বপ্ন। মনে মনে আওড়ালো “নতুন জীবনে আল্লাহ আমাদের দুজনকেই কবুল করুন”।

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী সিজন ২ পর্ব ৪০