অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী সিজন ২ শেষ পর্ব 

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী সিজন ২ শেষ পর্ব 
জিন্নাত চৌধুরী হাবিবা

সকল ব্যস্ততাকে ছুটি দিয়ে ঝুপ করেই সন্ধ্যা নামলো ধরার বুকে। অরুর আজ ফিরতে দেরি। সন্ধ্যা হয়ে এলো, অথচ তার ফেরার নাম নেই। ফোন তুলছে না। হয়তো ক্লাসের সময় ফোন সাইলেন্ট মোডে রেখেছিল। আর ফোনের দিকে মনোযোগই দেয়নি। অনেকটা চিন্তিত রামি। অমি তার পাশেই বসেছিল। দুজন একসাথে অরু আসার অপেক্ষায়। আর দেরি সইলো না রামির। সে একটা শার্ট জড়িয়ে বাইকের চাবি হাতে দরজার দিকেই পা বাড়াচ্ছিল। বারান্দা থেকে ছুটে এলো অমি।

“ঝড় আসছে, ঝড় আসছে।”
রামি বাইরে তাকালো। পরিবেশ স্বাভাবিক। ঝড় আসবে কোত্থেকে? ছোটো করে শুধালো,
“কোথায় ঝড় আসছে? বাইরে তো সব ঠিকঠাক।”
“তুমি দেখনি খালামনি আসছে। আমি বারান্দা থেকেই দেখলাম।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

এতক্ষণে চমক ভাঙলো রামির। হাত দিয়ে অমির মুখ চেপে ধরলো। অনুনয় করে বলল,“চেপে যা বাপ। তোর জ*ল্লা*দ খালা শুনতে পেলে তোর সাথে সাথে আমাকেও আছাড় মা*রা*র চেষ্টা করবে।”
অরু ততক্ষণে ক্লান্ত ভঙ্গিতে ঘরে এসে পৌঁছালো। ব্যাগ রাখতে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,“কী চেপে যেতে বলছো?”
“আজ এত দেরি হলো যে? ফোন তুলছিলি না। আমি কত টেনশনে ছিলাম তোর কোন ধারণা আছে?”

অরু জবাব না দিয়ে অমিকে জিজ্ঞেস করলো, “কীসের কথা বলছিল বাবা?”
অমি ঠোঁটে স্কচটেপ এঁটে দুপাশে মাথা নাড়লো। সে বলবে না। অরু ব্যাগ থেকে চকলেট বের করে দেখালো।
“সত্য কথা বললে আরো দেব।”
অমির চোখ চকচক করে উঠলো। লাফিয়ে চকলেট নিয়ে গড়গড় করে বলে দিল,“চাচ্চু তোমায় ‘ঝড়’ বলতে শিখিয়ে দিয়েছে।”

অমিকে আদর করে দিয়ে অরু বলল,“এখন খেলতে যা।”
অমি বেরিয়ে গেল। রামি থতমত খেয়ে বলল,“এই পিচ্চির কথা বিশ্বাস করিস না তো।”
অরু চোখ রাঙিয়ে বলল,“তোমায় বিশ্বাস করবো, তাইতো? আমার সামনেই কিছু মুখে আটকায় না, আর আড়ালে কত কী বলো আল্লাহ জানেন!”

“ছিঃ! এই তোর বিশ্বাস? আমি আর থাকবো না।”
অরু তীক্ষ্ণ কন্ঠে জানতে চাইলো,“কোথায় যাচ্ছো?”
রামি অভিমানের সুরে বলল,“যেখানে দু-চোখ যায়।”
অরু ঠান্ডা গলায় বলল,“ঠিক আছে, জামাকাপড় নিয়ে বের হও। আর ঘরের দিকে এগোলে তোমার ঠ্যাং ভে*ঙে দেব।”
রামি অসহায়বোধ করলো। তার দু’টাকার মিথ্যে অভিমানকে নর্দমার পানিতে চুবিয়ে দিল এই মেয়ে। হতাশাকে দূরে ঠেলে জিজ্ঞেস করলো,“আজ এত দেরি হলো কেন?”

অরু ত্যাড়া জবাব দিলো,“সতীন খুঁ*জ*তে গিয়েছি।”
“আজ মাথা গরম কেন?”
অরু এতক্ষণে রাগ ঝেড়ে ফেললো।
“বিয়ের আনন্দে একগাদা পড়া জমেছে আমার। আজ নোট কালেক্ট করতেই দিন কে*টে গেল।”
“দো*ষ কি আমার?”

“তো কার দো*ষ? বিয়ে কে করেছে? আরেক বাড়ির ছেলে এসে বিয়ে করেছে? যে তাঁকে দো*ষ দেব!”
ধুপধাপ পা ফেলে জামাকাপড় হাতে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল অরু। অনেকক্ষণ পর কাঁপতে কাঁপতে বের হলো। রামি চোখ বড়ো করে তাকালো।
“ঠান্ডার মধ্যে গোসল করলি কেন? জ্বরটর কিছু একটা হয়ে গেলে?”

অরু কথা বললো না। তার এখন প্রচুর বিরক্ত লাগছে। রামি সাড়া না পেয়ে আলমারি থেকে অরুকে সোয়েটার বের করে দিয়ে বারান্দায় চলে গেল। অরু কম্বল মুড়িয়ে শুয়ে পড়লো। কিছুক্ষণ এপাশ-ওপাশ করে আবার উঠে গেল। আপনাআপনি বিরক্ত কে*টে গেল। মাঝেমাঝেই এমন হয়। হঠাৎ প্রচুর রাগ হয় তার। এরপর আপনা-আপনি রাগ কমে যায়। চপ্পল পায়ে চেপে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। পেছন থেকে রামির তুলনায় ছোটো ছোটো হাত জোড়া আঁকড়ে ধরলো তাকে। রামি দেখলো দুটো কোমল, চিকন হাত পেছন থেকে উঁকি দিচ্ছে। তার পিঠে মাথা রেখে মৃদুস্বরে বলল,“সরি!”

এবার রামি কথা বললো না। হাত জোড়া ছাড়িয়ে দিয়ে দূরে সরে দাঁড়ালো। অরু নাছোড়বান্দার মতো পেছন থেকে সমানে গিয়ে দাঁড়ালো। ঝাপটে ধরে বলল,“কথা বলবে না?”
রামি যেন শুনতে পেল না। সে ভাবলেশহীন বাইরে তাকিয়ে রইলো। অরু ফের বলল,“ঘু*ষ দিলেও না?”
এবারও রামি প্রতিক্রিয়াহীন। অরু আর অপেক্ষা করলো না। পরপর রামির বুকে কয়েকটা চুমু খাওয়া শুরু করলো। রামি আর চুপ করে থাকলো না। তার মেকি রাগ ধরা পড়ে গেল। হেসে ফেললো অরুর পাগলামিতে।

সংসার হাতে নিয়েছে সুহা। খুব মন দিয়ে সবটা করার চেষ্টা করছে। বাসায় সে একাই থাকে। কথা বলার মানুষ নেই। বিকেল বেলা তরী আপু এসে কিছুক্ষণ থেকে যান। তাঁরও সংসার আছে। অরু বাসায় থাকে না বললেই চলে। বাসায় আসলে সেও এসে কিছুক্ষণ আড্ডা দেয়। তারপর মিঠু আসার আগ পর্যন্ত আবারও একা হয়ে যায়। একা হাতে তড়িঘড়ি করে সকালের নাস্তা তৈরি করে টেবিলে রাখলো। মিঠুর বাবা চেয়ার পেতে বসেছেন। মিঠুকে ডাকতে ঘরে গেল সুহা। কয়েকদিনেই মিঠুর অগোছালো স্বভাব সম্পর্কে অবগত হয়ে গেল। বিছানার উপর ভেজা তোয়ালে দেখে তেতে উঠলো সুহা। চোখ রাঙিয়ে তাকালো মিঠুর দিকে।

“ভেজা তোয়ালে এখানে রেখেছেন কোন সাহসে? সবকিছু এলোমেলো করতে উস্তাদ। নোং*রা লোক।”
মিঠু নিজেই নিজের উপর হাসলো। বাইরে সে সবাইকে চোখ রাঙায় আর ঘরে বউ তাকে চোখ রাঙাচ্ছে। মৃদু হেসে বলল,“মেলে দাও তো।”
সুহা কটমট করে বলল,“আবার হুকুম করছেন? এক্ষুণি এটা বিছানা থেকে তুলবেন। তারপর সুন্দর করে মেলে দিয়ে আসবেন।”

সুহা খুব চটেছে আজ। একেবারে অরুর মতো ঝাঁঝ। অরুই তো পেছন থেকে সব কলকাঠি নাড়ছে। সুহাকে হাতেকলমে শিক্ষা দিচ্ছে কীভাবে তার পেছনে পড়া যায়। সুহাও এলোমেলো সবকিছু গোছাবে আর তার নামসহ ধুয়ে দেবে। অরু তো এক কাঠি উপরে। সরাসরি চৌদ্দগোষ্ঠীর নাম ধুয়ে দেয়। মিঠু মাঝেমাঝে যখন বলে,“আমার চৌদ্দগোষ্ঠী তো তোরই গোষ্ঠী।”

সাথে সাথেই প্রতিবাদ জানিয়ে সে বলে উঠে,“বেসম্ভব! এটা হতেই পারে না। বাবা-মা দয়ামায়া করে কোন্ ডাস্টবিন ঘরে এনে তুলেছে, কে জানে! আমার গোষ্ঠীতে এমন নোং*রা লোক একটাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। ছিঃ বস্তি!”
“বেসম্ভব আবার কী?”

“এখন দেখছি ডাস্টবিনের পাশাপাশি অশিক্ষিত ধরে এনেছে। কালই স্কুলে ভর্তি হয়ে যেও।”
ভাবনার মাঝেই সুহার ঝাঁঝালো স্বর শোনা গেল,“এখনো যাচ্ছেন না কেন?”
মিঠু উপায়ন্তর না পেয়ে বিছানা থেকে তোয়ালে তুলে নিলো। বারান্দায় টানটান করে মেলে দিয়ে ঘরে ঢুকলো। এবার সুহা ঠান্ডা গলায় বলল,“খেতে আসুন। বাবা অপেক্ষা করছেন।”

মিঠু সুহার পিছুপিছু বেরিয়ে এলো। বাবা এখনো বসার ঘরে বসে আছেন। মিঠু নাস্তা করে সুহাকে ইশারা করলো ঘরে আসতে। শশুরকে এখানে রেখে ঘরে যাবে কীভাবে? তিনি নিশ্চয়ই বুঝে ফেলবেন৷ এমন সময় তো তিনিও পার করে এসেছেন। সুহা লজ্জায় আর ঘরে গেল না। রান্নাঘরে ঢুকলো চায়ের জন্য। মিঠু ঘরজুড়ে পায়চারি করছে। বারবার সময় দেখছে সে। ঘড়ি ধরা পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। রান্নাঘরে উঁকি দিতেই দেখলো সুহা শাড়ির আঁচল কোমরে চেপে কাপে চা ঢালছে। পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো মিঠু। উদরের পাতলা চামড়ায় হাত রাখতেই জমে গেল সুহা। তার পিঠ এসে ঠেকেছে মিঠুর বুকে। মিঠু বলল,“ডাকলাম তোমায়। আসলে না কেন?”

সুহা অস্থির গলায় বলল, “বাবা এদিকে এসে পড়বেন। প্লিজ এখান থেকে যান!”
“বাবা আমায় এদিকে আসতে দেখেছেন। নিশ্চিন্ত থাকো, তিনি এদিকে আসবেন না।” মিঠুর নির্লিপ্ত জবাব।
সুহার কন্ঠে বিষ্ময় ঝরে পড়লো,“বাবার সামনে দিয়ে এদিকে এসেছেন? ছিঃ! লজ্জাটজ্জা নেই আপনার?”

“কী করবো বলো? বিয়ের আগেও জ্বালিয়েছো, এখনও বড্ড জ্বালাচ্ছ তুমি।” বলেই সুহার কানে ঠোঁট ছোয়ালো। খানিক পরেই কানে ধারালো দাঁতের ছোয়ায় মৃদু আর্তনাদ করে উঠলো সুহা। মিঠু ছেড়ে দিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে হাসলো। বলল,“এটা তোমার শা*স্তি। এখন থেকে ডাকার সাথে সাথে সাড়া না দিলে এরচেয়ে বড়ো শা*স্তি পাবে।”
সুহার কপালে অধর স্পর্শ করে বেরিয়ে গেল মিঠু। সুহা হেসে ফেললো। দেখলো চা প্রায় ঠান্ডা হয়ে এসেছে। মিঠুর বাবা চুলা থেকে সদ্য নামানো গরম চা পছন্দ করেন। চা গরম করে উনার জন্য নিয়ে গেল। তিনিও চা খেয়ে বেরিয়েছেন। সুহা একা হয়ে পড়লো। দ্রুত রান্না সেরে
ফোন হাতে নিয়ে অপেক্ষা করলো। মিঠু কখন ফ্রি হবে, কখন কথা হবে?

সামনের মাসেই নির্বাচন। ব্যস্ত হাতে সবটা সামলাচ্ছে মিঠু। দু’দণ্ড জিরোনোর সময় নেই। সুহাকে খুব কম সময় দিচ্ছে ইদানীং। এমনিতেই মেয়েটা বাসায় একা থাকে। আগে দ্রুত বাসায় ফেরার চেষ্টা করতো। এখন সেটাও সম্ভব হয় না। এমদাদুল হকও সমান তালে কাজ করে যাচ্ছে। আজ অন্যান্য দিনের তুলনায় দ্রুত ফেরার চেষ্টা করলো মিঠু। সুহা ফোন দিয়ে কয়েকবার তাড়াতাড়ি ফিরতে বলেছে। ঘড়িতে এগারোটা আঠারো। দ্রুত ফিরবে বলেও বের হতে দেরি হয়ে গেল। বাসায় পৌঁছালো আরো অনেক পরে। বেল দিয়ে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি। সুহা জেগে ছিলো। দ্রুত এসে দরজা খুলে দিল। মিঠু ক্লান্ত ভঙ্গিতে বললো,“সরি! আজও দেরি হয়ে গেল। রাগ করেছো?”

সুহা অন্যদিন মন খা*রা*প করলেও আজ সহজেই মিঠুর সরি মেনে নিলো। হেসে বলল,“আজকের জন্য সাতখুন মাফ।”
মিঠু চোখ ছোটো করে তাকালো। বলল,“কেন? আজ কি বিশেষ কিছু?”
সুহার চোখেমুখে খুশির চিলিক, সাথে লজ্জা। বলল,“ঘরে চলুন, তারপর বলছি।”
মিঠু লম্বা কদম ফেলে ঘরে গেল। বিছানায় বসে সুহাকে পাশে বসালো। তার দু-হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে বলল,“এবার বলো।”

সুহা বলতে গিয়েই চোখ নামিয়ে নিলো। অধৈর্য হলো মিঠু। “তুমি এত লজ্জা কেন পাচ্ছো?”
কাঁপা হাতে মিঠুর হাত টে*নে পেটের উপর রাখলো সুহা। মুখ খোলার আগেই মিঠুর চোখজোড়া নজরে পড়লো। ওই ধারালো চোখ চকচক করে উঠলো। বলার পূর্বেই বুঝে গেল মিঠু। ইশারায় শুধালো,“সত্যি?”

সুহা ঠোঁট চেপে উপর-নিচ মাথা দোলালো। যার অর্থ “সত্যি”। মিঠুর ঠোঁটে আটকে রাখা হাসিটা ধরা দিলো। উজ্জ্বল হয়ে উঠেছো তার চোখমুখ। সুহা অনুভব করলো সে হাওয়ায় ভাসছে। মিঠু তাকে শূন্যে তুলে নিয়েছে। ঘনঘন শ্বাস নিচ্ছে মিঠু। উত্তেজনায় গলা থেকে শব্দ বের হচ্ছে না। দু-হাতে মিঠুর গাল স্পর্শ করলো সুহা। কোমল গলায় বলল,“আপনি খুশি হয়েছেন?”

মিঠু তড়িৎ মাথা দোলালো। মুখ নামিয়ে সুহার কপাল স্পর্শ করে বলল,“বাবা হওয়ার অনুভূতি এত মিষ্টি কেন সুহা? আমার এই মুহূর্তে ভয়*ঙ্কর রকম ভালোলাগছে। আমি আমি তোমায় বলে বোঝাতে পারবো না। অনুভূতি প্রকাশে ব্যর্থ আমি।”
দিশেহারা লাগছে মিঠুকে।
সুহা শক্ত করে মিঠুর গলা জড়িয়ে মাথা উঁচু করে মিঠুর অধর জড়ো আঁকড়ে ধরলো। ছেড়ে দিতেই মিঠু জিজ্ঞেস করলো,“বলো তুমি কী চাও?”

“এই বেপরোয়া মানুষটাকে আমার মায়ায় আটকে রাখতে চাই।”
মিঠু ফিসফিস শব্দে হাসলো। বলল,“সে তো কবেই আটকে গিয়েছে৷ তোমাতে।”
অতঃপর সুহাকে নামিয়ে দিয়ে পেটে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলো,“আর কেউ জানে?”
“অরু জানে।”
ছোট্ট করে জবাব দিলো সুহা।

হাসির পরই কান্না। জীবন নামক রেলগাড়ীতে প্রতিটি স্টেশনে সুখ থাকে না। কিছু স্টেশন হয় দুঃখের। মিঠুর জীবনেও তেমনি বিপর্যয় নেমে এলো। যার প্রভাব পড়লো তার পরিবারের উপর। বাবা, স্ত্রী, বোন সকলেই তাকে নিয়ে কেঁদেকেটে অস্থির। অথচ সে ভীষণ শান্ত।

নির্বাচনের আগে এমন কিছু হবে সবার ধারণাতীত ছিলো। এতকিছু কে করেছে সেটাও স্পষ্ট। মিথ্যা তথ্য দিয়ে মিঠুকে একজন দে*শ*দ্রো*হী, মুখোশধারী, স*ন্ত্রা*সী বলে ফাঁসিয়ে দেওয়া হলো। সমস্ত প্রমাণ খুব শক্ত না হলেও ফেলে দেওয়ার মতো নয়। নিত্যদিনের মতো বাড়ি থেকে বেরিয়ে পার্লামেন্টে গেল মিঠু। সেখান থেকেই তাঁকে এরেস্ট করা হয়েছে। সরকারি সহ বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে নিউজ দেখাচ্ছে। যেখানে ইবতেসাম মিঠুকে একজন দেশ*দ্রোহী বলে ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে। কিছু মানুষ আছে, যারা মিঠুকে পছন্দ করতো অথচ বিশ্বাস নড়বড়ে। তারা সাপোর্টের পরিবর্তে মিঠুকে ঘৃ*ণা শুরু করলো। ভাবলো তারা বুঝি এতদিন নিজেদের বিবেকের কাছে প্রতারিত হলো! মিঠু শীতল চাহনিতে দেখছে সবকিছু। বেশিরভাগ কাছের মানুষই এই মুহূর্তে তাকে ছেড়ে গা বাঁচিয়ে চলছে।

সুহাকে সামলানো যাচ্ছে না। সে অনবরত আহাজারি করে চলেছে। সুহার মামা বিয়ের প্রথমদিকে চোটপাট দেখালেও পরবর্তীতে মনের ক্ষো*ভ দূর হয়েছে। তিনিও মিঠুর পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। বাবার বুক ব্যথা শুরু হলো। মাহমুদ আর সাদাদ বাইরের সবটা সামলাচ্ছে। রামি আসবে দুদিন পর। তাকে কিছুই জানানো হয়নি। অরু প্রথমে বেশ কান্নাকাটি করলেও এখন নিজেকে শক্ত করে নিয়েছে। তরীর মন নরম। সুহা আর বাবাকে সামলাতে হবে।

একজন শক্ত না থাকলে কোনটাই সম্ভব নয়। সুহা একপলক মিঠুর সাথে দেখা করার জন্য আকুতি করলো। কেউ শুনলো না, দেখলো না তর আহাজারি। দেখা করার অনুমতি নেই। দেশ*দ্রোহীর শেষ পরিণতি কেমন হতে পারে আন্দাজ আছে সুহার। অরুকে ঝাপটে ধরে বলল,“একটা কথা রাখবে অরু! তার যদি কিছু হয়, সাথে আমাকেও কবর দিয়ে দিও।”
অরুর কলিজা ছিঁড়ে যাচ্ছে। তবুও শক্ত থেকে বলল,“কিছু হবে না ভাবি। আল্লাহ আছেন। ভাইয়ারা দেখছে। ইনশাআল্লাহ দ্রুত আমার ভাই ফিরে আসবে। আমরা সবাই অপেক্ষা করে আছি। আমাদের ছোট্ট সোনা তার বাবার হাত ধরে হাঁটবে। তুমি শুধু দোয়া করো।”

সুহা হাউমাউ করে কেঁদে বলল,“আমি যে আর সইতে পারছি না। আমাকে তার কাছে দিয়ে আসো।”
“শক্ত হও ভাবি। ভাইয়ার প্রফেশন সম্পর্কে তুমি জানো। তার স্ত্রী হয়ে এমন ভেঙে পড়া তোমায় মানায় না। ভাইয়া শুনলে ভীষণ কষ্ট পাবে।”

সুহার মাথাটা বুকে চেপে ধরলো অরু। সে বিরতিহীন কেঁদে চলেছে। তরী মাহমুদকে কল দিল। বাবার বুক ব্যথা বেড়ে গিয়েছে। মাহমুদ আজ সাদাদকে পাঠালো। সে মিঠুর সাথে দেখা করার চেষ্টা করছে।
পুরো বাড়িতে শোকের ছায়া। রামি বাড়ি ফিরলো। প্রতিবারের মতো এবার আর আনন্দটা রইলো না। বাড়ির কেউ তাকে মিঠুর কথা জানালো না। সেও দেশবাসীর মতো নিউজ দেখে জেনেছে।

বাবা, মামা শশুর, সাদাদ, রামি, মাহমুদ, রিয়াজ সহ দলীয় ছেলেরা উঠেপড়ে লেগেছে মিঠুর বিরুদ্ধে আনা মিথ্যা আরোপ ভুল প্রমাণ করতে। আজ একজন দেখা করার অনুমতি পেল। মাহমুদ সবাইকে বাদ দিয়ে মিঠুর বাবাকে পাঠালো মিঠুর সাথে দেখা করতে। মানুষটা একেবারে নরম হয়ে গিয়েছেন।

ছেলেকে শিকের ভেতর দেখে পা এগোতে চাইছে না। চোখে পানি চিকচিক করছে। মিঠু বাবাকে দেখে এগিয়ে এসে দাঁড়ালো। তার ক্ষ*ত শরীর দেখে চোখ জ্বলে উঠলো বাবার। এই কদিনে নিশ্চিয়ই ছেলেটার উপর অমানবিক নির্যাতন গিয়েছে। তিনি হুঁ হুঁ করে কেঁদে ফেললেন। মিঠু হালকা হেসে বলল,“কাঁদছো কেন বাবা? চিন্তা করো না। আমি জানিনা এখান থেকে বের হতে পারবো কি-না! তুমি নিজের খেয়াল রেখো। আপু আর অরুকে বলবে তোমাকে, সুহাকে আল্লাহ যদি দেন আমার সন্তানকে যেন দেখে রাখে। শুধু শুধু কান্নাকাটি না করে বাড়ি ফিরে যাও। আমার সমাপ্তি যদি এভাবে লেখা থাকে, তবে এভাবেই পতন ঘটবে আমার।”

বাবা কথা বলতে পারছেন না। তবুও কষ্ট করে বললেন,“তুই একবার বের হলে আমি তোকে আর এসবে জড়াতে দেব না। আমি তো বাবা। আমি কীভাবে নিজের সন্তানকে মৃ*ত্যু*র পথে ঠেলে দেব, বল? চিন্তা করিস না। বাবা তোকে বের করে নিয়ে যাবো।”
শিকের উপর দিয়েই বাবার হাতে হাত রাখলো মিঠু। বাবাকে আশ্বস্ত করে বলল,“মনোবল হারিওনা বাবা। দোয়া করো আমার জন্য। আমি শক্ত আছি। কঠিন জালে ফেঁ*সে*ছি। এখান থেকে মুক্তি পাওয়া দুঃস্বপ্ন। তোমার দোয়া করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই।”

বাবা ছেলে আর কথা বাড়াতে পারলো না। সময় শেষ। অনিচ্ছাকৃত বিদায় নিতে হলো বাবাকে।
আজ মিঠুকে কোর্টে তুলবে। তার ভক্তকুল ক্ষেপে আছে। তার পরিবারে সবার মাঝে আতঙ্ক। মিঠু বুক ফুলিয়ে সাহেবের মতো হাঁটছে। তার ঠোঁটে লেগে আছে মাধুর্য। এমন পরিস্থিতিতেও হাসছে সে। তার মাঝে বিন্দুমাত্র ভয় নেই। চারপাশে পুলিশ ঘেরাও দিয়ে রেখেছে তাকে। সবার হৈচৈ চারদিকে। মিঠুর হাসি আরো চওড়া হলো।
তাকে কোর্টে হাজির করা হলো। আজ রায় পড়বে। এরপর, এরপর একটি জীবনের সাথে সাথে একটি পরিবারের আত্মার সমাপ্তি ঘটবে।

বর্তমান রাজনীতিকে বলা হয় দু*র্নী*তি। মিঠুকে ঘরে ফেরানোর জন্য প্রচুর টাকা নষ্ট করেছে সবাই। সততা দিয়ে বর্তমান যুগে রাজনীতিতে টিকে থাকা যায় না। সবই টাকা আর ক্ষমতার খেলা। ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকায় আজই রায় দেওয়া হলো না। সামনে তারিখ দেওয়া হলো। মিঠুকে আবারো কোর্টে তোলা হবে নির্বাচনের পর।

এমদাদুল হক একপাক্ষিক ভোট কুঁড়িয়ে এমপি পদে জয়যুক্ত হলেন। তাঁর গলায় ফুলের মালা। ঠোঁটে মিঠুর উদ্দেশ্যে বিদ্রুপের হাসি। আজ আনন্দে মিঠুর সাথে দেখা করতে গেলেন। বি*শ্রী হেসে বললেন,“বলেছিলাম আমার পথ থেকে সরে যাও। শুনলেনা, এবার পঁচে ম*রো। রাজনীতি তোমাদের মতো বাচ্চা ছেলেদের জন্য নয়। প্রচুর মাথা খেলাতে হয়। যা তোমার নেই।”

মিঠু শিক খামচে ধরলো রাগে। তার চোয়াল শক্ত হয়ে দাঁতে দাঁত লেগে গেল। চোখ দুটো রক্তজবার মতো।
ওখান থেকে চলে গেলেন এমদাদুল হক। রিয়াজের সাথে পথেই দেখা। রিয়াজ, আর মিঠুর পরিবার মুখিয়ে আছে একটা প্রমাণ জোগাড়ের অপেক্ষায়। রিয়াজ সালাম দিয়ে শুভেচ্ছা জানালো এমদাদুল হককে। এতদিন সে আড়ালে থেকেই মাহমুদ আর রামিকে সাহায্য করেছে। এমদাদুল হক বিদ্রুপ করে বললেন,“কী খবর তোমার? নেতার খবর নিয়েছো নাকি?”
“আর বলবেন না ভাই। শা*লা*র ওই ইবতেসামের সাথে থেকে কিছুই পেলাম না।”

অতঃপর গলার স্বর নিচু করে জড়োসড়ো হয়ে বলল,“ভাই আমি আপনার সাথে কাজ করতে চাই।”
এমদাদুল হক অট্টহাসিতে মেতে উঠলেন। চাপা স্বরে বললেন,“আমাকে তোর ওই নেতার মতো বোকা পেয়েছিস না-কি? দল পরিবর্তন করবি? বেশি চালাকি করলে তোরও ইবতেসামের মতো অবস্থা করবো। আমার কথা শোনেনি। দেখ্ কীভাবে ফাঁসিয়েছি। বাঁচতে চাইলে আমার সাথে পাঙ্গা নিতে আসবি না। পরিবারসহ উধাও করে দেব।”
রিয়াজ ভয়কাতুরে গলায় বলল,“সত্যি বলছি ভাই। আমি আপনার সাথে কাজ করতে চাই।”

এমদাদুল হক রিয়াজকে পাশ কাটিয়ে দলবল নিয়ে চলে গেল। তার ধারণা রিয়াজ মিঠুর হয়েই কাজ করবে। পরিবারের সকলেই নিশ্চিত ছিলো সব এমদাদুল হকের কাজ। প্রমাণ ছাড়া তো কিছু করা যায় না। এবার তার সুযোগ এসেছে। রিয়াজ ফোন বের করে রেকর্ডটা চালু করে শুনলো। সব ঠিকঠাক। তার ঠোঁটে বিজয়ের হাসি। মাহমুদ, সাদাদ কাছেই এক জায়গায় ছিলো। তিনজন এটা নিয়ে আজকের মতো বাড়ি ফিরে গেল৷ আরো একটি পরিকল্পনা আছে তাদের।

পরবর্তীতে অডিও ক্লিপটি কোর্টে প্রেরণ করা হয়। আশ্চর্যের বিষয় এমদাদুল হকও নিজে সবটা স্বীকার করেন। মিঠুকে মিথ্যে মা*ম*লা থেকে মুক্ত করা হয়। তার পরিবারে খুশির ঢল। এদিকে এমদাদুল হকের পতন ঘটলো। মিঠুর পরিবর্তে পুলিশ তার হাতে হাতকড়া পরালো। ভোটে না জিততে পারলেও আজকে খেলায় মিঠু জিতে গেল। আজকাল সুষ্ঠু রাজনীতি হয়না। ন্যায় বলতে কিছুই নেই। মাঝেমধ্যে টিকে থাকতে হলে এমনকিছু পন্থা অবলম্বন করতে হয়, যা সমাজের চোখে খা*রা*প হলেও পরিস্থিতির চোখে উচিত কাজ। নয়তো পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে হয়।

মিঠু পরিবারের কাছে ফিরলো। বাড়িতে খুশির আমেজ।
রাতে অরু রামিকে জিজ্ঞেস করলো,“এই অসম্ভব কীভাবে সম্ভব হলো?”
ভুরু কুঁচকে তাকালো রামি। “কোনটা?”
“এমদাদুল হক কীভাবে সবটা স্বীকার করলেন?”
“সেটা তিনি জানেন।”

“আমার কাছে লুকানোর চেষ্টা করবে না। যে জেতার জন্য আমার ভাইয়ের পেছনে এতবড়ো ষড়*যন্ত্র করতে পারে, সে এমনি এমনি নিজের দো*ষ স্বীকার করবে না। বলো না!”
রামি আর অরুর কাছে লুকানোর চেষ্টা করলো না। বলল,“
“এমদাদুল হকের দু’টো মেয়ে আছে। দুজনকেই তিনি অসম্ভব ভালোবাসেন। ছোটো মেয়েটাকে আমরা কিডন্যাপ করেছি। মেয়েটা ঠিক কোথায় সেটা এমদাদুল হকের ধারণার বাহিরে। পুলিশে খবর দিয়ে লাভ হবে না। পুলিশকে জানালে মেয়েটাকে মে*রে ফেলা হবে বলে হু*ম*কি দেওয়া হয়েছে। তারপর আমাদের মাঝে একটা সুষ্ঠু বোঝাপড়া হয়।

মিঠুর বিরুদ্ধে করা মিথ্যা অভিযোগ নিজ মুখে স্বীকার করলে উনার মেয়েকে ছেড়ে দেওয়া হবে। সব বাবারাই মেয়েদের জন্য সবকিছু করতে রাজি হন। তাছাড়া এমদাদুল হকের খুব বেশি জেল-জরিমানা হবে না। এটা ছাড়াও আমাদের কাছে উপযুক্ত আরেকটি প্রমাণ ছিলো। যেটা রিয়াজ রেকর্ড করেছিল।এমদাদুল হক নিজ মুখেই স্বীকার করেছেন তিনি মিঠুকে ফাঁসিয়েছেন। এখন স্বীকার করলেও ফাঁসবেন, না করলেও ফাঁসবেন। আমাদের কথামতো কাজ না করলে মেয়েকে হারাবেন। তাই ভেবেচিন্তেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি।

কয়েকবছরের জেল আর পদ হারানো ছাড়া কোন বি*প*দ নেই উনার। যত সহজে বলে ফেলেছি, কাজটা ততটা সহজ ছিলো না সবার জন্য। আমি তো ডিউটিতে ছিলাম। সব করেছে ভাইয়ারা আর রিয়াজ। এতে অবশ্য তাঁদের দলীয় লোকজন, ছেলেপেলের অবদান বেশি। আমার ছুটি ছিলো না। দেখ্, ভাগ্য আমার সুপ্রসন্ন। মাঝখানে আমি ছিলাম না। কিন্তু মিঠুর জামিনের সময়, আমিও ছুটি কাটাচ্ছি।”

অরু রামিকে জড়িয়ে ধরে গভীর এক নিঃশ্বাস ফেললো। রামি বলল,“সেই দুষ্টু, ঝগড়ুটে অরুকে ভীষণ মিস করছি। এই একমাসে কতটা বড়ো হয়ে গিয়েছিস তুই।”
অরু হাসলো। বলল,“আমি ছোটো নই। শুধু পরিস্থিতি অনুযায়ী আচরণ করি। এই একমাস আমাদের সুখের মুহূর্ত ছিলো না। শক্ত হতে হয়েছে আমাকে।”
অরুর গালে ঠোঁট চেপে ধরলো রামি। অতঃপর ঘোর লাগা কন্ঠে ডাকলো,“অরু!”

“হুঁ?”
“মিঠু আমার পরে বিয়ে করেও ছয় মে*রে দিল। আমি আগে বিয়ে করেও পিছিয়ে গেলাম। কবে শুনবো বাবা ডাক? কবে আরেকটা দুষ্টু অমি আসবে?”
অরু চুপচাপ রামির বুকে মুখ গুঁজে দিল। রামি আবারও ডাকলো,“অরু!”
“হুঁ!”
“আমি তোকে ভালোবাসি অরু।”
অরু মাথা তুললো না। আরেকটু শক্ত হাতে রামিকে আঁকড়ে ধরলো।

এতদিনের ছোটাছুটিতে মাহমুদও ক্লান্ত। তার মাথাটা টনটন করছে। অমি ঘুমাচ্ছে তার দাদুআপুর কাছে। বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো মাহমুদ। মাঝেমধ্যে চুল খামচে ধরছে। কপালের উপর এক জোড়া শীতল হাতের স্পর্শ পেল মাহমুদ। বুঝলো এটা তরী। সে বাঁধা দিলো না। তরী কপালে মলম লাগিয়ে ম্যাসাজ করে দিলো। অনেকক্ষণ পর আরামবোধ করলো মাহমুদ। তরীর হাত ধরে থামিয়ে দিল। ছোট্ট করে বলল,“পাশে শুয়ে পড়ো। তুমিও ক্লান্ত। আবার ভোরে উঠলে আর ঘুমাও না।”

তরী বিভোর হয়ে দেখছে এই মানুষটাকে। তার ভালোবাসা কেমন অপ্রকাশিত। তবুও তরী টের পায় মানুষটা তাকে ভীষণ ভালোবাসে, পাগলের মতো ভালোবাসে। এই যে নিশ্চুপে, কতোটা যত্নে তার পাশাপাশি তার পরিবারেরও ঢাল হয়ে পাশে রয়েছে। এই মানুষটা তার জীবনে না এলে জীবনটা কেমন হতো? তরী আর ভাবতে পারলো না। হুট করে মাহমুদ তরীর হাত টেনে পাশে শুইয়ে দিল। একহাত তরীর উপর রেখে তারদিকে চোখ রেখে বলল,“কী এত ভাবছো?”

তরী যন্ত্রের মতো বলল,“আপনি আমার জীবনে না এলে জীবনটা কেমন হতো, সেটাই ভাবার চেষ্টা করছি।”
মাহমুদ চোখ বুজে হাসলো। মিটিমিটি হেসে বলল,“মাঝেমাঝে ক্লাস নিতে গিয়ে বিব্রত হতাম। কিছু বাচ্চা মেয়ে তাকিয়ে থাকতো। বিশেষ করে নতুন যারা, তারা। অনেকেই জানতো না আমি বিবাহিত। তাঁদের ধারণা কলেজের শিক্ষকরা দেরিতে বিয়ে করেন। আমাকে নিয়ে কানাঘুঁষা হতো। তারপর অমির একবছর বয়সে যখন ওকে নিয়ে কলেজে গিয়েছিলাম, সেদিন থেকে সবাই জেনেছে আমি শুধু বিবাহিত নই, আমার একটা সন্তান আছে। সেই থেকে এখন শান্তিতে ক্লাস করাতে পারছি”
তরী ফোঁস করে রেগে গেল।

“বয়স বাড়ার পরও মেয়েদের সামনে রঙঢঙ করবেন। তাঁদেরই বা কী দো*ষ?”
মাহমুদ বলল,“এদের চোখে আমাদের জন্য ক্ষণিকের ভালোলাগা থাকে। ক্রাশ যাকে বলে। জীবনসঙ্গী হিসেবে চাওয়া থাকে ভিন্ন।”
তরী গমগমে স্বরে বলল,“ভালোলাগা থাকতে হবে কেন?”
মাহমুদ আবারও হাসলো। তরীর চোখের পাতায় স্পর্শ করে বলল,“আমি এক তরীতেই আসক্ত। সে আমার জীবনের বড়ো সত্য।”
তরী ঠান্ডা হলো। মাহমুদের সাথে মিশে গিয়ে বলল,“বৃদ্ধ বয়সেও আমার আপনাকে চাই।”
মাহমুদ নিরব থেকে তরীকে আগলে নিলো।

মিঠু ঘরে আসার পর থেকেই সুহা তার বুকে হামলে পড়ে কেঁদে যাচ্ছে। মিঠু সুহার চুলের ভাঁজে হাত চালিয়ে বলল,“আমি ফিরে এসেছি সুহা। এমন বাচ্চামো করলে চলবে? কতদিন পরিবারের কারো হাসি দেখিনি। এভাবে কান্না দেখতে আমার ভালোলাগছে না। একটু হাসো প্লিজ!”
সুহা কান্না থামিয়ে হাসতে গিয়েও ঢুকরে কেঁদে ওঠে। মিঠু বলল,“চেহারার কী হাল করেছো তোমরা সবাই! এভাবে কাঁদলে কিন্তু আমি কোথাও চলে যাবো।”

মিঠুর হুমকিতে কাজ হলো। তাকে আরো শক্ত করে ধরলো সুহা। কান্না থামানোর চেষ্টা করে বলল,“আপনাকে আর কোথাও যেতে দেব না আমি। আপনি বলুন এসব রাজনীতি ছেড়ে দেবেন।”
এসব কথা বাদ দাও সুহা। আমার দিকে তাকাও। আমি তৃষ্ণার্ত। তোমাকে দেখার তৃষ্ণা, তোমার ঠোঁটে চুমু খাওয়ার তৃষ্ণা আমাকে কাবু করে ফেলেছে। একবার ছুঁয়ে দাও না।”

সুহা তাকিয়ে রইলো অপলক। মিঠু আর আগের মতো নেই। চোখ যেন তিনহাত নেমে গিয়েছে। গায়ের রং ফ্যাকাসে। গাল দুটো ভঙ্গুর। সবকিছু মিলিয়ে তাকে দেখতে ভালোলাগছে না সুহার। তার শুধু কান্না পাচ্ছে। হাউমাউ করে কাঁদতে গিয়েও মিঠুর চোখের দিকে তাকিয়ে ঢোক গিলে ফেললো। আস্তে আস্তে এগিয়ে গিয়ে মিঠুর ঠোঁটজোড়া আঁকড়ে ধরলো।
মিঠু সরে গিয়ে নিচু হয়ে বসলো। শাড়ি সরিয়ে সুহার পেটে চুমু খেয়ে বলল,“সে কেমন আছে?”

সুহা জেনেও শুধালো, “কে?”
মিঠু অকপটে বলল,“আমার জাত, আমার রক্ত, আমার অংশ।”
সুহা কান্না চোখে হেসে বলল,“এতদিন ভালো ছিল না। তার বাবাকে পেয়ে এখন সে বেশ ভালো আছে।”
মিঠু দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুহার হাzতের দিকে নজর দিল। নখ অনেকটা বড়ো হয়ে গিয়েছে। ভুরু কুঁচকে বলল,“তুমি আর অরু সবসময় আমাকে যাচ্ছেতাই বল। এত পরিষ্কার আর গোছালো মানুষের নখ কীভাবে এত বড়ো হলো?”
সুহা জবাব না দিয়ে হেসে ফেললো। মিঠুর কপালের ভাঁজ আরো গভীর হলো।

ছাড়া পাওয়ার মাস দুয়েক না যেতেই আবারও মাঠে নামলো মিঠু। সে ভয় পেয়ে পিছিয়ে যাওয়ার মতো ছেলে নয়। একবার যখন পা বাড়িয়েছে, তবে আর সে পিছু হটবে না। আবারও নির্বাচনে দাঁড়াবে সে।

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী সিজন ২ শেষ পর্ব ৪০

পরিবার, আত্মীয়স্বজন কারো বাঁধাই তাকে রোখাতে পারছে না। গত সপ্তাহে সুহা এ নিয়ে রাগ দেখিয়ে মামার বাড়ি চলে গেল। একঘন্টার মাঝে তাকে নিয়ে বাড়িতে ফিরে এসেছে মিঠু। বলল,“একদিন বলেছিলাম সুহা, আমি তিনটে জিনিস কখনো ছাড়তে পারবো না। পরিবার, তুমি আর রাজনীতি। আমাকে কখনো এগুলোর একটিও ছাড়তে বলবে না।”
একরোখা মানুষটার জেদের কাছে হার মানলো সুহা। এখন আর কিছু বলে না। মনে প্রাণে আল্লাহর কাছে শুধু মিঠুর সুস্থতা আর সফলতা কামনা করে। যেটাতে মানুষটার মন টা*নে, তৃপ্তি পায় সেটাই করুক।