বুকে যে শ্রাবণ তার পর্ব ১৯

বুকে যে শ্রাবণ তার পর্ব ১৯
নিশাত জাহান নিশি

“আমাকে এই জাহান্নাম থেকে নিয়ে যা বাপ। তাদের বাপ-ছেলের টর্চার আমি আর সহ্য করতে পারছিনা!”
মুহূর্তেই ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠল মিশাল। শরীরটা তার অনির্বাণ রাগে জ্বলে ওঠল। কাউকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাঁক করে দেওয়ার মতো এই জ্বালা। রক্তের জ্বালা কেবল রক্তেই বুঝে। তার ফুফুর কান্নার শব্দ ও আহাজারি এখনও তার কানে করুনভাবে বাজছে। সামান্তার পাশ কাটিয়ে কিঞ্চিৎ দূরে এসে দাড়ালো মিশাল। উদ্বিগ্ন গলায় ফোনের অপর প্রান্তে থাকা তার ফুফুকে শুধালো,

“কি হয়েছে ফুফু? খুলে বলো?”
“সাহিল ঘরে ভাঙচুর করছে। পুরো বাড়িঘর লণ্ডভণ্ড করে ফেলছে। পাগলের ন্যায় কার্যকলাপ করছে। সাহিলের বাবা ক্ষেপে এসে কিছুক্ষণ পর পর আমার গাঁয়ে হাত তোলার চেষ্টা করছে! দরজা আটকে বসে আছি আমি। আমার পরিবারের জন্য না-কি তার ছেলের এই করুন দশা। অথচ আমি এখনও অবধি বুঝে ওঠতে পারছিনা আমার পরিবার তার কী ক্ষতি করল। কোনো কথাই তারা আমাকে খুলে বলছেনা।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“ডোন্ট বি এফ্রেইড ফুফু। ঘরের দরজা বন্ধ করে তুমি চুপচাপ বসে থাকো। চাচাকে নিয়ে আমি এক্ষুণি আসছি। তারা তোমার কোনো ক্ষতি করতে পারবেনা। এতো বড়ো বুকের পাঠা তাদের এখনও হয়নি। বি স্ট্রং ওকে?”
“তাড়াতাড়ি আয় প্লিজ। এই জঞ্জাল থেকে আমাকে উদ্ধার করে নে। অনেক সহ্য করেছি তবে আর নয়। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে আমার।”

কথা বলে সময় নষ্ট করার মতো সময় আপাতত মিশালের হাতে নেই। যা করার তার কাজেক্ষেত্রে করে দেখাতে হবে। কলটি কেটে মিশাল ঝড়ের বেগে রুমের দরজাটি খুলল। এতো সময় ধরে মিশালের ফোনালাপের পরিপ্রেক্ষিতে সামান্তা বেশ বুঝতে পারল তার ফুফু ভালো নেই। বিপত্তির মুখোমুখি রয়েছেন তিনি। তাই আর মিশালকে প্রশ্ন করতে বিরক্ত করতে চাইলনা সে।

যদিও সমস্যাটি একান্তই সামান্তাকে ঘিরে তাই সামান্তাকেও এই বিষয় নিয়ে ভাবতে হবে। উৎকণ্ঠিত হয়ে মিশালের পিছু নিলো সামান্তা। দরোজার বাইরে থাকা শাহনাজ বেগম ও রুমকি হকচকিয়ে ওঠে তাদের জায়গা থেকে ঈষৎ নড়েচড়ে দাঁড়ালো। তারা আন্দাজও করতে পারছিলনা কী হয়ে যাচ্ছে তাদের আড়ালে। সম্বিত ভেঙে এবার নিজের রূপে ফিরে এলেন শাহনাজ বেগম। মিশাল ও সামান্তার যাওয়ার পথে তাকিয়ে তিনি মৃদু আওয়াজ তুলে মিশালকে শুধালেন,

“কী হয়েছে মিশাল? কোথায় যাচ্ছিস তোরা?”
“পরে এসে সব বলছি মা। এখন হাতে সময় নেই।”
মিশাল ও সামান্তা হম্বিতম্বি হয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। রেগে গেলেন শাহনাজ বেগম। তিরিক্ষি পূর্ণ গলায় তাদের যাওয়ার পথে তাকিয়ে বললেন,
“পর কখনও আপন হয়না এটাই তার প্রমাণ! ছেলেটা কোথায় যাচ্ছে একটু বলেও গেলনা। কী এমন ক্ষতি হতো আমাকে সব জানিয়ে গেলে?”

রাগে ফোঁস করে রুমকি পাশ ফিরে তার মায়ের দিকে তাকালো। কড়া গলায় তার মাকে বলল,
“সবসময় তো পরিস্থিতি এক রকম থাকেনা মা। পরিস্থিতি বিবেচনা করে কথা বলাটাও সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। হয়ত তারা খুব তাড়ার মধ্যে রয়েছে তাই আমাদের কিছু জানায়নি। সময় হলে সবটা জানাবে। সেই অবধি তুমি একটু মুখটা বন্ধ করে ধৈর্য্য ধরে থাকো তো।”

“সবসময় তোমার পাকা পাকা কথা। ভাইকে একটু কিছু বললেই গাঁয়ে ফোসকা পরে। বছরে দু-একটা জামা কিনে দিয়ে মাথা কিনে নিয়েছে তোমার!”
পক্ষান্তরে বিদ্রোহী গলায় রুমকি প্রতিবাদ করতে যাবে ইতোমধ্যেই রুমকির সেলফোনটি নিঃশব্দে বেজে ওঠল। আননোন নাম্বার থেকে কল এলো। কলটি দেখা মাত্রই রুমকির ভাবভঙ্গি পাল্টে গেল! নিমিষেই ঠোঁটের কোণে তার আলতো হাসির রেখা ফুটে ওঠল। মনমেজাজ ফুরফুরা হয়ে গেল। তৎক্ষণাৎ তার মাকে উপেক্ষা করে সে বাড়ির অন্য প্রান্তে চলে গেল! বিষয়টা তেমন আমলে নেননি শাহনাজ বেগম। বরং বিষয়টা তাঁর দৃষ্টি এড়িয়ে গেল। তিনি তো মিশালের উপর ক্ষোভে ফুলে ফেঁপে রয়েছেন। কখন তিনি মিশালকে ভাগে পাবেন আর কথার প্যাচে জড়িয়ে তাকে আক্রমন করবেন সেই ভাবনায় ডুবে আছেন।

সামান্তা মিশালের দু’কদম পেছনে। গতানুগতিক ছুটছে মিশাল। তার সমান হওয়া নিতান্তই দুঃসাধ্য। নিরুপায় হয়ে তাই সামান্তা পেছন থেকেই অধীর গলায় মিশালকে শুধালো,
“কী করবে এখন? ফুফুকে ঐ বাড়ি থেকে নিয়ে আসবে?”
“শুধু তাই নয়। ঘৃণিত ঐ বাপ-ছেলের নামে নারী নির্যাতনের মামলাও ঠুকে দিব! ফুফু যেহেতু নিজের ইচ্ছেতে এবার মুখ খুলতে বাধ্য হয়েছে সো আমাদেরও এবার একটা স্টেপ নিতেই হবে। এই সুযোগটার জন্যই তো আমরা এতোদিন অপেক্ষা করছিলাম।”

“মন্দ বলোনি কিন্তু। বাপ-ছেলে দুটোই সাংঘাতিক। প্রয়োজনে আমি সাহিল ভাইয়ের বিরুদ্ধে কোর্টে স্বাক্ষী দিব। তাদের মোটেও আর ছেড়ে দেওয়া যাবেনা।”
দুজনই তাদের গন্তব্যে পৌঁছে গেল। তৎপর ভঙ্গিতে মিজানুর রহমানের মুখোমুখি দাড়িয়ে রইল সামান্তা ও মিশাল। এতোক্ষণ যাবত দুজনের মুখ থেকে বৃত্তান্ত শুনে ক্ষেপে যাওয়ার বদলে উল্টো নীরব চিত্তে দাড়িয়ে রইলেন তিনি! বিষয়টায় বড়ো অবাক হলো মিশাল ও সামান্তা। এই নির্বাকতা আশা করেনি তারা। নির্বোধ রূপে দুজন দুজনের মুখ দেখাদেখি করতে লাগল। কিছুতেই যেনো মিজানুর রহমানের প্রতিক্রিয়া তারা বুঝে ওঠতে পারছিলনা। কিয়ৎক্ষণ অন্তর গভীর চিন্তায় ডুবে থেকে অতঃপর মিজানুর রহমান মুখ খুললেন। নিরবচ্ছিন্ন দৃষ্টিতে তিনি উদ্ধত মিশালের দিকে তাকালেন। ভাবুক গলায় শুধালেন,

“তুই শিওর নাজিয়া ঐ বাড়ি ছাড়ার কথা বলেছে?”
“কোনো ডাউট নেই চাচা। তুমি চাইলে আমার কল রেকর্ডিং চেক করতে পারো।”
“তার আর কোনো প্রয়োজন নেই। নাজিয়ার সংসারের ব্যাপার নাজিয়াকেই বুঝে নিতে দে!”
“হোয়াট? তুমি এসব কী বলছ চাচা? আমার থেকে এটা এক্সপেক্ট করিনি!”

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মিজানুর রহমান। নিষ্ক্রিয় ভঙ্গিতে তিনি মিশালের কাঁধে হাত রাখলেন। আক্ষেপ নিয়ে বললেন,
“নাজিয়া আমার ছোটো বোন হয় বুঝেছিস মিশাল? তাকে আমার চেয়ে ভালো কেউ চিনেনা। তোরা কেউ তাকে এখনও চিনতে পারিসনি। তবে তাকে আমি হাড়ে হাড়ে চিনি। তমালের সাথে তার প্রেমের বিয়ে ছিল। পরিবারের সবার বিরুদ্ধে গিয়ে তমালের সাথে সংসার পেতেছিল সে। বয়স তখন পনেরো ছিল তার। বিয়ের উপযুক্ত ছিলনা। পুরো মহল্লায় আমাদের মান সম্মান হানি হয়েছিল। তবুও বোনের সুখের কথাটা ভেবে তাদের বিয়েটা মেনে নিয়েছিলাম আমরা।

তখন বড়ো ভাই মানে তোর বাবাও বিয়ে করেনি। আর আমার বিয়ে তো দূর। বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে আমরা তার ভুলটাকেও সবসময় প্রশ্রয় দিতাম। দুই ভাইয়ের এক বোন ছিল। এবার বুঝ কতো আদরের ছিল। তবে তার বিয়ের একবছর পর থেকেেই শুরু হয় সংসারে তমালের অশান্তি। তাকে মারধর করা, কথা কাটাকাটি করা, মানসিক, শারীরিকভাবে তাকে অত্যাচার করা।

বড়ো ভাইও অনেকবার চেয়েছিল তাকে ঐ সংসার থেকে নিয়ে আসতে। তবে নাজিয়াই বার বার বাঁধ সেধেছিল! কতোবার যে সে আমাদের হেনস্তা করেছে তার বলার বাইরে। স্বামী, সংসারের মায়া ছাড়তে পারেনি সে। তখন তো সে ছিল যুবতী মেয়ে, চাইলে আমরা তাকে অন্য কোথাও বিয়ে দিতে পারতাম। আর এখন তো সে এক প্রাপ্তবয়স্ক ছেলের মা। জীবনের এতোগুলো সময় একটা সংসারে ব্যয় করার পর তোর মনে হয় সেই সংসার ছেড়ে সে আমাদের সাথে আসতে রাজি হবে?”
“কিন্তু আমরা তো একবার ট্রাই করতে পারি চাচা। হয়তো ফুফু এবার সত্যিই ঐ সংসার থেকে মুক্তি পেতে চাচ্ছে।”

ইতোমধ্যেই নাজিয়া খানের কল এলো মিশালের নাম্বারে। তড়াক দৃষ্টিতে মিজানুর রহমানের দিকে তাকাতেই তিনি বললেন কলটি তুলতে। তৎক্ষণাৎ মিশাল কলটি তুলল। ব্যাকুল স্বরে বলল,
“আমরা আসছি ফুফু৷ এইতো রওনা হয়ে গেছি।”
“আসতে হবেনা তোদের! ঝামেলা মিটে গেছে।”
“মানে? এই মাত্রই তো বললে ফুফা তোমার গাঁয়ে হাত তুলতে চাইছিল।”
“বলেছিলাম বাট এখন সব সলভ হয়ে গেছে।”

“তোমার আশেপাশে কী কেউ আছে ফুফু? কারো ভয়ে তুমি আমাদের আসতে বারণ করছ?”
তখনি নাজিয়া খানের কান থেকে ফোনটি কেড়ে নিলেন তমাল খান! হাজার জোরাজুরি করেও নাজিয়া খান ফোনটি তার আয়ত্তে রাখতে পারলেননা। ফোনটি কানে নিয়ে ব্যগ্র হাসলেন তমাল খান। কটু গলায় মিশালকে বললেন,
“কী রে পুলিশের দা’লা”ল? ইদানিং দেখছি প্রচুর উড়ছিস! ঘরে বাইরে সবখানেই দালালি করছিস! দালালি করতে হলে পুলিশের হয়ে কর। আমার ছেলের জীবন নিয়ে কেন দালালি করছিস? এমনিতেও তোর হায়াত ফুরিয়ে আসছে! জানিসই তো, চামচেদের কপালে শনি ছাড়া আর কিছুই থাকেনা।”

মিশালের মাথায় রক্ত ওঠে গেলেও মিশাল যথেষ্ট স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করল। মুখ বুজে সব অপমান সহ্য করে নিলো। গলা ভিজিয়ে ধীরস্থির গলায় সে জবাবে বলল,
“ভদ্রভাবে কথা বলুন ফুফা। আপনার কথার ধরণ শুনে মনে হচ্ছে আমি আপনার চিরশত্রু কেউ। বা আমি আপনার বিরাট কোনো ক্ষতি করে ফেলেছি। আপনার ছেলের জীবন নিয়ে ঐযে বললেন “দালালি” এসব করার কোনো ইন্টারেস্ট নেই আমার! আর কিছু কিছু শব্দ মডিফাই করে বলার চেষ্টা করুন। যেমন দালাল শব্দটা আমার কাজের সাথে একদমই যায়না। আপনি আমাকে পুলিশের সোর্স বলতে পারেন। তাছাড়া আমিতো আপনাদের গুনার মধ্যেও ধরিনা। তাই মুখ সামলে কথা বলুন।”

“বাহ্। খুব বড়ো বড়ো কথা বলতে শিখে গেছিস দেখছি। আমার ছেলের জীবন নিয়ে তোর যদি দালালি করার কোনো ইন্টারেস্টই না থাকে তবে সামান্তার জীবন থেকে তুই সরে দাড়া! আর আমি দালালকে দালালই বলব! সঠিক জায়গায় সঠিক শব্দের প্রয়োগ করতে আমি জানি।”
ফোনটা স্পিকারে থাকার দরুন উপস্থিত সবাই তমাল খানের কথা স্পষ্টভাবে শুনছিলেন। আর রাগে টগবগ করছিলেন। সামান্তার প্রসঙ্গ ওঠে আসতেই সামান্তা জোর করে মিশালের কাছ থেকে ফোনটি কেড়ে নিলো। চোয়াল উঁচিয়ে সে রুক্ষ গলায় বলল,

“সামান্তার জীবন থেকে মিশাল নয় বরং সাহিল সরে দাঁড়াবে! কথাটা ভালো করে মাথায় ঢুকিয়ে নিন তমাল খান! সরি টু সে আমি আপনাকে ফুফা ডাকতে পারছিনা। আপনাকে ফুফা ডাকলে ফুফা ডাকটারই অসম্মান হবে!”
সামান্তার কথা শুনে হু হা করে হেসে উঠলেন তমাল খান। খুবই বিদঘুটে এই হাসির ঝংকার। কথাগুলো তার কাছে মজার মনে হলো। গলায় কঠোরতা এনে তিনি বললেন,

“আমিতো ভেবেছিলাম তুমি ফুফুর মতো আলাভোলা হবে। বাট না, এখন তো দেখছি তুমি মাস্টার পিছ! তাহলে এবার সোজা পয়েন্টে আসি? ভুলে যেওনা তোমার ফুফু এখন আমাদের কাছে বন্দি। যদি ফুফুর ভালো চাও তো আমার ছেলের কথা মেনে নাও! পুলিশের দালালটাকে ছেড়ে আমার ছেলেকে গ্রহণ করে নাও। তাহলে অন্তত জীবনে ঠকবেনা তুমি। আমার এই আলিশান বাড়িটা কিন্তু আমার ছেলের নামেই লিখা!”

“এক সেকেন্ড এক সেকেন্ড আপনি কী আমাকে লোভ দেখাচ্ছেন? এসব ছাইপাশের লোভ করিনা আমি। তাছাড়া ফুফুকে নিয়ে এই মুহূর্তে ভাবছিনা আমি! কলটা রাখুন আপনি।”
তুখোড় রাগের বশবর্তী হয়ে সামান্তা কলটি কেটে দিলো! মিশাল তেড়ে গিয়ে তার চাচার মুখোমুখি দাড়ালো। সশব্দে বলল,
“এবারও তুমি চুপ করে থাকবে চাচা? তাদের বিরুদ্ধে কী কোনো স্টেপই নিবেনা?”
“তুই বুঝছিসনা কেন মিশাল? আমরা কোনো স্টেপ নিতে গেলে ওখানে নাজিয়ার অশান্তি হবে! তাদের কিছু করতে হলে নাজিয়াকে প্রথমে ঐ বাড়ি থেকে বের করে আনতে হবে!”

ইতোমধ্যেই হয়রান হয়ে যাওয়ার মতো একটি ঘটনা ঘটল। উপস্থিত সবাইকে অবাকের শীর্ষে পৌছে দিয়ে সাহিলের আগমন ঘটল ঘটনাস্থলে! নিস্তব্ধ, নির্বিকার সবাই। মাথা নুইয়ে সে উপস্থিত সবার সামনে দাড়ালো! এই মুহূর্তে কার কী রিয়েক্ট করা উচিত কেউ তা বুঝে ওঠতে পারছিলনা। তবে সামান্তার চোখে বিস্তর ক্ষোভ! সামান্তার দিকে মাথা তুলে তাকালো সাহিল। বেশ নমনীয়, জনাজীর্ণ ও কোমল গলায় বলল,
“আ’ম সো সরি সামান্তা। প্লিজ ফরগিভ মি! রাগের মাথায় বুঝতে পারিনি কী করে ফেলেছি আমি। তুই তো জানিস আমার রাগ কতোটা খারাপ। নিজের প্রতি কন্ট্রোল থাকেনা তখন।”

সাহিলের ভালোমানুষি ও অবিশ্বাস্য কার্যকলাপে মোটেও গললনা সামান্তা। উল্টো সাহিলের নাটকীয়তা দেখে তার গাঁ জ্বলে উঠল। চড়ের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য সে উদ্ধত হয়ে ওঠল! তেড়ে গিয়ে সাহিলের শার্টের কলার চেপে ধরল। রোষভরা গলায় বলল,

“কী ভেবেছ? তোমার ছলছাতুরি ধরতে পারবনা আমি? এতোটাই বোকা আমি? আমি জানি তুমি অভিনয় করছ। এই দেহে প্রাণ থাকতে আমি তোমাকে বিশ্বাস করতে পারবনা।”
সুযোগ পেয়ে সাহিলের গালে চড় বসাতে গেল সামান্তা! গোটা বিষয়টায় বেশ মজা নিচ্ছিল মিশাল। অপেক্ষা করছিল কখন সামান্তা মেরে ফাটিয়ে দিবে সাহিলকে। কিন্তু মিশালের সেই আশায় জল ঢেলে দিয়ে পাশ থেকে মিজানুর রহমান ছুটে এসে সামান্তাকে থামিয়ে দিলেন! সামান্তাকে টেনে এনে তিনি কিছুটা দূরে ছিটকে ফেললেন। সামান্তাকে শাসিয়ে বললেন,
“কী হচ্ছে কী এসব? আমার সামনে তুই আমার বোনের ছেলের গাঁয়ে হাত তুলছিস? এক্ষণি তুই আমার বাড়ি থেকে বের হয়ে যা! এই মিশাল? সামান্তাকে নিয়ে তুই এক্ষুণি এই বাড়ি থেকে বের হ তো!”

মিশালকে ইশারায় কিছু বুঝিয়ে দিলেন মিজানুর রহমান! সেই সূত্র ধরে বাধ্য ছেলের ন্যায় মিশালও উগ্র সামান্তাকে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। হুট করে সাহিল তার মামার হাত দুটো চেপে ধরল! বিমর্ষ, অনুতপ্ত ও অসহায় গলায় বলল,
“আ’ম সো সরি মামা। তখন আমি রাগের মাথায় সামান্তার গাঁয়ে হাত তুলে ফেলেছিলাম। প্লিজ সরি। পুরো বিষয়টাই আমার বিবেচনার বাহিরে ছিল। একচুয়েলি জোর করে কিছু হয়না তা আমার বোঝা হয়ে গেছে। আমি আর কখনও সামান্তাকে বিরক্ত করবনা মামা! সামান্তা তার লাইফে কাকে জড়াবে কি জড়াবেনা এটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। প্লিজ তুমি সামান্তাকে বলো আমাকে ক্ষমা করে দিতে। প্লিজ!”

“আচ্ছা ঠিক আছে। আমি মানছি তোর কথা! তুই এখন এখানে শান্ত হয়ে বস তো। তোকে স্বাভাবিক মনে হচ্ছেনা।”
সাহিলের ছলনা ধরতে বেশী সময় অপচয় করতে হয়নি মিজানুর রহমানকে! তবে তিনি ঠাণ্ডা মাথায় সাহিলকে হ্যান্ডেল করতে চাইলেন। সবাই যদি একসাথে গরম হয়ে যায় তবে পরিস্থিতি সামলানো কঠিন হয়ে পরবে। সাহিলকে কিছু করতে হলে ছলাকলা করে প্রথমে নাজিয়া খানকে এই বাড়িতে আনতে হবে। এরপর বাপ-ছেলেকে দেখা যাবে! হুট করেই তো আর তাদের বিরুদ্ধে মামলা মোকদ্দমা করা যাবেনা। হতে পারে ভোক্তভোগীও পরে পল্টি খেয়ে গেল! এই অভিজ্ঞতা তো নতুন নয় তার। তখন তো আমও যাবে ছালও যাবে।

বাড়ি থেকে বের হয়ে রাস্তায় ওঠে গেল মিশাল ও সামান্তা। বাড়ির পথে পা বাড়াতে গিয়েও থেমে গেল মিশাল। মুখ বন্ধ নেই সামান্তার। বকর বকর করেই চলছে! এই নিয়ে একই প্রশ্ন সে পাঁচবার করল। তেজী গলায় পুনরায় শুধালো,
“বাবা কেন আমাদের বাড়ি থেকে বের করে দিলো বলো? কী শলা পরামর্শ করলে তোমরা?”
পিছু ফিরে তাকালো মিশাল। গাঁ ছাড়া ভাব তার। মনে হলো ভীষণ নিশ্চিন্ত মনের মানুষ সে। মনে কোনো অস্থিরতা বা দুঃখ নেই। শার্টের কলারটা পেছনের দিকে এলিয়ে ভাবশূণ্য গলায় মিশাল বলল,

“চা খাবি?”
“আশ্চর্য তো। মনে হচ্ছে তুমি খুব চিল মুডে আছো?”
“চা অফার করেছি জাস্ট। আমার সাথে ডেটে যেতে বলিনি!”
“এই থামবে তুমি? তোমার সাথে ডেটে যাওয়ার কোনো ইচ্ছেই নেই আমার! আমিতো এখন সাহিলকে মারতে যাব! শরীর হিট হয়ে আছে আমার।”

প্রবল জিদ্দি ও একরোঁখা হয়ে সামান্তা বাড়ির দিকে মোড় নিতেই মিশাল পেছন থেকে সামান্তার কোমর চেপে ধরল! ছাড়া পাওয়ার জন্য সামান্তা হাত-পা ছুড়তে লাগল। ছটফটে গলায় বলল,
“মিশাল ভাই ছাড়ো বলছি। সাহিলকে আজ আমি দেখে নিব।”

“শান্ত হ বলছি। বেশি বাড়াবাড়ি করতে গেলে উল্টো সাহিল তোকে দেখে নিবে! যা হচ্ছে এখন হতে দে।”
“তার মানে তুমি বলতে চাইছ সাহিলকে আমি ছেড়ে দিব? আমার গাঁয়ে রা’স্কে’লটা হাত তুলল এতে তোমার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই? গাঁয়ে কোনো জ্বালা পোঁড়া নেই?”

বুকে যে শ্রাবণ তার পর্ব ১৮

“ইশ রে। একটু আগেই তো আমাকে অস্বীকার করলি! এখন আবার আমার থেকেই এটেনশন পাওয়ার চেষ্টা করছিস? নারী, তুমি শুধু ছলনাময়ী নও সুবিধাবাদীও বটে!” –

বুকে যে শ্রাবণ তার পর্ব ২০