বুকে যে শ্রাবণ তার পর্ব ১৮

বুকে যে শ্রাবণ তার পর্ব ১৮
নিশাত জাহান নিশি

সম্পূর্ণ কথা শেষ করে দমটুকু নেওয়ারও সময় পেলোনা সামান্তা। ঠাস করে শক্ত হাতের চড় পরল তার গালে! হতভম্ব হয়ে গেল সামান্তা। গালে হাত দিয়ে সে বিস্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে রইল ক্ষিপ্র সাহিলের পানে। জল্লাদ কিংবা নর পিশাচের চেয়ে কোনো অংশে কম মনে হচ্ছেনা তাকে। চোখেমুখে স্বৈরাচারী ভাব প্রতীয়মান। ভেজা আঁখিপল্লব সামান্তার৷ বেশ তাফালিং করে সাহিল তার গাড়িতে জোরে এক লা’থ মারল। মৃদু চিৎকার করে বলল,

“দুজন দুজনকে যেহেতু এতোই ভালোবাসিস তবে সেদিন সবার সামনে সস্তা নাটকটা করেছিলিস কেন? কী বুঝাতে চাইছিলিস তোরা? নিজেদের সৎ প্রমাণ করতে চাইছিলিস? বাট আমি তোদের দুজনকেই দেখে নিব। কাউকে কিন্তু ছাড় দিবনা আমি। জোরে করে হলেও আমি তোকে নিজের করে ছাড়ব! পারলে তোর বেকার প্রেমিককে বলিস আমাকে আটকাতে। দেখব তার কতো হিম্মত!”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

অবশেষে হঠকারিতা কাটিয়ে উঠল সামান্তা। চড়ের আঘাতে ক্রমশ তার আঁখিপল্লব থেকে টপটপ করে জল গড়িয়ে পরছিল। তবুও দমলনা সে। শরীরের শক্তি ব্যয় করল। নম্রতা, ভদ্রতা জলাঞ্জলি দিলো। রুখে এসে গাঁয়ের জোরে সাহিলকে পর পর তিন চারটে ধাক্কা দিয়ে বসল! গাড়ির সাথে একদম ফিট করে দিলো তাকে। হঠাৎ এতো শক্তি তার শরীরে কোথা থেকে উদয় হলো তা নিয়ে ভাববার একরত্তি সময় নেই তার! তবে রাগের মুহূর্তে মানুষকে খু*ন করে ফেলাও যে অসাধ্য কিছু নয় তা নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ রইলনা সামান্তার। গালে টনটনে ব্যথা হচ্ছে তার। দৃষ্টি ক্ষীণ। সেই ব্যথার প্রাদুর্ভাবে তার গলা ধরে এলো। যতটুকু সম্ভব গলায় দম এনে বলল,

“এতো বড়ো সাহস তোমার? তুমি আমার গাঁয়ে হাত তুলো? কোন সাহসে কোন, অধিকারে তুমি আমার গাঁয়ে হাত তুললে বলো? স্টু’পিট, নন’সেন্স, রা’স্কে’ল কোথাকার!”
ঘটনার আকস্মিকতায় হকচকিয়ে উঠল সাহিল। সামান্তার অকল্পনীয় পদক্ষেপে সে বোকা বনে গেল! ডান পায়ে কিঞ্চিৎ চোটও পেল। এখানে আর একটা মুহূর্ত দাড়িয়ে থাকলে যে তার গালে একের পর এক চড় থাপ্পড় পরবেনা তার কোনো নিশ্চয়তা নেই! নিজের অবশিষ্ট মান-সম্মানটুকু বাঁচাতে সাহিল হুড়োহুড়ি করে গাড়িতে ওঠে গেল! গাড়ি স্টার্ট করে জানালার গ্লাস দ্বারা অগ্নিঝরা দৃষ্টিতে রুদ্রাক্ষী সামান্তার দিকে তাকালো। বিক্ষুব্ধ গলায় সামান্তাকে হুমকি দিয়ে বলল,

“আমার গাঁয়ে হাত তুলে তোর বিপদ আরও বাড়িয়ে দিলি সামান্তা! তুই কল্পনাও করতে পারছিস না আমি তোর সাথে কী কী করতে পারি!”
গাড়ি নিয়ে বিদায় হলো সাহিল। নিজস্ব আবেগকে ধরে রাখতে পারলনা সামান্তা। সাহিলের ঠুনকো হুমকি ধমকিতে যদিও তার মধ্যে তেমন ভয়ের কোনো সূত্রপাত ঘটেনি তবে চড়টা সে হজম করতে পারছেনা। মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। ভীষণ পালপিটিশান হচ্ছে। না চাইতেও হুঁ হুঁ করে কেঁদে দিলো সামান্তা! দৌড়ে বাড়ির ভেতর ঢুকে গেল। ড্রইংরুমে আলাপচারীতায় ব্যস্ত থাকা শাহনাজ বেগম, জেনিয়া ও রুমকিকে উপেক্ষা করে সে সোজা তার রুমে ঢুকে গেল। দরোজা বন্ধ করে চুপিসারে কাঁদতে লাগল!

সামান্তার কার্যকলাপ দেখে উপস্থিত সবাই ঘাবড়ে গেল। তিনজনই চিন্তিত হয়ে সামান্তার পিছু নিলো। পেরেশান হয়ে রুমকি দরোজায় টোকা মারল। উঁচু গলায় শুধালো,
“এই সামান্তা আপু? দরোজা খোলো। কী হয়েছে তোমার?”

নিশ্চুপ সামান্তা। নিঃশব্দে কেবল কেঁদেই চলছে। শাহনাজ বেগমও বিচলিত হয়ে ডাকতে লাগলেন সামান্তাকে। কারো ডাকে কোনো সাড়া দিচ্ছেনা সামান্তা। ব্যক্তিগত কিছু সময় প্রয়োজন তার। সেই সময়টুকু সে একান্তে, নিরিবিলি কাটাতে চায়। তীব্র অপমানবোধ কাজ করছে তার মধ্যে। তাদের সামনে দাড়াতেও কেমন যেনো লজ্জা করছে! সামান্তার মৌন প্রতিক্রিয়া দেখে দুঃশ্চিন্তা আরও বাড়তে লাগল সবার মধ্যে। উদ্বিগ্ন হয়ে শাহনাজ বেগম এবার রুমকিকে বললেন,

“সাহিল কিছু বললনা তো সামান্তাকে? তুই এক কাজ কর তো সাহিলকে কল দে। জিজ্ঞেস কর কী হয়েছে তাদের মধ্যে।”
তড়িঘড়ি করে রুম থেকে ফোন এনে রুমকি ডায়াল করতে লাগল সাহিলের নাম্বারে৷ প্রথম কলটি সাহিলের নাম্বারে ঢুকলেও দ্বিতীয় কলটির পর থেকে ফোনটি বার বার বন্ধ আসছিল! মাথায় হাত চলে গেল শাহনাজ বেগমের। উদগ্রীব গলায় তিনি বললেন,

“কী এক জ্বালার মধ্যে ফেঁসে গেলাম রে? সামান্তার বাবা-মা যদি জানতে পারে তাদের আদরের মেয়ে আমার বাড়িতে থাকতে এসে এভাবে দরোজা বন্ধ করে কান্নাকাটি করছে কী হবে ব্যাপারটা বল তো? সব দোষ তো তখন আমাদের ঘাড়ে এসে পরবে! ভাববে আমরাই তাদের মেয়েকে কিছু বলেছি বা করেছি।”
বিরক্ত হলো রুমকি। তার মাকে থামিয়ে বলল,

“চুপ করো তো মা। তুমি সবসময় নেগেটিভ ভাবো। চাচা, চাচী এমন নয় যে তারা কিছু না জেনে না বুঝে আমাদের সম্পর্কে খারাপ কিছু ভাববে। আমার মনে হয় মিশাল ভাইকে একবার কল করা উচিত।”
“হ্যাঁ হ্যাঁ ভালো কথা মনে করেছিস। মিশালকে কল কর তো। একমাত্র মিশালই পারবে সামান্তাকে মানাতে!”
ব্যস্ত হয়ে রুমকি বাড়ির এক কোণায় চলে গেল মিশালকে কল করতে। জেনিয়া তার খালামনির কথা শুনে থমকালো! ব্যথীত হয়ে তার খালামনির মুখোমুখি দাড়ালো। শুকনো ও নিথর গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,

“তুমি কী বললে খালামনি? মিশাল ভাই-ই পারবে সামান্তার আপুকে মানাতে? কী মিন করতে চাইলে তুমি বুঝলাম না?”
“বাদ দে তো। তুই এসব বুঝবিনা। তোর তো কাল থেকে এক্সাম শুরু। যা পড়তে বস।”

জোর করে জেনিয়াকে পড়তে পাঠিয়ে দিলেন শাহনাজ বেগম। রুমকির পড়ার টেবিলে তার বই পত্র গোছানো ছিল। জেনিয়া পড়তে বসেছে ঠিকই, তবে তার মনে শান্তি নেই। মিশাল যে কবে তার ভালো লাগা থেকে ভালোবাসায় পরিণত হয়েছে সে নিজেও তা টের পায়নি!

খুবই গোপনে এসেছে এই প্রেম। চুপিসারে তার মনকে দোলা দিয়ে গেছে। ভার্সিটির অধিকাংশ সুদর্শন যুবক আছে যারা তার জন্য পাগল প্রায় তবে সে নিজেই পাগল মিশালের প্রেমে! কবে যে সে তার মনের কথা মিশালকে খুলে বলতে পারবে। মিশাল কী আদো তার অসীম ভালোবাসাকে মূল্যায়ন করবে? না-কি মিশালের মনে চলছে অন্যকিছু? মিশালের ব্যবহারে আজ ভীষণ আঘাত পেয়েছে জেনিয়া। সেই থেকেই তার মনে উল্টো পাল্টা ভাবনাচিন্তারা ভীড় করছে।

মিশালকে দেখে স্বস্তি পেল রুমকি। আশ্বস্ত হলো। বন্ধুদের আড্ডা মহল থেকে একপ্রকার ছুটে এসেছে মিশাল। রুমকির কল পাওয়া মাত্রই আর এক মুহূর্তও দেরি করেনি সে। সাহিলের সাথে সামান্তার টক ঝক হয়েছে সেই ব্যাপারে শতভাগ নিশ্চিত মিশাল। বড্ড অস্থির ও ব্যাকুল দেখাচ্ছে তাকে। চোখেমুখে শঙ্কা। হম্বিতম্বি হয়ে সে দরোজার সামনে দাড়ালো। শাহনাজ বেগম উত্তেজিত গলায় মিশালকে বললেন,

“দেখ তো কী হয়েছে সামান্তার। দরজাই খুলছেনা মেয়েটা।”
দরোজা খটখটিয়ে মিশাল উচ্চশব্দে সামান্তাকে ডাকল। শক্তপোক্ত অধীর গলায় বলল,
“দরজা খোল সামান্তা। এসব ছেলেমানুষী করার কারণ কী? তোর থেকে কিন্তু এসব অবিবেচকতা এক্সপেক্ট করিনা আমি।”
ইতোমধ্যেই সামান্তা এসে দরজা খুলে দিলো! চোখ মুখ ফুলে ফেঁপে তার টইটম্বুর। অতিরিক্ত কান্নার প্রভাব। নাক টানতে টানতে নাকটাও বড়ো লাল হয়ে গেছে তার। এই অবস্থায় তাকে যতোটা না দুঃখী দেখাচ্ছে তার চেয়েও অধিক ক্ষিপ্ত দেখাচ্ছে! খিটখিটে মেজাজ নিয়ে সে মিশালকে বলল,

“তুমি শুধু রুমে আসবে আর কেউ নয়!”
এই বলে মিশালকে টেনে রুমে ঢুকিয়ে নিলো সামান্তা। রুমের দরোজায় ভেতর থেকে খিল মেরে নিষ্ক্রিয় মিশালের মুখোমুখি দাড়ালো। বাইরে বেকুব বনে দাড়িয়ে রইল রুমকি এবং শাহনাজ বেগম। তারা যে এতক্ষণ ধরে এত কষ্ট করল তার বেলায় কী হবে? তাদেরও তো জানতে হবে কী হয়েছে। এভাবে কৌতূহল নিয়ে থাকা যায় না-কি?

মিশালের সূক্ষ্ম দৃষ্টি সামান্তার দিকে সীমাবদ্ধ। বাঁ গালে চড়ের দাগ স্পষ্ট। মেজাজ চওড়া মিশালের। চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। ঘাড়ের রগ টান টান হয়ে এলো। এই কাজ সাহিলের বুঝতে বেশি বেগ পেতে হলোনা তার! সাহিলের এবার একটা বিহিত করতে হবে৷ যথেষ্ট শাসনের অভাবে দিন দিন উচ্ছন্নে যাচ্ছে সে। সাহস বেড়ে যাচ্ছে তার। কারো গাঁয়ে হাত তুলতেও কুণ্ঠা বোধ করছেনা। সামান্তার গাঁয়ে হাত তুলে মিশালকে আরও একদফা রাগিয়ে দিলো সাহিল। দু’হাতের উল্টো পিঠ দ্বারা চোখের জল মুছল সামান্তা। মাথা নুইয়ে করুন স্বরে মিশালকে বলল,

“সাহিল ভাই আমার গাঁয়ে হাত তুলেছে।”
“তুই কিছু বলিসনি?”
“তিন-চারটা ধাক্কা মেরেছি! এর বেশি কিছু করতে পারিনি। কজ এর আগেই ইডিয়টটা গাড়িতে ওঠে গেছে।”
“ইশ! ভয় পেয়েছে তোকে!”
“তোমার কী এই বিষয়টা খুব ফানি মনে হচ্ছে?”
“না। সিরিয়াস মনে হচ্ছে।”
“সিরিয়াস মনে হলে ইশ ইশ করছ কেন?”

“চড়ের বদলে ধাক্কা মেরেছিস তাই ভেতর থেকে সুখধ্বনি বের হয়ে এলো! আমিতো ভেবেছিলাম তুই হয়ত চড় খেয়ে অবলা নারীদের মতো ঘরের কোণায় বসে বসে কাঁদছিলিস!”
“তবুও আমার জেদ শান্ত হয়নি। আমি তাকে আরও হিট করতে চাই!”
“ওকে। আমি তার দু’হাতে, দু’পায়ে ধরব। আর তুই তাকে ইচ্ছেমত হিট করবি। রাজি?”

“হ্যা রাজি! এখনি চলো।”
“স্টুপিট কোথাকার!”
“কী আজব! বকলে কেন?”
সামান্তার দিকে তুখোড় দৃষ্টি মিশালের। দাঁতে দাঁত চেপে রূঢ় গলায় বলল,
“যখন সুযোগ ছিল তখন হিট করিসনি এখন এসব বলে কী লাভ?”
“কেন? সুযোগ আর নেই?”

“না নেই। এখন তুই আগ বাড়িয়ে তাকে হিট করতে গেলে সবাই তোর বিপরীতে চলে যাবে। তার বিরুদ্ধে এখন শুধু নালিশ দেওয়া যাবে। এর বেশী কিছু করা যাবেনা।”
“নালিশ জানালেও বাবা কোনোদিনও তার বিচার করবেনা! ফুফুর সংসারের কথা ভেবে চুপ হয়ে যাবে।”
“তবে এর একটা বিহিত করতেই হবে। তোকে কিছু করতে হবেনা যা করার আমি করব।”
“কী করবে তুমি?”

“সময় হলে টের পাবি। তাকে যা করার কৌশলে করতে হবে। প্রকাশ্যে কিছু করতে গেলেই ফুফা ও ফুফার গোটা পরিবার ফুফুর উপর, চাচার উপর, আমাদের সবার উপর ক্ষেপে যাবে। ফুফু তো আর ঐ সংসার ছেড়ে আসার পাত্রী নন। একটা মানুষকে আর কতোবার বুঝানো যায়?”

কথায় ডুবে গিয়ে মিশাল মনের অজান্তেই সামান্তার আঘাত পাওয়া চড়ের জায়গাটিতে আলতো হাত বুলিয়ে দিলো! অনেকক্ষণ যাবত এই ইচ্ছেটিকে চেপে রেখেছিল সে। তবে তার এই অতৃপ্ত বাসনা আপনাআপনি পূরণ হয়ে যাবে তা ঘুনাক্ষরেও ভাবেনি সে! মাঝে মাঝেই বেখেয়ালে আমাদের সাথে এমন কিছু ঘটে যায় যার জন্য আমরা মোটেও দায়ী নই৷
মিশালের হাতের উষ্ণ ছোঁয়াতে ঈষৎ কেঁপে উঠল সামান্তা। সর্বাঙ্গ তার শিউরে উঠল।

বুকের ভেতরটা পরম আবেশে ছেঁয়ে গেল। দেহে ও মনে প্রশান্তি মিলল। হৃদপিণ্ড দুরুদুরু করতে লাগল। মিশালের এই একটু ছোঁয়া তার বড্ড প্রয়োজন ছিল। ব্যথা উপশমের মতো কাজ করছিল। মাঝে মাঝে হৃদয় বেসামাল হওয়া জরুরি। মিশ্র এক ধরনের অনুভূতি হতে লাগল তার ভেতর। বুঝে ওঠতে পারছিলনা মিশালকে এই মুহূর্তে তার আটকানো উচিত কি-না! যদিও মিশাল এর আগেই টের পেয়ে গিয়েছিল তার উদাসীন, বেখেয়ালি ও বেপরোয়া কাজকর্মের বিষয়টা!

বুকে যে শ্রাবণ তার পর্ব ১৭

ইতোমধ্যেই মিশালের সেলফোনটি বেজে ওঠল। ধ্যান এবার ভাঙল মিশালের। স্কীনের দিকে তাকিয়ে দেখল তার ফুফুর নাম্বার থেকে কল এসেছে! সামান্তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মিশাল তড়িঘড়ি করে কলটি তুলল। নম্র কণ্ঠে ফুফুকে সালাম জানালো। সালামের উত্তর নিয়ে মিশালের ফুফু নাজিয়া খান ফুপিয়ে কেঁদে বললেন,
“আমাকে এই জাহান্নাম থেকে নিয়ে যা বাপ। তাদের বাপ-ছেলের টর্চার আমি আর সহ্য করতে পারছিনা!”

বুকে যে শ্রাবণ তার পর্ব ১৯