বুকে যে শ্রাবণ তার পর্ব ৪৪

বুকে যে শ্রাবণ তার পর্ব ৪৪
নিশাত জাহান নিশি

“দ্রুত গাড়ি চালান। যে করেই হোক সামনের রিকশাটিকে আমাদের ফলো করতে হবে।”
রিকশাওয়ালা দ্রুত গতিতে গাড়ি ছেড়ে দিলেন। তবে শর্ত রাখলেন মূল ভাড়া থেকে তাকে ভাড়া বাড়িয়ে দিতে হবে! নাকোচ করলনা সামান্তা। নির্দ্বিধায় ভাড়া বাড়িয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলো।

স্বার্থের ওপর যেখানে দুনিয়া চলছে সেখানে একজন গরীব রিকশাওয়ালার শর্ত মানতেই বা অসুবিধা কীসে? ভেতরে ভেতরে ছটফট করতে লাগল সামান্তা। আদো শেষ অবধি রুমকি অবধি পৌছাতে পারবে তো সে? যদি কোনোভাবে তার উদ্দেশ্য পথে বাঁধা পরে যায়? কোনোভাবে যদি রুমকিকে হারিয়ে ফেলে?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মোটামুটি দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে পাশের গলির একটি পুরাতন বিল্ডিংয়ের সামনে এসে রুমকির রিকশাটি থামল! এদিক ওদিক অস্থির দৃষ্টি ফেলে রুমকি তরতরিয়ে হেঁটে সোজা বিল্ডিংটির ভেতরে ঢুকে গেল। ভীতসন্ত্রস্ত রুমকি।আতঙ্কিত দেখাচ্ছিল তাকে। যেনো তার গন্তব্যে পৌঁছে যেতে পারলেই সে বাঁচে।
ইতোমধ্যে সামান্তার রিকশাটিও এসে বিল্ডিংটির আশেপাশে থামল। রিকশাওয়ালাকে চকচকে একটি একশ টাকার নোট ধরিয়ে দিলো সামান্তা। মূলত ভাড়া সত্তর টাকার বেশি নয়। তবুও যেনো নারাজ রিকশাওয়ালা! চলতি পথে সামান্তাকে থামিয়ে দিলেন তিনি। অভিযোগের স্বরে বললেন,

“মাত্র একশ টাকা আফা? আফনার তো ভাড়া বাড়াইয়া দেওনের কথা ছিল।”
“মূল ভাড়া থেকে আমি আপনাকে ত্রিশ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছি মামা। এছাড়া আমার কাছে আর কোনো টাকা নেই। প্লিজ আমাকে আর থামাবেন না।”

চুপ হয়ে গেলেন রিকশাওয়ালা। সামান্তাকে আর পিছু ডাকলেননা তিনি। তাৎক্ষণিক রিকশা ঘুরিয়ে চলে গেলেন। সামান্তা চুপিসারে বিল্ডিংটির ভেতর প্রবেশ করল। ভাগ্যিস প্রথম তালার গেইটটি খোলা ছিল। বিল্ডিংটি হয়তো ভাড়ায় দেওয়া। নিচ তালার সদর দরজার সামনে কয়েক জোড়া জুতো দেখা যাচ্ছে। পা টিপে দোতলার সিঁড়ির দিকে পা বাড়াতেই সামান্তা খেয়াল করল রুমকির একটি কানের ঝুমকা পরে আছে সিঁড়িতে!

তাড়াহুড়োয় হয়তো পরে গেছে কান থেকে। দু’তলার ফ্ল্যাটের দরজার দিকে এগিয়ে যেতেই সামান্তা অপ্রত্যাশিত ভাবে রুমকির কানের আরও একটি ঝুমকা খুঁজে পেল! টনক নড়ল সামান্তার। ঘটনাগুলো মোটেও তার কাছে কাকতালীয় মনে হলোনা। মনে হলো এসব রুমকির ইশারা।

দুরুদুরু বুকে সামান্তা ফ্ল্যাটের সদর দরজাটিতে কান রাখতেই রুমকির কান্নাকাটির আওয়াজ শুনতে পেল! ভীত হয়ে ওঠল সামান্তা। চিৎকার করে ফ্ল্যাটের দরজায় সজোরে ধাক্কা মারার পূর্বেই তার মনে হলো এই মুহূর্তে একা তার পক্ষে কিছুই করা সম্ভব নয়। এতে উল্টো জারিফ সতর্ক হয়ে যাবে। রুমকির পাশাপাশি সামান্তাও বিপদে পরে যাবে। উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে তার।

ধীর পায়ে হেঁটে সামান্তা বিল্ডিং থেকে বের হয়ে গেল। বিল্ডিংটির ভেতরের ভাড়াটিয়া কিংবা বাইরের কেউ যে তাকে সাহায্য করবেনা তা তার নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে জানা। পুরো বিল্ডিংটি যখন জারিফের দখলে তখন সবাই জারিফের পক্ষেই কথা বলবে। আর এটাই স্বাভাবিক।

বুদ্ধি খাটিয়ে সামান্তা লাবিবের মেসেঞ্জারে কল করল! লাবিবকে বলল টুটুল চৌধুরী ব্যতিত থানার অন্য কোনো পুলিশ অফিসারকে নিয়ে তার দেওয়া ঠিকানা অনুযায়ী চলে আসতে। সামান্তার সাহায্য চাওয়াকে লাবিব গুরুত্বের সাথে নিলো। সামান্তাকে প্রতিশ্রুতি দিলো শীঘ্রই সে পুলিশ নিয়ে আসছে। আশ্বস্ত হলো সামান্তা। ফোনের ভয়েস রেকর্ডার অন করে সে ফোনটি তার বুক পকেটে রাখল!

অতঃপর বুকে সাহস নিয়ে সে বিল্ডিংটির ভেতরে পুনরায় প্রবেশ করল। সোজা হেঁটে দু’তলায় ওঠে গেল। নির্ভীকভাবে দরজায় কড়া নাড়ল। চিৎকার করে বলল,
“এই জারিফ? দরজা খোল?”

রুমকির সাথে জোর জবরদস্তি করতে ব্যস্ত ছিল জারিফ! শ্লীলতাহানির চেষ্টা করছিল রুমকির। মুখের মধ্যে ওড়না বাঁধা অবস্থায় রুমকি নিজের সম্মান বাঁচানোর জন্য কাকুতিমিনতি করছিল। সামান্তার গলার আওয়াজ পেয়ে জারিফ ভড়কে ওঠল। যদিও সামান্তাকে সে চিনেনা তবে এতটুকু ঠিকই বুঝতে পারল রুমকি তার সাথে ডাবল গেইম খেলেছে! একা আসবে বলে তাকে কথা দিয়ে সাথে কাউকে নিয়ে এসেছে। ক্ষিপ্ত হয়ে রুমকির গলা চেপে ধরল জারিফ! চোখ রাঙিয়ে রুমকিকে বলল,

“কাকে নিয়ে এসেছিস সাথে করে? তোর কোন মা-বোনকে নিয়ে এসেছিস?”
এই বলে রুমকিকে দেয়ালের সাথে জোরে একটি ধাক্কা মারল জারিফ। সঙ্গে সঙ্গেই রুমকির মাথা ফেঁটে রক্ত গড়াতে লাগল! অবচেতন হয়ে গেল রুমকি। ব্যথা তার সহ্য ক্ষমতার বাইরে চলে গেল। দিন দুনিয়া তার ঝাপসা হয়ে এলো। রুমকিকে রুমে ফেলে রেখে জারিফ সদর দরোজায় গেল।

দ্বিধায় পরে গেল দরজা খুলবে কী খুলবেনা। পালানোর রাস্তাও খুঁজে পাচ্ছিলনা সে। অতিরিক্ত নেশা করার প্রভাবে মাথা কাজ করছিলনা তার। নিজেকে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য ও বদ্ধ পাগল মনে হচ্ছে তার। একই দিনে দু’টো ক্রাইম করে বসেছে সে! তবে কী আজই তার পাপের পতন ঘটবে?

শঙ্কিত হয়ে ওঠে সামান্তা অনবরত দরজা ধাক্কাতে লাগল। প্রয়োজনে দু-একটা লাথও মারল। বাট ভেতর থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া এলোনা। ঘাবড়ে ওঠল সামান্তা। পুনরায় সে দম লাগিয়ে হাঁকডাক ছেড়ে বলল,
“এই জারিফের বাচ্চা দরজা খোল। আমি যদি দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকি তবে আজই কিন্তু তোর শেষ দিন হবে।”

কথাগুলো বলে সামান্তা দম নিতে পারলনা। এর পূর্বেই জারিফ দরজা খুলে অজ্ঞান হওয়ার স্প্রে মেরে দিলো সামান্তার চোখেমুখে! সঙ্গে সঙ্গেই মাথা ঘুরে এলো সামান্তার। টেনেহিঁচড়ে সামান্তাকে জারিফ রুমের মধ্যে ঢুকিয়ে নিলো। মেঝেতে ফেলে রাখল তাকে। সামান্তার চারিপাশে গোল গোল হয়ে ঘুরতে লাগল জারিফ। পৈশাচিক হেসে ওঠল সে। ঢুলুঢুলু শরীর নিয়ে বলল,

“বেডি মানুষ হয়ে বেশ তেজ দেখাচ্ছিলিস তাইনা? এবার দেখা তেজ। চ্যাচা, হুমকি দে, মারতে আয় আমায়। সবাইকে একে একে শেষ করব আমি। যে আমার পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়াবে তাদের প্রত্যেককে আমি এভাবেই শেষ করে দিব। যেভাবে তাদের দুই ভাইবোনকে শেষ করেছি!”

সামান্তার অবচেতন দেহটিকে ডিঙিয়ে জারিফ হেলেদুলে তার ফ্ল্যাটে থাকা ছোটোখাটো বারটিতে গেল। ঠোঁটের কোণে তার তৃপ্তির হাসি। সেখানে আবার রাফিনের অবচেতন দেহটিকে ডিঙিয়ে একটি বিয়ারের বোতল হাতে নিলো জারিফ! রুমকিকে ফ্ল্যাটে ডাকার আগে জারিফ রক্তাক্ত করেছে রাফিনকে! কারণ, রাফিন চেয়েছিল রুমকিকে ফ্ল্যাটে না ডাকতে কিংবা রুমকির কোনো ক্ষতি না করতে। সেই সময় দুজনের মধ্যে তর্কাতর্কি লেগে রাফিনকে আ’হ’ত করেছে জারিফ! এখনও জ্ঞান ফেরার সাথে কোনো নাম নেই রাফিনের। মাথায় বেশ চোট পেয়েছে সে।

ঘণ্টা খানিক এভাবে কেটে যাওয়ার পর অবশেষে পুলিশ ঘটনাস্থলে এলো। পুলিশের সাথে একজন মহিলা কনস্টেবলও এলো। তাদের সাথে লাবিবও ছিল। সামান্তার ঠিকানা অনুযায়ী দোতলার ফ্ল্যাটের দরজায় ধাক্কা মারতে লাগল পুলিশ। অতিরিক্ত নেশা জাতীয় দ্রব্য সেবনের ফলে জারিফ নিজেও অবচেতন হয়ে পরে আছে ফ্ল্যাটের এক কোণে! ফ্ল্যাটের ভেতর থেকে কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে পুলিশ বাধ্য হলেন দরজা ভাঙতে! ফ্ল্যাটের ভেতরে ঢুকতেই প্রথমে তারা সামান্তার অবচেতন দেহটি খুঁজে পেল। ঘাবড়ে ওঠল লাবিব। সামান্তার পাশে বসে সে সামান্তাকে ঝাকাতে লাগল। উদ্বিগ্ন গলায় বলল,

“আপু? শুনছেন? চোখ খুলুন। পুলিশ এসে গেছে।”
সামান্তার কোনো প্রতিক্রিয়া না পেয়ে লাবিব পানির সন্ধানে ফ্ল্যাটের কিচেন রুমের দিকে এগিয়ে যেতেই দেখতে পেল পাশে থাকা ছোটোখাটো বারটির সামনে পুলিশ রাফিনের অবচেতন দেহ খুঁজে পেয়েছে! গ্লাস ভর্তি পানি এনে লাবিব প্রথমে সামান্তার চোখেমুখে পানি ছিটালো। এভাবে দু’তিন মিনিট পানি ছিটানোর পর সামান্তার জ্ঞান ফিরল। অস্ফুটে চোখ মেলে সে দৃষ্টির সম্মুখে প্রথমেই লাবিবকে দেখতে পেল। পেরেশান হয়ে লাবিব বলল,

“আপু আপনি ঠিক আছেন?’
হকচকিয়ে ওঠল সামান্তা। হুড়োহুড়ি করে শোয়া থেকে ওঠে গেল। ফ্ল্যাটের এদিক ওদিক বিচলিত দৃষ্টি ফেলল। শুকনো গলায় বলল,
“রুমকি কোথায়?”

লাবিবকে প্রত্যুত্তর করার সুযোগ না দিয়েই সামান্তা হন্ন হয়ে বসা থেকে ওঠে গেল। দুজন কনস্টেবল এতক্ষণে রুমকির অবচেতন দেহটিও খুঁজে পেল। মহিলা কনস্টেবল রুমকিকে ধরে হসপিটালের উদ্দেশ্যে ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে গেল। অন্যদিকে রাফিনকে নিয়েও দুজন পুরুষ কনস্টেবল হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল। দুজনের অবস্থাই সাংঘাতিক। কান্না বিজড়িত সামান্তা।

এই মুহূর্তে রুমকির পিছু পিছু ছুটলে চলবেনা তার। জারিফকে দোষী সাবস্ত করে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া বাকী তার। মিশালকে জেল থেকে বের করার এই সুবর্ণ সুযোগ কিছুতেই হাতছাড়া করতে চায়না সামান্তা। বুক পকেট থেকে সামান্তা তার সেল ফোনটি বের করল। তখনও ফোনটিতে রেকর্ডিং সিস্টেম চালু ছিল! সামান্তা তার ফোনটি মাঝবয়সী পুলিশ অফিসারের দিকে এগিয়ে দিলো। উত্তেজিত গলায় বলল,

“স্যার এই ফোনে সব রেকর্ড করা আছে। কে বা কারা এখানে একজন অন্যজনকে আহত করেছে সবকিছুর জবানবন্দি আছে।”

পুলিশ অফিসার তখন বেহুশ হয়ে পরে থাকা জারিফের আশেপাশে ঘুরছিলেন। ভ্রু উঁচিয়ে তিনি সামান্তার হাত থেকে ফোনটি নিলেন। রেকর্ডার অন করে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সব শুনলেন। গম্ভীর গলায় প্রশ্ন ছুড়লেন,
“সব বুঝলাম। কিন্তু আপনি এখানে কী করছিলেন? আর ওরাই বা কারা? ডিটেইলসে বলুন?”
“ডিটেলসে জানতে হলে আগে আমাদের ওই মাতালটার জ্ঞান ফেরাতে হবে স্যার। তাহলে আমরা তার থেকে সব ডিটেলসে জানতে পারব।”

চোখেমুখে কয়েকবার পানি ছিটাতেই জ্ঞান ফিরল জারিফের। চোখ খুলে সে ঘাবড়ে ওঠল! পুলিশ দেখে পালানোর চেষ্টা করল। তবে তার সব চেষ্টা বৃথা গেল। পুলিশ তাকে ধরে বেঁধে একের পর এক চ’ড়, থাপ্পর দিতে লাগল। তবুও নত স্বীকার করলনা জারিফ। পিটুনি খেতে খেতে ক্ষিপ্ত গলায় বলল,

বুকে যে শ্রাবণ তার পর্ব ৪৩

“আমি কিন্তু আপনাকে চিনে রাখলাম স্যার। আমার ভাইকে বলে আপনাকে কীভাবে চাকরী থেকে বরখাস্ত করা যায় তার ব্যবস্থা আমি করব!”

বুকে যে শ্রাবণ তার শেষ পর্ব