বুকে যে শ্রাবণ তার পর্ব ৪২

বুকে যে শ্রাবণ তার পর্ব ৪২
নিশাত জাহান নিশি

“মিশাল ভাইয়ার জন্য তুমি এতোটুকু করতে পারবেনা বাবা? স্বার্থপরের মতো কথাগুলো বলতে পারলে তুমি? বিপদ ও অসহায়ত্ব কী মানুষকে আপন পর ও ভুলিয়ে দেয়?”
সিদ্ধান্তহীনতায় জর্জরিত মিজানুর রহমান। ঠিক এই মুহূর্তে সামান্তার এহেন জ্ঞানমূলক ও বিদ্বেষমূলক কথা অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি মনে হলো তাঁর! তৎক্ষণাৎ চটে গেলেন তিনি। সামান্তার ভরাট দু-চোখে চোখ রাখলেন। ক্ষীণ গলায় বললেন,

“বিষয়টা আপন পরের নয়। বিষয়টা হলো টাকা পয়সার, বিষয়টা হলো লেনদেনের। আপাতত ক্যাশ এতোগুলো টাকা নেই আমার কাছে। সারা জীবনের যতো সঞ্চয় ছিল আমার সব আমি বাড়ি তৈরির কাজে লাগিয়ে দিয়েছি। তোর তো কোনো ভাইও নেই যে আমার বাইরেও আমাদের আলাদা কোনো ইনকাম সোর্স থাকবে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

কোনোভাবে আমাদের ফ্যামেলিতে যোগান দিতে পারবে। এছাড়াও তোদের তিন বোনের ভবিষ্যত রয়েছে। এমন তো নয় যে মিশালকে এখন আমি টাকাগুলো ধার হিসেবে দিলাম একটা সময় পর সে টাকাগুলো ফেরত দিয়ে দিবে! বেকার ছেলে। কোনো সম্ভাবনাই নেই তার। সো জেনেবুঝে আমি এত বড়ো রিস্ক নিই কীভাবে?”

নিস্তব্ধ, নির্বিকার সামান্তা। এই মুহূর্তে তার বাবাকে তার স্বার্থপর মনে হচ্ছে! আপন হয়েও পর পর মনে হচ্ছে। তার মাথায় এখন শুধু কাজ করছে মিশালকে কীভাবে মুক্ত করা যায়। দুনিয়ার সবার সব যুক্তিতর্ক তার কাছে অযৌক্তিক মনে হচ্ছে। মিশালের সাথে এক আত্মিক সম্পর্ক বোধ করছে।

যে সম্পর্কের কাছে তার রক্তের সম্পর্কও ফিকে মনে হচ্ছে! সামান্তা তার ভেতরের অনুভূতি কোনো ভাবেই কাউকে ব্যক্ত করতে পারছেনা। এই মুহূর্তে যদি কেউ তাকে বলে মিশালকে বাঁচাতে হলে তাকে তার নিজের জীবন উৎসর্গ করতে হবে তবে সে বিনাবাক্যে হাসতে হাসতে তার জীবন উৎসর্গ করে দিতে পারবে! আক্রোশভরা দৃষ্টিতে সামান্তা তার বাবার দিকে তাকালো। অবলীলায় চোখের কোণ বেয়ে পরতে থাকা অশ্রুকণাগুলোকে দু-হাত দ্বারা মুছে নিলো। তীক্ষ্ণ গলায় বলল,

“এর শেষ আমি দেখে নিব বাবা। মিশাল ভাইয়াকে কীভাবে জেল থেকে বের করতে হয় তা আমি দেখিয়ে দিব! তুমি যেমন অন্যের বিপদে নিজের স্বার্থের কথা ভাবছ, তেমনি আমিও কিন্তু তোমার মেয়ে বাবা! আমিও আমার স্বার্থ ষোলো আনা বুঝে নিব! তিন মেয়ের ভবিষ্যত নিয়ে খুব টেনশন তোমার তাইনা? সম্পত্তির ভাগ বাটোয়ারা বসাও তুমি! আমি আমার অংশের ভাগ বুঝে নিব! প্রয়োজনে আমি তোমাদের বিপক্ষে যাব।”

মিজানুর রহমানকে সম্পূর্ণ হতবাক করে দিয়ে সামান্তা জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো। ক্ষেত্রবিশেষে সামান্তার এহেন উগ্রতার সঙ্গে পূর্ব পরিচিত মিজানুর রহমান। তবে এবার মাত্রাতিরিক্ত মনে হলো। ভেজায় দুঃশ্চিন্তায় পরে গেলেন তিনি। বড্ড একরোঁখা ও জিদ্দি মেয়ে যে সামান্তা। কোনোকিছু করার কথা একবার ভাবলে সে তা যেকোনো মূল্যেই হোক করে ছাড়বেই। দুনিয়া এদিক থেকে ওদিক হয়ে গেলেও তার বাহাল সে রাখবেই। তবে কী সামান্তা এখন মিশালের জন্য তার ভবিষ্যত নষ্ট করবে? বাবা ও মেয়ের মধ্যকার সুন্দর সম্পর্ক নষ্ট করবে?

রিমান্ডের ভেতর থেকে আ’হ’ত মিশালকে কয়েকজন কনস্টেবল মিলে টেনে এনে সেলে স্থানান্তর করল। সাহিলের মুখোমুখি সেলটিতে তাকে রাখা হলো। কাজ শেষে কনস্টেবলগণ তাদের জায়গা ছাড়ল। অবস্থা করুণ মিশালের। শরীরের বিভিন্ন অংশ কেটেছিঁড়ে টপটপ করে রক্ত গড়িয়ে পরছে। ঘামের ন্যায় তার রক্তের প্রবাহ হচ্ছে। জ্ঞান আছে কি-না তাও সন্দেহ।

নিথর দেহ প্রায়। ধুঁকে ধুঁকে কেশে ওঠছে সে। কাশির শব্দ ব্যতীত শরীরের রক্তিম ও ক্ষতবিক্ষত অবস্থার জন্য তার ভেতর থেকে কোনো তীব্র আর্তনাদের শব্দই শোনা যাচ্ছেনা। সামনের সেল থেকে সাহিল ভেজা চোখে সব পর্যবেক্ষণ করছিল। নিষ্ক্রিয় সে। মিশালের বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে বুকটা কেঁপে ওঠল তার। দুঃখ সংযত করতে না পেরে চাপা কান্নায় বলে ওঠল,

“মিশাল তাকা এদিকে। তুই ঠিক আছিস তো? এই মিশাল?”
নিরুত্তর মিশাল। দেয়ালের সাথে ঘেঁষে বসে রইল সে। চোখ দুটিতে অন্ধকার তার। ঝাপসা চোখে দুনিয়া দেখার চেয়ে চোখ দুটি বুজে রাখাই শ্রেয়! ঘাঁড়টা ডানদিকে হেলে পরল তার।

গাঁয়ে থাকা সাদা শার্টটি রক্তে ও ঘামে ভিজে একাকার হয়ে গেল। পানির বড্ড তেষ্টা পেল তার। তবে মুখ খুলে বলতে পারছিলনা তার জলতেষ্টার কথা। কান দুটোতে কেমন যেনো ভোঁ ভোঁ শব্দ হতে লাগল। ইতোমধ্যেই সামান্তা কায়দা করে সকল পুলিশ ও কনস্টেবলদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে দৌড়ে এলো সেলের দিকে। সামান্তাকে এক পলক দেখামাত্রই সাহিল চ্যাচিয়ে ওঠল। উৎসুক গলায় বলল,

“সামান্তা আমরা এদিকে।”
সাহিলের গলার আওয়াজ পেয়ে সামান্তা ঝট করে পিছু ঘুরে তাকালো। জলে সিক্ত দু’চোখে সে বিষণ্ন সাহিলের পানে তাকালো। স্বস্তির শ্বাস ফেলল সে। ভারী কণ্ঠে শুধাল,
“মিশাল ভাইয়া কোথায়?”

আঙুল তাক করে সাহিল তার সামনের সেলটি দেখালো। হন্ন হয়ে সামান্তা সেইদিকে ছুটে এলো। মিশালের সেলের মুখোমুখি দাড়িয়ে সে থমকে দাড়ালো। চোখ দুটিতে তার ঘন কালো বিষাদ নেমে এলো। অন্তর কেঁদে ওঠল। বুকের পাঁজরে নিগূড় ব্যথার অনুভব হলো। হৃদয় নিংড়ে ওঠল। সেলের লোহার দুটি শিকে হাত রেখে সে মিশালকে খুব ডাকল। কণ্ঠে জোশ এনে আকুতিভরা গলায় বলল,

“এই মিশাল? শুনছ তুমি আমার কথা?”
মিশালের অবস্থা বেগতিক ভয়াবহতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে সে নিঃশক্তি, নিথর ও অকেজো হয়ে ওঠছে। এই মুহুর্তেই তার কার্যকরী চিকিৎসার প্রয়োজন৷ দিশাহীন সামান্তা। দিক বিদিক হারিয়ে নিরুপায়। ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠল সে। পুনরায় বলল,

“এই মিশাল? প্লিজ তুমি চোখ খোলো৷ আমার দিকে তাকাও। আমি জানি তুমি স্ট্রং। ভেতর থেকে স্ট্রং তুমি। জালিমদের কোনো নৃশংস অত্যাচারও এই শক্তিশালী মিশালকে দুর্বল করতে পারেনা। তাকে এক ইঞ্চিও টলাতে পারেনা। স্বয়ং উপর ওয়ালা ব্যতীত এই দুর্বার মিশালকে কেউ পরাহত করতে পারেনা। এরচেয়েও কতো গভীর আঘাত তুমি নীরবে সয়েছো। কতো শতো ক্ষত তোমার শরীরে মজেছে। রক্তের সাথে ঘাঁ মিশে গেছে। এই সামান্য আঘাতও তুমি কাটিয়ে ওঠতে পারবে মিশাল। প্লিজ ওঠো তুমি। আমাকে একটু শান্তি দাও।”

সামান্তার এই তীব্র আহাজারি মিশালের কান অবধি পৌছোতে বেশ অনেকখানি সময় লেগে গেল। ক্রমশ মিশাল তার বোধশক্তি ফিরে পেতে লাগল। হাত-পা নাড়াতে শুরু করল। ছোটো ছোটো আওয়াজে খুক খুক করে কাশি দিতে লাগল। ভেতরটা তার দুমড়ে মুচড়ে আসছিল। সামান্তা মেঝেতে বসে বিলাপ শুরু করল! সাহিল নিশ্চল দৃষ্টিতে সামান্তার প্রবল আহাজারি দেখতে লাগল।

মিশালের প্রতি কতোটা ভয়ঙ্কর ভালোবাসার প্রতিচ্ছবি সামান্তা! যদি তাই না হতো তবে কী ভালোবাসার মানুষটির জন্য কেউ এভাবে বুক ভাসিয়ে কাঁদতে পারে? কান্না যে খুব কঠিন কাজ।কেউ কারো জন্য অবলীলায় এভাবে কেঁদে ভাসাতে পারেনা। হাসির অভিনয় করা গেলেও কান্নার অভিনয় এতোটা নিঁখুতভাবে করা যায়না। মিশালের বাবা-মা বেঁচে থাকলে হয়তো ঠিক এভাবেই মিশালের জন্য কাঁদত! বিধাতা কখনও কারো জায়গা শূণ্য রাখেননা। কাউকে না কাউকে সেই জায়গা ভরাট করতে নিশ্চয়ই পাঠিয়ে দেন। সামান্তার কান্নার মাত্রা ক্রমশ বেড়ে যেতেই সাহিল গলা ঝাকালো। নরম গলায় বলল,

“প্লিজ থাম এবার। মিশাল ঠিক আছে। কতো মানুষের দোয়া আছে তার ওপর বল তো? এতো মানুষের দোয়া কী বিফলে যাবে?”
“মানুষটাতো রেসপন্সই করছেনা সাহিল ভাই। এই যাত্রায় কী তার আর বেঁচে ফেরা হবেনা? দুনিয়ার সব দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা, আপদ-বিপদ, শত্রুতা কী এই মানুষটার কপালেই লিখা আছে? কেন উপর ওয়ালা তার সাথে এমন করে বলো তো? আমি যে আর সইতে পারিনা তার এই যন্ত্রণা। তার বুকের শ্রাবণ আমি বইতে পারিনা!”

ইতোমধ্যেই মিশাল কাশতে কাশতে সামান্তার কথার জবাব দিলো! জনাজীর্ণ শরীর নিয়ে সে বসা থেকে ওঠে দাড়ানোর বৃথা চেষ্টা করল। ধপ করে পুনরায় মেঝেতে ছিটকে পরে আ’হ’ত কণ্ঠে বলল,
“এই যাত্রায় আমার আর বাঁচা হবেনা রে। মন বলছে আমার শান্তি এসে গেছে। বাবা মায়ের সাথে একসাথে থাকার শান্তি! যেখানে জাগতিক কোনো কষ্ট থাকবেনা। তবে মন মানছেনা রে। রুমকির জন্য ভেতরটা বড্ড পোঁড়াচ্ছে।

রক্তের টান বুঝি এমনই হয়? তবে তোর জন্য বিরাট খুশি হচ্ছে। এই যে আমি আছি বলে তুই এতো কষ্ট পাচ্ছিস আমাকে নিয়ে সবসময় দুঃশ্চিতার মধ্যে থাকছিস। সেই দুঃশ্চিন্তা কেটে যাবে তোর! তবে একটাই অনুরোধ, চাচাকে বলিস মাকে আর বোনকে দেখে রাখতে। তাদের ওপর থেকে যে মিশাল নামক ছায়াটি সরে যাবে!”

দম বের হয়ে যাওয়ার মতো একটি নিঃশ্বাস ফেলে মিশাল দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসল। আপনা আপনি তার চোখ জোড়া বুজে এলো। মুহূর্তেই সামান্তা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠল! বসা থেকে ওঠে দাড়িয়ে গেল। শক্ত গলায় বলল,
“প্রলাপ বকতে হবেনা তোমার। আমাকে ছেড়ে যাবার দোহাই দেখিয়ে খুব খুশি উদযাপন করবে ভাবছ তাইনা? সেই খুশি তোমার জীবনে স্থায়ী হবেনা। সামান্তা যে করেই হোক তোমাকে এই নরক থেকে বের করেই ছাড়বে। সামান্তা হার মানবার পাত্রী নয়।”

চোখ জোড়া বুজে রেখেই মিশাল হেয়ো হাসল! বিদ্রুপের স্বরে বলল,
“পারবিনা। তোকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলাম!”
“শুনেছি টাকার কাছে নাকি পাথরের মূর্তিও হা করে? টাকার কাছে সব হার মেনে যায়।”
“আমার মরহুম আব্বা বা আমাকে কোনদিক থেকে তোর কোটিপতি মনে হয়?”

“যা করার আমি করব, তোমাকে কোটিপতি হতে হবে কে বলল? তুমি শুধু ধৈর্য ধরে কয়েকটা দিন অপেক্ষা করো। টাকার ব্যবস্থা আমি করব। একটু এদিকে আসবা প্লিজ? তোমাকে একটু ছুঁয়ে দেখব!”
“কেন? ঐসময় ফিরিয়ে দেওয়ায় খুব আফসোস হচ্ছে? আমি তোর আফসোস হয়েই থাকতে চাই! যদি সম্ভব হয় তো সাহিল ভাইকে ছাড়ানোর চেষ্টা কর। কথা বাড়াসনা আর। আমার কথা বলতে খুব কষ্ট হচ্ছে!”

মিশালকে ছুঁয়ে দেখার অতৃপ্ত ইচ্ছে নিয়ে সামান্তা কাঁদতে কাঁদতে স্থান ত্যাগ করল। তাছাড়া এখানে বেশিক্ষণ থাকাটাও তার জন্য বিপদজনক হয়ে পরবে। ধরা পরে গেলে মিশালের জন্য তা ঝুঁকি হয়ে যাবে। যাওয়ার আগে সামান্তা কড়া গলায় মিশালকে বলে গেল,

“শোনো? আমাকে ছেড়ে তুমি পরকালে গিয়েও শান্তি পাবেনা। হাশরের ময়দানেও আমি তোমার পাশে, তোমার ছায়া হয়ে দাড়িয়ে থাকব! আমার ভালোবাসা থেকে তোমার মুক্তি নেই।”
সামান্তার অস্তিত্ব পুরোপুরি বিলীন হয়ে যেতেই মিশাল কয়েকদফা রুদ্ধশ্বাস ফেলল। শুকনো কেশে সাহিলকে বলল,

“সাহিল ভাই। এখান থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর তুমি সামান্তাকে একটু বুঝিও আমার পেছনে অযথা না ছুটতে। অহেতুক সময় নষ্ট না করতে। আমার জীবনের সত্যিই আর কোনো নিশ্চয়তা নেই। তার এসব পাগলামি দেখলে আমার মুক্তি নেশা, বেঁচে থাকার নেশা বাড়তে থাকবে।

কিন্তু আমিতো জানি আমার হাতে বেশি সময় নেই। আর একটা কথা, তোমার কাছে হয়তো ক্ষমা চাওয়ার কোনো মুখ নেই আমার। শুধুমাত্র আমার কারণেই আজ তুমিও ফেঁসে গেলে। পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও। ফুফা হয়তো তোমাকে ছাড়ানোর ব্যবস্থাও করে ফেলেছে। জেনিয়াকে নিয়ে সুখী হও তুমি। আমার মা আর বোনকেও একটু দেখে রেখো।”

চোখ ভিজে এলো সাহিলের। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
“দোষটা মূলত তোর নয়। তোর সাথে যে আমিও ফেঁসে যাবো এটা হওয়ারই ছিল আর তাই হয়েছে। তবে আমি এখান থেকে ছাড়া পাওয়ার পর আমার সর্বাত্নক চেষ্টা করব তোকে ছাড়ানোর।বি পজেটিভ ওকে?”
বিনিময়ে মিশাল শুধু হেয়ো হাসল। মেঝেতে গুটিশুটি মেরে শুয়ে পরল। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এলো তার। পানির তেষ্টাতেই বুঝি তার মরতে হবে?

টুটুল চৌধুরীর অফিস-রুম থেকে বের হওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালেন তরুন চৌধুরী। ক্রুর হেসে তিনি শুধু এতোটুকুই বললেন,

“তাকে আজীবন সাজা দিয়ে মারতে মারতে মেরে ফেললেও আমার কোনো আফসোস নেই। তবে আমার ছেলের গাঁয়ে যেনো একটা ফুলের টোকাও না পরে! এক সপ্তাহ পর আমি তাকে এখান থেকে নিয়ে যাব। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে। ঐ গুন্ডাটার জন্য আজ আমাকে এতোগুলো টাকা জরিমানা দিতে হলো, সেই টাকার ডেমারেজ তার রক্ত দিয়ে পরিশোধ করতে হবে!”

ব্যগ্র হেসে টুটুল চৌধুরী সায় জানালেন তমাল চৌধুরীকে! বললেন মিজানুর রহমান ও সামান্তাকে ভেতরে পাঠিয়ে দিতে। অফিস-রুম থেকে বের হলেন টুটুল চৌধুরী। রাগী গলায় তিনি মিজানুর রহমান ও সামান্তাকে বললেন ভেতরে যেতে। হনহনিয়ে তিনি জায়গা থেকে প্রস্থান নিলেন! সামান্তা ও মিজানুর রহমান ভেতরে প্রবেশ করলেন। চেয়ার টেনে দুজন টুটুল চৌধুরীর মুখোমুখি বসল। আক্রোশিত ভাব নিয়ে সামান্তা মাথা নুইয়ে বসে রইল। টুটুল চৌধুরীকে এক্ষণি তার গলা টিপে মেরে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে। সামান্তার এহেন আক্রমনাত্নক হাবভাব দেখে টুটুল চৌধুরী বিদঘুটে হাসলেন! হাতে থাকা কলমটি ঘুরাতে ঘুরাতে তিনি বিদ্বেষী সামান্তাকে বললেন,

“মিশাল কী শুধুই আপনার চাচাতো ভাই নাকি আশিক টাইপ কিছু হয়? কী সম্পর্ক আপনাদের মধ্যে? না মানে মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি মনে হচ্ছে!”
তাৎক্ষণিক চটে গেল সামান্তা। টেবিলের ওপর সজোরে হাত রাখল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলল টুটুল চৌধুরীর দিকে। বলল,

“আমি আপনাকে বলছি লিমিটের মধ্যে থাকুন। কার সাথে কার কীসের সম্পর্ক এসব জানার প্রয়োজন নেই আপনার। আমরা এখানে এসেছি কেইস সম্পর্কে আলোচনা করতে, একটা মিমাংসায় যেতে। নির্দোষ মানুষকে ফাঁসিয়ে কীভাবে টাকার ধান্দা করা যায় ব্যক্তিগত শত্রুতা কীভাবে দমানো যায় সেই সম্পর্কে আলোচনা করতে!”

মিজানুর রহমান অনেক রাগ দামা দিয়েও সামান্তাকে আটকে রাখতে পারছেননা। সামান্তার খোঁচানো কথা ও ক্ষিপ্রতা দেখে চটে গেলেন টুটুল চৌধুরী! চোয়াল উঁচিয়ে তিনি সামান্তাকে বললেন,
“আগামী তিনদিনের মধ্যেই মিশালকে কোর্টে তোলা হবে! এরপর তার যাবত জীবন জেল! কিছু করার হলে এই তিনদিনের মধ্যেই করে দেখা। দেখব কথার তেজের সাথে কাজের কতোটা মিল!”

“আপনার ডিমান্ড বলুন?”
“কীসের ডিমান্ড?”
“হাসি পেল! অফিস বলে মুখ খুলতে চাচ্ছেননা তাইনা? ওকে কোনো ব্যাপার না। আপনার পার্সোনাল নাম্বারে যোগাযোগ করব! যদি আপোষে কাজ না হয় তবে আপনাকে ফাঁসিয়ে হলেও আমি আমার কথার তেজের সাথে কাজের মিল রাখব!”

টুটুল চৌধুরীকে দ্বিগুণ রাগিয়ে দিয়ে সামান্তা অফিস রুম থেকে প্রস্থান নিলো। অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে টুটুল চৌধুরীকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন মিজানুর রহমান। সামান্তা একা একাই বাড়ি ফিরে এলো। এসে দেখল রুমকি বিছানায় পরে গেছে। তাকে স্যালাইন দেওয়া হয়েছে! তার পাশেই বাড়ির সবাই বসে। শাহনাজ বেগমের চোখে জল। উদ্বিগ্ন হয়ে সামান্তা রুমকির পাশে বসল। চোখে জল নিয়ে রুমকি সামান্তার চোখে চোখ রাখল। বলল,

“ভাইয়া ঠিক আছে তো আপু?”
“হুম ঠিক আছে! তোকে টেনশন না করতে বলল। মিশাল ভাইয়া খুব শীঘ্রই আমাদের মধ্যে ফিরে আসবে।”
“কিন্তু আমার মন বলছে ভাইয়া ভালো নেই! তুমি কী একবার ভাইয়ার সাথে আমাকে দেখা করিয়ে দিতে পারবে আপু?”

“পারব। কেন পারবনা? তবে এর আগে তোকে সুস্থ হতে হবে।”
তখনি সামান্তাকে সেখান থেকে টেনে নিয়ে গেলেন শাহনাজ বেগম! সবার আড়ালে নিয়ে গেলেন। চোখে তাঁর বেদনার ঘনঘটা। গভীর অনুতাপের ঝড়! উত্তেজিত গলায় তিনি প্রশ্ন ছুড়লেন,

“সত্যিই মিশাল ভালো আছে তো?”
“কেন? তুমি আবার কবে থেকে মিশাল ভাইয়াকে নিয়ে এতো ভাবতে শুরু করলে?”
“বল না সে কেমন আছে এখন?”
“রিমান্ডে নিয়ে যাওয়া ব্যক্তিটি কেমন থাকতে পারে বলে তোমার মনে হয়?”
“খুব মেরেছে তাকে?”
“কেন? খুশি হওনি তুমি?”

বুকে যে শ্রাবণ তার পর্ব ৪১

“ভাবছি আমাদের বাড়িটা বিক্রি করে দিব! শহরের মধ্যেই তো আমাদের বাড়ি। দশ লাখ প্লাস তো বিক্রি করা যাবেই! মিজানকে বলবি আমাদের কিছু টাকা ধার দিতে? মিশাল ফিরলে সব ধার শোধ করে দিবে।”

বুকে যে শ্রাবণ তার পর্ব ৪৩