বুকে যে শ্রাবণ তার পর্ব ৪১

বুকে যে শ্রাবণ তার পর্ব ৪১
নিশাত জাহান নিশি

“সর্বনাশ হয়ে গেছে জেসমিন। সাহিল ও মিশালকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে! দুজনের নামেই নাকি অ’স্ত্র পা’চা’র ও খু’নে’র অভিযোগ রয়েছে!”

উপস্থিত সবাই স্তম্ভিত হয়ে গেল। ঝট করে বসা থেকে ওঠে দাড়ালো। হন্ন হয়ে সবাই একে একে ছুটে গেল মিজানুর রহমানের দিকে। কেবল সামান্তাই তার জায়গায় ঠাঁয় দাড়িয়ে রইল। দুনিয়াটা বুঝি তার ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবের ন্যায় চক্রাকারে ঘুরতে লাগল। চোখেমুখে ঘোর অন্ধকার দেখতে লাগল।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সন্দেহ তার সত্যিতে রূপান্তরিত হলো! মনের অশান্তি মহা বিপদের রূপ নিলো। কাল থেকে এই বিপদের আশঙ্কাই করছিল সে। ভেতরের গোঙানো থেকে তার চোখ থেকে আপনাআপনি জল গড়াতে লাগল! দিশা খুঁজে না পেয়ে সে ধপ করে সোফায় বসে পরল।
রুমকির অবস্থাও করুন। কাঁপা কাঁপা শরীর নিয়ে সে তার চাচাকে একনাগাড়ে ঝাঁকাতে লাগল। মৃদু চিৎকার করে বলল,

“এসব আপনি কী বলছেন চাচা? মিশাল ভাই এখন থানায়? কী করেছে আমার ভাই? কী অপরাধ তাঁর?”
ঘাবড়ে রইলেন মিজানুর রহমান। উদগ্রীব গলায় বললেন,
“আমি কিছু জানিনা রে। তবে কেউ হয়তো তাকে ফাঁসিয়ে দিয়েছে! তার সাথে আবার সাহিলও জড়িয়ে গেছে। তরুন তো তাই বলল। আমাকে এক্ষণি একবার থানায় যেতে হবে। কী থেকে কী হয়ে গেল এসব।”

তড়িঘড়ি করে তিনি বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলেন। তুমুল অস্থিরতা কাজ করছে তাঁর মধ্যে। তরুন চৌধুরীও থানায় তাঁর জন্য অপেক্ষা করছেন। মাথায় হাত পরে গেছে তাঁর। মিশাল ও সাহিলের সাথে কিছুতেই দেখা করতে দেওয়া হচ্ছেনা তাঁকে! উৎকণ্ঠিত হয়ে ওঠছেন তিনি। মিশাল ও সাহিলকে জেরা করার জন্য রিমান্ডে নিয়ে যাওয়া হয়েছে! থানার পরিবেশ এখন গরম। সাহিলের গাড়ি থেকে একটি ক্ষত বিক্ষত লাশ উদ্ধার করা হয়েছে! শুধু তাই নয়, বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্যও উদ্ধার করা হয়েছে! টুটুল চৌধুরী এই ঘটনার তদন্তে রয়েছেন! কাউকে ঘেঁষতে দিচ্ছেননা তিনি তার আশেপাশে।

খবরটি পাওয়ার পর থেকে নাজিয়া চৌধুরী থেকে শুরু করে মিশাল ও সামান্তার পরিবারে নেমে এলো বিস্তর শোকের ঝড়। নাজিয়া চৌধুরী তো বারবার জ্ঞান হারাচ্ছেন। সামান্তা যেনো তার সত্তা হারিয়েছে! মুর্তির ন্যায় এক জায়গায় স্থির হয়ে পরে আছে। বাড়ির সবার মধ্যে কান্নাকাটি বিরাজ করছে। নীরব দর্শক হয়ে সামান্তা তা বসে বসে দেখছে। রুমকিকে সামলাতে পারছেনা জেনিয়া!

বিরতিহীনভাবে সে কেবল কেঁদেই চলছে। শাহনাজ বেগম কান্নাকাটি না করলেও প্রবল আশঙ্কায় রয়েছেন। হুট করেই যেনো সবকিছু ঘটে গেল। মুহূর্তেই সব উলোট পালোট হয়ে গেল। মিশালের এতো বড়ো ক্ষতি চাননি তিনি। শুধু চেয়েছিলেন মিশালের ঘাড়ের ওপর থেকে তার নিজের ছেলে মেয়েদের জন্য পুঁজি করতে! কান্না মুখে সাইফা সামান্তার পাশে এসে বসল। সামান্তাকে কয়েকটি ঝাঁকুনি দিলো। ভরাট গলায় শুধালো,

“কী হয়েছে আপু? তুমি এভাবে পাথরের মতো বসে আছো কেন? কিছু বলছনা কেন?”
নির্বিকার গলায় সামান্তা বলল,
“কী বলব?”
“কিছুই বলার নেই তোমার?”

“না নেই। আমি জানি আমার মিশাল কখনও অন্যায় কিছু করতে পারেনা। ভালো মানুষদের সাথে আল্লাহ্ কখনও অন্যায় করেননা, অকারণে তাদের সাজা দেননা। খুব শীঘ্রই সে বেকসুর খালাস হয়ে আসবে। এখানে এতো ভেঙে পরার কিছু নেই।”
“সাহিল ভাইয়ার গাড়ি থেকে একটি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে আপু। তোমার কাছে ব্যাপারটা ইজি মনে হচ্ছে? এতো সহজে সব মিটে যাবে?”

“পুলিশ তো তদন্ত করবে তাইনা? তদন্তে যখন দেখবে এই কাজের সাথে তাদের দুজনের কোনো ইনভলভমেন্ট নেই তখন তারা দুজনকে এমনিতেই ছেড়ে দিবে। অযথা এতো ভাবিসনা তো। সাহস রাখ। মনোবল শক্ত কর।”
এই বলে বসা থেকে ওঠে দাড়ালো সামান্তা। সাইফাকে যতোটুকু সম্ভব জ্ঞান দিলো। ধীর পায়ে হেঁটে তার রুমে গেল। রুমের দরোজা বন্ধ করে মুখ চেপে ধরে ভেতরের সব যন্ত্রণাকে বের করার জন্য মৃদু চিৎকারে কেঁদে ওঠল! ফুঁপিয়ে ওঠে অস্ফুটে গলায় বলল,

“আমি নিজেকে শক্ত রাখতে পারছিনা মিশাল! আমার মনটা এখনও কুহ্ গাইছে। মনে হচ্ছে তোমার সাথে আরও খারাপ কিছু ঘটতে চলছে। কী করে রক্ষা করব আমি তোমায়? আমার যে খুব অশান্তি লাগছে। মনকে মানাতে পারছিনা আমি। আল্লাহ্ যেনো একটু রহম করেন। তোমাকে যেনো রক্ষা করেন। তবে তোমাকে বাঁচানোর জন্য আমি সব করতে পারব মিশাল ভাই, সব!”

ডুকরে কাঁদছে সামান্তা। কিছুতেই যেনো তার কান্না থামাতে পারছেনা। মেঝেতে লুটোপুটি খেয়ে কাঁদছে সে। কান্না থামার এক পর্যায়ে সামান্তা ওয়াশরুমে গেল। চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে হাত ব্যাগটি কাঁধে ঝুলিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। মিশালকে একটি নজর দেখার বড্ড জেদ চেপে বসল তার মধ্যে। জেসমিন বেগম পিছু ডাকতেই বলল সে থানায় যাচ্ছে! তাই সামান্তাকে আর আটকালেননা তিনি। কোনো বাঁধা বিপত্তি ছাড়াই যেতে দিলেন তাকে।

সাহিল ও মিশালকে আলাদা আলাদাভাবে রিমান্ডে নিয়ে যাওয়া হবে! সাহিলকে আপাতত সেলে বন্দি করে রাখা হয়েছে। রাগে, দুঃখে, জেদে নিশপিশ করছে সাহিল। চার দেয়ালের মাঝে দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। সেলের বাইরে দুজন কনস্টেবল তাকে পাহারা দিচ্ছে। সেলের শিকে হাত রেখে সাহিল দুই কনস্টেবলের দিকে রক্তচক্ষুতে তাকালো। ক্ষোভ ভরা গলায় বলল,

“দেখুন আপনারা অযথাই আমাদেরকে তুলে এনেছেন। আমরা ঐ খুনের ব্যাপারে কিছুই জানিনা। ঐ লাশটি কার তাও তো আমরা জানিনা। লাশটি আমার গাড়িতে কখন গেল তা তো আরও আগেই জানিনা। গাড়িতে লাশ পাওয়া মানেই যে গাড়ির মালিক খুনি এই কথার কোনো ভিত্তি আছে বলুন? কেউ হয়তো উদ্দেশ্যপ্রবণভাবে আমাদের ফাঁসাতে চাইছে!”

হেয়ো হেসে একজন কনস্টেবল বললেন,
“খুন করার পর প্রত্যেকটি আসামী ঠিক একই কথা বলে! এসব কথা শুনতে শুনতে আমাদের কান পঁচে গেল। চুপচাপ বসে থাক সেলের ভেতর। একটু পর তোকেও রিমান্ডে নিয়ে যাওয়া হবে।”

সেলের শিকে সাহিল তার মাথা ঠুকাতে লাগল। এই প্রথম নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে তার। কোথাও না কোথাও তার মনে হচ্ছে মিশালের সঙ্গই আজ তার এই অবস্থার জন্য দায়ী! তার বাবা তরুন চৌধুরী হয়তো এই কারণেই মিশালের সাথে তার চলাফেরাটা পছন্দ করতনা!

মিশালকে প্রথমে রিমান্ডে নিয়ে যাওয়া হলো। মৃদু অন্ধকারে ঢাকা রুমটি। মনে হলো যেনো ড্রিম লাইট জ্বলছে রুমে। চারিদিক থেকে বদ্ধ রুমটি। পর্যাপ্ত আলো বাতাসের ব্যবস্থা নেই। দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হলো মিশালের। ঘাবড়ে ওঠছে সে। বুকের ভেতরটা ভয়ে ধকধক করছে। এই প্রথম এমন কোনো পরিস্থতির মুখোমুখি পরল সে। এই জন্মে হয়তো এই পরিস্থতি থেকে বের হতে পারবেনা সে!

তাকে যে উদ্দেশ্যপ্রবণভাবে ফাঁসানো হয়েছে সে বিষয়ে তার কোনো সন্দেহ নেই। না আছে তার ক্ষমতার জোর, না আছে তার টাকা পয়সার জোর! কোনো মাধ্যমেই সে এই রণক্ষেত্র থেকে বের হতে পারবেনা! জীবনে এই প্রথম বেশ আফসোস হচ্ছে তার। বিধাতা বুঝি তার ভালো চাইলনা? তাকে নতুনভাবে সবকিছু শুরু করতে দিলোনা? বেঁচে থাকতেই এভাবে তাকে নরকে ঠেলে দিলো? এতোটাই নারাজ বুঝি বিধাতা তার ওপর? এই জীবনে কী সে একটিও পূণ্যের কাজ করেনি? যে কাজের উছিলায় সে এখান থেকে বেঁচে ফিরতে পারবে?

তার ধ্যান ভাঙল চোখেমুখে পানির ছিঁটে পরায়। তাও আবার কুসুম গরম পানি! ভড়কে ওঠল মিশাল। আচ্ছন্ন দৃষ্টিতে তাকালো সামনে। পৈশাচিক হাসিতে মত্ত টুটুল চৌধুরী! ভ্রু উঁচিয়ে তিনি প্রশ্ন ছুড়লেন,
“কী রে? সামান্য গরম পানির ছেঁকায় এতোটা ভীমড়ি খেয়ে ওঠলি? যখন তোকে উল্টো লটকিয়ে পেটানো হবে তখন কী করবি?”

বুকে সাহস রেখে মিশাল শক্ত গলায় বলল,
“আপনি যা করছেন ঠিক করছেননা স্যার। আমি বা আমরা যে পুরোপুরি নির্দোষ তা যেমন আপনিও বেশ ভালোভাবে জানেন আমরাও জানি। আসল খুনিকে খুঁজে বের করুন প্লিজ। অযথা নির্দোষ মানুষকে ফাঁসাবেননা।”
মুহূর্তেই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠলেন টুটুল চৌধুরী। মিশালের শার্টের কলার চেপে ধরলেন তিনি। দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
“আসল খুনিকেই খুঁজে বের করেছি আমি!

তুই তোর ভাইকে নিয়ে মিলেমিশে খুন করেছিস ওসমানকে! এক সপ্তাহ আগে খুন করে আজ তাকে গুম করতে বের হয়েছিলি। যার সাথে তোর চরম শত্রুতা ছিল! তার প্রমাণ ছিলাম আমি। আর লাশটি তোদের গাড়িতেই পাওয়া গেছে। লাশসহ তোদের হাতেনাতে ধরা হয়েছে। উদ্দেশ্য সফল হওয়ার আগেই দুর্ভাগ্যবশত পুলিশের হাতে ধরা পরে গেলি তোরা। এই খুনের তদন্তে আমি রয়েছি। তাই তোরা কেউ আমার হাত থেকে বাঁচতে পারবিনা।”

“লাশ আমাদের গাড়িতে পাওয়া গেছে মানে প্রমাণ হয়না যে খুনটা আমরা করেছি! হ্যা তবে এটা বলতে পারেন যে ওসমানের সাথে আমার দ্বন্ধ ছিল। আর সেই দ্বন্ধ আপনার অপারেশন নিয়েই ছিল! সেদিন হাতাহাতির পর থেকে ওসমানের সাথে আমার আর কোনো যোগাযোগই হয়নি।

পার্সোনাল শত্রুতা থেকে আপনি আমাকে ফাঁসানোর মতো বোকামো করবেননা স্যার! অন্যান্য পুলিশরা আপনার মতো ঘাসে মুখ দিয়ে চলেনা যে তাঁরা সঠিকভাবে তদন্ত না করেই আমাকে দোষী সাবস্ত করবে কিংবা আপনার ইনভেস্টিগেশনের ওপর আঙুল তুলবেনা! আর প্লিজ সাহিল ভাইকে এর মধ্যে জড়াবেননা। ধান্দা সব জায়গায় খাটেনা!”

মিশাল তার কথা বলে শেষ করতে পারলনা! ইতোমধ্যেই তাকে এলোপাথাড়ি লাঠি চার্জ করতে লাগলেন টুটুল চৌধুরী! চাইলেই মিশাল এখন উল্টে ধরতে পারবেনা টুটুল চৌধুরীকে। এতে তার রিস্ক বেড়ে যেতে পারে। ডিউটি অফিসারের গাঁয়ে হাত তোলা এখন তার জন্য চরম বোকামি হয়ে দাড়াবে। মুখ বুজে সব লাঠির আঘাত সহ্য করতে লাগল মিশাল। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ক্ষত হতে লাগল তার। রুহ্ বের হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো! ভেতর থেকে চাপা আকুতি বের হয়ে আসছিল। তার শরীর ক্রমাগত অসাড় হয়ে এলো। মারধরের পাশাপাশি ভেতরের সব ক্ষোভ ঝেরে টুটুল চৌধুরী বললেন,

“সাহস খুব বেড়ে গেছে তোর তাইনা? নিজের অবস্থান ভুলে যাচ্ছিস তুই? ভুলে যাচ্ছিস তুই কার সামনে দাড়িয়ে কথা বলছিস? আমি চাইলে ঠিক কী কী করতে পারি আই হোপ তোর সেই সম্পর্কে বেশ ভালোভাবেই ধারণা আছে। সত্যিকে মিথ্যা, মিথ্যাকে সত্যি প্রমাণ করতে আমার দুই সেকেন্ড সময়ও লাগবেনা।

এমন কেলানি দিবোনা? হরহর করে সব মিথ্যাও সত্যি হয়ে বের হয়ে আসবে। এই দিনটার জন্যই তো আমি এতোদিন ধরে অপেক্ষা করছিলাম। আমাকে থ্রেড দেওয়ার সাহস কোথায় পেয়েছিলি তুই? কে দিলো তোকে এই সাহস? টুটুল চৌধুরীর বিপক্ষে যাওয়া তাইনা? জীবনভর এই জেলের ভেতর পঁচে মরবি তুই! কেউ তোকে বাঁচাতে পারবেনা কেউনা।”

মিশালকে মারতে মারতে প্রায় আধমরা করে ফেললেন টুটুল চৌধুরী। নিজেও প্রায় ক্লান্ত হয়ে এলেন। শেষের বারের মতো তিনি মিশালের পিঠ বরাবর সজোরে একটি লাঠিকাঘাত করতেই মিশাল ‘আব্বাহ্হ্’ বলে আর্তনাদ করে মেঝেতে লুটিয়ে পরল! শরীরের গভীর থেকে গভীরতর আঘাত তার দু’চোখে ফুটে ওঠল। কাশির সাথে রক্ত বের হতে লাগল। বুজে আসা চোখ দুটি থেকে তার আপনাআপনি জল গড়াতে লাগল! অস্ফুটে দু’চোখে তার বাবার মুখটি ভেসে ওঠল! অস্থির দেখাচ্ছে তার বাবাকে। ছেলের দুঃখে দুঃখী তিনি। চোখে বিভীষিকার ঝড়। গুঙিয়ে ওঠে মিশাল বলল,

“আব্বা আমারে বাঁচান!”
বিক্ষুব্ধ গলায় টুটুল চৌধুরী বললেন,
“তোর কোনো আব্বাই তোকে বাঁচাতে পারবেনা! আমার সাথে পাঙা নিয়ে তুই ভুল করেছিস মিশাল। আমাকে তুচ্ছ মনে করে তুই জীবনের মস্ত বড়ো ভুল কাজটি করেছিস। তবে আমি তোকে একটি শর্ত দিতে পারি। যদি তুই এই মারধর থেকে মুক্তি পেতে চাস তবে স্বীকার করে নে যে খুনটা তুই করেছিস! জবানবন্দি দে আমায়। কসম বলছি আমার কথা মতো কাজ করলে তোর গাঁয়ে একটাও ফুলের টোকা পরতে দিবনা আমি।”

“ভুল বললি তুই! মারতে মারতে আমাকে মেরে ফেললেও আমার মুখ থেকে মিথ্যা জবানবন্দি পাবিনা তুই! তোর অন্য কোনো গড ফাদারকে বাঁচাতে গিয়ে যে তুই আমাকে ফাঁসাতে চাইছিস সেই বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই আমার। এসব তোর পকেট গরম করার ধান্দা! তবে তোর কাছে আমার একটাই রিকুয়েষ্ট, সাহিল ভাইকে ছেড়ে দে তুই। এরমধ্যে তাকে ফাঁসাবি না তুই।”

বিড়বিড় করে কথাগুলো বলে চোখ জোড়া নির্বিকারভাবে বুজে নিলো মিশাল! জ্ঞান হারালো সে। শরীরের সমস্ত যন্ত্রণা নিরাময় হতে লাগল। ডুবে গেল অন্ধকার একটি জগতে। পাষণ্ডের ন্যায় হেসে ওঠলেন টুটুল চৌধুরী। শার্টের কলারটি ঝেড়ে বললেন,

“টাকা খাওয়ার লাইন যেহেতু একটা খুঁজে পেয়েছি আমি সেই সুযোগ কী করে হাতছাড়া করি! গড ফাদার বল, সাহিল বল, তুই বল কাউকে আমি বিনা ধান্দায় ছাড়বনা!”

জায়গা থেকে প্রস্থান নিলেন টুটুল চৌধুরী। অঝরে ঘাম ঝরছে তার গাঁ থেকে। পাশের সেল থেকে তেজী দৃষ্টিতে সব দেখছে সাহিল। বুঝতে বেশি বাকী রইলনা তার মিশালকে কতোটা টর্চার করে এসেছেন তিনি। শরীরের ঘামই তা স্পষ্ট বলে দিচ্ছে। মিশালের জন্য অস্থির হয়ে ওঠল সাহিল। অন্তর্আত্তা কেঁপে ওঠল তার। তবুও শান্ত থাকতে চাইল সাহিল। ক্ষেপাতে চাইলনা টুটুল চৌধুরীকে। সেলের ভেতর থেকে সে টুটুল চৌধুরীকে উদ্দেশ্য করে নরম স্বরে বলল,
“প্লিজ স্যার আমাদের ছেড়ে দিন। বিশ্বাস করুন আমরা কোনো খুনের সাথে জড়িত নই। জানিনা আমার বা মিশালের কোন শত্রু আমাদের ফাঁসাতে চাইছে। মিশালের সাথে খারাপ কিছু করবেননা প্লিজ।”

“একটু ওয়েট কর। তোর ক্লাসও আমি নিতে আসছি!”
সাহিলকে ঠাণ্ডা মাথায় হুমকি দিয়ে টুটুল চৌধুরী নিজের অফিস রুমে গেলেন। বাইরে তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন তরুন চৌধুরী, মিজানুর রহমান ও সামান্তা। সামান্তাকে দেখে তিনি হাঁটা থামিয়ে দিলেন! তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নিষ্ক্রিয় সামান্তার দিকে ফিরে তাকালেন। শুধু তরুন চৌধুরীকে তিনি ভেতরে আসতে বললেন! মিজানুর রহমান ও সামান্তা বাইরে দাড়িয়ে রইলেন। উদ্বিগ্ন গলায় সামান্তা তার বাবাকে বলল,

“মিশাল ভাইয়া ঠিক আছে তো বাবা? টুটুল চৌধুরীকে দেখে আমার সুবিধার মনে হচ্ছেনা।”
“রিমান্ডের আসামীকে কী এমনি এমনি ছেড়ে দিবে? যে করেই মিশালের সাথে আমাদের একবার দেখা করতে হবে।”
শুকনো ঢোঁক গিলল সামান্তা। বুকটা অস্বাভাবিক ভাবে কেঁপে ওঠল তার। মন বলতে লাগল মিশাল ভালো নেই। মিশালকে দেখার জন্য ছটফট করে ওঠল সে। আবদার খাটিয়ে সে তার বাবাকে বলল,

“আমরা কী পারিনা বাবা মিশাল ভাইয়াকে টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে নিতে? আমি জানি টুটুল চৌধুরী ইচ্ছে করে ট্রেপে ফেলেছে মিশাল ভাইয়া ও সাহিল ভাইয়াকে। টাকা পেয়ে গেলেই তিনি তাদের দুজনকে ছেড়ে দিবেন। প্লিজ বাবা তুমি কিছু একটা করো। মিশাল ভাইয়াকে বাঁচাও।”

“পাগল হয়ে গেছিস তুই? এতো লাখ লাখ টাকা কোথায় পাব আমি? তরুন পুলিশকে কতো টাকা অফার করবে বলে ভেবে রেখেছে জানিস? লাখ দশেকের ওপরে৷ মিশালকে ছাড়ানোর কথা ভাবতে হলে আমাকে এরচেয়ে তিনগুন বেশি টাকা অফার করতে হবে! তার জন্য কী আমি জায়গা জমিন সব বিক্রি করে দিব?”

বুকে যে শ্রাবণ তার পর্ব ৪০

হতবাক হয়ে গেল সামান্তা। তার বাবার দিকে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকালো। অবাক কণ্ঠে বলল,
“মিশাল ভাইয়ার জন্য তুমি এতোটুকু করতে পারবেনা বাবা? স্বার্থপরের মতো কথাগুলো বলতে পারলে তুমি? বিপদ ও অসহায়ত্ব কী মানুষকে আপন পর ও ভুলিয়ে দেয়?”

বুকে যে শ্রাবণ তার পর্ব ৪২