আমি মায়াবতী পর্ব ২৩

আমি মায়াবতী পর্ব ২৩
তাহমিনা মিনা

“তুমি কেন দিনের ট্রেনে গেলে না বাবা? এই রাতের বেলা এখন ট্রেন নষ্ট হলো। এখন আমরা কি করবো?” রাগে গজগজ করতে করতে বললো সাবিহা।
“মা, ট্রেন নষ্ট হয়নি। সামনের ব্রিজ নষ্ট হয়েছে। এইজন্য ট্রেন থেমে আছে।”
“কখন ঠিক হবে?আমরা দিনে কেন গেলাম না? “সেটা তুমি বাড়িতে গেলেই বুঝবে।”
“এখন কি আমি এই উপরের বেডে পা ঝুলিয়ে থাকবো?”

“নিচে নেমে আয় সাবিহা।” মায়া বললো।
সাব্বির উপরের দিকে তাকিয়ে বললো, “সাবিহা আপু, নিচে নেমে এসো। আমরা চানাচুর খাচ্ছি। ঝালঝাল চানাচুর। তুমিও এসে খাও।”
“তুই উপরের দিকে না তাকিয়ে মাথা নিচু করে রাখ। ঘাড় ভেঙে যাবে। ইডিয়ট কোথাকার।” কথা বলতে বলতে নিচে নেমে আসে সাবিহা।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সাগরিকা এইবার বিরক্ত হয়ে বলে,”যথেষ্ট হয়েছে সাবিহা। সবসময় মুখ গোমড়া করে রাখলে কেমন লাগে।”
“আমি তো আসতে চাইনি। তোমরাই আমাকে নিয়ে এসেছো।” মাথা নিচু করে বলে সাবিহা।
রিজভী ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,” ওকে। তোমার কথাই থাক। যদি তোমার ওখানে ভালো না লাগে, তাহলে তোমাকে নিয়ে আমরা ২ দিন পরেই চলে আসবো।”

আনন্দে লাফিয়ে উঠে সাবিহা বলে,”সত্যি?”
“হ্যাঁ, সত্যি।”
“ওকে। কিন্তু এখন আর মুখ গোমড়া করে রাখা যাবে না। ”
“ওকে বাবা। কিন্তু তোমার উচিত ছিল দিনে জার্নি করা। তাহলে অনেক কিছুই দেখতে পারতাম। ”
“ফেরার সময় চেষ্টা করবো দিনের টিকিট নিতে। ওকে?”
“ওকে বাবা। কিন্তু এখানে বসে থাকতে ভালো লাগছে না। বাইরে দেখো অনেক মানুষ বের হয়ে হাটাহাটি করছে। আমরাও যাই। চলো না বাবা।”

“যথা আজ্ঞা আম্মা।”
মায়া ট্রেন থেকে বের হয়ে দেখলো ছোটখাটো একটা স্টেশন। তারা যেখান থেকে উঠেছে, সেখানের তুলনায় এখানে কিছুই নেই৷ এইখানের বেশি মানুষ নেই। যারা আছে, তারা বেশিরভাগই ট্রেনের যাত্রী তাদের মতোই। মায়া চারদিকে চোখ বুলিয়ে সবকিছু দেখে নিলো। অনেক মানুষই মানবেতর জীবনযাপন করছে এখানে। রেললাইনের ধারে ঘুমুচ্ছে মানুষ। কিছু ভিক্ষুক তাদের দেখে এগিয়ে আসছে। একটা বাচ্চা ছেলে ফ্লাক্সে করে চা বিক্রি করছে আর অদ্ভুত ভঙিতে চা গরম, চা গরম বলছে। বাচ্চা ছেলেটা সাব্বির এর বয়সীই হবে হয়তো। আশেপাশের হোটেলগুলো আজ যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে।

মাঝরাতেই রান্নাবান্না শুরু করে দিয়েছে। অনেকে খাওয়া শুরু করে দিয়েছে। সাবিহা আবদার করলো চা খাবে। তার নাকি এই গরমে চা খেতে ইচ্ছে করছে। মুখে বললেও সবাই জানে তার চা খেতে ইচ্ছে করছে না। বাচ্চা ছেলেটিকে দেখে মায়া লাগছে। মায়া অবাক হয়ে চারপাশ দেখছে। রাতের পরিবেশ তার ভালো লাগছে। জীবনের প্রথম ট্রেন জার্নি, প্রথম পরিবার নিয়ে ভ্রমণ আর প্রথম পরিবার সহ বাইরে খোলা আকাশের নিচে বসে চা খাওয়া। সাবিহা নিজের কথার ফুলঝুরি খুলে বসেছে। সাব্বির নতুন যা দেখছে, সেটা নিয়েই প্রশ্ন করছে। আম্মা তাদের কথার জবাব দিতে দিতে কাহিল। বাবা চুপ করে বসে আছে। হয়তো অতীতের কথা ভাবছে। কত বছর পর নিজের গ্রামে যাচ্ছে কে জানে!বাবারও তো মা নেই। বাবারও কি মায়ের জন্য কষ্ট হয়?

“আপনারা এই রুমে কেন থাকেন? ” গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন করে রিজভী।
আজমল হোসেন একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে,”তাইলে কি ঐ অট্টালিকায় থাকুম নাকি বাজান? আমার ছাওয়ালগুলান তো মানুষ হইছে অনেক। আমারে অট্টালিকায় রাখবো তো এইজন্য। ”
“বাড়িটাতো আপনার আব্বা। তাহলে আপনারা এই ঝুপড়ি ঘরে থাকেন কেন?”
“সবজায়গায় সবার থাকনের অনুমতি থাহে না বাজান। তুমি কয় বছর পর আইলা কও তো বাজান?”
“জানিনা আব্বা। হিসেব করতে আমার ভালো লাগে না। ”

“এতোদিন কেন আসোনাই?”
“আপনে আমারে তাড়ায় দিছিলেন আব্বা। বলছিলেন আর যেন বাড়িমুখো না হই।”
“হো। আমিই কইছিলাম। বাপের মুখের কথাডা রাখছো বাজান। মনের কথা শুনোও নাই রাখোও নাই।”
“অত্যাচার সহ্য করার চাইতে দূরে গিয়ে একবেলা না খেয়ে থেকেও শান্তিতে ছিলাম আব্বা।”

“হ রে বাজান। ঠিকই করছোস। দূরে গেছিলি দেইখাই বড় মানুষ অইতে পারছোস। না হইলে তো এইহানে কামলা দিয়া খাইতি। তোর ভাইগুলানরে দেখ। ২ টা দামড়া পোলা। ভালা ব্যবসা করে। বিয়া করতে না করতেই আমাগো বুড়া-বুড়িরে পর কইরা দিছে। তাও ভালা যে বাড়ি থাইক্কা বাইর কইরা দেয় নাই। খাওয়ন পরনের সবকিছু তো তাও দেয়।”
“এই ঘরে ফ্যান নাই কেন আব্বা?”

“আমাগো আবার ফ্যান লাগেনিরে বাজান? আমরা হইলো বুড়া-বুড়ি। আইজ আছি তো কাইল নাই। আমাগো ফ্যান না হইলেও চলবো।” বলেই একটু মুচকি হাসার চেষ্টা করে সে।
“সকালে কি খাইছেন আব্বা?”
“খাইছি মুড়ি চিড়া।”

অন্ধকারে হোঁচট খায় যেন রিজভী আহমেদ। তার বাবা সকালে মুড়ি চিড়া খেয়েছে? অথচ তার ভাইদের ঘরে তারা আসার পর ভালোমন্দ খাবার খেয়েছে। তার এক মুহুর্ত সময় লাগে না বুঝতে এখানে কি হচ্ছে বা হয়ে থাকে।
“তোমার মাইয়া দুইডা তো এক্কেবারে তোমার মায়ের মতো হইছে। তোমার বড় মাইয়ারে দেইখা আমি প্রত্থমে ভাবলাম তোমার মায় বুঝি আইছে। আমি তো অবাকই হয়া গেছিলাম। অতটুক বয়সেই তো তোমার মায়েরে আমি বিয়া কইরা আনছিলাম। ওরা কই সবাই? ওগোরে ডাকো। না থাক। আমিই যাই। এই ঘরে আইলে তো ওগো সবার গরম লাগবো।” বলেই লাঠিতে ভর দিয়ে উঠানের দিকে পা বাড়ায় আজমল হোসেন।

রিজভী আহমেদও পেছন পেছন বের হয়ে আসে। বাইরের উঠোনে অনেক মানুষ। সবাই তাদের আসার খবর শুনে তাদের দেখতে এসেছে। মায়া, সাবিহা আর সাব্বির কে ঘিরে রেখেছে সবাই। সাগরিকা উঠোনের এক কোণায় রান্নাঘরে সবার সাথে বসে আছে। রিজভী চুপিচুপি চলে আসে বাড়ির পিছনে। তাদের পারিবারিক কবরস্থানে। যেখানে তার দাদা-দাদি, এক ফুপি, আর তার দুঃখীনী মা শুয়ে আছে। চুপিসারে সে এসে বসে মায়ের কবরের সামনে। ইট দিয়ে বাঁধাই করে দেওয়া কবর। সময়ের ব্যবধানে আজ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে সেগুলো। তবুও সে চিনে কোনটা তার মায়ের কবর।

ছোট্ট শিশুর ক্ষুধা লাগলে যেভাবে সে মায়ের কাছে হামাগুড়ি দিয়ে বসে পড়ে, রিজভীও সেভাবে বসে পড়ে তার মায়ের কবরের কাছে। তার ইচ্ছে করে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে কান্না করতে। কিন্তু সে পারে না। গলার কাছে এসে সব যেন আটকে যায়। সে চায় মা মা বলে চিৎকার করতে কিন্তু সেটাও পারে না। কিন্তু চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়তে থাকে তার। কাঁদতে কাঁদতে মায়ের কবরের উপর শুয়ে পড়ে সে।

কতক্ষণ সে এভাবে ছিল সে জানে না। তার হুশ ফিরে যখন সে অনুভব করে তার পিঠে কারো হাত পড়েছে। আতঙ্কিত হয়ে পিছনে ঘুরেই সে দেখে মানুষটা সাগরিকা। তার সহধর্মিণী। যার মুখের দিকে তাকিয়েই সে তার অতীত আর দুঃখকে ভুলেছিল। সে উঠে আঁকড়ে ধরে তাকে। সাগরিকা হতভম্বের মতো তাকিয়ে থাকে তার দিকে। এতো বছরের সংসার জীবনে তার স্বামীকে সে এতোটা ভেঙে পড়তে কখনোই দেখেনি। সাগরিকার কাঁধে মাথা রেখে ঢুকরে কেঁদে উঠে রিজভী। সাগরিকা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়৷ এর চাইতে বেশি আর কিইবা করতে পারবে সে। চাইলেও তো এর বেশি আর কিছুই করতে পারবে না। অতীতকে তো আর কোনোভাবেই বদলানো যাবে না। সেই সাধ্য তো তার নেই।

গ্রামে এসে সবচেয়ে বেশি যে কথা বলা শুরু করেছে, সে সাবিহা। সে যেদিকে তাকাচ্ছে, সবদিকেই যেন সৌন্দর্য খুঁজে পাচ্ছে সে৷ গাছের ডালে ডালে পাখির কলকাকলি, কত রঙের ফুল,কত ধরনের মানুষ। তারা যেন কোনো এক অনুষ্ঠানের মূখ্য অতিথি। সবাই তাদের দিকে তাকাচ্ছে যেন তারা দূর কোনো গ্রহ থেকে এসেছে। মায়ার সবচেয়ে যে জিনিসটা ভালো লাগলো, সেটা হচ্ছে পুকুর। এখানেই সে গোসল করতে চেয়েছে।

বাড়ির পাশেই পুকুর হওয়ায় রিজভী পুকুরের পাশে এসে দাঁড়ায়। কারণ মায়া বা সাবিহা কেউই ভালোভাবে সাঁতার জানে না। সাব্বিরের অনুমতি মিলেনি পানিতে নামার। তাই সে ছুটে গিয়ে নিজের ব্যাগ থেকে কাগজের নৌকাগুলো নিয়ে এসে ভাসাচ্ছে। পুকুরের মাঝখানে কয়েকটি লাল শাপলা ফুটে আছে। সাবিহা বাবার কাছে বায়না ধরে সেটা আনার৷ সে বলামাত্রই তাদের পাশের বাড়ির মেয়েটা সাঁতরে গিয়ে নিয়ে এসেছে।

সাবিহা এর আগে কখনোই পুকুরে গোসল করেনি। তাদের শহরে পুকুর থাকলেও সেখানে গোসল করার অবস্থা নেই। এখানে এই স্বচ্ছ পানি দেখে সে যারপরনাই অবাক। তার ছোট ছোট চাচাতো ভাই বোনেরা তাদের আশে পাশেই আছে। সবাই তাদের থেকে বয়সে অনেক ছোট। কিন্তু পাশের বাড়ির মেয়ে মরিয়মের সাথে ইতোমধ্যেই খুব ভাব হয়ে গেছে সাবিহা আর মায়ার৷ মেয়েটার নাম মরিয়ম।

কিন্তু এলাকার মানুষ তাকে মরিয়ম না ডেকে তাকে ডাকে মইরম বলে। সাবিহার বেশ হাসি পায়। কিন্তু সে কিছু বলে না। মরিয়ম তাদের উৎসাহ দেখে বলে, “তোমরা এই পুকুর দেইখা এমন করতাছো? আরো বড় পুকুর আছে। আর আছে একটা নদী। এখন মেলা পানি সেইহানে। নৌকা চলে সেইহানে।”

“সত্যিকারের নৌকা?”
“হ।”
“ইশ! আমি যদি নৌকায় ঘুরতে পারতাম। ” প্রবল উৎসাহ নিয়ে বলে সাবিহা।
“তুমি চড়বা? আমার ভাই তাইলে নৌকা নিয়ে আইবোনে।”
মরিয়মের বোন পুকুরেই ছিল। তার বয়স কত হবে? এগারো কি বারো? সাব্বির এর বয়সীই হবে হয়তো। সাবিহা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,” ও তো ছোট। ও কি পারবে?”
ছেলেটার চোখমুখ কেমন যেন হয়ে গেল। যেন খুব একটা অপমানজনক কথা বলেছে তাকে নিয়ে কেউ।
মরিয়ম হেসে বলে,”ওর কাছে এইডা ডাইল ভাত খাওনের সমান।”

চোখ লাল হয়ে গেছে সাবিহা আর মায়ার। জোর করে তাদের পানি থেকে তুলেছে সাগরিকা৷ এই গরমে এখন তারা ঠকঠক করে কাঁপছে। উঠোনে রোদ পোহাচ্ছে তারা। সেই মুহুর্তে বাড়িতে প্রবেশ করে রিজভী। সে গিয়েছিল এলাকার বাজারে। টুকটাক কেনাকাটা করতে৷ আজমল সাহেব দেখলো সেই জিনিসপত্র গুলোর মধ্যে সিলিং ফ্যানও আছে। চোখে পানি চলে আসে তার৷ সে জানে না তার চোখে কেন পানি আসলো।

আনন্দে না কষ্টে? সাবিহা আর মায়াও বুঝলো কেন বাবা রাতের ট্রেনে বাড়ি এসেছে। রিজভী উঠোনে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলো। মায়া আর সাবিহাকে নিজের ছোটবেলার গল্প বলছিল। তার ছোট ভাইদের বাচ্চাদের শহরের গল্প শুনাচ্ছিল। সাগরিকা এক গ্লাস ঠান্ডা পানি হাতে এনে দিলে সে সেটায় এক চুমুক দিতেই কোথা থেকে একটা মাঝবয়সী এক মহিলা এসেই বাবাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো।

আমি মায়াবতী পর্ব ২২

বাবাও তাকে দুহাতে আগলে নিয়ে তাকে থামানোর চেষ্টা করলো। মায়াসহ সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। মহিলার পিছুপিছু একটা মেয়েও বাড়িতে ঢুকে। সাগরিকার দম প্রায় বন্ধ হয়ে আসছিল। কে এই মহিলা? হুট করেই মহিলাটি রিজভীকে ছেড়ে বললো,”তুমি না কইছিলা আমার জন্য চুড়ি কিনবার যাইতাছো? আমি তো তাই তোমারে যাইবার দিলাম। এতো দেরি করলা কেন? তুমিও আইলা না। আমি আর আমার জীবনে চুড়িও পড়লাম না। তুমি না কইছিলা তুমি তাড়াতাড়ি আইবা? এতো দেরি কইরা আইলা কেন মিয়াভাই?”

আমি মায়াবতী পর্ব ২৪