আমি মায়াবতী পর্ব ৪৪

আমি মায়াবতী পর্ব ৪৪
তাহমিনা মিনা

“তুমি কি নিশ্চিত সোহাগ ভাই? ”
“হ্যাঁ, শতভাগ নিশ্চিত। আমি তোকে ভালোবাসি রিজা।”
রিজা মুচকি হাসে। সোহাগের দিকে একবারও চোখ তুলে তাকায় না।কফির কাপের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। কি যেন কি খুঁজে সেখানে।

“তুমি তাহলে আমাকে বিয়ে করতে চাও?”
“হ্যাঁ, মায়ার বিয়েটা হয়ে গেলেই তোকে আমার ঘরের বউ করে নিয়ে যাবো।”
রিজা এবার সরাসরি সোহাগের দিকে তাকিয়ে বলে,”কিন্তু আমি যে আর গ্রামে ফিরে যাবো না। ওখানে আমি আর থাকতে পারবো না। আসলে শহুরে জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেছি তো।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“তুই চাপ নিচ্ছিস কেন? আমি তো তোকে গ্রামে নিয়ে যাবো না। আমি ফ্ল্যাট ভাড়া করবো। তোকে নিয়ে সেখানে থাকবো। বাবা-মাও আসবে। আর আমার বোন তো এখন হোস্টেলে থাকে। তখন তাকেও নিয়ে আসবো। সবাই একসাথে থাকবো।”

“সত্যি?”
“হুমম, সত্যি।”
“তাহলে তুমি নিশ্চিতভাবে বলছো যে তুমি আমাকে ভালোবাসো আর আমাকে বিয়ে করতে চাও?”
“হ্যাঁরে বাবা। ভালোবাসি, ভালোবাসি।”
“তুমি কোথায় ফ্ল্যাট নিবে?আমি কিন্তু আমার মাকেও আমাদের সাথে রাখবো।”
“সমস্যা নেই। ফুপিও আমাদের সাথেই থাকবে।”

“আমি কিন্তু মামা-মামীদের কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করবো।”
“হ্যাঁ, সেদিকেই নিবো। শোন, আমার অফিস মায়ার শ্বশুরবাড়ির ঐদিকেই। আমি চেষ্টা করবো ঐদিকে বাসা ভাড়া নিতে।”

রিজা কফির কাপে চুমুক দিয়ে বেশ ভাবলেশহীন ভাবে বলে,” বাসা ভাড়া নেওয়ার চেষ্টা করবে নাকি বাসা ভাড়া নেওয়া হয়ে গেছে?”
সোহাগ বেশ থতমত খেয়ে বলে,”কি সব আবোলতাবোল বলছিস? মাথা খারাপ হয়ে গেছে? ”
রিজা সোহাগের দিকে তাকিয়ে বেশ শক্তভাবেই বলে,”ভুল কিছু বললাম? নাকি মিথ্যে বললাম? অবশ্য মিথ্যে বললেই কি? আমি না হয় একটা ভুল কিংবা মিথ্যে কথা বললাম। কিন্তু তুমি তো আমার সামনে বসে অনর্গল মিথ্যে বলেই চলেছো। তার বেলায়?তোমার মাথা খারাপ হয়ে যায়নি তো?”

সোহাগ শেষ একবার নিজেকে শান্ত করে বলে,”আবোল তাবোল কি সব বলিস না তুই। নে, আরো কিছু খাবি নাকি অর্ডার কর।”
রিজা একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে, “আমি কিন্তু জানি তুমি কেন আমাকে বিয়ে করতে চাইছো। বলি আমি?”
রিজার গলার স্বরের কাঠিন্য দেখে সোহাগ বেশ ভড়কে গিয়ে বলে,”তোকে ভালোবাসি তাই।”

রিজা আবার হাসে। হাসতে হাসতেই বলে,”আমার গ্রামে কেন সোহাগ ভাই, বস্তিতেও তোমার সাথে সংসার পাততে সমস্যা হতো না। কারণ আমি যে তোমাকে বড্ড ভালোবাসি। আমি দুই কাপড়ে বছর পার করে দিতে পারতাম যদি তুমি আমাকে ভালোবাসতে।”

“আমি তো তোকে ভালোবাসিই, রিজা।”
“নাহ, তুমি আমাকে ভালোবাসো না।তুমি নিজের স্বার্থসিদ্ধি করার জন্য আমাকে বিয়ে করতে চাইছো। আমি কি বলবো, কেন তুমি আমাকে বিয়ে করতে চাইছো? কিংবা মায়ার শ্বশুরবাড়ির কাছেই আমাদের সংসার পাততে চাইছো?”

সোহাগ মাথা নিচু করে থাকে। সে বুঝে গেছে সে ধরা পড়ে গেছে। কিন্তু মুখ দিয়ে একটা কথাও বের করতে পারেনা। রিজা বেশ কিছুক্ষন তার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে,”তুমি আমাকে বিয়ে করতে চাও কারণ তুমি মায়া আপুকে ভালোবাসো। তার সাথে কিছুটা সম্পর্ক বজায় রাখতেই তুমি আমাকে বিয়ে করে তার আশেপাশেই থাকতে চাও। মিস্টার সোহাগ, আমি কি ভুল বললাম?”

সোহাগ তবুও মাথা নিচু করে থাকে। কোনো জবাব দেয়না।
রিজা বলে,”আমার তো তোমার উপর কোনো অভিযোগ ছিল না সোহাগ ভাই।আমি যদি আগের রিজা হতাম,তাহলে আমি সহজেই তোমাকে বিয়ে করতে চাইতাম। তুমি মায়া আপুকে ভালোবাসো এটা জেনেও বিয়ে করতাম।কারণ আমার কোনো আত্মমর্যাদা ছিল না আগে।

তুমি যখন মায়াপুকে পড়াতে এসে আমাকে ইন্ডিরেক্টলি অপমান করতে,আমি বুঝতাম না।মায়াপু আমাকে বোঝাতো তোমার কাছে না যেতে।তার তোমার এই আচরণ ভাল লাগতো না৷সে আমার বোন।আমার অপমান সে মেনে নিতে পারতোনা। আমার রাগ হতো কেন তুমি আমাকে ভালোবাসতে না।তোমাকে খুশি করতে আমি কত কিছুই না করতাম। তবুও আমার দিকে ফিরেও তাকাতে না।

তখন তোমার প্রতি অভিযোগ থাকলেও এখন আমার কোনো অভিযোগ নেই। কারণ আমি এখন জানি ভালোবাসা জোর করে হয়না।না হলে তোমার মতো ছেলেকে মায়াপু কেন রিজেক্ট করবে?ভালোবাসা রুপ দেখে হয়না।না হলে তো তুমি আমার সাজগোজ করা চেহারা দেখেই ভালোবাসতে।আমার পাগলামো দেখে ভালোবাসতে।তুমি তো বুঝতে আমার অনুভূতি।তুমি তো আর আমার মতো অবুঝ না। তাইনা?”
“আমি তোকে কখনোই ভালোবাসিনি,রিজা।”

রিজার চোখে পানি এসে পড়ে।সে জানে সোহাগ তাকে ভালোবাসে না।তবুও তার মুখ থেকে ভালোবাসিনা শব্দটা তাকে ভেতর থেকে ভেঙে দিচ্ছে।সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,”তুমি কাজগুলো ভালো করলে না সোহাগ ভাই।মায়াপুর বিয়ে ভাঙতে চাইলে আবার মায়াপুর আশেপাশে থাকার জন্য আমার অনুভূতিগুলো আবার জাগিয়ে তুমি মোটেও ভালো কাজ করলে না।”

সোহাগ আঁতকে উঠে। সহসাই তাকায় রিজার দিকে।রিজা কিভাবে জানে যে সে মায়ার বিয়ে ভাঙতে চেয়েছিল। অস্ফুট স্বরে রিজাকে জিজ্ঞেস করে,”তুই কিভাবে জানলি?”
“উফফ, থ্যাংকস সোহাগ ভাই। তুমি স্বীকার করে নিলে।অন্ততপক্ষে আবার তো বলোনি যে রিজা,তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?”
“তুই কিভাবে জানলি?”

“সেদিন তুমি কাব্য ভাইয়ের বড় ফুপির সাথে শপিংমলে কথা বলেছো। তোমাকে আমি দেখেছিলাম।তুমি মাস্ক পড়ে ছিলে বলে যে তোমাকে আমি চিনবো না,তুমি ভাবলে কিভাবে?তুমি না মায়াপুকে ভালোবাসো?তাকে ভালোবাসলে তার ক্ষতি কিভাবে চাইতে পারলে?তার সবচেয়ে বড় দূর্বলতাকে কেন সবার সামনে তুলে ধরলে?তুমি আসলে মায়াপুকে ভালোই বাসোনি কোনোদিন। আমি তো তোমাকে ভালোবাসি।কিন্তু আমি চাই তুমি যেখানেই থাকো,যার সাথে থাকো,তুমি যাতে ভালো থাকো।”

“আমি মায়াকে ভালোবাসি।ভালোবাসলে তাকে পেতে চাওয়া অন্যায় না।”
“তাতে কি লাভ হলো? বিয়েটা তো হচ্ছেই।কোনোভাবেই আটকাতে পারলে না।জীবনটা মায়াপু আর কাব্য ভাইয়ার।ওরা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিয়ের।ওদের সমর্থন করেছে ওদের বাবা-মা।কে ওদের বিয়েতে আসলো আর কে আসলো না,সেটা নিয়ে কারো মাথা ব্যথা নেই।

ওদের দাওয়াত দেওয়ার দরকার,ওরা দাওয়াত দিয়েছে।আর জানো তো, আমে দুধে মিলে যায় আর আঁটি কিন্তু অবহেলায় ডাস্টবিনে পড়ে থাকে। ওদের ফুপি ওদের ঠিকই মেনে নিবে।ভাইপোর বিয়েতে এসে অনেক আনন্দও করবে। কিন্তু আমি আশা করবো তুমি যাতে না আসো।আমি এখন যথেষ্ট বড় হয়েছি।বুঝতে শিখেছি সবকিছুই।সামনে কলেজে ভর্তি হবো।আমাকে ভুলভাল বোঝাতে এসো না ভুলেও।”

“তুই চাস না আমি মায়ার বিয়েতে যাই?”
রিজা বেশ কঠিনভাবে জবাব দেয়,”নাহ, আমি চাইনা।”
“হুমম। ”

“আমাকে যেতে হবে সোহাগ ভাই। মায়াপুকে পার্লারে বসিয়ে রেখে এসেছি।সবাই আমাকে কল করছে।আজ মায়াপুর গায়ে হলুদ। আমাকে সাজতে হবে।বুঝোই তো,বউয়ের একমাত্র ফুপাতো বোন আমি। আমি না সাজলে কি হয়?তবে ভেবোনা,আমি উল্টাপাল্টা সাজবোনা আর। আর না তোমার জন্য সাজবো।”

“হুমম। ”
“কফির জন্য ধন্যবাদ সোহাগ ভাই।”
কথাটা বলেই রিজা উঠে চলে যায় রেস্টুরেন্ট থেকে।সোহাগ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ওর চলে যাওয়ার দিকে।এই কি সেই রিজা,যে সোহাগ আসার কথা শুনলে পাশের গ্রাম থেকে হেঁটে আসতো নিজের নানাবাড়ি।যেখানে তাকে কেউ মূল্যায়নও করতো না।

শত অপমান সহ্য করে যে শুধুমাত্র সোহাগকে দেখার জন্য মাটি কামড়ে পড়ে থাকতো। আর আজ তার এতো পরিবর্তন? ভাবা যায়?সোহাগ বুঝতে পারে না সে এখন কি করবে।সে সবই হারিয়েছে আজ।তার ভিতরে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। সে বুঝতে পারছে না কার থেকে রিজেক্ট হয়ে তার কষ্ট হচ্ছে।তার ভালোবাসার মানুষ মায়া নাকি তাকে যে ভালোবাসে সেই রিজার থেকে?

“আজকে আমাকেই সবচেয়ে সুন্দরী লাগতেই হবে মায়াপু। তোমার ঐ দেবরটা জোস। আমি তো জাস্ট ফিদা হয়ে গেছি। আপু, আপনি আমাকে গোলাপি ব্লাশ করে দিন তো মুখে। দেখেছি আমি ছেলেটা গোলাপি পাঞ্জাবি পড়েছে।”
সাবিহার কথায় বিরুক্ত হয়ে রিজা বলে,”আর একটা কথা বললে আমি তোর মুখ সেলাই করে দিব ইডিয়ট। তুই প্রেমে পড়েছিস ভালো কথা। তাই বলে সারা দুনিয়া জানাতে হবে?আর এতো নড়নচড়ন করছিস যে তোর মেকআপ ভালোভাবে বসছেই না। চুপচাপ থাক। ”

“থামবি তোরা?আমার এমনিতেই ভয় লাগছে এর মধ্যে আবার বকবক করছিস। তোদের নিয়ে আর পারি না আমি। তোদের….”
মায়া কথা শেষ করতে পারেনা। তার আগেই তার ফোন বেজে উঠে। রিজা উঠে স্ক্রিনে দেখে ◑কাব্য স্যার◑ নামে সেইভ করা নাম্বার থেকে কল এসেছে। রিজা মুখে কৌতুক এনে বলে,”নাম বদলে দিই?কাব্য বর দিয়ে? নাও তোমার বর কল করেছে।তোমাকে দেখতে চায় হয়তো। ” বলেই চোখ টিপে হাসে।

আমি মায়াবতী পর্ব ৪৩

মায়া লজ্জিত মুখে ফোনটা হাতে নেয়। নিজের মনেই বলে, এই লোকটার মোটেও ধৈর্য নেই। দু ঘন্টা ধরে অপেক্ষা করছে কখন সাজ শেষ হবে আর কখন সে দেখবে। তার বউকে নাকি সবার আগে তাকেই দেখতে হবে।ইশশ!কি লজ্জা। এতো লজ্জা রাখবে কোথায় সে?

আমি মায়াবতী পর্ব ৪৫