আমি মায়াবতী পর্ব ২২

আমি মায়াবতী পর্ব ২২
তাহমিনা মিনা

“মায়া আপু, তুমি কখনো গ্রাম দেখেছো? আমি কখনোই দেখিনি।”
“আমিও দেখিনি সাব্বির। কিন্তু আমার অনেক ইচ্ছে ছিল আমি গ্রামে যাবো।”
“তুমি গ্রামে গিয়ে কি করবে আপু?”
“জানিনা। তুমি কি কি করবে?”

“আমি তো নদীতে নৌকা চালাবো। আমি অনেক গুলো কাগজের নৌকা বানিয়েছি। তোমার মনে আছে, আমি কক্সবাজার গিয়ে নৌকা ভাসিয়েছিলাম। কিন্তু একটাও আর ফিরে পেলাম না।”
“কিন্তু নদীতে তো হারাবে না।”
“সাবিহা আপু, তুমি কি কি করবে?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“ফ্যাঁসফ্যাঁস করবি না তো। আমার গ্রাম ভালো লাগে না। বিরক্ত লাগছে। আমি কীভাবে কি করবো বুঝতে পারছিনা। বাবা যে কিসের জন্য যেতে চাইছে কে জানে। ”
“ওখানে আমাদের দাদা-দাদি আছেন। তারা বাবার মা-বা সাবিহা। তাদের প্রতি তো আমাদের দায়িত্ব কর্তব্য আছে৷ সেটা তো পালন করতে হবে।”

“ওনারা কি বাবার প্রতি দায়িত্ব পালন করেছে? তাহলে আমরা কেন করবো? বাবাকে তো বের করে দিয়েছিল। খাবারও খেতে দেয়নি ওরা। আমাদের কি দরকার ওদের দেখাশোনা করা?” রাগে গজগজ করতে করতে বললো সাবিহা।
“এইসব বলে না সাবিহা। ওনাদের এখন বয়স হয়েছে। এখন তাদের আমাদেরকে দরকার। আমরা না দেখলে কারা দেখবে বল?”

“আমি অতশত জানিনা, বুঝিনা। জানতে বা বুঝতে চাইও না। আমার ইচ্ছে করছে বাসায়ই থেকে যাই। কিন্তু সেটা সম্ভব না। মা বলেছে নানাবাড়িতে থাকতে। কিন্তু মামী যে কাহিনি করে গেছে, তারপর আর সেখানে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না।”
“আমার তো অনেক ভালো লাগছে। আমি সারাজীবন চার দেয়ালের মাঝে বন্দী ছিলাম। নানাবাড়ি দাদাবাড়ী কি জানিনা। এইবার একটা সুযোগ পেয়েছি। আমি তো আনন্দের সাথেই যাবো।”

সাবিহা আর কোনো কথা না বলে ভাজ না করেই ওর ব্যাগে টি-শার্ট ঢুকাচ্ছিল। সাগরিকা রুমে এসে ওকে একটা ধমক দিয়ে টি-শার্টগুলো বের করে থ্রি-পিস আর লং ফ্রক ওর হাতে ধরিয়ে দিল। মায়ার কাছে গিয়ে মায়াকেও দিল। সাবিহা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “এইসব দিচ্ছো কেন মা?”

“আমরা গ্রামে যাচ্ছি সাবিহা। ঐটা শহর না। আমাদের মন মানসিকতার সাথে ওখানের মানুষের মন মানসিকতা মিলবে না। তোমরা ঐখানে টি-শার্ট পড়ে থাকতে পারবে না। অনেকে অনেক কথা বলবে। চুপচাপ এগুলো নিয়ে নাও। আর হ্যাঁ, সাথে দুটো বইও নিবে। শুধু ওখানে গিয়ে ঢ্যাংঢ্যাং করে নাচলেই হবে না। পড়তেও হবে।”
“কিহ? আমি ওখানে গিয়ে নাচবো? আমি রুম থেকেই বের হবো না দেখে নিও। আবার তো নাচানাচি।”
“ওখানে গিয়েই সেটা দেখা যাবে।” একটা রহস্যময় হাসি দিয়ে বলে সাগরিকা।

সাবিহা তেজ দেখিয়ে সবকিছু রেখে বারান্দায় চলে যায়। সাগরিকা হতাশ হয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকলে মায়া তাকে আশ্বস্ত করে। সবার এইসব কর্মকাণ্ড দেখে সাব্বির চোখ গোলগোল করে সাগরিকাকে বলে,
“মা, আমিও কি শার্ট পড়তে পারবো না? আমি টিভিতে দেখেছি গ্রামে ছোট বাচ্চা ছেলেরাও লুঙি পড়ে। আমিও কি লুঙি পড়বো ওখানে গিয়ে? আমার জন্য লুঙি আনোনি?”
সাব্বিরের কথা শুনে মায়া আর সাগরিকা হাহা করে হাসতে থাকে। এমনকি বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা সাবিহাও।

“তাহলে গ্রামের ছুটিটা তুই গ্রামেই কাটাবি? ” কফির কাপে চুমুক দিয়ে কবিতা মায়াকে জিজ্ঞেস করলো।
“হুমম। আমি অনেক এক্সাইটেড। জীবনে এই প্রথম দাদাবাড়ি যাচ্ছি।”
“কখন রওনা দিবি আজকে?”
“রাতে।”
“কতক্ষণ লাগবে পৌছুতে?”

“সকালের দিকেই চলে যাবো। জ্যামে পড়লে হয়তো আরো সময় লাগবে।”
“আমি ভেবেছিলাম ঢাকার শহর দাপিয়ে বেড়াবো দুজনে মিলে।”
“নেক্সট টাইম। তোরা কোথাও যাবি না? তোদের গ্রামের বাড়ি নেই?”
“নাহ। আমাদের গ্রামের বাড়ি নেই। আমার বাপ দাদা চৌদ্দ পুরুষ ঢাকার শহরেই থেকেছে। আর আমার নানাবাড়ি মানে তো আমার নিজেরই বাড়ি। যদিও বাবাকে বাবা বলে ডাকতে আমার কম্ফর্টেবল লাগে না মোটেই।”
“কিন্তু যতো যাই হোক, সে তোর বাবা। তোর তাকে বাবা বলে ডাকা উচিত। ”

“জানি। কিন্তু তার প্রতি আমার সেইরকম মায়া-মমতা কাজ করে না। তবে, আমার ৩ টা ভাই-বোনের জন্য খুব খারাপ লাগে। সবচেয়ে বড় টাকে আমি অনেক আদর করতাম। কত ছোট ছিল। একদম পিচ্চি। আমি যখন হাসপাতালে দেখতে যাই, তখন আমাকে দেখেই ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে দিল৷ আমিই তখন ছোট। চার কি পাঁচ বছর বয়স তখন। বাবা আমাকে ওকে আমার কোলে দিলে অদ্ভুতভাবে ওর কান্না থেমে গেলো।

ও অনেক রোগা হয়েছিল। নতুন মা এর গর্ভাবস্থায় মা যথেষ্ট খাবার বা বিশ্রাম কিছুই পায়নি। তাই হয়তো এমন হয়েছিল। ভাইয়ের জন্মতে আমি বাবা খুশি হলেও দাদী খুশি হয়নি। আমাকে সবসময়ই বলতো তোর কপাল পুড়েছে রে। তোর কপাল পুড়েছে। বাবুকে বাসায় আনার পরও ওকে আদরও করেনি। নতুন মাকেও অনেক কাজ করতে হতো। বাবুটা অবশ্য আমার কাছেই থাকতো। আমি ওকে কোলে নিয়ে বসে থাকতাম।

একবার জানিস কি হলো, বাবুটার বয়স তখন ২ মনে হয়, খেলতে খেলতে পড়ে গেলো খাট থেকে। মুহুর্তেই মাথা ফেটে গলগল করে রক্ত পড়তে লাগলো। আমিও ছুটে গেলাম। কিন্তু খাটের কাছে যাওয়ার আগেই ওর ফেলে রাখা খেলনায় হোঁচট খেয়ে আমিও পড়ে গিয়ে ব্যথা পেলাম। আমি ভয়ে আর ব্যথায় চিৎকার করতে লাগলাম। নতুন মা আর দাদী এসে আমাদের এভাবে দেখে মা কে বললো আমাকে কোলে নিতে।

আদর করতে। দাদী আমাদের কাউকে না ধরে বাবুর খেলনাগুলো লাথি দিয়ে সরাতে সরাতে নতুন মাকে বকাঝকা করছিল। জানিস, নতুন মা তখন কি করেছিল? আমাকে আর বাবুকে দুহাতে আগলে নিয়ে ছুটে গিয়েছিল হাসপাতালে। তারপর ফোন দিল আমার ফুপিকে। বিচার -সভা সবই বসল।দাদীর বিরুদ্ধে মা হাজারটা অভিযোগ পেশ করলো। দাদীও কম যায় না। সেও আমাদের এই অবস্থার জন্য মায়ের খামখেয়ালিকে দায়ী করলো।

মা যদি সব কিছু গুছিয়ে রাখতো, তাহলে নাকি কারো কিছু হতো না। মা সেদিন তার উপর হওয়া সব অন্যায়ের জবাব দিল। ফুপি আর এই ঝামেলা সহ্য করতে পারছিল না। বাধ্য হয়েই আমাকে তার বাসায় নিয়ে এসেছিল। দাদী তবুও থামছিল না। শেষপর্যন্ত আমাকে দত্তকই নিয়ে নিলো। দাদীও বিছানায় পড়ে মাস সাতেক ভুগে উপরে চলে গেল। আমাকে বাবা ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিল, আমি যাইনি। কেন যাইনি আমি জানিনা। তবে, আমার ভাই আর বোনদের জন্য আমার সেখানে যেতে ইচ্ছে করে। আমার খুনশুটি করতে ইচ্ছে করে। তাইতো কাব্য ভাইয়া এতো বড় হয়েও আমার সাথে ঝগড়াঝাটি মারামারি করে।” কথাগুলো বলতে বলতে প্রায় কেঁদেই দিল কবিতা।

মায়া ওকে কাঁদতে দিল। সে জানে কাঁদলে মন হালকা হয়। তাই সে বাঁধা দিল না। প্রসঙ্গ ঘুরানোর জন্য মায়া বললো,”তোর জমজ বোনেরা কি একই রকম দেখতে?”
“নাহ। ওরা আলাদা। একটাকে দেখতে আমার মতো কিছুটা। আরেকটা ওর মায়ের মতো হয়েছে। ওরাও আমাকে অনেক পছন্দ করে। ঐ বাড়িতে গেলে আমাকে আসতে দিতে চায় না। ফুপির বাসায় আসলেও আর যেতে চায় না আমাকে রেখে৷ তাই আমি চাই যতো দূরে দূরে থাকা যায়, ততোই ভালো। কারণ, এই মায়াটা মোটেই ভালো নয়।”

“গ্রামে নেটওয়ার্ক কম থাকে কিন্তু কবিতা। আমাকে মেসেজ দিলে মাঝেমধ্যে নাও পেতে পারিস।”
“কল দিব।”
“অবশ্যই। ”
“এখানে কি হচ্ছে কি না হচ্ছে তোকে না জানানো পর্যন্ত আর তোর ওখানে কি কি হলো সেটা না জানা পর্যন্ত আমার পেটের ভাত হজম হবে না।”
“আসল কথা বল যে বকবক না করলে তোর পেটের ভাত হজম হবে না। “বলেই মায়া আর কবিতা খিলখিল করে হেসে উঠে।

রিজভী আহমেদ ভেবেছিল ট্রেনের টিকিট পাবে না। কিন্তু শেষ মুহুর্তে একজন টিকিট বাতিল করায় সে কেবিন পেয়েছে। তাও আবার ৪ টা বেডের৷ উপরে দুটো নিচে দুটো বেড। স্ত্রী,কন্যা,পুত্র নিয়ে আরামসে রাতে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে যেতে পারবে সেই কথা ভাবতেই সে খুশি হলো।সাবিহা এখনও মেজাজ গরম করে আছে। সাব্বির আর মায়া ভীষণ খুশি। সাবিহা রাগে গজগজ করতে করতে কেবিন এর উপরের বেডে গিয়ে শুয়ে পড়লো। সাব্বির বায়না ধরলে মায়া আর সাব্বিরকে উঠিয়ে দিয়ে মায়াকে বললো,” বেড শেয়ার করতে কষ্ট হবে না তো মায়া? ও ঘুমিয়ে গেলে ওকে আমাদের কাছে নিয়ে আসবো তাহলে।”

“আমি উপরে মায়া আপুর কাছেই শুবো বাবা।”
“আচ্ছা ঠিক আছে। আপুর কাছেই শোও।”
কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেন ছেড়ে দিল। হেলতে দুলতে ট্রেনটি চলতে শুরু করলো। একসময় গতি বাড়িয়ে দিল। সাগরিকা দোয়া পড়ে সবার বুকে ফু দিয়ে দিল। একসময় নিজেও শুয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে কাঁদা হয়ে গেল।

ঘুম নেই মায়ার চোখে। সে জেগে আছে। কবিতার কথা মনে পড়ছে তার। মায়া গতবারের কক্সবাজার ভ্রমনের কথা মনে করলো। তখন বাসে ভ্রমন করলেও কোনো আনন্দ পায়নি সে। সাবিহা তার প্রতি বিরক্ত ছিল। যাওয়ার সময় একটা কথাও বলেনি। বরং তাকে নিয়ে যাওয়ায় সবার সাথে রাগ করেছিল। আর এইবার?

এইবার তাকে অনুরোধ করেছিল তারা দুজন যেন বাসায় থাকে। ভাবা যায়? জীবন কখন কাকে কোন জায়গায় দাড় করায়? আজ মায়ার সবই আছে। সবই আছে। মায়ের কথা মনে পড়লো তার। যদি মা আজ থাকতো? নাহ, সে ভাবতে চায় না। কিছু কিছু মৃত্যু অনেকের জন্য সৌভাগ্য হয়ে আসে।

আমি মায়াবতী পর্ব ২১

যেমনটা তার মায়ের মৃত্যু তাকে একটা নতুন জীবন, একটা নতুন পরিবার দিয়েছে। তার বাবাকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশঙ্কা থেকে বাঁচিয়েছে। নানা-নানিকে কতশত গ্লানি থেকে বাঁচিয়েছে। মামার মতো মানুষের কাছে দুনিয়া থেকে একটা পাপ দূর হয়েছে। ভালোই হয়েছে মা মরে গেছে।নিজেকে বোঝায় মায়া। না হলে সে কি আজ এখানে থাকতো? তবুও, মা তো। কিভাবে ঘৃণা করবে সে?সাব্বিরকে একহাতে আঁকড়ে ধরে আরেক হাতে নিজের চোখের জল মোছার ব্যর্থ চেষ্টা করে সে।

আমি মায়াবতী পর্ব ২৩