ফেরারি প্রেম পর্ব ৬২

ফেরারি প্রেম পর্ব ৬২
নিশাত জাহান নিশি

রূপলের দিকে অমিমাংসিত প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে তাকে সম্পূর্ণ অবাক করে দিয়ে নীহারিকা গটগট করে হেঁটে রুম থেকে বের হয়ে গেল। তখনি রূপল হতভম্ব গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,
“হোয়াট?”

রূপলকে সম্পূর্ণরূপে বিভ্রান্তিতে ফেলে দিয়ে নীহারিকা মুখ টিপে হাসল। বেচারা রূপলকে বারো ঘাটের পানি খাওয়াবে সে! কবুল বলার আগ মুহূর্ত অবধি তাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে আঙরা করে ছাড়বে। সে তার এই সিদ্ধান্তে অনড়। তার এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার মূল উদ্দেশ্যই হলো রূপল যেন নেক্সট টাইম কোনো রকম ফালতু জেদ দেখানোর সাহস না পায়। হুটহাট কোনো অবিবেচকমূলক সিদ্ধান্ত নেওয়ার পূর্বে ভেবেচিন্তে নেয়। ভুল থেকে অন্তত ভালো কিছু যেন শিক্ষা পায়।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

দ্রুত পায়ে হেঁটে নীহারিকা বাড়ির সদর দরোজার দিকে চলে এলো। কৌতুহল নিয়ে রূপল হনহনিয়ে হেঁটে নীহারিকার পিছু নিলো। পেছন থেকে সে নীহারিকার ডান হাতটি টেনে ধরল। গরম দৃষ্টি নিক্ষেপ করল নীহারিকার আচমকিত মুখমণ্ডলে। তীক্ষ্ণ গলায় শুধালো,

“মিস এলিনা সম্পর্কে তুমি কীভাবে জানো?”
প্রত্যত্তুরে নীহারিকাও বেশ কড়া গলায় বলল,
“আচ্ছা আপনি আমাকে কী ভাবেন বলেন তো? এই একবছরে আমি আপনার কোনো খোঁজ খবর রাখিনি? এটলিস্ট আমি আপনার মতো সেলফিস নই ওকে? যে দূরে চলে গেলেই কাছের মানুষদের খোঁজ খবর নিতে ভুলে যাব।”
“হাউ স্ট্রেঞ্জ নীহু! তুমি ওখানে কার থেকে আমার খোঁজ খবর নিয়েছ?”

“এই বিষয়ে আমরা এখন না যাই ওকে? ভালো লাগছে না আমার কিছু। আপনি আসার পর থেকেই শুভ কাজে বাঁধা পরছে! একটা জিনিস মাথায় রাখবেন। আপনার উটকো ঝামেলার জন্য যেন আমার বিয়ে না ভেঙে যায়! বিয়ে নিয়ে আমি খুব সিরিয়াস। এতটাই সিরিয়াস যা আমি আপনাকে বলে বুঝাতে পারবনা! রাহুলের বিষয়টা যত দ্রুত পারুন সলভ করুন। আই রিপিট বড়ো কোনো ঝামেলা যেন না হয়।”

“রাহুলকে নিয়ে ঝামেলা হওয়ার কোনো চান্সই নেই। আচ্ছেমত ক্যালিয়েছি তাকে। আমার সম্পর্কে মুখ খোলার সাহসও পাবেনা সে! এই বিষয় নিয়ে আমি আপাতত ভাবছিনা। যদিও ঝামেলা হয়, এতে অবশ্য আমারই ভালো। অন্তত তোমার বিয়েটা তো ভাঙবে! আমি কোনো ক্রাইসিসে ফেঁসে গেলে তুমি নিশ্চয়ই হেসে হেসে বিয়ে করতে যাবেনা?”
“হাহ্। দিবাস্বপ্ন দেখছেন আপনি! আপনাকে পুলিশে ধরে নিয়ে গেলেও না? আমি আমার বিয়ে ভাঙব না। বিয়ে তো আমি করেই ছাড়ব!”

রূপলের হাতটা ঝেড়ে ফেলে দিলো নীহারিকা। মহা বিপাকে রূপল। যাওয়ার সময় নীহারিকা হতভম্ব রূপলকে সুমিষ্ট গলায় বলে গেল,
“বাড়ির সবাইকে নিয়ে সন্ধ্যা ছয়টার মধ্যেই আমাদের বাসায় চলে যাবেন। আপনার প্রাক্তনের বিয়ে বলে কথা একটু সেজেগুজে না গেলে হয় বলুন? আমি আন্টিকে বলে দিয়েছি আপনাকে একটা হলুদ রঙের পাঞ্জাবি দিতে! হলুদ পাঞ্জাবি পড়েই আপনি আমার হলুদে যাবেন ওকে?”

তেজী রূপ নিয়ে রূপল নীহারিকার মুখের উপর ঠাস করে দরোজাটি বন্ধ করে দিলো! দরোজায় জোরে এক লাথ মেরে সে দরোজার ঐ প্রান্তে অট্ট হাসতে থাকা নীহারিকাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“ভাগ আমার সামনে থেকে! আমি যাবই না তোর হলুদে!”

রূপলকে আর ঘাটাতে চাইলনা নীহারিকা! কম বিচ্ছেদে নিশ্চয়ই রূপল তাকে তুই তুকারি করেনি। হু হা করে হাসতে হাসতে নীহারিকা রূপলদের বাড়ি থেকে প্রস্থান নিলো। রিকশায় ওঠে কিছুক্ষণের মধ্যেই বাড়ি ফিরে এলো। লামিয়াদের বাড়ি থেকে আর কোনো শোরগোলের আওয়াজ শোনা যাচ্ছেনা। হয়ত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসে গেছে।
বাড়ি ফিরে নীহারিকা প্রথমে নিহালের সাথে দেখা করতে গেল। রুমে তখন পিয়াসাও উপস্থিত ছিল। নীহারিকাকে দেখে পিয়াসা অধৈর্য্য হয়ে উঠল। পেরেশানি গলায় নীহারিকার দিকে প্রশ্ন ছুড়ল,
“ওখানের কী খবর নীহারিকা? ভাইয়া ভালো আছে তো?’

মলিন হাসল নীহারিকা। পিয়াসাকে শান্তনা দেওয়ার উদ্দেশ্যে নরম সুরে বলল,
“ভালো আছে ভাবি। টেনশন করার কোনো কারণ নেই। তবে কিছু কিছু জায়গা একটু কেটে ছিঁড়ে গেছে৷ মেডিসিন লাগালেই ঠিক হয়ে যাবে। তুমি অযথা হাইপার হয়ো না।”
নিহাল সন্দিহান গলায় নীহারিকার দিকে প্রশ্ন ছুড়ল,
“বিয়েটা সুস্থভাবে করতে পারবে তো শালা?”

“পারবে না মানে? দৌড়াবে! আচ্ছা যাই হোক, এখন বলো তো রাহুলের কী খবর? দেখে এসেছ তাকে? বেশী ক্ষয়ক্ষতি হয়নি তো তার?”
“আরে ধ্যাত। তেমন সাংঘাতিক কিছু হয়নি! মাথা ফেটেছে অনেকখানি আর হাত-পায়ের কিছু কিছু অংশ কেটেছিঁড়ে গেছে। এই সামান্য বিষয় নিয়ে পুলিশ কেইসও হবেনা। তাছাড়া আমি যখন রাহুলকে দেখতে কেবিনে গেলাম তখন তার মধ্যে আক্রমনাত্নক ভাব দেখিনি! উল্টো আমাকে বলছিল তোর বিয়েটা যেন ভালোভাবে হয়! রূপলের ক্যালানি খেয়ে হয়ত বেচারা সোজা হয়ে গেছে।”

“হ্যাঁ হতে পারে।”
“আচ্ছা এখন এসব বাদ দে। মনে হয়না বিয়েতে কোনো ঝামেলা হবে। তুই নিশ্চিন্ত থাক। খেয়েদেয়ে কিছুক্ষণ ঘুমা। বিকেলে পার্লার থেকে মেয়েরা আসবে। সন্ধ্যায় হলুদ। সো হলুদের প্রিপারেশন নে।”
নিহালের কথায় সম্মতি জানালো নীহারিকা। রুম থেকে প্রস্থান নেওয়ার পূর্বে সে উদ্বিগ্ন গলায় ভাবুক পিয়াসাকে বলল,
“ভাবি? কাইন্ডলি একটু আন্টিকে ফোন করে বলবে রূপলের কাটাছেঁড়া জায়গাগুলোতে একটু মেডিসিন লাগিয়ে দিতে? একচুয়েলি আমি ইচ্ছে করেই তার প্রতি সিমপ্যাথি দেখাইনি! এতে হয়ত আমার ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল।”
“আচ্ছা আমি বলছি।”

ফোন হাতে নিয়ে পিয়াসাও যেইনা তাড়াহুড়ো করে নীহারিকার পিছু পিছু রুম থেকে বের হতে যাবে অমনি নিহাল পেছন থেকে মিহি স্বরে পিয়াসাকে ডাকল! ইতস্তত গলায় শুধালো,
“হলুদ শাড়ি আছে তোমার?”
পিছু ঘুরে পিয়াসা শূণ্য দৃষ্টিতে নিহালের দিকে তাকালো। ঝট করে নিহাল তার চোখ নামিয়ে নিলো! অনুভূতি কিছুতেই বুঝতে দেওয়া যাবেনা পিয়াসাকে। নির্জীব গলায় তখন পিয়াসা বলল,

“হুম আছে।”
“পার্লারের মেয়েরা এলে তাদের থেকে সাজগোজ করে নিবেন!”
“তুমি থেকে আপনি? আচ্ছা হোয়াটএভার! এত সেজেগুজে কী লাভ হবে বলুন? যে মানুষটি আমার সাজগোজ দেখবে, আমার সৌন্দর্য দেখবে সেই মানুষটিই তো আমাকে এখন ঘৃণা করে! তাই ওসব সাজগোজের আমার আর প্রয়োজন নেই।”
ভরাট গলায় কথাগুলো বলে পিয়াসা বুকভরা দুঃখ ও আক্ষেপ নিয়ে দ্রুত পায়ে হেঁটে রুম থেকে প্রস্থান নিলো। পিয়াসার যাওয়ার পথে তাকিয়ে নিহাল দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মাথা নুইয়ে গভীর অনুতাপে ভরা গলায় বিড়বিড় করে বলল,
“শাস্তি কী তবে বেশিই হয়ে গেল?”

রাত আটটা চলমান তখন। হলুদ কাপড়ে, হলুদের বাহারি ও চোখ জুড়ানো সাজে মাথায় বড়ো ঘোমটা টেনে নীহারিকা তার বেডরুমে বসে আছে। গরমে উসখুস করছে সে। ভারী মেকাপে অস্বস্তি বোধ করছে। এই প্রথম ব্রাইডাল সাজল সে। একটু তো হাসফাস লাগবেই। বাড়িতেও মেহমানরা গিজগিজ করছে। হৈ, হট্টগোল, শোরগোল হরদম লেগেই আছে। একটু পরেই নীহারিকাকে স্টেজে নিয়ে যাওয়া হবে। হলুদ পরানো হবে। পিয়াসাকে ধারে কাছে খুঁজে না পেয়ে নীহারিকা তার বেস্টফ্রেন্ড তুলি ও দিশাকে পাঠালো রূপলদের বাড়ি থেকে কেউ এলো কিনা তা এক নজর দেখে আসার জন্যে।

কয়েক মাস জেল খেঁটে আসার পর দিশা এখন পুরোপুরি ভালো হয়ে গেছে! নীহারিকার হাত-পা ধরে ক্ষমা চেয়েছে বহুবার। তাই নীহারিকা বাধ্য হয়ে দিশাকে আরও একবার সুযোগ দিয়েছে। এই তো পাঁচমাস আগে থেকেই নীহারিকা দিশার সাথে চলাফেরা করছে। এই অবধি খারাপ কিছু তার চোখে পরেনি। হয়ত মন থেকেই ভালো হয়ে গেছে দিশা।

সানি ও ইনভাইটেড ছিল নীহারিকার বিয়েতে! তবে কাজের ব্যস্ততার কারণে সে আজও এটেন্ড করতে পারেনি নীহারিকার গাঁয়ে হলুদে। তবে কাল বিয়েতে নিশ্চয়ই সানি এটেন্ড থাকবে। হাজার কাজের ব্যস্ততাও তাকে আটকে রাখতে পারবেনা। অতীতের সব কালো অধ্যায় ও রেশারেশি ভুলে তারা সবাই এখন ভালো বন্ধুত্বে পরিণত হয়েছে। বরং আগের চেয়েও তাদের বন্ধুত্ব আরও বেশী স্ট্রং হয়েছে।

প্রায় আধঘণ্টা অতিবাহিত হয়ে গেল। তবে দিশা ও তুলির ফেরার সাথে কোনো নাম গন্ধ নেই। এতক্ষণ লাগে নাকি একটা খবর নিয়ে আসতে? এত অলস ও অপদার্থ কেন তারা? কোনো কাজ হয়না তাদের দ্বারা। রূপল আদোতে তার হলুদে এলো কিনা এখনও জানতে পারলনা নীহারিকা। আর এজন্যই তো নীহারিকার মনটা কেমন ব্যাকুল হয়ে আছে।

বিরক্ত হয়ে নীহারিকা মাথা থেকে ঘোমটাটি খুলল। মুখশ্রীতে রাগী ভাব ফুটিয়ে তুলল। অমনি তার মনে হলো কেউ ঝড়ের বেগে দরোজা খুলে তার রুমে প্রবেশ করল। আচম্বিত ও হকচকানো দৃষ্টি ফেলে নীহারিকা দরোজার দিকে তাকাতেই দেখল হলুদ পাঞ্জাবি পড়ে কেউ একজন উল্টোদিক ফিরে রুমের দরোজায় খিল দিচ্ছে। চোখের পলকে পিছু ঘুরে দাড়ালো রূপল! ঠোঁটের কোণে লেগে আছে তার ক্রুর হাসির রেখা!চোখে বিরাজমান রসিকতা৷ কপালেও ব্যান্ডেড তার৷ হলুদ পাঞ্জাবিতে বেশ মানিয়েছে তাকে। কিন্তু হঠাৎ এমন মিচকে হাব ভাবের কারণ কী তার?

শঙ্কায় ডুবে গেল নীহারিকা। বিস্ফোরিত দৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে রইল রূপলের দিকে। রূপলকে দেখতে মোটেও উদাস বা বিষণ্ন মনে হচ্ছেনা! বেশ চনমনে ও দুষ্টু ভাব তার মধ্যে বিদ্যমান। রাতারাতি রূপলের এই পরিবর্তনের কারণ সে বুঝল না। ছ্যাকা খাওয়া ভাব পরিবর্তনের কারণ কী তার? দেবদাস থেকে হঠাৎ রোমিও ভাব? পাঞ্জাবির হাতা ভাজ করতে করতে রূপল এগিয়ে এলো নীহারিকার দিকে৷ ধপ করে বসল নীহারিকার পাশে। চোখ টিপে দিলো নীহারিকাকে! মাথাটা এগিয়ে আনল জড়তাগ্রস্ত নীহারিকার মুখের দিকে। বেসামাল দৃষ্টি নিক্ষেপ করল নীহারিকার মুগ্ধিত মুখশ্রীতে। ঠোঁট কামড়ে ডানপিটে গলায় বলল,

“হায়এ মেরি জান। তোমার হটনেস তো আমার বুকে আগুন জ্বালিয়ে দিলো! রূপের আগুনে প্রাক্তন প্রেমিকের দিলকে এতটা নির্মমভাবে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছ, না জানি তোমার বরের দিলকে কতটা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিবে তুমি! ইশশ! বেচারা কতটা লাকি। আমার তো তার গুড লাকের কথা চিন্তা করেই ভয়ঙ্কর জেলাস ফিল হচ্ছে!”

বুকে কম্পন শুরু হলো নীহারিকার! দুরুদুরু বুকে সে জায়গা থেকে হটতে লাগল। রূপল কোনোভাবে তার প্ল্যানিং ধরে ফেলল না তো? রাতারাতি এত নরমাল কীভাবে হয়ে গেল সে? নিশ্চয়ই প্ল্যানিংয়ে কোনো গন্ডগোল হয়ে গেছে। নীহারিকার পিছু হটা দেখে রূপল খপ করে নীহারিকার হাত চেপে ধরল। ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্ন ছুড়ল,
“নিজেকে খুব চালাক মনে করো তাইনা?”

শুকনো ঢোঁক গিলল নীহারিকা! মনে সংশয় কাজ করতে লাগল তার। তীরে এসে বুঝে তরী ডুবে গেল না তো? কাঠ কাঠ গলায় সে শুধালো,
“মামামানে?”
আগ্রাসী ভাব নিলো রূপল। নীহারিকার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“একদম পল্টি নিবা না আমার সাথে। কী ভাবছ? তুমি না বললে আমি কিছু বুঝতে পারব না? এতটাই বোকা আমি?”
“কী হইছে বলবেন তো?’

নীহারিকার হাত দুটো মেলে ধরল রূপল। দুই হাতের তালুতেই সূক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল সে। হুড়োহুড়ি করে নীহারিকা তার হাত দুটো গুটিয়ে নিলো! এই বুঝি ধরা পরে গেল সে৷ রাগ দেখিয়ে রূপল পুনরায় নীহারিকার হাত দুটো টেনে এনে মেলে ধরল। ভ্রু উঁচিয়ে তাকালো ধরে পড়ে যাওয়া নীহারিকার দিকে! প্রশ্ন ছুড়ল,
“তুমি কী ভেবেছ? এতকিছুর পরেও আমি বুঝতে পারবনা তোমার বর কে?”

ঝট করে অন্য পাশ ফিরে গেল নীহারিকা! জিভ কেটে কপাল চাপরাতে লাগল সে। এখন কথা ঘুরাবে কী করে সে? রূপলের নাম তো হাতে আর্ট করা তার! তবে মনে হচ্ছে শুধু এই থেকে নয় রূপল অন্য কোনো মাধ্যম থেকেও কিছু আঁচ করতে পেরেছে। তবে সেই মাধ্যমটা কী?

অকপট হেসে রূপল পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল নীহারিকাকে! শক্ত বাহুতে কোমর প্যাঁচিয়ে ধরল তার। হেয়ালি স্বরে বলল,
“তুমি চলো ডালে ডালে আর আমি চলি পাতায় পাতায় ওকে? আমাকে গোল খাওয়ানো এত সহজ নয় মিস নীহু রানী! কাল রাতেই তুমি আসল মজাটা টের পাবা! যখন তুমি আজীবনের জন্য শুধু আমার হবা।”
গরম শ্বাস ফেলল রূপল। নীহারিকার উষ্ণ শরীরের ছোঁয়ায় ক্রমশ সে উত্তেজিত হয়ে উঠছিল। রাগী ও ভীরু নীহারিকার পিঠে সে সম্মোহিত হয়ে নাক ঘঁষল। নেশায় আচ্ছন্ন গলায় বলল,

“আমি চাইলেও আজ বেশিক্ষণ তোমার আশেপাশে থাকতে পারবনা নীহু। অসম্ভব সুন্দরী দেখাচ্ছে তোমাকে। ঠিক যেন অপ্সরী। কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলছি আমি ইট’স ফ্যাক্ট! তাই যত কথা যত শাস্তি সব আগামীকালের জন্যই তোলা রইল! এখন তো আমি তোমাকে হলুদ পড়াতে এসেছি।”

নীহারিকাকে ছেড়ে বসল রূপল। টেবিলের উপরে থাকা হলুদের কৌটোটি থেকে হাত ভর্তি হলুদ নিলো। মুহূর্তের মধ্যেই বাকরুদ্ধ নীহারিকার দুই গালে আলতো করে হলুদ মেখে দিলো! টুপ করে নীহারিকার কপালে চুমু খেয়ে মিহি সুরে বলল,
“থ্যাংকস নীহু। আমাকে আরও একবার সুযোগ দেওয়ার জন্য। আমাকে আমার চেয়েও বেশী বুঝার জন্য! আমার ভালোবাসাকে সম্মান করার জন্য।”

হনহনিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল রূপল। ছুটে গিয়ে স্টোর রুমের দরোজা খুলে দিলো। হাঁপাতে হাঁপাতে বদ্ধ ও অন্ধকারাচ্ছন্ন স্টোররুম থেকে বের হয়ে এলো তুলি ও দিশা! বাঁকা হেসে রূপল তাদের দুজনের দিকে তাকালো। ভাবশূণ্য গলায় বলল,
“থ্যাকস অ্যা লট শালিকারা। সঠিক সময়ে সত্যিটা ফাঁস করার জন্যে!”
জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো রূপল। শঙ্কিত দৃষ্টি দিশা ও তুলি দুজন দুজনের দিকে তাকালো। শুকনো ঢোঁক গিলে সমস্বরে বলল,

“নীহা আজ আমাদের আস্ত রাখবে তো? জিজুর জালে তো আমরা পা দিয়ে ফেললাম! সব প্ল্যান ভেস্তে গেল নীহারিকার।”
ভীরু পায়ে হেঁটে দুজনই নীহারিকার রুমে প্রবেশ করল। রুমে ঢুকতেই দেখল নীহারিকা হলদে মুখে মারাত্মক রাগী ভাব নিয়ে তাকিয়ে আছে দিশা ও তুলির দিকে! এক্ষুণি বুঝি সপাটে দুটি চড় পরবে তাদের গালে! সেই বুঝে আগে থেকেই গালে হাত রেখে দিশা ভীতসন্ত্রস্ত গলায় নীহারিকাকে বলল,
“আমাদের কী দোষ বল? জিজুই তো আমাদের স্টোর রুমে আটকে রেখেছিল! বদ্ধ ঘরে দম হয়ে আসছিল আমাদের। তাইতো বাধ্য হয়ে সত্যিটা স্বীকার করলাম!”

ধপাধপ পায়ে হেঁটে নীহারিকা এগিয়ে এলো দুই আহাম্মকের দিকে। বদরাগী হয়ে কান মোচড়ে ধরল দুজনের। অমনি নাকমুখ কুঁচকে নিলো দিশা ও তুলি। খিটখিটে গলায় নীহারিকা বলল,
“তোদের জায়গায় যদি আমি থাকতাম না? মরে গেলেও সত্যিটা স্বীকার করতামনা। দুজনই হয়েছিস আহাম্মক! সত্যিটা স্বীকার না করলে নিশ্চয়ই রূপল তোদের মেরে ফেলত না? স্টোররুমে আটকে রাখা এটা তার ট্রেপ ছিল মাত্র। তোদের ভুলের জন্য আমার সব প্ল্যান মাঠে মারা গেল। কত ইচ্ছে ছিল কবুল বলার আগ মুহূর্তে বদরাগী ভীমরুলটাকে বলব বর সেজে আসতে! সারপ্রাইজ দিব তাকে! ধ্যাত, সব অনর্থ হয়ে গেল।”

যে যাই বলুক বা করুক না কেন রূপল আজ মহাখুশি! এক এক করে সে তার মা-বাবা থেকে শুরু করে পিয়াসা, নিহাল ও তার হবু শ্বশুড় শ্বাশুড়ি মা সবাইকে ধন্যবাদ জানালো! উদ্ভ্রান্তের মত সে সজল ও শাকিলের সাথে স্টেজে কতক্ষণ ধেই ধেই করে নাচানাচি করল! আত্নীয়স্বজন ও পাড়া প্রতিবেশী সবার কাছে এবার পরিষ্কার হলো রূপলই হতে যাচ্ছে নীহারিকার বর। বিয়ের দাওয়াত পাওয়ার পর থেকেই সবার মধ্যে কৌতূহল ও আগ্রহ কাজ করছিল যে কে হতে পারে নীহারিকা বর। অবশেষে সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটল।

খুশিতে দুই হাতে টাকা ছিটাতে লাগল রূপল! শাকিল ও সজলকে টাকা দিলো ব্যাচালর পার্টির এরেঞ্জমেন্ট করতে। সেখানে রূপলের এলকার সব ভাই ব্রাদারস থেকে শুরু করে উজ্জ্বলকে ও সাথে রাখার প্ল্যানিং করল রূপল! মাস চারেক হলো সুইটিকে বিয়ে করেছে উজ্জ্বল! সময়ের সাথে সাথে সুইটিকে মানিয়ে নিয়েছে সে। সুইটির নিঃস্বার্থ ভালোবাসার কাছে হার মেনেছে। নোংরা মনমানসিকতা পাল্টে নিজেকে যতখানি সম্ভব শুধরে নিয়েছে। কানাডায় যাওয়ার প্রায় পাঁচ থেকে ছয় মাস পর উজ্জ্বল নিজে থেকেই রূপলের সাথে যোগাযোগ করে। তার খারাপ ব্যবহারের জন্য রূপলের কাছে ক্ষমা চায়। মোটামুটি তাদের মধ্যে ভালো একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

নীহারিকার হলুদের অনুষ্ঠানে সবাই বেশ সাজুগুজু করলেও পিয়াসা বিধবার মত ঘুরে বেড়াচ্ছে! না আছে তার পরনে হলুদের রঙচঙা শাড়ি না আছে কোনো সাজগোজ। নিহাল অনেকক্ষণ যাবত সুযোগ খুঁজছিল পিয়াসাকে একা পাওয়ার। রাগে গজগজ করছে সে। নিহালের কথা অমান্য করল সে? এর বড়ো স্পর্ধা তার? সুযোগ পেতেই নিহাল ভীড়ের মাঝখান থেকে পিয়াসাকে টেনে নিয়ে এলো তাদের বেডরুমে!

ফেরারি প্রেম পর্ব ৬১

বিস্ফোরক হয়ে পিয়াসা তাকিয়ে রইল হম্বিতম্বি করতে থাকা নিহালের দিকে। দরোজার খিল আটকে নিহাল আগুন ঝরা দৃষ্টিতে তাকালো পিয়াসার দিকে। বাজখাঁই গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,
“কী ব্যাপার? কথা কানে যায়না আমার? কতবার করে বলেছি আজ একটু সেজেগুজে থাকতে? শুনেছ আমার কথা?”

ফেরারি প্রেম পর্ব ৬৩