ফেরারি প্রেম পর্ব ৬১

ফেরারি প্রেম পর্ব ৬১
নিশাত জাহান নিশি

“থ্যাংকস মিস্টার বাঘা রূপল। আমার কাজটা আরও সহজ করে দিলেন আপনি। আমার হাতের মেহেন্দি আপনার হাতেও লেগে গেল এখন! ইশ, এটাই তো চাইছিলাম আমি!”

গটগটিয়ে হেঁটে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল রূপল। মেজাজ তার তুঙ্গে। গরম ধোঁয়া নিঃসরন হচ্ছে তার কানের ছিদ্র থেকে। মেইন রাস্তায় ওঠে সে আশেপাশে সর্তক দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। তখনি টং দোকানের ভেতর আকস্মিক দৃষ্টি পড়ল তার। সেখানে সজল ও শাকিলকে দেখতে পেল। তাদের পাশেই রয়েছে রূপলের ল্যাকেজগুলো। তা দেখেই যেন মেজাজটা আরও চওড়া হয়ে গেল রূপলের। এখনও তার ল্যাকেজগুলো বাড়িতে পৌছালো না তারা? কত গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র আছে এই ল্যাকেজগুলোতে তাদের কোনো ধারণা আছে?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

রাস্তা পাড় হয়ে রূপল দোকানের ভেতর ঢুকল। রূপলকে দেখামাত্রই দুজন ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে উঠল। বেঞ্চি থেকে ওঠে সোজা হয়ে দাড়ালো। ক্ষিপ্র ভাব নিয়ে রূপল দুজনের মুখোমুখি দাড়ালো। সজল তার শার্টের কলারটি ঠিক করল। আমতা আমতা স্বরে বলল,

“প্লিজ বিলিভ মি ভাই আমি সত্যিই জানিনা নীহারিকা আপুর উডবি কে। খামোখা নীহারিকা আপু আমাকে ফাঁসাচ্ছে। আই ডোন্ট নো কেন এমন করছে।”
সেই প্রসঙ্গে যেতে চাইলনা রূপল। কারণ তার নিশ্চিন্তভাবে বুঝা হয়ে গেছে নীহারিকা তার মাথা ঘুরানোর চেষ্টা করছে। আলাভোলা সজলকে তার প্ল্যানে কাজে লাগিয়েছে! কিছুতেই ঐ ধুরন্দর মেয়ের জালে পা দেওয়া যাবেনা। নতুন করে নীহারিকাকে চেনার মত কিছুই নেই তার। এখন যা করতে হবে নিজের বুদ্ধিতেই করতে হবে। তাই রূপল খামোখা বেচারার সাথে চোটপাট করতে চাইলনা। প্রসঙ্গ পাল্টে সে চোয়াল উচিয়ে অশান্ত গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,

“এত ইররেসপন্সিবল কেন তোরা? ল্যাকেজগুলো এখনও বাড়িতে পৌছে দিতে পারিসনি? দায়িত্ব জ্ঞান বলতে কিছু আছে তোদের মধ্যে?”
ইতস্তত গলায় পাশ থেকে শাকিল বলল,
“সরি ভাইয়া। একচুয়েলি আমরা ভাবছিলাম তুমিও হয়ত আমাদের সাথে বাড়িতে যাবা। তাই…
“না। এখন আমি বাড়িতে যাচ্ছিনা। সময় হলে যাব। তাছাড়া এখন যদি আমার বাড়িতে যাওয়ারই ছিল নিশ্চয়ই তোদের এই দায়িত্বটা দিতাম না?”

“বড়ো আম্মুর সাথে দেখা করবা না?”
“সময় তো চলে যাচ্ছেনা তাইনা? অনেক সময় পড়ে আছে মায়ের সাথে দেখা করার। এখন আমি একটা মিশনে নেমেছি ওকে? মিশন সাকসেস হলে দেন আমি বাড়ি ফিরব। ল্যাকেজগুলো নিয়ে কেয়ারফুললি বাড়ি যা তোরা। অনেক ইম্পর্টেন্ট জিনিসপত্র আছে ল্যাকেজগুলোতে। আমি না আসা অবধি আনবক্সিং করবিনা ওকে?”

সজল ও শাকিলকে বুঝিয়ে শুনিয়ে রূপল ল্যাকেজপত্র সমেত তাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিলো। দিশেহারা হয়ে রূপল টং দোকানের বেঞ্চিতে বসল। গরম গরম এক কাপ চায়ের অর্ডার করল। চা খেয়ে মাথাটা একটু ঠিক করতে চাইল। কার থেকে সঠিক খবরটা জানতে পারবে সেই চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠল। নীহারিকার মুখ থেকে তো কিছুতেই সত্যি কথাটা বের করা যাবেনা৷ তার ফ্যামিলির অন্য কারো কাছ থেকেও হেল্প নেওয়া যাবেনা।

রূপলের ধারণামতে, প্রতিশোধ নেওয়ার চক্করে পরে নীহারিকা জীবনের মস্ত বড়ো এক ভুল করতে যাচ্ছে! রূপলকে ছাড়া যে নীহারিকাও সুখি হবেনা সে বিষয়ে রূপল শতভাগ নিশ্চিত। তাইতো নীহারিকার বিয়ে ভাঙার পেছনে এতটা কঠোরভাবে ওঠে পড়ে লেগেছে সে। তার চেয়ে বড়ো কথা হলো রূপল নীহারিকাকে ছাড়া থাকতে পারবেনা। যদিও এখানে থাকতে না পারার প্রসঙ্গই উঠছেনা। কারণ, রূপল কিছুতেই নীহারিকাকে তার কাছ থেকে আলাদা হতে দিবেনা। রূপলের মনে মনে কোথাও না কোথাও জানা আছে রূপলের ভাগ্য নীহারিকার সাথেই জুড়ে আছে! আর ভালো কাজে বাঁধা আসবে এটাই স্বাভাবিক।

দুঃশ্চিন্তা ও হতাশায় জর্জরিত হয়ে রূপল একটি সিগারেট ধরালো। ঘামে সিক্ত চুলগুলো পেছনের দিকে টেনে ধরে অধৈর্য্য হয়ে সিগারেটটিতে প্রথম ফুঁক দিলো। তখনি রূপল অপ্রত্যাশিতভাবে লামিয়ার বড়ো ভাই রাহুলকে দেখতে পেল! রাহুলকে একনজর দেখা মাত্রই রূপল উত্তেজিত হয়ে উঠল। সিগারেটটি ঠোঁটে চেপে ধরে বসা থেকে ওঠে দাড়ালো। রাহুলের মুখোমুখি দাড়ালো। দাঁতে দাঁত চেপে অস্পষ্ট গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,
“তোকে না লাস্ট টাইম ওয়ার্নিং দিয়েছিলাম আমার চোখের সামনে না পরতে?”

নতজানু হয়ে গেল রাহুল! তেজী রূপলের দিকে সে দ্বিধাগ্রস্ত দৃষ্টিতে তাকালো। ভয় কাজ করছিল তার মনের ভেতর। কয়েক মুহূর্ত পর সে শুকনো ঢোঁক গিলল। নরম সুরে বলল,
“প্লিজ রূপল। অতীতে যা হয়েছে সব ভুলে যাও। তোমার বোনের সাথে আমি যা করেছিলাম পাপ করেছিলাম। তার শাস্তি তো আমি পেয়েই গেছি তাইনা? টানা দুইমাস আমাকে জেল খাটতে হয়েছিল। নিহাল ভাই ও তুমি কেউ কিন্তু আমাকে একরত্তিও ছাড় দাওনি। নীহারিকার প্রমাণের কাছে সেদিন আমাকে হারতে হয়েছিল। আমি এখন আমার ভুল বুঝতে পেরেছি রূপল। প্রতিনিয়ত নিজেকে সংশোধন করার চেষ্টা করছি। একচুয়েলি আমার বাড়ির ছাদ থেকে অনেকক্ষণ যাবত লক্ষ্য করছিলাম তুমি কিছু একটা নিয়ে বেশ টেনশনে আছো! আমি কী কোনোভাবে তোমাকে হেল্প করতে পারি?”

রাহুলের সহজ সরল ও অসহায় হাবভাব দেখে রাহুলকে অবিশ্বাস করার কোনো কারণই খুঁজে পেলনা রূপল। তবুও তার মনে সন্দেহ কাজ করছিল! অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ না হয়ে দাড়ায় সেই জন্যে। রাহুলকে উপেক্ষা করে রূপল উল্টো দিকে ফিরে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে বেঞ্চিতে এসে বসল। পায়ের উপর পা তুলে রাহুলকে উদ্দেশ্য করে তীক্ষ্ণ স্বরে বলল,
“উঁহু। তোকে বিশ্বাস করার কোনো মানেই খুঁজে পাচ্ছিনা আমি। আপাতত আমার সামনে থেকে দূর হ৷ তোকে দেখে আমার মেজাজের আরও বারোটা বেজে যাচ্ছে।”

তবুও বেহায়ার মত রাহুল একই জায়গায় দাড়িয়ে রইল। রূপলের সহানুভূতি পাওয়ার চেষ্টা করল। নির্ভীক পায়ে রূপলের দিকে দু-কদম এগিয়ে এলো। শার্টের কলার ঠিক করে গলা ঝাকিয়ে বলল,
“আমি হয়ত জানি রূপল। তুমি একচুয়েলি কী নিয়ে চিন্তা করছ।”
ভ্রু যুগল সংকুচিত করে রূপল সবজান্তা ভাব নিয়ে দাড়িয়ে থাকা রাহুলের দিকে তাকালো। কপাল কুঁচকে ভাবশূণ্য গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,

“কী জানিস বল?”
“নীহারিকার উডবি কে আমি জানি রূপল!”
সদিশ্বাস খুঁজে পেল রূপল। এতক্ষণ তো রূপল এই হেল্পটিই কারো কাছ থেকে চাইছিল। একমাত্র রাহুলই হয়ত তাকে হেল্প করতে পারবে। বিশ্বাস অবিশ্বাসের ব্যাপারে পরে যাওয়া যাবে আগে তো সে জানুক নীহারিকার সো কল্ড উডবিটি কে। ঝট করে হাত থেকে সিগারেটটি ফেলে দিলো রূপল। কৌতূহলী হয়ে বসা থেকে ওঠে দাড়ালো। রাহুলের মুখোমুখি দাড়িয়ে আগ্রহী গলায় শুধালো,

“কে? নাম বল তার?”
“শুধু নাম কেন ঠিকানা দিলেও তুমি তাকে চিনবেনা।”
“মানে? চিনব না কেন?”
“তুমি বরং আমার সাথে চলো রূপল। আমি তার বাড়িতে তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি। ছেলে আমার রিলেটিভ। সরাসরি কথা বলার সুযোগ করিয়ে দিব! এতে তোমারই হেল্প হবে।”
সেই সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইলনা রূপল! হঠকারীতায় ফেঁসে গেল সে। রাত তখন দশটা পেরুলো। সময়ের দিকে লক্ষ্য নেই তার। আশ্বম্ত হয়ে রাহুলের কাঁধে হাত রাখল সে। হুড়োহুড়ি করে টং দোকান থেকে বের হয়ে গেল। দ্রুত স্বরে রাহুলকে বলল,
“কাম অন ফাস্ট।”

সকাল সকাল পাশের বাড়ি থেকে শোরগোলের আওয়াজ শোনা গেল। দীর্ঘ দেড় বছর পর হওয়া সুন্দর ও মজার ঘুমটি এক নিমিষেই ভেঙে গেল নীহারিকার। বড্ড আফসোস হচ্ছে যেমন, তেমনি ভীষণ রাগও হচ্ছে তার। কী এমন হলো পাশের বাসায়? যে সকাল সকাল এত চিৎকার চ্যাচাম্যাচি করতে হলো? নীহারিকার ধারণামতে, লামিয়াদের বাসা থেকে চিৎকারের আওয়াজ ভেসে আসছে! সাংঘাতিক কিছু একটা হয়েছে বোধ হয়। শোয়া থেকে ওঠে বিছানায় বসল নীহারিকা। ফোঁস করে শ্বাস ফেলল। শরীরের আড়মোড়া ভেঙে ঘুম ঘুম চোখে তার মেহেন্দি রাঙা হাতটির দিকে তাকালো। অমনি মনটা নেচে উঠল তার। রাগ নিমিষেই ভুলে গেল। ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল মৃদু হাসির রেখা। প্রশান্ত গলায় বলল,

“ইশশ। কত গাঢ় হয়েছে মেহেন্দির রঙটা। যদিও কিছু কিছু জায়গা লেপ্টে গেছে! থাক কোনো ব্যাপার না। রঙটা তো গাঢ় হয়েছে? এই অনেক। তার মানে মানুষ খেঁকো রূপল আমাকে অনেক ভালোবাসবে?”
জিজ্ঞাসা নিয়ে লজ্জায় মাথা নুইয়ে নিলো নীহারিকা! চিৎকারের আওয়াজ তখন ক্রমশ বাড়তে লাগল। মনে হচ্ছে যেন কেউ হাপিত্যেশ করে কান্নাকাটি করছে। এবার আতঙ্কিত হয়ে উঠল নীহারিকা।

জায়গায় আর বসে থাকতে পারলনা সে। জানালার থাই খুলে লামিয়াদের বাড়ির নিচতলায় সূক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই দেখল লামিয়া ও তার মা কান্নাকাটি করছে! আশেপাশে এলাকার মানুষজন ভীড় জমিয়ে দাড়িয়ে আছে। তাদের মধ্যে আবার নিহালকেও দেখা যাচ্ছে! বেশ অস্থির হয়ে ফোনে যেন কার সাথে কথায় ব্যস্ত সে। মনটা খচখচ করে উঠল নীহারিকার। উদ্বিগ্ন হয়ে সে বাড়ি থেকে বের হয়ে লামিয়াদের বাড়িতে চলে এলো। ভীড় ঠেলে নিহালের মুখোমুখি দাড়ালো। অধীর গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,

“কী হয়েছে ভাইয়া?”
কান থেকে ফোনটি নামাল নিহাল। উদগ্রীব হয়ে কপাল ঘঁষল। নীহারিকার দিকে সরু দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। আগ্রাসী গলায় বলল,
“রাহুলের অবস্থা খারাপ! হসপিটালে ভর্তি।”
“হ্যাঁ। তো এতে আমাদের কী? গুন্ডামী করতে গিয়ে হয়ত ছেঁচা খেয়েছে! তুমি এখানে কী করছ? তার হয়ে তুমি এখানে কী করছ?”

“আরে আমাদেরই তো সব! তুই জানিস এই কান্ড কে ঘটিয়েছে?”
“কে?”
“তোর উডবি!”
হতভম্ব হয়ে গেল নীহারিকা। কপাল কুঁচকে নিলো সে। মুখশ্রীতে উত্তেজিত ভাব ফুটিয়ে তুলল। অশান্ত গলায় শুধালো,
“রূপল?”
“ইয়েস! এবার আর রক্ষে নেই কারোর। রূপল কেন এমনটা করতে গেল বলতো? কালই তোদের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। এরমধ্যে এই উটকো ঝামেলা। ভাল্লাগে বল?”

নিজেকে শান্ত রাখল নীহারিকা। কয়েকদফা রুদ্ধ শ্বাস ফেলে অস্থিরতাকে দমন করল। হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ অবস্থা থেকে ছাড়িয়ে নিলো। স্বাভাবিক সুরে বলল,
“রূপল নিশ্চয়ই এমনি এমনি কিছু করেনি ভাইয়া। এর পেছনেও নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। কুকুরের লেজ কখনও সোজা হতে শুনেছ? রাহুল হলো সেই কুকুর, যার লেজ কখনও সোজা হবেনা। আমি এখনি ঐ বাড়িতে যাচ্ছি। রূপল ঠিক আছে কিনা সেটাও তো আগে দেখতে হবে তাইনা?”

“কলে ও পাচ্ছিনা তাকে। ঐ বাড়ির কেউ-ই কল তুলছেনা।”
“আচ্ছা আমি যাচ্ছি ঐ বাড়িতে। তুমি না হয় এই দিকটা সামলাও ভাইয়া। আমি ঐ দিকটা সামলাচ্ছি। তবে কিছুতেই বিয়ের ডেইট কিন্তু পেছানো যাবেনা! আজ হলুদ, কালই আমাদের বিয়ে।”
“ওকে। বাট আগে কনফার্ম হ রূপলের কিছু হলো কিনা। সে সেইফ থাকলে আমার কোনো সমস্যা নেই।”

হন্তদন্ত হয়ে নীহারিকা বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই রূপলদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল। মনে আশঙ্কা, দুঃশ্চিন্তা ও ভয় নিয়ে সে মিনিট ত্রিশেকের মধ্যে রূপলদের বাড়ির সামনে এসে পৌছে গেল। রিকশা ভাড়া চুকিয়ে সে বাড়ির ভেতর ঢুকে গেল। বাড়ির কেউ এখনও ঘুম থেকে ওঠেনি! সবাই যেন নাকে তেল দিয়ে ঘুমুচ্ছে। মেজাজ খারাপ হয়ে গেল নীহারিকার!

কলিংবেল বাজতেই কাজের বুয়া এসে সদর দরোজা খুলে দিলো। অধীর হয়ে নীহারিকা দ্রুত পায়ে হেঁটে রূপলের রুমের সামনে এসে দাড়ালো। দরোজায় হাত লাগাতেই দরোজাটি খুলে গেল। রুমের ভেতর প্রবেশ করতেই দেখল রূপল বিছানার উপর উবুড় হয়ে শুয়ে আছে। উন্মুক্ত শরীর তার। পিঠের কিছু কিছু অংশ কাটাছেঁড়া! রক্ত শুকিয়ে গেছে। চুলেও রক্ত লেগে আছে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে মোটামুটি আহত হয়েছে সে।
ঘাবড়ে উঠল নীহারিকা। ছুটে এলো সে রূপলের কাছে। বিচলিত হয়ে রূপলের পাশে বসল। কাটা জায়গাগুলোতে কাঁপা কাঁপা হাত ছোঁয়াতেই রূপল কেঁপে উঠল! ঘুমের ঘোরেই সে ব্যথযুক্ত গলায় বলল,

“প্লিজ ডোন্ট টাচ।”
নীহারিকা হঠাৎ উগ্র হয়ে উঠল! শঙ্কিত ও চিন্তিত মুখভঙ্গি পাল্টে সে তেতে উঠল। হঠাৎ তার মন পরিবর্তনের কারণ সে নিজেও বুঝতে পারলনা। দাঁত গিজগিজ করে সে কাঁটা জায়গাগুলোতে জোরে চাপ দিয়ে ধরল! অমনি রূপল ‘উফ’ বলে আর্তনাদ করে উঠল! চোখ বুজেই সে আর্ত গলায় ‘কে’ বলে মৃদু চিৎকার করে উল্টো পাশের মানুষটিকে ঘুরিয়ে তার দিকে নিয়ে এলো। বিছানায় শুইয়ে দিলো নীহারিকাকে। ঘটনার আকস্মিকতায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল নীহারিকা।

আহত অবস্থাতেও এই লোকের গাঁয়ে এত শক্তি? তাজ্জব দৃষ্টি ফেলে নীহারিকা রূপলের দিকে তাকিয়ে রইল। চোখ খুলল রূপল। নীহারিকাকে তার চোখের সামনে দেখামাত্রই তার হিংস্র দৃষ্টি শিথিল হয়ে এলো। হকচকিয়ে ওঠে সে শোয়া থেকে ওঠে বসল। ঘুমের ঘোর ভেবে চোখ কচলালো। পুনরায় সামনে স্বচ্ছ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। সত্যিই নীহারিকা তার সামনে শুয়ে?

আবেগী হয়ে রূপল নীহারিকাকে জড়িয়ে ধরার পূর্বেই নীহারিকা ঝট করে শোয়া থেকে ওঠে বসল! মুখে গম্ভীর ভাব ফুটে উঠল রূপলের। নীহারিকার দিকে সে অভিমান ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। রিক্ত সুরে বলল,
“সিরিয়াসলি নীহু? আমি কী এতটাই ঘৃণা পাওয়ার যোগ্য?”

কপাল কেটে ক্ষত হয়ে আছে রূপলের। গলায় ও বুকে নখের আঁচড়ের দাগ। এসব কাটাছেঁড়া দেখে নীহারিকার মাথা গরম হয়ে গেল। আজ বাদে কাল তার বিয়ে। অথচ সম্পূর্ণ শরীর তার জখমে ভরা? কী এমন দরকার ছিল রাহুলের সাথে ফাইট করা? ক্রমশ আক্রমনাত্নক হয়ে উঠল নীহারিকা! রূপলের দিকে তেড়ে এলো সে। দয়ামায়া ভুলে চোয়াল উঁচিয়ে প্রশ্ন ছুড়ল,
“রাহুল ভাইয়ার সাথে ফাইট কেন করলি তুই? কী হয়েছিল কাল তোদের মধ্যে বল?”

রাহুলের কথা শুনতেই রেগে উঠল রূপল। ফ্যাকাসে মুখশ্রী তার রাগে রঙিন হয়ে উঠল। ক্ষোভ জড়ানো গলায় বলল,
“আরে ধ্যাত। তার বিষয়ে কথা বলার কোনো ইন্টারেস্ট নেই আমার।”
“ইন্টারেস্ট না থাকলেও বলতে হবে আপনাকে। বলুন কাল কী হয়েছিল?”
“হঠাৎ তুই থেকে আপনিতে কেন? ভদ্রতা বজায় রাখার কোনো প্রয়োজন নেই আমার সাথে! তুই করেই বলুন। এজ অলওয়েজ আমি তুই তুকারি শোনারই যোগ্য!”

বিষণ্ন মনে রূপল বসা থেকে ওঠে দাড়ালো! নীহারিকার উল্টোদিকে ফিরে দাড়ালো। ক্ষেপে এসে নীহারিকা রূপলের মুখোমুখি দাড়ালো। কোমরে এক হাত গুজে তটস্থ গলায় বলল,
“আমার যখন যা ইচ্ছা হবে আমি তখন আপনাকে তাই বলেই সম্বোধন করব! ইট’স মাই পার্সোনাল ম্যাটার। তাছাড়া আপনি এমন কোনো ভালো কাজ করেননি, যার জন্য আপনার সাথে আমার মিষ্টি ভাষায় কথা বলতে হবে। সবার শরীরেই রাগ থাকে, জেদ থাকে তবে তা প্রয়োজনের চেয়ে বেশী দেখালে সেটাকে আমি মূর্খতা মনে করি। যে সর্বনাশা জেদ মানুষের জীবনে ক্ষতি বয়ে আনে সে জেদকে আমি ঘৃণা করি। কী করতে পেরেছেন অহেতুক জেদ দেখিয়ে বলুন? উল্টো নিজের ক্ষতি করেছেন, সবার মন থেকে ওঠে গেছেন, ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে ঘৃণা পেয়েছেন। এইতো কাল বাদে পরশুই আপনার চোখের সামনে দিয়ে আমি অন্য একজনের হাত ধরে….

আর কিছু বলতে দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হলোনা নীহারিকাকে। চিতা বাঘের ন্যায় ক্ষেপে ওঠে রূপল নীহারিকার মুখ চেপে ধরল! চোখে জ্বলন্ত শিখা নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে সে ভীতু নীহারিকাকে শাসিয়ে বলল,
“অন্য কারো হওয়ার আগেই তুই আমার হাতে খুন হবি! তোকে খুন করার পর আমি নিজে খুন হব! ইহকালে না হোক পরকালে তুই আমার হবি। উপর ওয়ালা প্রতিবার আমার সাথে অবিচার করবেনা। আর এটা আমার বিশ্বাস।”

দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হলো নীহারিকার। চোখে বিপর্যের ছাপ। ঝট করে হাত নামিয়ে নিলো রূপল। পিছু ঘুরে কম্পিত হাতে প্যান্টের পকেট থেকে একটি সিগারেট বের করল। সিগারেটটি জ্বালিয়ে লম্বা একটি ফুঁক দিলো। নাকমুখ থেকে ধোঁয়া উড়িয়ে বিষাদে ডুবুডুবু নীহারিকাকে বলল,
“এত সকালে হঠাৎ আমার বাড়িতে আসার কারণ কী? রাহুলের সাথে বুঝাপড়া আমরা। আমাদের মধ্যে যা হয়েছে তা আমরা দুজন বুঝে নিব। এতে তৃতীয় ব্যক্তির এত কৌতূহল কেন?”

নীহারিকার চোখ থেকে তখন অনবরত জল গড়িয়ে পরছিল! বিষণ্নতায় নিমজ্জিত হয়ে থাকলেও সে হিংস্র গলায় রূপলকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আমি একবার বারণ করেছি আমার সামনে সিগারেট না ফুঁকতে।”
“ইট’স মাই পার্সোনাল ম্যাটার! আমার সামনে থাকতে অস্বস্তি লাগলে প্লিজ আপনি চলে যেতে পারেন!”
কথাগুলো প্রচণ্ড গাঁয়ে লাগল নীহারিকার। রাগ জেদ আরও ভয়াবহভাবে বাড়ল তার। রূপলকে ঘুরিয়ে সে তার মুখোমুখি এনে দাড় করালো। চোখ রাঙিয়ে থুতনী চেপে ধরল রূপলের! খরতর গলায় শুধালো,

“একটু আগেই তো বলেছিলি না? আমাকে না পেলে তুই মরে যাবি! এখন আবার নিজের মত পাল্টে নিয়েছিস কেন? আমাকে তোর সামনে থেকে চলে যেতে বলছিস? এই তোর ভালোবাসা? খুব অহংকার তোর তাইনা? ভালোবাসার চেয়েও রাগ, অভিমান, অহংকার বড়ো তোর? দেড় বছর আগে যে ভুলটা করেছিলি আজ আবার তার রিপিট করছিস?”

হাত থেকে সিগারেটটি ফেলে দিলো রূপল। ক্লান্ত ও আবেগঘন হয়ে সে ঝট করে নীহারিকাকে জড়িয়ে ধরল! এতটাই শক্ত করে নীহারিকাকে জড়িয়ে ধরল যে বুকের ভেতর অনায়াসে ঢুকিয়ে ফেলছিল তাকে! অসহায় হয়ে ভরাট গলায় বলল,
“আমি পারছিনা আর তোমাকে ছাড়া থাকতে। খুবই ক্লান্ত, বিষণ্ন, ব্যর্থ প্রেমিক আমি। সব ভুলের পরেও আমি নির্লজ্জের মত তোমার কাছেই একটুখানি শান্তি চাই, স্বস্তি চাই, ঠাঁই চাই। প্লিজ আমাকে বাঁচতে সাহায্য করো। মৃত্যুর পথে আর ঠেলে দিওনা আমাকে।”

রাগ শিথিল হয়ে এলো নীহারিকার। রূপলকে কাছে পেয়ে তার শরীরের সমস্ত জ্বালা দূর হয়ে গেল। দেহ মন প্রশান্তিতে পরিপূর্ণ হয়ে উঠল। চোখ বেয়ে সুখের অথৈ জল গড়াতে লাগল। সেই জলে ভিজে একাকার হয়ে যাচ্ছিল রূপলের বুকের পাঁজর। সেই সাথে নীহারিকা উপলব্ধি করতে পারছিল রূপলের সুখের তীব্রতাও। অন্তর্দহন থেমে গেল। স্বস্তির জায়গা খুঁজে পেয়ে রূপল যেন তার শরীরের সমস্ত ভর নীহারিকার গাঁয়ের উপর ছেড়ে দিচ্ছিল। শীতল গলায় তখন নীহারিকা তাকে শুধালো,

“রাহুলের সাথে কাল কী ঘটেছিল প্লিজ বলুন?”
“বিলিভ মি নীহু আমি ইচ্ছে করে কিছু করিনি। রাহুলের ইন্টেশনই খারাপ ছিল। আমার ক্ষতি করতে চেয়েছিল সে। যাকে বলে রিভেঞ্জ।”
“তার ইন্টেশন খারাপ জেনেও আপনি কেন তার সাথে গেলেন? কী কারণে গেলেন?”
“মাথা কাজ করছিলনা তখন আমার। হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে পরেছিলাম। ইন্টেনশনালি আমার উইক পয়েন্টের সুযোগ নিয়েছে সে। তোমার উডবির সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার বদলে সে আমাকে পাশের এলাকায় নিয়ে গিয়েছিল মারামারি করতে!”

“হোয়াট রাবিশ রূপল? আপনার মাথায় কী গোবর ভরা? তার মতো একটা ক্রিমিনালের কথা আপনি বিশ্বাস করলেন কীভাবে?”
“বললাম তো মাথা কাজ করছিলনা তখন।”
“সে হসপিটালে ভর্তি এখন জানেন আপনি?”
“হওয়ারই কথা। রূপলের হিংস্রতা সম্পর্কে তার কোনো ধারণা নেই। আমাকে মারতে এসে নিজেই গুরুতরভাবে আহত হলো।”

“এখন যদি থানা পুলিশ হয় তো?”
“হলে হবে, এসবে ভয় পাইনা আমি।”
“কিন্তু আমার তো ভয় হয়!”
“আমাকে নিয়ে ভয়?”
“হুম!”
“সিরিয়াসলি? তাহলে বিয়েটা ভেঙে দাও প্লিজ!”
মুহূর্তেই রূপলকে ছেড়ে দাড়ালো নীহারিকা। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলল অসহায়ত্বে সিটিয়ে থাকা রূপলের মুখশ্রীতে। ভ্রু যুগল প্রসারিত করে সে নিথর গলায় বলল,

“কাইন্ডলি কাটা জায়গাগুলোতে মেডিসিন লাগিয়ে নিন। আপনার জন্য দয়া হচ্ছে এর মানে এই নয় যে আমি বিয়েটা ভেঙে দিব! অসম্ভব বিষয় নিয়ে ঘাটাঘাটি করা বন্ধ করুন। পারলে আপনিও অন্য কাউকে বিয়ে করে দেখান। মিস এলিনা তো আপনাকে বিয়ে করার জন্য এক পায়েঁ দাড়ানো তাইনা?”

ফেরারি প্রেম পর্ব ৬০

রূপলের দিকে অমিমাংসিত প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে তাকে সম্পূর্ণ অবাক করে দিয়ে নীহারিকা গটগট করে হেঁটে রুম থেকে বের হয়ে গেল। তখনি রূপল হতভম্ব গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,
“হোয়াট?”

ফেরারি প্রেম পর্ব ৬২