ফেরারি প্রেম পর্ব ৬০

ফেরারি প্রেম পর্ব ৬০
নিশাত জাহান নিশি

“দাড়া ভাই দাড়া। মরার আগে তো আমার ওয়াচটা আমাকে দিয়ে যা! যাক বাবা ফাইনালি তোর মত ছ্যাঁচড়া কাজিনের হাত থেকে মুক্তি মিলবে আমার! থ্যাংকস রূপল ভাইয়া। তোমাকে ম্যানি ম্যানি থ্যাংকস।”
দম ফেলারও সময় পেলোনা শাকিল। সজলের হাত থেকে ওয়াচটি কেড়ে নিয়ে সে বাঁকা হেসে যেইনা ওয়াচটি হাতে পড়তে গেল অমনি সজল রাগে গজগজ করে শাকিলকে নুইয়ে শাকিলের পিঠ বরাবর সজোরে এক কনি দিলো! তেজী কণ্ঠে বলে উঠল,

“বেঁচে থাকতেই এই ঘাটিয়া রূপ দেখাচ্ছিস তোর? মরার পর আর কী কী করবি বুঝা হয়ে গেছে আমার। আরে এই? তুই আমার ভাই না শত্রু রে? পারলে আমাকে ঐ রাবণের হাত থেকে বাঁচা।”
কনি খেয়ে শাকিল ব্যথায় নাকমুখ কুঁচকে নিলো। পিঠটা ঘঁষতে ঘঁষতে সে অসহনীয় গলায় বলল,
“আরে আমি কী করব? নীহারিকা আপুই তো তোকে ফাঁসালো। এখন এই মরণ পথ থেকে আপু ছাড়া অন্য কেউ তোকে রক্ষা করতে পারবেনা। আপুকে বল কিছু একটা করতে।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

অসহায় দৃষ্টিতে সজল এবার পাশ ফিরে উড়নচণ্ডী নীহারিকার দিকে তাকালো। নিরুপায় হয়ে সে হাত জোর করে কাকুতি মিনতি করে বলল,
“প্লিজ আপু আপনি আমাকে বাঁচান। আমিতো আপনার ছোটো ভাইয়ের মত তাইনা? কেন আপনি আমাকে এভাবে ফাঁসাচ্ছেন বলুন? কার সাথে আপনার বিয়ে ঠিক হয়েছে বলে দিন না ভাইয়াকে। তাহলেই তো লেটা চুকে গেল।”
সজলকে শান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করল নীহারিকা। কঠোর ভাব পাল্টে নিজেকে সহজ করল। ঠান্ডা মাথায় তাকে বুঝিয়ে বলল,

“আরে চিল সজল। তুমি এত ঘাবড়ে যাচ্ছ কেন? এই নীহা তোমার পাশে থাকতে তোমার ভাইয়া তোমার কিচ্ছু করতে পারবেনা। গাঁয়ে একটা টাচও করতে পারবেনা। ট্রাস্ট মি ওকে? আমার হ্যাঁ তে জাস্ট হ্যাঁ মিলাবা তুমি। বাকিটা আমি বুঝে নিব।”

নীহারিকার দিকে আশ্বস্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল সজল। তবুও পুরোপুরি স্বস্তি খুঁজে পাচ্ছিলনা সে। ইতোমধ্যেই রূপল ঝড়ের বেগে তেড়ে এলো সজলের দিকে। সজলের গাল চাপা ভেঙে দেওয়ার পরিকল্পনা তার! প্রয়োজনে আধমরা করে হসপিটালে ভর্তি করাবে আজ সজলকে। এত বড়ো বিশ্বাসঘাতকতা তার সাথে? বড়ো ভাইয়ের প্রেমিকাকে বিয়ে করার মত স্পর্ধা দেখিয়েছে সে? একবছর দেশে ছিলনা বলে এতকিছু ঘটে গেল? যদিও তার মনে তখনও খটকা কাজ করছিল সজল এত বড়ো দুঃসাহস দেখাবে কি-না! কম বেশি তো সজলকে চেনাই আছে তার। কিন্তু নীহারিকার মুখের কথাও সে অবিশ্বাস করতে পারছেনা। করবেটা কী সে এখন? কোন দিকে যাবে সে? তবে মাইরের উপরে আর কোনো ঔষধ নাই। সজলকে দু-এক ঘাঁ দিলেই এখন আসল সত্যিটা বের হয়ে যাবে।

বিস্ফোরিত হয়ে রূপল সজলের গাঁয়ে হাত তোলার পূর্বেই নীহারিকা এসে সজলের সামনে দাড়ালো! সজলের গাঁয়ে হাত তুলতে গিয়েও রূপল থেমে গেল। গরম দৃষ্টিতে তাকালো নীহারিকার দিকে। নীহারিকাও কম যায়না। পাল্টা রাগী দৃষ্টি ফেলল ক্ষিপ্ত রূপলের দিকে। গলা উঁচিয়ে বলল,

“হেই স্টপ। আমার উডবি হাসবেন্ডের গাঁয়ে হাত তোলার দুঃসাহস দেখাবেন না আপনি! দুইদিন পর তার সাথে আমার বিয়ে! আমি চাইনা আমার বিয়েতে কোনো থার্ড পার্সন এসে ব্যাঘাত ঘটাক।”
সুযোগ পেয়ে সজল মানে মানে করে জায়গা থেকে দৌড়ে পালালো! পিছু ঘুরে তাকালোও না আর। সজলের পিছু পিছু শাকিলও ছুটল। দুজনই চোখের পলকে পগারপার! বাড়ি থেকে বের হয়ে দুজন মেইন রাস্তায় দাড়িয়ে হাঁপাতে লাগল। কোমড়ে হাত রেখে শাকিল পেরেশানি গলায় বলল,

“আমার কী মনে হচ্ছে জানিস সজল? দুই পরিবারের সবাই আমাদের থেকে কিছু গোপন করছে। মা-বাবা, বড়ো আব্বু, বড়ো আম্মু এমনকি পিয়াসা আপু ও বলছেনা নীহারিকা আপুর উডবি কে! কার সাথে আপুর বিয়ে হচ্ছে। তার মানে কী দাঁড়ায় বল তো?”
শাকিলের সাথে তাল মিলিয়ে সজলও বেশ ভাবুক ভাব নিলো। সন্দিহান গলায় বলল,

“আমারও তো মনে হচ্ছে দুই পরিবারের মধ্যে কোনো ডাবল প্ল্যানিং চলছে। কাউকে কিছু জানতে দিচ্ছেনা তারা। তবে মনে হচ্ছে যা হবে ভালোর জন্যই হবে! দেখা যাক পরে কী হয়।”
নীহারিকার মেহেন্দি রাঙা ডান হাতটি তৎক্ষণাৎ আলতোভাবে চেপে ধরল রূপল। মেহেন্দির নকশা বদলে দিলো মুহূর্তেই! কিছু কিছু জায়গা লেপ্টে গেল। নীহারিকাকে ঝাকিয়ে সে ঝাঁজালো গলায় শুধালো,

“পাগল হয়ে গেছ তুমি হ্যাঁ? সজল তোমার উডবি? বয়সে তোমার ছোটো, একটা বেকার বেরোজগার ছেলেকে বিয়ে করছ তুমি? একটা নিকাম্মা ছেলের হাতে ধেই ধেই করে তোমার পরিবার তোমাকে তুলে দিচ্ছে? বোকা বোঝাচ্ছ আমাকে? সত্যি করে বলো নীহু, কার সাথে তোমার বিয়ে ঠিক হয়েছে? রেদার খুব খারাপ হয়ে যাবে কিন্তু।”
লেপ্টানো মেহেন্দির দিকে তাকিয়ে নীহারিকার মুখটা কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল! সাথে রাগেও ফুঁসে উঠল। এক ঝটকায় নীহারিকা তার হাতটা ছাড়িয়ে নিলো। চোয়াল উঁচিয়ে রূপলের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুড়ল,

“ইউ ইডিয়ট রূপ কূপ! মেহেন্দিটা নষ্ট করলেন কেন আমার? আপদ হয়ে এসেছেন আমার সব শুভ কাজে বাঁধা দিতে, না? এখন আমি আমার উডবিকে লেপ্টানো হাতটা দেখাব কীভাবে? বিশ্রী লাগছে দেখতে। এমনিতেই তো আমার হাত বিশ্রী! সে তো একটু পরেই আমাকে ভিডিও কল করবে! হায় আল্লাহ্ এই লেপ্টানো হাত আমি তাকে দেখাব কী করে?”
মাথা ভনভন করে ঘুরতে লাগল রূপলের। ভ্রু যুগল খরতরভাবে কুঁচকে সে হঠকারী গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,
“এক সেকেন্ড এক সেকেন্ড ভিডিও কল দিবে মানে? এই মাত্রই তো বললে তুমি সজল তোমার উডবি। এর মাঝে ভিডিও কল এলো কোত্থেকে?”

“পাগল না-কি আমি? আমার আসল বর কে তা বলে আমি আমার সাধের বিয়ে ভাঙব না-কি? আপনার উদ্দেশ্য এই জন্মে সফল হবেনা মিস্টার রূপ কূপ। আমাকে হার্ট করার সাজা আপনাকে পেতেই হবে! হাড়ে হাড়ে পেতে হবে। নিজের চোখের সামনে আপনি আমার বিয়ে দেখবেন! আপনার চোখের জল দেখেই আমার তৃপ্তি মিটবে।”
রূপলের মাথা ১৬০ ডিগ্রি এঙেলে ঘুরিয়ে দিয়ে নীহারিকা রাগে ফোঁস ফোঁস করে জায়গা থেকে দৌড়ে পালালো। মাথায় প্যাচ লেগে গেল রূপলের। উত্তেজিত হয়ে সে মাথার চুল টানতে লাগল। ক্ষুব্ধ গলায় বলল,

“আরে কী হচ্ছেটা কী এসব আমার সাথে? নীহু কী গেম খেলছে আমার সাথে? আসলে নীহুর বরটা কে? বিয়ের কার্ডও তো ছাপায়নি তারা! জিজুর মুখোমুখি হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় দেখছিনা।”
নিহালের মুখোমুখি হওয়ার উদ্দেশ্যে রূপল বাড়ির ভেতর ঢুকল। এয়ারপোর্ট থেকে রূপল সোজা এই বাড়িতে চলে এসেছে। নীহারিকার সাথে একটি বার দেখা করতে। নীহারিকার মান ভাঙাতে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে। তবে এসবের কিছুই তো হলো না। উল্টো তার মাথা আরও ঘেঁটে ‘ঘ’ হয়ে গেল। অপ্রত্যাশিতভাবে হৃদির সাথে ঠিকই দেখা হয়ে গেল রূপলের। রূপল ভাবতেও পারেনি হৃদি এই বাড়িতে আছে!

বন্ধুুদের সাথে তাল মিলিয়ে নাচতে থাকা হৃদিকে এক পলক দেখামাত্রই রূপল আবেগপ্রবণ হয়ে ছুটে গেল হৃদির কাছে। টানা একবছর পর রূপলকে দেখে হৃদি থমকে দাড়ালো। নাচ থামিয়ে অভিমান নিয়ে অন্যপাশে ফিরে গেল! চোখে এক রাশ জল নিয়ে সে দৌড়ে ওঠে গেল বাড়ির উপর তলায়। রূপল তখন পেছন থেকে খপ করে হৃদির হাত টেনে ধরল। তাকে টেনে এনে মুখোমুখি দাড় করালো। মাথা নুইয়ে হেঁচকি তুলে কেঁদে দিলো হৃদি! হৃদির কান্না দেখে রূপলের বুকটা কেঁপে উঠল।

বুঝতে পারল হৃদির সাথে সে কত বড়ো অন্যায় করেছে! হৃদির দায়িত্ব নিয়েও সে হৃদির দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারেনি! দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছে। অনুতপ্ত বোধ থেকে রূপলের চোখ দুটিও জলে ভিজে এলো। কান ধরে সে মাথা নত করে হৃদির মুখোমখি বসল। অপরাধী গলায় বলল,
“আ’ম সো সরি হৃদি মা। প্লিজ ফরগিভ মি। আর একবার সুযোগ দাও আমায় প্লিজ। দ্বিতীয় বার বাবার ভুলের জন্য তোমাকে আর কখনও কাঁদতে হবেনা।”

অকল্পনীয়ভাবে তখন হৃদির পাশে এসে দাড়ালো নীহারিকা। হৃদিকে তার কাছে টেনে আনল। তার চোখেও টইটম্বুর জল! হৃদির মত সেও চাপা অভিমানে সিঁটিয়ে আছে। তবুও সে শক্ত গলায় রূপলকে খোঁচা দিয়ে হৃদিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“না হৃদি! তুমি তোমার এই সেলফিস বাবাটাকে কখনও ক্ষমা করবেনা। তাকে আর কোনো সুযোগ দিবেনা তুমি। সে তোমার সাথে যা করেছে অন্যায় করেছে। অন্যায়কারীকে প্রশয় দিতে নেই।”

মাথা নুইয়ে রাখার দরুন নীহারিকার উপস্থিতি এতক্ষণ টের পায়নি রূপল। তবে নীহারিকার গলার আওয়াজ পেয়ে সে মাথা তুলে তড়াক দৃষ্টিতে তাকালো নীহারিকার দিকে৷ রক্তিম দু’চোখে বেদনার ছড়াছড়ি রূপলের। তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পেশাল মানুষগুলোই এখন তার বিরুদ্ধে? তার উপর তাদের এত শত অভিযোগের পাহাড়?

সর্বনাশা রাগ জেদ রূপলকে কোথায় এনে দাড় করালো? জীবনটাই তার তছনছ করে দিলো। ভালোবাসার মানুষদের চোখে ঘৃণা দেখার চেয়ে মৃত্যুকে অতি সহজ মনে হলো রূপলের! সম্ভব হলে এই মুহূর্তে তাই করত রূপল।
চোখ থেকে গড়িয়ে পরা জলগুলো মুছল হৃদি। নাক টেনে ভরাট দৃষ্টিতে আহত রূপলের দিকে তাকালো। অভিযোগ নিয়ে বলল,

“তুমি আমার বাবা নও রূপল চাচ্চু! বাবারা কখনও এত নিষ্ঠুর হয়না! গত একবছরে তুমি আমার একটু খোঁজ খবরও নাওনি! কিন্তু আমার দাদা, দাদু, ফুফু, ফুফা এমনকি নীহা মা ও সবসময় আমাকে আগলে রেখেছে! তাই তারাই এখন আমার আপনজন।”

ছলছল দৃষ্টিতে নীহারিকা আঘাতপ্রাপ্ত রূপলের দিকে একবার তাকালো। নিগূঢ় কষ্টের ছাপ ফুটে উঠেছে রূপলের দু’চোখে। দীর্ণ বিদীর্ণ অসহায় দেখাচ্ছে তাকে। ভেঙেচূড়ে যেন পড়ে যাচ্ছে সে। তবুও যেন মায়া হলোনা নীহারিকার! তার ধারণামতে, এই দুঃসাধ্য কষ্টটাই রূপলের প্রাপ্য ছিল! বেশিক্ষণ রূপলের ব্যথাযুক্ত চোখে চোখ রাখতে পারলনা রূপলের নীহারিকা। ঝট করে দৃষ্টি ফিরিয়ে হৃদিকে নিয়ে জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো।

রূপল বাবা থেকে রূপল চাচ্চু হয়ে ওঠার নির্মমতা সইতে পারলনা রূপল। হাঁটু মুড়ে জায়গায় বসে রইল সে। না চাইতেও তার চোখ থেকে টপটপ করে জল গড়িয়ে পরছে! এ কেমন যন্ত্রণায় ডুবে গেল সে? বুকের মাঝে ক্রমশ শূণ্যতা বাড়ছে। ঘৃণায় পতিত হচ্ছে। একের পর এক সবাই তার উপর অভিযোগ তুলছে। অথচ কেউ এটা জানতে চাইল না যে,,গোটা একটা বছর সে কাছের মানুষের ছেড়ে প্রিয় মানুষদের ছেড়ে কতটা নিঃসঙ্গতায় কাটিয়েছে! একেকটা দিন তার কাছে একেকটা বছরের মত মনে হয়েছে। আদোতে কী কেউ বুঝবে তার ভেতরের যন্ত্রণা?

বিয়ে বাড়ির গান বাজনা থেকে খানিকটা দূরে সরে এসে বাড়ির ছাদে নিরিবিলি জায়গায় চেয়ার পেতে মুখোমুখি বসে আছে রূপল ও নিহাল। মাথা নুইয়ে রেখেছে রূপল। হাত কচলাচ্ছে বার বার। আঘাতের পর আঘাত পেতে পেতে সে ক্লান্ত হয়ে গেছে। নিহালের থেকে আর কোনো আঘাত পেতে প্রস্তুত নয় সে। রূপলের দিকে সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল নিহাল। উপলব্ধি করল রূপল ভালো নেই! দুঃখে, যাতনায় মুর্ছে আছে। চোখমুখ দেখে মনে হলো কেঁদেছেও! পুুরুষ মানুষ তখনই কাঁদে যখন তাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায়। রূপলের অবস্থাও এখন ঠিক তাই। মুহূর্ত কয়েক বাদে দীর্ঘশ্বাস ফেলল নিহাল। রূপলের দিকে প্রশ্ন ছুড়ল,

“তা বলো রূপল কী খবর তোমার? কেমন আছো তুমি?”
ক্ষোভ পুষে রাখতে পারলনা রূপল। মাথা তুলে আক্রোশিত দৃষ্টিতে তাকালো নিহালের দিকে! তিরিক্ষিপূর্ণ গলায় বলল,
“কাজটা আপনি মোটেও ঠিক করছেন না জিজু!”
ভ্রু কুঁচকে নিলো নিহাল। অবুঝ গলায় শুধালো,
“কী কাজ রূপল? বুঝলাম না।”

“আপনি আমাকে কথা দিয়েছিলেন জিজু নীহুর বিয়েটা আপনি আমার সাথেই দিবেন। আজ যখন আমি প্রতিষ্ঠিত হয়ে ফিরে এলাম তখন দেখলাম আপনি আপনার বোনকে অন্যত্র বিয়ে দিচ্ছেন! কথার বল খেলাফ করছেন?”
“তুমি হয়ত ভুলে যাচ্ছ রূপল। সেই কথা আমি আরও দেড় বছর আগেই ফিরিয়ে নিয়েছিলাম। তুমিও তো সেদিন বিনাবাক্যে আমার কথা মেনে নিয়েছিলে! কারো সাথে কোনো যোগাযোগ না করেই কানাডা চলে গিয়েছিলে। এখন যখন আমি ভালো পাত্র পেয়ে বোনকে বিয়ে দিতে যাচ্ছি তখন তোমার মনে হলো আমি আমার কথার বল খেলাফ করছি?”

“সেদিন আমি কেন আপনার কথার কোনো প্রতিবাদ করিনি তা যেমন আপনি জানেন তেমনি কিন্তু আপনার বোন নীহুও ভালো করে জানে! সেদিন আপনি ও নীহু দুজনে মিলেই আমাকে বাধ্য করেছিলেন চুপ থাকতে। দুজনই সেদিন আমাকে ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছিলেন। সেদিনের ধাক্কাটা আমি সামলাতে পারিনি জিজু। তাই আমি দূরে সরে গিয়েছিলাম। তবে এমনি এমনি দূরে সরে যাইনি আমি। এতে অনেক লাভও হয়েছে আমার। নিজেকে কিছুটা হলেও প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি আমি। এখন নীহুকে বিয়ে করতে আমার কোনো বাঁধা নেই। আপনি নীহুকে আমার হাতে তুলে দিন জিজু! দূরত্ব বাড়িয়েছি বলে আমি কিন্তু নীহুকে ভালোবাসা বন্ধ করিনি। এতটাও ঠুনকো নয় আমার ভালোবাসা যে, আমি হাসতে হাসতে আমার ভালোবাসার মানুষকে অন্য কারো হতে দিব।”

“তুমিও ভুলে যেওনা রূপল সেদিন কেন আমি তোমাদের ছাড়াছাড়ি করাতে বাধ্য হয়েছিলাম। তোমার বোনের কুকীর্তি এবং তোমার মায়ের অনিচ্ছার কারণেই আমি বাধ্য হয়েছিলাম তোমাদের আলাদা করতে।”
“হ্যাঁ আমি মানছি জিজু, সেদিন আমার বোনের অন্যায় ছিল। তার শাস্তিও আপনি তাকে দিয়েছেন। হয়ত এখনও দিচ্ছেন। আপনাদের ব্যক্তিগত জীবনে নাক গলানোর বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই আমার। তখন আমার মা রাজি না থাকলেও এখন কিন্তু আমার মা রাজি জিজু! মা-ই কিন্তু আমাকে খবরটা দিয়েছে যে নীহারিকার বিয়ে ঠিক হয়েছে।

আমি যেন তাকে জোর করে হলেও বিয়ে করি! যদিও আমি ভেবে রেখেছিলাম কিছুদিন পরেই আপনার সাথে কন্ট্রাক্ট করব। কারণ এই মাসের শেষের দিকেই আমার দেশে ফেরার কথা ছিল। হুট করে দেশে ফিরে সবাইকে চমকে দিব ভেবেছিলাম। কিন্তু এর আগেই এতকিছু ঘটে গেল। মা তার ভুল বুঝতে পেরেছে। তাছাড়া এখন আমার মা অসুস্থ জিজু।

আমাদের ভাই বোনের কারণে দু দু’বার স্ট্রোক করেছে আমার মা। আমি চাইব না নিশ্চয়ই আমার কারণে আমার মা তৃতীয় বার স্ট্রোক করুক? বিয়েটা আপনি ভেঙে দিন জিজু। নয়ত আমি বাধ্য হব বিয়ে ভাঙতে। যদি তাও না পারেন কাইন্ডলি বলুন নীহুর বিয়ে কার সাথে ঠিক হয়েছে? প্রয়োজনে আমি তাকে বুঝিয়ে বলব যে আমার এবং নীহুর মাঝখান থেকে সরে যেতে।”
বসা থেকে ঝট করে ওঠে গেল নিহাল। হঠাৎ ঘাবড়ে গেল সে৷ শার্টের কলার ঠিক করে গলা ঝাড়ল। হকচকানো গলায় বলল,

“সরি রূপল। এই সম্পর্কে আমি তোমাকে কিছু বলতে পারবনা। একচুয়েলি নীহারিকার বারণ আছে! বিয়ের দিন সে চায় সবাইকে সারপ্রাইজ দিতে।”
গটগট করে হেঁটে ছাদ থেকে প্রস্থান নিলো নিহাল! বেফাঁস কিছু বলে চাপে পরতে চায়না সে। রূপলকে কিছু বলার সুযোগই দিলোনা নিহাল। রাগে, দুঃখে, হতাশায় ছাদের দেয়ালে জোরে এক ঘুষি মারল রূপল! মৃদু চিৎকার করে বলল,

“এখন আমি কার কাছে হেল্প চাইব? কে আমাকে এই দুঃসময়ে এসে হেল্প করবে? এত মানসিক চাপ সহ্য করতে পারছিনা আমি।”
নিজেকে সামলে রূপল ছাদের সিড়ি বেয়ে নামতেই মারজিনা বেগমের মুখোমুখি হয়ে গেল। ব্যস্ত ভঙ্গিতে তিনি নীহারিকার রুমের দিকেই হেঁটে যাচ্ছিলেন। এর মাঝেই রূপলের সাথে দেখা হয়ে গেল। যদিও রূপল ফেরার পর একবার দেখা হয়েছিল রূপলের সাথে উনার। তবে কথা হয়নি তখন। মারজিনা বেগমকে দেখে রূপল ভদ্র ভাব নিলো। শার্টের কলার ঠিক করে মাথা নুইয়ে দাড়ালো। হাত দুটো পেছনের দিকে নিয়ে নম্র সুরে শুধালো,

“কেমন আছেন আন্টি?”
বাঁকা হাসলেন মারজিনা বেগম। কুচুটে গলায় বললেন,
“মেয়ের বিয়ে বলে কথা। আমি ভালো থাকব না, তা কী করে হয় বাবা?”
নিথর দৃষ্টিতে রূপল মাথা তুলে তাকালো হাসোজ্জল মারজিনা বেগমের দিকে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এলো তার। দুঃখ বিজড়িত গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,

“আন্টি আপনিও কী রাজি এই বিয়েতে?”
“বালাইষাট। রাজি হবো না কেন? যেখানে ছেলে আমার মেয়ের পছন্দের! সেখানে আমি কেন রাজি থাকবনা বলো?”
কাতর হয়ে উঠল রূপল! হাত জোর করে অনুনয় ভরা গলায় বলল,
“প্লিজ আন্টি একবার বলুন ছেলেটি কে? প্লিজ!”

“কেন? আমার মেয়ের বিয়ে ভাঙার প্ল্যান করছ নাকি তুমি? যদি এই ব্যাপার হয়ে থাকে তো খবরদার বলছি রূপল। এই দুঃসাহস দেখাবে না তুমি! এভাবে মনমরা হয়ে না ঘুরে বরং হাতে একটু মেহেন্দি টেহেন্দি লাগাও তুমি! দাড়াও আন্টি তোমার জন্য মেহেন্দি নিয়ে আসছি!”

রূপলকে দাড় করিয়ে রেখে মারজিনা বেগম হাসি চেপে নীহারিকার রুমে ঢুকলেন। তবে নীহারিকাকে রুমে খুঁজে পেলেন না তিনি! মেহেন্দি খুঁজতে খুঁজতে মারজিনা বেগম হয়রান হয়ে গেলেন। তবে মেহেন্দি কোথাও খুঁজে পেলেন না।
তাজ্জব হয়ে দাড়িয়ে রইল রূপল। নীহারিকার বিয়েতে সে কেন মেহেন্দি পরবে? সবাই মিলে তার সাথে মজা নিচ্ছে কেন? বোকা পেয়েছে তাকে?

শেষমেশ নীহারিকার মাও কিনা তার সাথে মজা করল? এত অবহেলা সহ্য করার পরেও রূপল দেখবে নীহারিকাকে তারা অন্য কোথাও কীভাবে বিয়ে দেয়! বিয়ের আগেই শুনবে বর ফেরার। তখন সবাই বাধ্য হয়ে রূপলের সাথেই তার বিয়ে দিবে। তবে এই বরটা কে? কার সাথে নীহারিকার বিয়ে ঠিক হলো? কারো মুখ থেকেই তো সত্যিটা জানা যাচ্ছেনা। পিয়াসার কাছ থেকে হেল্প নিবে সে?

বাঘের মত ক্ষেপে ওঠে রূপল জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো। পিয়াসার রুমের উদ্দেশ্যে রওনা হলো। অমনি পিয়াসার রুমের ভেতর থেকে নীহারিকার উত্তেজিত গলার আওয়াজ তার কানে ভেসে এলো! পিয়াসাকে চিন্তিত সুরে সে ভাবি ভাবি বলে ডাকছে। দ্রুত পায়ে হেঁটে এলো রূপল পিয়াসার রুমে। মেঝেতে অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে পিয়াসা! তার পাশে বসেই নীহারিকা পিয়াসাকে ডাকছে। তবে হাতে মেহেন্দি থাকায় সে পিয়াসাকে ঠেলতে পারছেনা। বসা থেকে ওঠে নীহারিকা যেইনা আতঙ্কিত হয়ে কাউকে ডাকতে যাবে অমনি পিছু ঘুরে রূপলকে দেখল সে। এই দৃশ্য দেখে অস্থির হয়ে উঠল রূপল। ছুটে এলো পিয়াসার দিকে। অবচেতন পিয়াসার দিকে ভীত দৃষ্টিতে তাকিয়ে সে নীহারিকার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়ল,

“কী হয়েছে পিয়াসার?”
বিচলিত গলায় নীহারিকা পাশ ফিরে উদ্বেগি রূপলের দিকে তাকালো। কাঠ কাঠ গলায় জবাবে বলল,
“জানিনা কী হয়েছে। অনেকক্ষণ হলো ভাবিকে দেখছিলাম না। তাই রুমে খুঁজতে এসে দেখি এই অবস্থা।”
“সেন্সলেস হয়ে গেছে। ওয়েট আমি তাকে বিছানায় শুইয়ে দিচ্ছি। মেবি স্ট্রেস থেকে এমন হয়েছে।”

পিয়াসাকে পাঁজা কোলে তুলে রূপল বিছানায় শুইয়ে দিলো। একবছর পর আজ এইমাত্র পিয়াসার সাথে দেখা হলো তার। তাও আবার এই শোচনীয় অবস্থায়। পানি ছিটানোর মিনিট কয়েক পর পিয়াসার জ্ঞান ফিরল। চোখ মেলে তাকালো সামনে। স্বস্তির শ্বাস ফেলল রূপল ও নীহারিকা। রূপলকে চোখের সামনে দেখামাত্রই দুর্বল অবস্থাতেও আলতো হাসলো সে! রহস্যময়ী দৃষ্টিতে পাশ ফিরে নীহারিকার দিকে তাকালো! পিয়াসাকে চোখের ইশারায় কিছু একটা বুঝিয়ে নীহারিকা দৃষ্টি নামিয়ে নিলো! দুজনের ইশারায় কথা বলার সময় সেদিকে দৃষ্টিপাত করলনা রূপল। উদ্বিগ্ন হয়ে রূপল পিয়াসার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

“ঠিক আছিস তুই?”
প্রসঙ্গ পাল্টাতে চাইল পিয়াসা। ঝট করে শোয়া থেকে ওঠে বসল। মাথা ঘুরে এলো তার। তবুও শক্তি রাখল। নেতানো মুখেও হাসি ফুটে উঠল তার। রুপলের হাতে হাত রেখে প্রাণোচ্ছ্বল গলায় বলল,
“নীহারিকার বিয়েতে তুমি এসেছ আমি খুব খুশি হয়েছি ভাইয়া! বিয়েটা জমবে এবার জানো?”
“হোয়াট রাবিশ পিয়াসা! তুই এখনও আগের মতই রয়ে গেলি? এতকিছুর পরেও তুই এখনও চাস নীহুর অন্য কোথাও বিয়ে হোক?”

বিক্ষুব্ধ হয়ে রূপল বসা থেকে ওঠে দাড়ালো। নীহারিকার দিকে তেড়ে এলো। ঘাবড়ে ওঠে নীহারিকা পিছু হটতে লাগল। রূপল এখনি তার হাত চেপে ধরবে তা বুঝতে পেরে নীহারিকা মেহেন্দি রাঙা হাত দুটো রূপলের মুখের সামনে ধরে রূপলকে থামালো। হম্বিতম্বি গলায় বলল,
“এই না। একদম না। আমার হাতের মেহেন্দি নষ্ট করার আর দুঃসাহসও দেখাবেন না আপনি!”

এই বলে নীহারিকা দৌড়ে তার রুমে ঢুকে গেল! নীহারিকার পিছু পিছু রূপলও ছুটল। খাটের উপরে বসে দুঃখ ভুলে মুখ টিপে হাসতে লাগল পিয়াসা। রূপল ও নীহারিকার খুনসুটি দেখে বেশ খুশি পিয়াসা! চোখ দুটো যেন জুড়িয়ে এলো তার। তখনি রুমে নিহালের আগমন ঘটল। পিয়াসা তার শরীর খারাপ বা দুর্বলতা বুঝালো না নিহালকে! ঝট করে সে বিছানা ছেড়ে ওঠে ভীরু পায়ে হেঁটে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল! পিয়াসার দিকে ফিরেও তাকালো না নিহাল। আলামারি থেকে টাকা বের করতে সে রুমে ঢুকেছিল।

হাতের তালুতে থাকা মেহেন্দি প্রায় শুকিয়ে এসেছে নীহারিকার। উগ্র মেজাজ নিয়ে রূপল রুমে ঢুকে রুমের দরোজা বন্ধ করে দিলো! রক্তচক্ষু নিক্ষেপ করল নীহারিকার দিকে। চোয়াল উঁচিয়ে বলল,
“নীহু প্লিজ আমাকে রাগিওনা। তোমার সাথে যে স্ক্রাউন্ডেলটার বিয়ে ঠিক হয়েছে কাইন্ডলি তার নামটা বলো। যদি তাও না পারো তাহলে তার সাথে আমাকে ফোনে কথা বলিয়ে দাও। হাত জোর করছি তোমার কাছে প্লিজ।”

ওয়াড্রবের ভেতর থেকে নীহারিকা একটি মেহেন্দি খুঁজে বের করল। মেহেন্দিটি হাতে নিয়ে সে ফিচেল হেসে রূপলের দিকে এগিয়ে এলো। ভাবশূণ্য দৃষ্টিতে রূপলের দিকে তাকালো। সৌহার্দপূর্ণ গলায় বলল,
“দেখি হাতটা দিন। একটু মেহেন্দি পরিয়ে দিই! আপনার প্রাক্তন প্রেমিকার বিয়ে বলে কথা সেই খুশিতে তো আপনার একটু পরা দরকার।”

রূপলের বাঁ হাতটি টেনে ধরতেই রূপল নীহারিকার হাতটি ঝেড়ে ফেলে দিলো। রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে সে নীহারিকার হাতের পিঠে দেওয়া কাঁচা মেহেন্দিগুলো দু-হাত দ্বারা নিঁখুতভাবে লেপ্টে দিলো! নীহারিকাকে শাসিয়ে বলল,
“নেক্সট টাইম আমার ইমোশনকে হার্ট করার আগে দু’বার ভাববে তুমি। আমি এখন ফানি মুডে নেই। সিরিয়াস আমি। তোমরা কী ভেবেছ? তোমরা কেউ সেই ছেলের সম্পর্কে না বললে আমি তাকে খুঁজে বের করতে পারবনা? আগামী দুইদিনের মধ্যেই তোমরা তার মরা লাশ দেখবে! নিজ হাতে আমি তাকে খুন করব।”

হনহনিয়ে রূপল রুম থেকে বের হয়ে গেল। লেপ্টানো হাতের দিকে তাকিয়ে নীহারিকা আলতো হাসল। পেছন থেকে রূপলকে ডেকে বলল,
“হেই মিস্টার রূপল শুনুন? তার গাঁয়ে টাচ করারও সাহস নেই আপনার। আর তাকে খুন করা তো দূরে থাক! যদি তাকে কিছু করতে হয় তো আমার লাশের উপর দিয়ে গিয়ে তাকে কিছু করতে হবে!”

ফেরারি প্রেম পর্ব ৫৯

নীহারিকার কোনো কথায় কান দিলোনা রূপল। হন্তদন্ত হয়ে সে নীহারিকাদের বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। পুনরায় লেপ্টানো হাতের দিকে তাকিয়ে নীহারিকা ক্রুর হাসল! বলল,
“থ্যাংকস মিস্টার বাঘা রূপল। আমার কাজটা আরও সহজ করে দিলেন আপনি। আমার হাতের মেহেন্দি আপনার হাতেও লেগে গেল এখন! ইশ, এটাই তো চাইছিলাম আমি!”

ফেরারি প্রেম পর্ব ৬১