খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ৮

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ৮
আভা ইসলাম রাত্রি

‘বড়সাবরে সাপে কাটছে রে, জলদি সাপুড়ে ডাইকা আনো রে সবে, খালাম্মা, ভাবি, ভাইজান জলদি আন আফনারা।’
শেহজাদ আঁতকে উঠল। এলোমেলো দৃষ্টি চিত্রার দিকে নিক্ষেপ করে দ্রুত ছুটল নওশাদের ঘরের দিকে। পেছনে পেছনে চিত্রা মাথায় আঁচল তুলে ধুরুধুরু বুক নিয়ে ছুটল। নওশাদের ঘরে ভিড় জমেছে। রেখা চোখের জল মুছতে মুছতে পায়ের পাশে বসে শক্ত করে ছোবল দেওয়া জায়গায় পট্টি বেধে দিচ্ছেন। নওশাদ ব্যথায় ততক্ষণে জ্ঞ্যান হারিয়েছেন। শেহজাদ হুংকার ছাড়ল,

‘দ্রুত সদরের ডাক্তার ডেকে আনো।’
চিত্রা পাশ থেকে দ্রুতদমে বলল,
‘ডাক্তার না আইনা, আমাদের যাইতে হবে। তাইলে তাত্তারি হবে। বেশি দেরি করলে বিপদ আছে।’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

শেহজাদ কোনো কথা বাড়াল না। চিত্রার কথাই উপস্থিত লোকদের সঠিক মনে হল। শেহজাদ মুহূর্ত ক্ষয় না করে দ্রুত নওশাদকে পাঁজাকোলা তুলে নিয়ে ছুটল গাড়ির দিকে। রেখা বোরকা পরে নিজেও ছুটলেন ছেলের পেছনে। রয়ে গেল চিত্রা এবং বাকি মেয়ে-বউরা। চিত্রা উপলব্ধি করছে, ও ভয় পাচ্ছে।

এ বাড়ির প্রতিটা সদস্য একেকটা প্রাণ! একজন হারিয়ে গেলে বাড়িটা নির্জীব হতে সময় নেবে না। চিত্রা না চাইতেও একটু আগে নওশাদের পায়ের দিকে চেয়ে সঙ্গেসঙ্গে চোখ সরিয়ে নিয়েছে। দুটো দাতের দাগ, অর্থাৎ বিষধর সাপের কামড়। চিত্রা পুরো ঘর একবার দেখে নিল। কোথা থেকে সাপ বেরিয়েছে ঠাওর করতে পারছে না সে। হঠাৎ চিত্রার চোখ পরল ঘরের একদম কোণে ছোট একটা গর্ত। চিত্রা গর্ত দেখে এগিয়ে গেল। গর্তের ভেতর দেখে ফেলার চেষ্টা করে বলল,

‘সাপটা কি এহান থেকে বাইর হইসে?’
চিত্রা পাশে থাকা সৌরভ আয়ুষ্মানের স্ত্রী শিউলি বেগমকে বলল,
‘ছোট আম্মাজান, একজন সাপুড়ে আনিয়া গর্ত পরখ কইরা দেখলে বোধহয় ভালো ওয়।’
শিউলি ভ্রু কুঁচকে চিত্রার দিকে চাইলেন। চিত্রার কথা তার কাছে নিছক মজা লাগছে না। তাই তিনি পাশে দাড়িয়ে থাকা ভৃত্যকে বলেন,

‘সাপুড়ে আনাও। সম্পূর্ন এ বাড়ি পরখ করা প্রয়োজন।’
ভৃত্য মাথা নাড়িয়ে ছুটে গেল সাপুড়ে আনতে। চিত্রা তাৎক্ষণিকভাবে মোম গলিয়ে ওই গর্ত ঢেকে দিল।
খবর এল, নওশাদ আয়ুষ্মানের সাপের বিষ ছাড়ানো হয়েছে। সবাইকে আশ্বস্ত হতে দেখা গেল। ততক্ষণে সাপুড়েও বাড়ি এসেছে। পুরো বাড়ি খুঁজে খুঁজে অনেকগুলো সাপের গর্ত লক্ষ করলেন সাপুড়ে। তিনি গর্ত ঢেকে দিলেন। নওশাদের ঘরে ঐ গর্তে সাপেরা বাসা বেঁধেছিল। বিষধর থেকে নির্বিষ সকল সাপের বসবাস ঐ গর্তে। সবাই সাপুড়ের মুখে তা শুনে আঁতকে উঠলেন। শিউলী পর্দার আড়াল থেকে ভৃত্যকে ইশারা দিলেন। ভৃত্য এগিয়ে গিয়ে সাপুড়েকে জিজ্ঞেস করল,

‘সাপগুলা মাইরা ফেললে বালা ওয় না? তারফর গর্ত ঢাইকা দিলেন?’
সাপুড়ে উত্তর দিলেন,
‘না পূত্তুর, ইয়ে নিষ্পাপ সাপ মেরে কিয়া হোগা? গর্ত ঢাকলে, সাপ আর আপলোগোকো কামুর দেবা না।’
সবাইকে আশ্বস্ত হতে দেখা গেল। সাপুড়ে একে একে সকল গর্ত নিজের অভিজ্ঞতা দ্বারা ঢেকে দিলেন। সাপুড়েকে বকশিস দিয়ে বিদায় দিলেন আয়ুষ্মানরা।

নওশাদকে বাড়ি আনা হয়েছে। শেহজাদ পাশে দাঁড়িয়ে আছে। নওশাদ সিলিংয়ের দিকে চেয়ে বিড়বিড় করে বললেন,
‘মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে আনার আল্লাহর কাছে কোটি শুকরিয়া!’
শেহজাদ পাশ থেকে জিজ্ঞেস করলে,
‘এখন ভালো অনুভব করছেন, আব্বাজান?’
নওশাদ ক্লান্ত কণ্ঠে উত্তর দিলেন,

‘আল্লাহর রহমতে ভালো লাগছে। আসরের আযান কি হয়ে গেছে?’
সৌরভ উত্তর দিলেন,
‘মাগরিবের আযান পরল একটু আগে। আমরা নামাজ পরে আসলাম মাত্র।’
নওশাদ আফসোস করে বললেন,

‘আসরের নামাজ কাজা পরতে হবে, মাফ করো আল্লাহ্। শেহজাদের আম্মা, নামাজ পরব আমি। ব্যবস্থা করো।’
রেখা দ্রুত তরিগরি করে অযুর ব্যবস্থা করে দিলেন। নওশাদ বিছানায় বসে অজু করলেন। বিছানায় জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজ আদায় করলেন। মোনাজাতে অনেকক্ষন কান্নাকাটি করলেন, আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় এতটুকুও কার্পণ্য করলেন না। শরীর এখনো অনেক দূর্বল। হাঁটতে পারছেন না, পায়ে প্রচন্ড ব্যথা। নওশাদকে ঘুমের ঔষধ দেওয়া হয়েছে। নামাজ পরেই কিছুক্ষণের মধ্যে তিনি ঘুমিয়ে গেলেন।

সৌরভসহ সকলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। থেকে গেলেন শুধু শেহজাদ এবং রেখা। ঘরের এক কোণে চিত্রা দাঁড়িয়ে আছে। শেহজাদ মায়ের উদ্দেশ্য বলল,
‘আগামিকাল সকালে মেহজাদকে আনতে যাচ্ছি আমি, আম্মাজান। রাতে সব গুছিয়ে রাখতে হবে।’
রেখা স্বামীর পা মালিশ করে দিতে দিতে বললেন,

‘ফিরছ কবে?’
‘সপ্তাহ পর, মেহজাদকে সাথে নিয়ে।’
‘ও ফিরতে চাইবে তোমার সঙ্গে? ওর জেদ চেনো না?’
‘না ফিরতে চাইলে যা কখনও করিনি সেই কাজ করব, হাত তুলতে বাধ্য হব। ওর চালচলন উশৃঙ্খল হয়ে যাচ্ছে। যতদ্রুত সম্ভব দেশে আনিয়ে বিয়ে করিয়ে দিলে ভালো হবে।’

‘বিয়ে? মেয়ে ঠিক করা নাকি?’
‘না, তবে খুঁজলে ভালো মেয়ে পাওয়া যাবে।’
‘দেখো আবার, তোমার মত পথের কোনো মেয়েকে বিয়ে করে এ ঘরমুখো যেন না করে।’

চিত্রা পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। রেখার এ কথা শুনে চিত্রা ফ্যালফ্যাল চোখে তাকাল রেখার দিকে। চোখে নিমিষেই জলে ভরে গেল। শেহজাদের দৃষ্টি পরল ঐ দু চোখে। জলের উপস্থিতি লক্ষ্য করলে, শেহজাদ চোখ উল্টে ছোট্ট নিঃশ্বাস ছাড়ে। শেহজাদ আয়ুষ্মানের স্ত্রী এমন নরম হলে কিভাবে চলবে? শেহজাদের মত তার স্ত্রী হতে হবে বাঘের বাঘিনী। শেহজাদের স্ত্রী রাজ করবে চতুর্দিকে, ত্রাস চালাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে। কিন্তু সুভাষিণীর এমন নরম, কোমল আচরণে কিছুটা ক্ষিপ্ত শেহজাদ। শেহজাদ রেখার দিকে চেয়ে বলল,

‘বিয়ে হয়ে গেছে, আম্মাজান। এখন এসব ভেবে আপনার মন দুঃখী করবেন না। আমি সুখে থাকব ইন শা আল্লাহ্!’
রেখা বেগম আড়চোখে চিত্রার দিকে চেয়ে মুখ বাঁকিয়ে আবারও স্বামীর পা মালিশ করায় মন দিলেন। চিত্রাকে ইশারা করল শেহজাদ। চিত্রা থতমত খেয়ে রেখার দিকে এগিয়ে গেল। বিড়ালের মত মিনমিনে গলায় বলল,
‘আম্মাজান, চা কই–করে দেই আপনাকে?’

রেখার রাগ কিছুটা নির্মূল হল বোধহয়। তবুও তিনি কড়া কণ্ঠে উত্তর দিলেন,
‘চা করে, খোকাকে সাহায্য করো। বিদেশে যাচ্ছে, কি কি প্রয়োজন সকল কিছু যেন তোমার নখদর্পনে থাকে।’
চিত্রা মাথা দুলাল। পাকের ঘরের দিকে চলল সে। শেহজাদ মাকে সালাম দিয়ে বেরিয়ে গেল নিজের ঘরের দিকে।

শেহজাদ আজকে যাবে বিদেশে। সকাল থেকে আয়ুষ্মান বাড়িতে তোড়জোড় চলছে। চিত্রা ব্যস্ত শাশুড়ির সঙ্গে পাকের ঘরে শেহজাদের জন্যে খাবার বানানোয়। একফাঁকে চিত্রাকে শেহজাদের ঘরে পাঠিয়ে দিলেন রেখা, যাবার আগে কিছু দরকার হয় কি না!
চিত্রা ঘরে এসে দেখে শেহজাদ লাগেজের চেইন লাগাচ্ছে। চিত্রা ধীর পায়ে শেহজাদের পাশে এসে দাঁড়াল। ভয়ে ভয়ে বলল,

‘কিছু লাগবে আফ-আপনার?’
শেহজাদ স্পষ্ট দৃষ্টিতে তাকাল চিত্রার দিকে। বলল,
‘আমি চলে গেলে, আম্মাজান কিছু বললে মনে নিবে না। এ বিয়েতে তিনি নারাজ আছেন এখনো। নারাজি দূর হয়ে যাবে ইন শা আল্লাহ্! মন খারাপ না করে, তার মন জয় করা শিখে ফেলো। তাহলে রানীর মত থাকতে পারবে এ বাড়িতে। হু?’

চিত্রা আলগোছে মাথা দুলাল। কি সুন্দর করে কথা বলে সে! স্পষ্ট এবং ছাড়াছাড়া কথা শুন যে কেউ গলে যেতে বাধ্য! আর এ তো স্বয়ং শেহজাদ এর স্ত্রী। শেহজাদ আয়নার দিকে এগিয়ে গেল। আতর মাখল শরীরে। পাঞ্জাবির বোতাম লাগাবে, তখন চোখ গেল চিত্রার দিকে। মেয়েটা সবসময় শেহজাদকে দেখে ভয়ে কাঁপে। তার এ ভয় কাটানো লাগবে। শেহজাদ ডাক দিল,

‘এদিকে এসো।’
চিত্রা গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গেল। দুরত্ব রেখে দাঁড়াল শেহজাদের থেকে। শেহজাদ ভ্রু কুঁচকে তাকাল। আবারও বলল,
‘স্বামীর থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলা স্ত্রীকে আল্লাহ্ তায়ালা পছন্দ করেন না। কাছে এসে দাঁড়াও।’

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ৭

স্বামী! সম্বোধনটা যেন চিত্রাকে আলোড়িত করে তুলল। চিত্রার বুকের ভেতরটা দাউদাউ করে উঠল যেন। ধূরুধুরু বুক নিয়ে চিত্রা এগিয়ে গেল শেহজাদের দিকে। চিত্রা এখনো অনেকখানি দুরত্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তাই নিজেই কিছুটা ঘন হয়ে দাঁড়াল শেহজাদ। বুক টানটান করে শেহজাদ আদেশ করল,
‘পাঞ্জাবির বোতাম লাগিয়ে দাও।’

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ৯