খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ৩৯

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ৩৯
আভা ইসলাম রাত্রি

শেহজাদ চিত্রার চুলে হাত বুলিয়ে দেয়। চুল গুছিয়ে দেবার ভঙ্গি করে সুধায়,
‘নতুন শাড়িতে রক্ত লেগে যাচ্ছে। গোসল করে নিই?’
চিত্রা শুনে না। বরং হাতের বাঁধন আরো শক্ত করে! তার জড়িয়ে ধরার ভঙ্গিমা প্রমাণ করে যে, যে মানুষটা আপাদমস্তক স্বয়ং চিত্রার,তার কাছে কিসের সংশয়। তার রক্তের দাগ চিত্রার নতুন শাড়ি নষ্ট করে খানখান করে দিক।

চিত্রার তাতে এটুকু মন খারাপও হবে না , কখনো না। চিত্রা ফুঁপিয়ে উঠে। কেঁদে কেঁদে বুক ভাসায়। শেহজাদ ক্লান্তিকর দৃষ্টিতে চেয়ে দেখে সব। নারীর ভালোবাসা একজন পুরুষের জীবনে সবচেয়ে বড় অর্জন। যে পুরুষ যত যত্নে নারীকে ভালোবাসে, নারী সেই পুরুষে দ্বিগুণ ভালোবাসায় মত্ত রয়। শেহজাদ চিত্রার পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়। মৃদু স্বরে আওড়ায়,
‘আমি ঠিক আছি, কান্না থামাও।’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

চিত্রা দু চোখ মুছে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। শেহজাদ দেখে, চিত্রা কেঁদে চোখ-মুখ মাখিয়ে ফেলেছে একদম। শেহজাদ মনেমনে কিছুটা আশাহত হয়। যদি আল্লাহ চাইতেন, সে রাস্তায় মারা যেত? চিত্রা এখন কেঁদে যাচ্ছে, তখন কি করত? শেহজাদের সন্তান! কি হত তাদের? চিত্রাকে অসহায় দেখলে শেহজাদ মরে গিয়েও শান্তি পাবে না। শেহজাদ আবেগে চিত্রার গালে হাত গলিয়ে দেয। চিত্রা চোখ বুজে দু ফোঁটা জল ছাড়ে। শেহজাদ দু কদম এগিয়ে এসে বড্ড আচমকা জিজ্ঞেস করে,

‘আমি মারা গেলে তুমি আমার সন্তানকে নিয়ে কি করবে, সুভাসিনী? দ্বিতীয়–
শেহজাদের বলতে কষ্ট হচ্ছে। চিত্রার শরীরে অন্য কারো স্পর্শ শেহজাদ মোটেও বরদাস্ত করবে না। দুনিয়া তোলপাড় হয়ে গেলেও নিজের স্ত্রী সন্তানের ভাগ কাউকে দিবে না। কিন্তু এ দুনিয়া বড্ড স্বার্থপর! শেহজাদের জীবনে অনেক বড় ঝুঁকি আছে। ঝুঁকি জেনে বিয়ে করেছে,ভালোবেসেছে স্ত্রীকে, সন্তান জন্মেছে।

এসব মায়া ছেড়ে শেহজাদ একদিন জীবন বিসর্জন দিতেও পারে। এতকিছু জেনেও শেহজাদ ভাবতেও পারছে না, স্ত্রীর দ্বিতীয় বিয়ের কথা। কিন্তু আজকের পর ভাবতে হচ্ছে, হবে। শেহজাদ থামে কিছুক্ষণ। গলা ভিজিয়ে আবারো চোখ সরু করে নরম গলায় প্রশ্ন করে,

‘আমি মারা গেলে তুমি আবার বিয়ে করবে, সুভাসিনী! যে ভালোবাসার ওয়াদা আমি পূরণ করতে পারব না, সেই ওয়াদা পূরণের দায়িত্ব অন্য কেউ নিবে। আমি চাইনা, অল্পবয়সে তুমি স্বামী ছাড়া সারাটাজীবন ধুকে ধুকে মরো। সুভাসিনী, তোমার গায়ের সাদা শাড়ি আমার চক্ষের বিষ সমতুল্য। আমি মরে গেলেও এই রঙের শাড়ি যেন কখনো তোমার গা স্পর্শ না করে।’

চিত্রা শেহজাদের কথা শুনে হতভম্ব হয়ে যায়। দু চোখের কান্না থেমে শুকিয়ে গেছে এতক্ষণে। গলায় যেন কেউ পাথর চেপে রেখেছে। গলাটা এত জ্বলছে কেন? শ্বাস নিতে পারছে না চিত্রা। শেহজাদ চিত্রার কপালে ঠোঁট বসায়। বিরবির করে আওরায় কটা কথা,

‘মারা গেলেও জানবে, শেহজাদ আয়ুষ্মান তার কথা রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে। স্ত্রী সন্তানকে ভালোবাসতে সে এটুকু কার্পণ্য করেনি। নিজের সকল ওয়াদা পূরণ করেছে। শুধু একটা ওয়াদা রক্ষায় সে হেরে গেছে, একসঙ্গে বেঁচে থাকার ওয়াদা!’

চিত্রা অনুভব করে তার নাকের উপর অশ্রু ফোঁটা। বুকটা ফেটে যায় চিত্রার। শেহজাদ কেন এতটা ত্যাগ স্বীকার করছে? শুধুমাত্র চিত্রাকে ভালো রাখার জন্যে! চিত্রা জানে এসব শেহজাদের মনের কথা নয়। যে শেহজাদ স্ত্রীর উপর পরপুরুষের সামান্য নজর সহ্য করতে পারে না, সেই শেহজাদ তার স্ত্রীকে মৃত্যুর পর অন্য পুরুষকে বিয়ে করতে বলছে? চিত্রা শেহজাদের বুকের পাঞ্জাবি দু আঙুলের মুঠোয় খামচে ধরে। আদ্র কণ্ঠে করে বসে কঠিন এক প্রশ্ন,

‘উল্টোটা হয় যদি? আমি মারা গেলে আপনি কি করবেন? আমাকে যেভাবে বলছেন, নিজেও তেমন ভাবে দ্বিতীয় বিয়ে করবেন? আমাদের সন্তানের জন্যে সৎ মা আনবেন ঘরে? উত্তর দিন!’
শেহজাদের কণ্ঠমনি স্পষ্টভাবে কেঁপে উঠে। চিত্রার কপাল থেকে ঠোঁট সরিয়ে অবিশ্বাস্য চোখে তার দিকে চায়। চিত্রা পুনরায় ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে,

‘চুপ কেন? উত্তর দিন।’
শেহজাদ কি বলবে ভেবে পায় না। চিত্রার থেকে চোখ সরিয়ে বিছানায় ঘুমিয়ে থাকা ছেলের দিকে চায়। পরপরই ছেলের দিকে এগিয়ে চিত্রার কথার সরাসরি অদেখা করে। শেহজাদ ঘুমন্ত ছেলের গালে চুমু খায়। চিত্রা সব দেখে। তারপর শেহজাদের কাছে দ্রুত কদমে এগিয়ে এসে আবারো জিজ্ঞেস করে,

‘উত্তর দিলেন না কেন? নিজের বেলায় সবসময়ই আপনি ভালো থাকতে চান। আমার গায়ের সাদা শাড়ী আপনার পছন্দ নয়। ঠিকাছে। পরব না আমি সাদা শাড়ি কোনোদিন। পরব না আপনি মারা গেলেও। তবুও দয়া করে এসব দ্বিতীয় বিয়ে এসব বলে আমাকে অপমান করবেন না আর। আমি যেভাবে আপনার গায়ে অন্য নারীর স্পর্শ সহ্য করতে পারব না, তেমনি আমি জানি আপনিও পারবেন না। অযথা এসব বলে আমাদের বৈবাহিক সম্পর্ককে অপমান করবেন না। হাত জোড় করছি আমি।’

শেহজাদ ছেলেকে কোলে নিয়ে চিত্রার দিকে চায়। স্পষ্ট গলায় বলে,
‘বাস্তবতা এত সহজ নয়।’
‘আপনি কঠিন বানাচ্ছেন।’

শেহজাদ আরো কিছু কথা বলতে চায়। বলতে চায় নিজের জীবনের অজস্র ঝুঁকির কথা। কিন্তু বলতে পারে না। ছেলে ঘুম থেকে উঠে কাঁদতে শুরু করে। চিত্রা আর কথা বাড়ায় না। বারবার শেহজাদের এমন মহান সাজা চিত্রার অসহ্য লাগতে শুরু করেছে। চিত্রা শেহজাদের কোল থেকে ছেলের নিজের কোলে নিয়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। শেহজাদ পালঙ্গের হাতল শক্ত করে চেপে ধরে। চোখ দুটো লাল হয়ে আসছে। ধিক্কার এমন জীবনকে। যে জীবন হারিয়ে ফেলার ভয়ে বিধবা স্ত্রীকে অন্য পুরুষের হাতে তুলে দেবার জন্যে বাধ্য করে।

আকীকা প্রায় শেষের দিকে। এবার আয়ুষ্মান বংশের দ্বিতীয় নাতীর নামকরণ করার পালা। শেহজাদ ছেলেকে কোলে নিয়ে বসে আছে। একে একে সবাই অনেকগুলো নাম বলে। শেহজাদের পছন্দ হয়না সেগুলো। শেহজাদ আয়ুষ্মান এর ছেলের এসব অভিন্ন নাম কেন হবে? শেহজাদ রান্নাঘরের দিকে চায়। চিত্রা উঁকিঝুঁকি দিয়ে এদিকে চেয়ে। শেহজাদের চোখে চোখ পড়লেই রাগে লুকিয়ে যাচ্ছে। শেহজাদ হালকা হাসে। তারপর উঠে দাঁড়ায়। ঘোষনা করে নেতার একমাত্র ছেলের নাম!
ছেলের কানের কাছে হালকা আওয়াজে জপে সে,

‘শাহবীর আয়ুষ্মান, শাহবীর আয়ুষ্মান, শাহবীর আয়ুষ্মান!’
নাম শুনে আজকের আকীকাতে আসা সকল মেহমান একজোট হতে উচ্চারণ করল. ‘আলহামদুলিল্লাহ! উত্তম নাম!’
নওশাদ ছেলের কাঁধে হাত রেখে শিশুর দিকে তাকান। কি নিশ্চিন্তে শেহজাদের কোলে ঘুমিয়ে আছে শিশুটি। যেন এমন ভরসার স্থান ইহজনমে আর কোনোদিন তার পাওয়া হবে না। নওশাদ হাসেন। তার নিজের যৌবনকালের কথা মনে পরে যাচ্ছে। শেহজাদ, মেহ্জাদের আকিকার দৃশ্যের কথা আজ খুব মনে পরছে। ঘুমন্ত দুই ছেলের কানে এভাবেই নওশাদ নাম জপেছিলেন। শেহজাদ নওশাদ এর দিকে তাকায়। গম্ভীর কণ্ঠে সুধায়,

‘নাম কেমন লেগেছে, আব্বাজান?’
নওশাদ হাসেন হালকা। ছেলের কোল থেকে ঘুমন্ত নাতিকে নিজের কোলে নিয়ে নেন। নাতির নরম গালে হাত ডুবিয়ে সুধান,

‘একদম বাপ কা বেটা! শেহজাদ- শাহবীর! আয়ুষ্মান বংশের দুই নক্ষত্র!’
বাকিরাও প্রশংসা করে নামের। শেহজাদ আবারো রান্নাঘরের দিকে চায়। চিত্রা পর্দার আড়ালে এদিকেই চেয়ে। শেহজাদ এবার দাঁত দেখিয়ে হেসে ফেলে। চিত্রা শরীর যেন সেই হাসি দেখে থম হয়ে যায়। সমস্ত রাগ গলে মুহূর্তেই পানি হয়ে যায়। আশ্চর্য হয়ে চেয়ে থাকে অমাবস্যার চাঁদের ন্যায় অত্যন্ত সুন্দর এক হাসির পানে।

নওশাদ এবং শেহজাদ বাড়ির লাইব্রেরীতে বসে আছেন। দুজনের হাতে ধোয়া উঠা চায়ের কাপ। শেহজাদ বই বন্ধ করে বেশ সময় ধরে ঠাই মাথা নিচু করে বসে আছে। না নিজে কিছু বলছে আর নাইবা নওশাদকে এখান থেকে যেতে দিচ্ছে। একসময় চা শেষ হয়। নওশাদ টেবিলে চায়ের কাপ রেখে বলেন,

‘চা আরো দুকাপ আনানো দরকার। আমার মনে হয়, তোমার সেই জরুরি কথা বলা শেষ হতে রাত পেরুবে।’
শেহজাদ এবার নড়েচড়ে বসে। চা কবেই ঠান্ডা হয়ে গেছে। ঠান্ডা চা এক চুমুকে শেষ করে টেবিলে রাখে। তারপর সরাসরি চায় নিজের আব্বাজানের দিকে। জড়তা ভেঙে স্পষ্ট কণ্ঠে বলে,
‘আমার জীবনের ঝুঁকির কথা চিন্তা করে আমি এক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আব্বাজান।’
‘কি সিদ্ধান্ত?’

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ৩৮

নওশাদ তীক্ষ্ণ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন। শেহজাদ গম্ভীর গলায় জানায়,
‘আল্লাহ না করুন- আমি যদি কোনোদিন শত্রুপক্ষের আঘাতে মারা যাই, সুভাসিনী আবার বিয়ে করবে। অল্পবয়সে তাঁকে বিধবার কাপড় পড়ানো হবে না। আর আমি চাই, আপনারা আমার শেষ ইচ্ছা হিসেবে এই বিয়ের সকল দায়িত্ত্ব নিজ কাঁধে নিবেন।’

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ৪০