খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ৪০

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ৪০
আভা ইসলাম রাত্রি

শেহজাদ গম্ভীর গলায় জানায়,
‘আমি যদি কোনোদিন আল্লাহ না করুন- শত্রুপক্ষের আঘাতে মারা যাই, সুভাসিনীকে আবার বিয়ে করবে। অল্পবয়সে তাঁকে বিধবার কাপড় পড়ানো হবে না। আর আমি চাই, আপনারা আমার শেষ ইচ্ছা হিসেবে এই বিয়ের সকল দায়িত্ত্ব নিজ কাঁধে নিবেন।’

নওশাদ ছেলের কথা শুনে কিছুটা চমকে যান। শেহজাদ যথেষ্ট বিচক্ষণ পুরুষ! দূরদর্শী চিন্তার ক্ষেত্রে তার জুড়ি মেলা ভার। এমন পুরুষের কণ্ঠে নিছক ছেলেমানুষী কথা শুনে তিনি যারপরনাই বিস্মিত। নওশাদ ভরাট গলায় প্রশ্ন করেন,
‘তুমি যা বলছ এ ব্যাপারে কি তুমি সম্পূর্ণ নিশ্চিত?’
শেহজাদ ক্লেশপূর্ণ চোখে বলে,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘আমি সম্পূর্ণ ভেবেই বলছি। আমার জীবনের পেছনে অনেক শত্রু পরে আছে। যাদের সকাল শুরু হয় আমাকে খু/ন করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আর রাত শেষ হয় আমাকে খু/ন করতে না পারার আফসোস নিয়ে। একজনের নাম আমি জানি! তার জন্ম আমাদের এই আয়ুষ্মান পরিবার থেকে। আমার পরবর্তী শিকার সেই হতে যাচ্ছে।’
নওশাদ এসব শুনে কথা হারিয়ে ফেললেন বোধকরি। তাজ্জব হয়ে বললেন,

‘কিন্তু তুমি বলেছিলে তোমার গাড়ি এক্সিডেন্ট—’
‘ওটা করানো হয়েছিল, আমাকে মেরে ফেলার জন্যে।’
শেহজাদের কথা শুনে নওশাদ আতঙ্কে চেয়ারের হাতল শক্ত করে চেপে ধরে অবাক চোখে চেয়ে থাকেন ছেলের দিকে। শেহজাদ থামে, পরপর জানায়,

‘কে করেছিল সেটা আমি জানি। অতি শীঘ্রই তার মুখোশ উন্মোচন হবে, এবং সেটা করবে এই শেহজাদ আয়ুষ্মান নিজে।’
নওশাদ শুনেন। আরো কিছু কথা বলতে চান তার পূর্বেই কোথা থেকে হন্তদন্ত হয়ে লাইব্রেরীতে ছুটে আসে পলাশ আয়ুষ্মান। লাইব্রেরীর দরজায় টোকা দিলে ভেতর থেকে শেহজাদ অনুমতি দিয়ে আরাম করে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে। যেন এই মুহূর্তে যে সার্কাস চলবে সেটা সম্পর্কে শেহজাদ আগে থেকেই জ্ঞাত! পলাশ ভেতরে ঢুকে। শেহজাদ এর কপালে শুধু নামমাত্র এক ব্যান্ডেজ! পুরোটা শরীর অক্ষত এবং সুস্থ। পলাশ ভেতরে ভেতরে চিরবিরিয়ে উঠে। রাগে চোখ লাল হয়ে এলে নিজেকে সামলে পলাশ দুঃখভরা কণ্ঠে বলে,

‘শেহজাদ, শরীর কেমন এখন তোমার? শুনলাম শহরে যাবার পথে গাড়ির সঙ্গে ট্রাকের ধাক্কা লেগেছে?’
শেহজাদ আরাম করে থুতনিতে হাত ঠেসে চোখ ছোটছোট করে পলাশের দিকে চায়। তারপর ঈষৎ ভ্রু কুঁচকে বলে,
‘আপাতত ভালো আছি। তবে যে এক্সিডেন্ট করিয়েছে তাকে যোগ্য জবাব দিতে পারলে আরো বেশি ভালো থাকব।’

পলাশ এমন কথা শুনে থতমত বনে যায়। ভেতরে ভেতরে ভয় উপচে পরে। শেহজাদ বেঁচে ফিরেছে কেন? এখন শেহজাদের ভয়ানোক থাবা থেকে পলাশকে কেউ বাঁচাতে পারবে না। শেহজাদ চতুর পুরুষ, মুহূর্তেই জেনে যাবে এই দুর্ঘটনার পেছনে কার হাত ছিল? অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে আয়ুষ্মান মহলে নিজের এক জায়গা তৈরি করেছে পলাশ। আছে এক কুৎসিত উদ্দেশ্য। শেহজাদ মারা গেলে সে উদ্দেশ্যে প্রাণ পেতে বেশী দেরি হবে না। অথচ শেহজাদ বেঁচে গেছে। সঙ্গে বেড়ে গেছে পলাশের জীবনের ঝুঁকি! শেহজাদ পলাশের চিন্তিত চেহারা দেখে ভেতরে ভেতরে শান্তি অনুভব করে। জিজ্ঞেস করে,

‘কি ব্যাপার পলাশ? তোমার মুখের রং বদলে যাচ্ছে কেন?’
পলাশ সঙ্গেসঙ্গে গা ছাড়া ভাব দেখিয়ে হেসে বলে,
‘তোমার জন্যে বাড়ির সবাই যেমন চিন্তায় ছিল শেহজাদ তেমনি আমিও ছিলাম। চিন্তার রং ফুটেছে বোধহয় চেহারায়।’
শেহজাদ থুতনি থেকে হাত সরায়। উঠে ধীর কদমে এগিয়ে যায় পলাশের দিকে।

পলাশ ভ্রু কুঁচকে শেহজাদের এগিয়ে আসা প্রতিটা পদক্ষেপ দেখে। আতঙ্কে পলাশের গলার পানি শুকিয়ে যায়। তবুও পলাশ মুখের অভিব্যক্তি স্বাভাবিক রেখে তাকিয়ে থাকে শেহজাদের ঠিক চোখের দিকে। শেহজাদ এগিয়ে গিয়ে পলাশের চওড়া কাঁধে হাত রাখে। কাধে ঈষৎ শক্ত করে দুটো চাপড় দিয়ে ময়লা ঝারার ভঙ্গি করে সুধায়,

‘সকলকে চিন্তা করতে মানা কর কারণ আমি ফিরে এসেছ। যে বা যারা এই দুর্ঘটনার পেছনে ছিল, শেহজাদ তাদের জীবন জাহান্নাম করে দেবে। সবাইকে জানিয়ে দিও এ কথা।’
পলাশ শুনে মাথা দুলায়। শেহজাদ বেরিয়ে যায় লাইব্রেরী থেকে। যাবার আগে শেহজাদের গায়ের সঙ্গে পলাশের চওড়া হাতে ধাক্কা লাগে। পলাশ ব্যথায় হাত চেপে ধরে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকে শেহজাদের যাবার দিকে।

চিত্রা শাহবীরকে ঘুম পাড়িয়ে সবে জানালার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। মনে পরছে শেহজাদের একেকটা কষ্ট দেওয়া কথা। শেহজাদ কেমন করে বললেন এসব কথা। চিত্রা শেহজাদের স্মৃতি ভুলে অন্য পুরুষকে বিয়ে করবে? তার বুকে মাথা রাখবে, যেমন করে শেহজাদের বুকে মাথা রেখে ঘুমায়। সেও চিত্রার মাথায় হাত বুলিয়ে দিবে, যেমন করে শেহজাদ প্রতি রাতে দেন? আর চিত্রাকে তেমন করে আদর–! না না! শেহজাদের হাতের স্পর্শ ছাড়া আর কারো স্পর্শ চিত্রা নিজের শরীরে পরতে দেবে না। কোনোদিন নয়, এতে চিত্রার মরণ হলে হোক!

আর ভাবতে পারছে না চিত্রা। দু চোখ বেয়ে জল গড়াচ্ছে। সব কথা ছাপিয়ে চিত্রার কানে বাজছে শেহজাদের প্রথম বলা কথা! শেহজাদের জীবনে ঝুঁকি আছে! যেকোনো সময় শেহজাদ মারা যেতে পারে। এইজন্যেই শেহজাদ চিত্রার ভবিষ্যৎ পূর্ব থেকেই ভেবে রাখতে বাধ্য হচ্ছে। চিত্রা আদৌ বেঁচে থাকতে পারবে, যদি এমন কিছু সত্যি ঘটে? কক্ষনো নয়!
ভাবনার মধ্যে লাগাম টানে এক ভরাট কণ্ঠস্বর শুনে,

‘ঠান্ডা লেগে যাবে! ঘরে চলো।’
চিত্রা পাশে তাকায়। শেহজাদ পাঞ্জাবি গায়ে এদিকেই চেয়ে। শুভ্র রঙের পাঞ্জাবি পরিধান করা শেহজাদকে দেখে বরাবরই পবিত্রতার কথা মাথায় আসে। এমন সুপুরুষ পাওয়া যেকোনো নারীর স্বপ্ন থাকে। চিত্রা না চাইতেও তাকে পেয়েছে! তার ভালোবাসা অর্জন করেছে।তার সন্তানের মা হয়েছে। যতবার চিত্রা নিজেকে এ সুপুরুষের অর্ধাঙ্গিনী কল্পনা করে, ভালো লাগায় চিত্রার বুক কেঁপে উঠে। এইতো, এখনো কাঁপছে।

শেহজাদ হয়ত বুঝে, এ নারী আবারো শেহজাদে ডুবে গেছে। শেহজাদ ভেতরে ভেতরে কেমন আত্মিক প্রশান্তিতে খলবলিয়ে উঠে। চিত্রা হাত চেপে দু কদম এগিয়ে যায়। শেহজাদ জানে, এক্ষুনি মোক্ষম সময়, দুপুরের রাগ ভাঙ্গানোর।তাই শেহজাদ সময়টাকে কাজে লাগায়। শেহজাদ হাত চিত্রা নরম গালে ডুবে! চিত্রা তাকায় শেহজাদের ঘোলাটে চোখের দিকে। বরাবরের মত নিজের সর্বনাশ দেখে সেই চোখে।

শেহজাদ হাত গালের পেছনে নিয়ে চিত্রার চুল মুঠো করে ধরে ঠোঁটের দিকে এগিয়ে যায়। চিত্রা এবার বরাবরের মত চোখ বন্ধ করে না। চেয়ে দেখে শেহজাদের এগিয়ে আসা, শেহজাদের গরম নিঃশ্বাস অনুভব করে, হাতের অস্বাভাবিকতাও অনুভব করে। ঠোঁটে ঠোঁট যখন ছুঁইছুঁই, ঠিক তখন চিত্রা হাত দিয়ে শেহজাদের ঠোঁট চেপে ধরে তাকে আটকে ফেলে। শেহজাদ চায়, চোখের ইশারায় আটকানোর কারণ জানতে চায়। চিত্রা নিচু স্বরে সুধায়,

‘এবারে আমি রাগ নয়, কষ্ট পেয়েছি! কষ্ট মুছে ফেলার পদ্ধতি আজ এটা নয়!’
কথাটা বলেই চিত্রা শেহজাদের থেকে সরে গিয়ে চোখ মুছে বিছানার দিকে এগিয়ে যায়। শেহজাদ ভ্রু কুঁচকে একান্ত সরল নারীর বিড়াল থেকে বাঘ হতে যাওয়া পরখ করে।

পলাশ সুহাস ঠাকুরের অফিসের দরজা শব্দ করে খুলে ভেতরে ঢুকে গেল অনুমতি ছাড়াই। সুহাস তখন টেলিফোনে কথা বলছে। পলাশকে দেখে সুহাস আর কথা না বাড়িয়ে টেলিফোন কেটে দে। সুহাসের দিকে খুশি খুশি চেটে উঠে দাঁড়ায়। পলাশের দিকে এগুতে এগুতে বলে,

‘মরে গেছে শেহজাদ না? শালা, আজকে আমিষ ভোজন করে মেয়ে নিয়ে সারারাত মাস্তি করমু! পলাশ, পলাশ, পলাশ! তুমি আমাকে জীবনের সবচেয়ে বড় উপহার দিয়েছ। কি চাও তুমি? শুধু একবার বলো!’
কথাগুলো বলে পলাশকে সমস্ত শক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরল সুহাস ঠাকুর। পলাশের কাঁধে হাত বুলিয়ে দিতে পলাশ পাথরের মত শক্ত হয় জানায়,

‘শেহজাদ মরে নি, বেঁচে আছে!’
থমকে যায় সুহাস ঠাকুর। সঙ্গেসঙ্গে পলাশকে ছেড়ে দু কদম পিছিয়ে যায় সুহাস। বিস্মিত হতে সুধায়,
‘অসম্ভব! এত বিশাল ট্রাকের ধাক্কা খেয়ে শেহজাদের গাড়ি দুমড়ে মুচড়ে যাবার কথা! শেহজাদ বেঁচে ফেরার প্রশ্নই আসে না।’

পলাশ দাতে দাঁত চেপে ধরে রেগে রেগে জানায়,
‘ঠিক বলেছ তুমি। শেহজাদের গাড়ি ঠিকই দুমড়ে মুচরে গেছে। কিন্তু শেহজাদ— ও বেঁচে আছে। আমি আগেই বলেছিলাম, এরকম কাঁচা খেলা খেলো না। সময় যাক আরো, আমি আমার পা শক্ত করি আয়ুষ্মান মহলে। অথচ তুই শালা! তোর তো মেয়ে নেশা বড় ছিল।

জলদি শপথ ভেঙে ফুর্তি করবি ভেবে আজকে আয়ুষ্মান মহলে আমার জায়গা নড়বড়ে হয়ে গেছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, শেহজাদ জানে ওর এক্সিডেন্ট আমি করিয়েছি।ও হয়তো ভাবছে, ওর সেই গোপন পারিবারিক শত্রু আমি। অথচ আমি জানি, আমি সে নই। আমি নিজেই জানিনা কে এসবের পেছনে কলকাঠি নড়ছে। শালা, এতবড় রাজনৈতিক ব্যক্তি হয়ে তুই খোঁজ লাগাতে পারস না, শেহজাদের সেই প্রধান শত্রু কে? থু তোরে!’

সুহাস পলাশের এসব কড়া কড়া কথা শুনে প্রচন্ড রেগে যায়। রেগে তেরে এসে পলাশের শার্টের কলার ধরে নিজের দিকে টেনে নিয়ে হিসহিসিয়ে বলে,
‘আমি জানি সে কে! ওর কথা আমি তোরে বলব কেন? কে তুই? দু আনার চামচা কোথাকার! অন্যের কথায় নিজের ভাইকে খেতে গেছিলি।’

পলাশ শুনে, কলার থেকে সুহাস হাত সরিয়ে নিয়ে সরাসরি চোখে চোখ রেখে আত্মবিশ্বাস নিয়ে স্পষ্ট কণ্ঠে বলে,
‘আমি জানি তুই জানিস না ওই অজ্ঞাত লোকের কথা। মিছামিছি বাণী ছাড়িস না আমার সামনে। একবারে মুখের নকশা বদলে দিমু। আর আমি তোর কথা এসব কেন করছি, সেটা আমি তোরে বলব কেন? কে তুই? শালা গো হারা পুরুষ!’

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ৩৯

সুহাস রেগেমেগে অস্থির হয়ে যায়। একদম আঁতে লেগেছে পলাশের কথাগুলো। আর না, অনেক হয়েছে! এবার ওই অজ্ঞাত শত্রুকে মাথা বেঁধে খুঁজতে হবে। অনেক হয়েছে লুকোচুরি খেলা! এবার মুখোশ উন্মোচন করার সময় এসেই গেছে!

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ৪১