সে আমার সুকেশিনী পর্ব ৫

সে আমার সুকেশিনী পর্ব ৫
রাউফুন

যত দিন যাচ্ছে মিনহাজের অস্থিরতা বাড়ছে বৈ কমছে না৷ নিজের অনুভূতি পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। বিউটি তার জন্য কি তা প্রগাঢ় ভাবে অনুভব করছিলো মিনহাজ। প্রতিটি মুহুর্ত বিউটিকে ছাড়া তার কাছে কঠিন মৃত্যু যন্ত্রণা সম লাগছিলো! দপদপ পায়ে সিড়ি বেয়ে নিজের রুমে গিয়ে বসলো মিনহাজ। সে ফ্রেশ হয়ে গায়ে টিশার্ট জড়িয়ে নিলো। যথাক্রমে, যথা সময়ে আজকে কফি না পেয়ে সে গলা উঁচিয়ে ডাকলো।

‘রাহেলা বুবু, আমার রুমে কফি নিয়ে আসুন!’
দশ মিনিট পর রাহেলা কফি নিয়ে রুমে এলো। কফির মগ নিঃশব্দে রেখে ফিরে আসতে নিলে একটু অবাক হলো মিনহাজ। কোনো রকম বাক্য বিনিময় না করে তো রাহেলা যায় না রুম থেকে। কফি এনেই ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করে থাকে তাকে। আজকে তাকে ওমন ফ্যাকাসে লাগছে কেন? কি হয়েছে তার? নিশ্চয়ই আবার কিছু গন্ডগোল করেছে ঐ আদবহীন বেয়াদব টা। মিনহাজ স্থির হয়ে কাষ্ঠ কন্ঠে বললো, ‘কি হয়েছে রাহেলা বুবু? সুমন্ত আবার কিছু করেছে?’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

রাহেলা লজ্জায় মাথা নত করে ফেললো। তিনি এই বাড়ির পরিচারিকা কিন্তু মিনহাজ তাকে বড় বোনের স্থানে বসিয়ে যে সম্মান দিয়েছে সেটা সে বলে প্রকাশ করতে পারবে না। মিনহাজ তাকে কখনোই পরিচারিকা হিসেবে ট্রিট করেইনি। সুমন্ত আর নিহাত রাহেলার দুই ছেলে। সুমন্তর বয়স ষোলো, ভীষণ ডাকাবুকো, বাড়ন্ত ছেলে। উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপন করে মিনহাজের নাকের ডগায় বসে। নিহাতের বয়স দশ বছর। পড়াশোনায় বেশ ভালো।

ক্লাসে ফার্স্ট প্লেস টা তারই থাকে। চল্লিশ বছর বয়সী এই নারীকে দেখে কেউ বলবে না তার বয়স এতো কম। অথচ বৃদ্ধ স্বামী, দুই ছেলে এবং ভাইয়ের জন্য অতিরিক্ত টেনশনে চুলে পাক ধরে তাকে ষাট বছর বয়সী বৃদ্ধা মনে হয়। লজ্জার কারণে রাহেলা যখন কিছুই বলতে পারলো না তখন মিনহাজ নিজেই বললো, ‘রাহেলা বুবু আপনি কেন লজ্জা পাচ্ছেন? যা করেছে সুমন্ত করেছে। ওঁকে এতো সাবধান করার পরও শুধরালো না। ও কি আবারও আপনার গায়ে হাত তুলেছে? বলুন বুবু!’

রাহেলা তখনও নত মস্তকে দাঁড়িয়ে চোখের জল ফেলছেন। ছেলে মায়ের গায়ে হাত তুলেছে এটা কি কম লজ্জার একজন মায়ের জন্য? একজন মা দশ মাস দশ দিন সন্তানকে গর্ভে ধারণ করে কি এই দিনটা দেখার জন্য? মায়ের বিসর্জন গুলো কি সন্তানের চোখে পরে না? রাহেলার নিশ্চুপ থাকাটা অনেক কিছু বুঝিয়ে দিয়েছে। মিনহাজের পুরো শরীর জ্বলছে রাগে, ক্ষোভে। এই যে রাহেলা বুবু, আজ এই নারীর জন্য সে এতো দূর পর্যন্ত এসেছে।

মিনহাজ আর তার বয়সের পার্থক্য মাত্র পাঁচ বছরের। পনেরো বছর বয়সী মিনহাজ একটা ভয়ংকর দুর্ঘটনায় বাবা মা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাওয়ার পর রাহেলার সঙ্গে পরিচয় হলো মিনহাজের। বাবা মাকে নিয়ে সেই ভয়ংকর অতীত টা সে আর ভাবতেই চাই না। সেই ছোট বেলা থেকে তার বাবার এই পুরো বাড়িতে ছয় জন পরিচারিকা সহ রাহেলা সহ সাতজন এখানে আছে।

কুড়ি বছর বয়সে রাহেলা গ্রাম থেকে শহরে এসে দিশাহারা অবস্থায় প্রতিটি মুহুর্ত আতংকে ছিলো৷ সদ্য যুবতী মেয়ে ভোর সন্ধ্যায় কি করুন ভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলো৷ কত গুলো নোংরা লোকের কবলে পরে রাহেলা একেবারেই মূর্ছা গেছিলো। ভয়ে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করছিলো।

প্রাণপনে নিজের জীবন বাঁচানোর জন্য ছুটা রাহেলার ধাক্কা লাগে পনেরো বছর বয়সী মিনহাজ এর সঙ্গে। মিনহাজ কোচিং করে বাড়ি ফেরার সময় তাকে দেখতে পায় ঐ অবস্থায়। ছোটো বেলা থেকেই একটা পাউয়ার তার তৈরি হয়ে গেছিলো। বাবার অঢেল ধনসম্পদ এর জোরেই তো হয়েছিলো সেটা। তাই সেই ছেলে গুলোর ব্যবস্থা করতে মুহুর্তের মধ্যেই ফোনে ছবি ক্লিক করে নিয়েছিলো মিনহাজ। পরবর্তীতে পুলিশের হাতে তুলে দিয়ে রাহেলা আর…..

‘মিনহাজ ভাই, তুই আর কত করবি আমাদের জন্য? এবারে ছাড়, একটু নিজের কথা ভাব। সুমন্ত উচ্ছ্বন্নে গেছে একেবারে। এতো বছর হলো, এভাবে বিগড়ানো ছেলেকে কি আর মানুষ করা যায়?’
‘যায় রাহেলা বুবু! আমি এর একটা ব্যবস্থা না করে আমি ক্ষান্ত হবো না। এতো দিন তোমার সন্তান বলে ছাড় পেয়েছে। কারণ ওঁর কিছু একটা হলে তুমি বাঁঁচবে না। ঐ কুলাঙ্গারের জন্য তোমার এতো কিসের দরদ শুনি? ওঁ তোমাকে কখনোই মা হিসেবে মানেই নি। এবারে দেখো আমি কি করি!’

‘মিনহাজ ভাই, ভাই শুন, যতোই হোক ওঁ তো আমার সন্তান। মা হয়ে সন্তানের জন্য কবর তো খু’ড়ে দিতে পারি না আমি তাই না?’
‘যে ছেলে মায়ের গায়ে হাত উঠায় তাকে কি করে ছাড়ি বলো তো? তুমি পারলেও আমি পারবো না। আমায় বাঁধা দেবে না তুমি। ওঁর মতো বেয়াদবের জন্য এবারে আলাদা করে আমাকে ভাবতে হবে।’
রাহেলা আর একটিও শব্দ বের করতে পারলো না কণ্ঠনালী থেকে। মিনহাজের ঘর থেকে প্রস্থানের সময় বড্ড ইতস্ততের সঙ্গে বলা কিছু কথা শুনলো।

‘রাহেলা বুবু, একটি মেয়েকে আমার ভালো লাগে, ভীষণ পছন্দ করি তাকে। কিন্তু তার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। এখন কি তার কাছে আমার অনুভূতি ব্যক্ত করা উচিত হবে? পরামর্শ চাইছি তোমার কাছে।’
এতক্ষণে অমাবস্যায় অন্ধকারে ঢাকা রাহেলার মুখ উজ্জ্বল হয়ে গেলো। চকচক করে উঠলো আঁখিদ্বয়।হাসি মুখে উল্লসিত গলায় বললো, ‘এতো বছরে তবে কাউকে ভালো লাগলো। নাম কি তার? বাড়ি কোথায়, কি করে, কোন মেয়ে! অফিসের কেউ নাকি কোনো বাচ্চা মেয়ের প্রেমে পড়েছিস তুই?’

‘আহাহ্ বুবু, থামো, থামো! আমি কি পঁচিশ বছরের টগবগে যুবক নাকি যে বাচ্চা মেয়েকে পছন্দ করবো? এতোটা খারাপ রুচি আমার, তোমার মনে হয়?’
‘আচ্ছা কবে যেতে হবে বলো তো ওঁদের বাড়ি!’

মিনহাজ ভীষণ মন খারাপ করে বললো, ‘বুবু মেয়েটির এখন বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। আমার তাকে এখন প্রপোজাল দেওয়াটা কতটা সমীচীন বুঝতে পারছি না। তুমি এর একটা সমাধান দাও বুবু! আমার জীবনে ভালো মন্দ সব কিছুই তো এতো বছর তুমি দেখে এসেছো। তুমি না থাকলে হইতো আমি আর এভাবে বেঁচে থাকতাম না।’

রাহেলার মন খারাপ হলো মুহুর্তেই। উত্তেজিত হয়ে মিনহাজের কথাটা পুরো ভাবে আমলে নেইনি পছন্দের ব্যাপারটা ছাড়া। সেও দারুন মন খারাপ করে বললো,’ দেখে দেখে এমন মেয়েকে আমার ভাইয়ের মনে ধরলো? আচ্ছা, ওঁর তোকে নিয়ে কেমন অনুভূতি বুঝেছিস? ওরঁ ও কি তোকে ভালো লাগে? আমার ভাই এতো সুন্দর তাকে তো যে কোনো মেয়ের ভালো লাগবেই। তারও কি তোক নিয়ে একই অনুভুতি? বুঝিস কিছু?’

‘আর অনুভুতি বুবু, সেই নির্দয়া, নিঠুরও নারী আমার দিকে তাকিয়ে কথায় বলে না পর্যন্ত। বরং তার ত্বেজে আমার ভয় লাগে। ভয় পায় আমি তাকে!’
রাহেলা হো হো করে ঘর ফাটিয়ে হাসলো। মিনহাজ মুখ চোরা করে অসহায় ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইলো রাহেলার দিকে। রাহেলা হাসি থামিয়ে বললো, ‘মেয়ের নাম কি? তোর অফিসের কেউ?’

‘ওঁর নাম বিউটি। আমার অফিসের বেস্ট এমপ্লয়ি!’
‘আহাহ তাহলে জল এতো দূর অব্দি গড়িয়েছে। যেহেতু এতো দিন থেকে দেখছিস তাহলে আগে বলিস নি কেন? এখন বিয়ে ঠিক, এখন আসছস নিজের কথা বলতে! আমি কি করবো এখন?’ গুমরা মুখে বললো রাহেলা।
‘আগে বুঝতে পারলে না বলবো। তুমি এর একটা সমাধান করো প্লিজ!’

রাহেলা চিন্তায় পরে গেলো। সেই প্রথম বারের পর ছেলেটা দ্বিতীয় বার কাউকে মনে জায়গা দিলো। আর এখানেও একটা ঝামেলা। কি হবে এবারে? এই ছেলেটার কি কখনোই সুখ হবে না? কি করবে সে এখন?

‘প্রিয়তমেষ্যু, আমার প্রাণ প্রিয় সুপ্রিয় ভাই, আপনি জানেন আমি এখন উনত্রিশ বছর ছুঁইছুঁই? আমার সায়র নামের ছেলেটার সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়ে হয়েছে সেপ্টেম্বরের ষোল তারিখে। আর আমার জন্মদিন পনেরো তারিখে। আমি প্রতি বারের মতো এবারেও আমার জন্মদিনের দিন আপনার আসার অপেক্ষা করবো। এবারে কেন যেনো মনে হচ্ছে আমার জীবনে নতুন কিছুর আবির্ভাব ঘটবে। নতুন উদ্ভাষে আমিও ভাসবো। কারণ আমার এবারে আলাদা কিছুই অনুভব হচ্ছে। কেন এমন হচ্ছে তার কারণ জানি না তবে মন বলছে আলাদা কিছুই ঘটবে। আর আপনি জানেন, আমার অফিসের বস… ‘

বিউটি আরও কিছু লেখার মধ্যেই হুরোহুরি করে মারিয়াম তার রুমে প্রবেশ করলো। বড়সড় কিছু ঘটেছে মারিয়ামের মুখের অবস্থা দেখেই বুঝলো বিউটি। কি হতে পারে আন্দাজ করলেও চুপ করে রইলো সে। মারিয়াম কোনো বাক্য বিনিময় ছাড়াই সরাসরি বললো,’ ভাই আমারে বাঁচা৷ আমি ঐ জানুয়ার টার সঙ্গে যাবো না। ওঁ আবার আমার সহজ সরল বাবা মাকে পটিয়ে আমাকে ঘরে নিতে চাইছে। কিন্তু তুই তো জানিস, আমার পক্ষে কখনোই ওঁর কাছে যাওয়া সম্ভব না। ওমন আঁষটে গন্ধওয়ালা,নোংরা, চোর, বাটপার এর সঙ্গে আমি আর সংসার করবো না। শু’য়রে’র বাচ্চা হাত পা ধুঁয়ে আমার পিছে লেগে আছে!’

‘শান্ত হ মারিয়াম। আশ্চর্য, আবার কি করেছে সিজান?’
‘ঐ জানুয়ারের নাম মুখে নিবি না। ঐ একই কাহিনি, বার বার বাড়িতে এসে বাবা মাকে কনভিন্স করছে। বলছে জীবনে আর কোনো ভুল সে করবে না। কিন্তু কুকুরের লেজ কি কখনোই সোজা হয়! আমার বাবা মা যে আবার ঐ পা’গ’লা কুত্তার ফাঁদে পা দিয়েছে রে। এবারে বেশ ভালোই কনভিন্স করেছে! আবার যদি আমায় ওখানে পাঠায় পরবর্তীতে আমার লাশ আসবে, ওঁ আমাকে মে’রে ফেলবে দেখে নিস!’

বিউটি মারিয়াম কে শান্ত করার চেষ্টা করলো। মারিয়াম ভয়ে অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপছে। কথার প্রকোপে গলা কেঁপে উঠছে বার বার। সে মারিয়ামের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, ‘ডিভোর্স পেপারে তো সই হয়ে গেছে তবুও কেন এমন করছে?’
‘জানি না, ঐ বর্বর, পা’গ’লা কু’ত্তা আমায় নাকি ডিভোর্স দিবে না। ভাব একবার কতটা জঘন্য! আমি চাকরি করবো আর ঘরে বসে জোয়া খেলা, মদের আসর জমাবে। উউচ্ছৃঙ্খল মেয়ে এনে বেলাল্লাপনা করব। এবারে এসে কি বলছে জানিস, বলছে সে রিহ্যাবে গিয়ে সংশোধন হয়ে ফিরেছে। আর বাবা মাকে এমন ভাবে পটিয়েছে যে বাবা মা ওঁর কাছে ছাড়বে বলে কথা দিয়েছে।’

সে আমার সুকেশিনী পর্ব ৪

‘আশ্চর্য, এখানে যখন তোর জীবনের প্রশ্ন তখন আংকেল আন্টি কিভাবে চাইছেন তোকে ওঁর কাছে পাঠাতে?’
‘সেটাই তো। বাবা মা উলটো ভুজুংভাজুং আমাকে বুঝাতে চাইছে।’
‘তুই চিন্তা করিস না আবারো আমি আংকেল আন্টিকে বোঝাবো।’
‘এবারে সব কিছু তোর হাতে বোন!’

সে আমার সুকেশিনী পর্ব ৬