সে আমার সুকেশিনী শেষ পর্ব 

সে আমার সুকেশিনী শেষ পর্ব 
রাউফুন

কনের সাজে বসে আছে বিউটি। আজ বিউটির বিয়ে। ধুমধামে সুপ্রিয় আর বিউটির বিয়ে হচ্ছে। কোনো কিছুর কমতি নেই। এসব কিছু অবশ্যই সুপ্রিমর জেদে হচ্ছে। বিউটিকে হসপিটাল থেকে রিলিজ করে আনা হয়েছে কয়েক ঘন্টার জন্য! বিয়ে পরানো শেষ হলেই আবার তাকে অবজারভেশনে নেওয়া হবে।

বিউটি নিজের এই অনিশ্চিত জীবনের সঙ্গে কাউকে জড়াতে চাইনি বলেই বিয়ে করতে চাইনি সুপ্রিয়কে। কিন্তু সুপ্রিয়র অবাধ পাগলামীর কাছে হার মানতে হয়েছে তাকে। সবার মুখেই রয়েছে হাসি। বিউটির বাবা, মা, ভাই, ভাবি সবাই যে আড়ালে কাঁদে সেটা আর কেউ না জানলেও বিউটি খুব ভালো করেই জানে। ক্ষনে ক্ষনে ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসছে। বিয়ে পরানো হবে রাত আট টাই।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এখন বাজে সাতটা। এই দুই দিনের মধ্যে যে এতো জমজমাট আয়োজন হবে তা ছিলো বিউটির কল্পনাতীত! মারিয়াম দরজার আড়াল থেকেই নিজেকে সামলালো। চোখ ভর্তি জল আড়াল করে ধীর পায়ে রুমে এলো। বিউটির পাশে বসলো এবং বিউটিকে মুগ্ধ হয়ে দেখলো। কি সুন্দর দেখাচ্ছে মেয়েটাকে। কে বলবে মেয়েটির ব্লাড ক্যান্সার এর মতো ভয়াবহ অসুখ করেছে। ভেতরে হাড় ক্ষয় হয়ে ঝাজড়া হয়ে গেছে। তাকে পলকহীন তাকিয়ে থাকতে দেখে বিউটি কেশে উঠলো। দুই ঠোঁট চেপে ধরলো।

‘কি হলো? এভাবে কি দেখছিস।’
বিউটি মিষ্টি হেসে শুধালো মারিয়ামকে। বিনিময়ে মারিয়াম মিষ্টি করে হাসলো। বললো, ‘সবাই বিয়েতে লাল বেনারসি পড়তে চাই আর তুই কি না কালো? সাদা, লাইট পিংক আরো কত রঙ আছে। কালোই কেন?’
‘সবাই আর আমি কি এক? আমি হলাম এক্সট্রা অর্ডিনারী! বুঝলি? কালো তে কি আমাকে জঘন্য লাগছে?’
মারিয়াম বিউটিকে জড়িয়ে ধরলো। মাথায় আলতো ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে বললো, ‘মোটেও না সোনামনা। এতোগুলা সুন্দর লাগছে।’

বিউটি হেসে ফেললো। বললো, ‘সুপ্রিয় ভাই ঘায়েল হবে বল?’
‘হবে মানে, পটল তুলবে!’
‘যাহ!’ বিউটি মৃদু ধাক্কা দিলো মারিয়ামকে।
‘তোদের বিয়েটা হচ্ছে শুকনা শুকনা বিয়ে।’
‘মানে? বিয়ে কি ভেজা ভেজা হয়?’
‘আমি কি বলেছি বিয়ে ভেজা ভেজা হয়?’
‘তাহলে শুকনা বিয়ে মানে টা কি?’

‘এই যে হুটহাট সব হচ্ছে, কোন আমেজ নাই, বিয়ে বাড়ি বলে মনেই হচ্ছে না। বিয়ে বাড়িতে মানুষ আসবে, আনন্দ করবে। তা না, এসে দুঃখ প্রকাশ করছে। এটা কিন্তু খুবই বাজে ব্যাপার হচ্ছে।’
বিউটি কিছু বললো না। গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। প্রসঙ্গ বদলাতে মুখে হাসি টেনে বললো, ‘আমাকে কি কালো বেনারসি তে ভালো লাগছে? ঠিক করে বল তো’

‘খুব সুন্দর লাগছে জানুউ! একদম প্রিন্সেস!’
‘থ্যাংক ইউ! সুপ্রিয় ভাই দেখলে অক্কা না গেলেও অজ্ঞান হবে নিশ্চিত!’
‘কিছুক্ষনের মধ্যে যার সঙ্গে তোর বিয়ে হতে যাচ্ছে, তাকে তুই এখনো ভাই বলছিস?’
‘তো কি বলবো?’

‘শুধু সুপ্রিয় বলবি! শোন, একটু পর কাজি আসবে, এসে দুটো সিগনেচার আর কবুল পড়াবে। দোয়া করবে, এরপর সোজা সুপ্রিয় ভাইয়ের বাড়িতে। তোকে বাসর ঘরে বসিয়ে দিবে।সবাই বাসর ঘরে যাওয়ার আগে বরকে আটকাবে, টাকা না দিলে বউকে দেখতে পাবে না৷ তোকে দেখার বা সুপ্রিয় ভাইয়া পারলে নিজের আজীবনের উপার্জিত ব্যাংক ব্যালেন্স দিয়ে দেবে৷ তারপর রাত বারোটা বাজবে। তোর দুরুদুরু বুক, সুপ্রিয় ভাই বাসর ঘরে প্রবেশ করবে৷ তোর একদম নিকটে আসবে আর…!’

‘চুপ কর মারিয়াম। লজ্জায় আমার মাথা কা’টা যাচ্ছে। এতো বেহায়াপনা কথা বার্তা কিভাবে বলছিস?’
‘বাসর ঘরের কথা শুনে লজ্জা লাগছে? লাগুক, আমার কথা শেষ হয়নি! যদি লজ্জা লাগে তাহলে বিয়ে করিস না।’
‘তোর হাত,পা ধরি, এবারে থাম!’

‘আগে পা ধর, তা না হলে সেন্টেন্স শেষ করবো।’
বিউটি সত্যি সত্যিই মারিয়ামের হাত চেপে ধরে অনুরোধ করলো আর কোনো বেফাঁস কথা না বলার জন্য! মারিয়াম হেসে লুটোপুটি খেতে খেতে বললো,

‘হয়েছে হয়েছে আর কিছু বলছি না। শোন, আমি বিয়ে করতে চাইতাম না কেন জানিস? রাত বারোটার কথা ভেবে। কথায় আছে না, টকের ভয়ে ছাড়লাম দেশ, তেঁতুল তলায় বাসা। সেই বিয়ে হলোই আর এমন একজনের সঙ্গে…!’
‘থাক না, পুরনো কথা মনে করে কি লাভ?’

‘কি হয়েছে জানিস? সিজানকে খুব বা’জে অবস্থায় পাওয়া গেছে একটা হসপিটালের সামনে। ওর যে বাজে মানুষের সঙ্গে আব-ভাব ছিলো আমার মনে হয় ওরাই ওর পেছনে ছু’রি মে’রেছে। এসিড আক্রান্ত, মুখের সারা শরীরেত খুবই কু’ৎসিত অবস্থা!’

‘আচ্ছা! তাকে দেখতে গেছিলি?’
মারিয়াম অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবে উত্তর দিলো।
‘নাহ!’
‘যাওয়া উচিত ছিলো তোর!’
‘মোটেও না। স্বার্থপরদের কে যত দ্রুত ভুলে যায় ততই ভালো।’
বিউটি আর কথা বাড়ালো না।

রাত আটটাই সুপ্রিয় আর বিউটির বিয়ে পড়ানো হলো। সুপ্রিয় সবার থেকে বিদায় নিয়ে বিউটিকে নিয়ে পৌঁছে গেলো নিজের বাড়ি। হাশেম আলী বিদায়ের সময় মেয়ের সামনে আসেননি। বারান্দা থেকে বুকে চাপা ব্যথা নিয়ে জল জল করা চোখে মেয়ের শেষ বিদায় দেখেছেন। সন্দিপ্তা, লিমন, শাহানা বেগম সবার অবস্থায় ছিলো ভীষণ করুণ। শাহানা বেগম জ্ঞান হারিয়ে গেছে। মেয়ের বিদায়ের সময় তার মনে হচ্ছিলো তার দেহ থেকে একটা অমূল্য অংশকে কে’টে ফেলে দেওয়া হয়েছে। এদিকে বিউটি ছিলো সম্পুর্ন নির্লিপ্ত। অতি শোকে পাথর হয়ে গেছে না হলে অধিক কষ্টে ভেতরে কষ্ট অনুভবের তীব্রতাটাই ম’রে গেছে। সেজন্যই হইতো তাকে কোনো কিছুই প্রভাব ফেলছে না।

মারিয়ামের বর্ণনা অনুযায়ী কিছুই তেমন হলো না এই বাড়িতে। বিউটি সুপ্রিয়র রুমে বসে ছিলো। সুপ্রিয় দশটার দিকে রুমে এলো। রুমে এসেই হাত ঘড়ি খুলতে খুলতে বললো,
‘কিছু নিয়মের জন্য এখানে এসেছিলাম। ড্রেস চেঞ্জ করে নে বিউটি। আমাদের বের হতে হবে!’

‘এক্ষুনি?’
‘হ্যাঁ!’
‘আজ আমাদের বিয়ে হয়েছে সুপ্রিয় ভাই!’
‘তো?’
‘তো আজকে…!’

সুপ্রিয় বিউটির দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। বিউটির মনোভাব বোঝার চেষ্টা করলো। ইশারায় জিজ্ঞেস করলো, ‘কি?’
‘আজকে তো আমাদের বাসর রাত তাই না?’
‘ফ্রেশ হয়ে নে আমি বাইরে আছি!’

বিউটি এই পর্যায়ে এসে ডুকরে কেঁদে উঠলো। সে নির্লজ্জের মতো কথা আগানোর চেষ্টা করলো আর সুপ্রিয় ভাই তাকে অগ্রাহ্য করলো। এই যে তাদের বিয়ে হলো একবারও চোখ তুলে তাকালো না পর্যন্ত। বললোও না কেমন লাগছে তাকে। সুপ্রিয়র গলায় কান্নারা কুন্ডলী পাকিয়ে যাচ্ছে। কথারা যেনো গুম হয়ে পেটের কোনো গোপন আস্তানায় লুকিয়ে আছে। সে কথা বলতে পারছে না।

‘সুপ্রিয় ভাই, আমাকে কি এতোটাই খারাপ লাগছে দেখতে?’
‘কি বলছিস এসব? খারাপ লাগবে কেন?’
কোনো রকমে জবাব দিলো সুপ্রিয়।
‘তাহলে আমার দিকে একবারও চোখ তুলে তাকালেন না কেন?’

কথা শেষ হওয়ার আগেই ঝড়ের বেগে সুপ্রিয় বিউটিকে বুকের সঙ্গে চেপে ধরলো। শুধু মাত্র তার ভেতরটা জানে ঠিক কতটা ভেঙে চু’ড়ে গেছে। খন্ড বিখণ্ড এই হৃদয়ের কথন, হাহাকার কি বিউটি শুনতে পায় না? বিউটি শব্দ করে কাঁন্না করছে। সুপ্রিয়র বুক উঠানামা করছে কান্না নিবারণের চেষ্টায় আছে সে। যদি সে দূর্বল হয়ে পড়ে, তবে তো যে বিউটিও নিজের মনোবল হারাবে। কিন্তু শখের নারীর এই ব্যথা যে সহনীয় নয়৷ কিভাবে সে মেনে নেবে সবকিছু? একটা মিনিট নষ্ট করার সময় নেই। বিউটিকে বুকের সঙ্গে পিষে ফেলবে এভাবে চেপে ধরেছে। ইচ্ছে করছে নিজের বুকের ভেতর লুকিয়ে রাখতে। সুপ্রিয় নিজেকে ধাতস্থ করে বললো,

‘আমি তোকে দেখিনি কে বললো? তোর দিকে তাকালে আমি দিন দুনিয়া ভুলে যায়। আশেপাশের সব কিছুই তখন আমার কাছে ধোয়াসা মনে হয়। আমাদের হাতে সময় নেই বিউটি। তোকে হসপিটালে যেতে হবে। এই রাত, এই সময়, এই রজনী আবার আসবে আমাদের জীবনে। কিন্তু তোকে যদি হারিয়ে ফেলি, আমি শেষ হয়ে যাবো একদম। তুই কি এটা চাস তোর সুপ্রিয় ভাই শেষ হোক?’

বিউটি সুপ্রিয়র বুক থেকে মাথা তুললো। সুপ্রিয়র দু হাতে প্রিয় পুরুষের চোখ মুছে দিলো। সুপ্রিয়র মুখে দেখে কাঁদতে কাঁদতেই হেসে দিলো সে। হাসতে হাসতে বললো, ‘সুপ্রিয় ভাই, কাঁদলে আপনাকে মেয়েদের মতো লাগে। একদম নাকে মুখে বাঁধিয়ে ফেলেন। ইশ! কি কিউট জামাই আমার।’

সুপ্রিয় চ’ট করে দুই হাত দিয়ে পুরো মুখ মুছে ফেললো। বললো ‘একদম হাসবি না। আমার সঙ্গে ফাজলামো হচ্ছে?’
‘ইশ হাসবো না, বললেই হলো? আমার তো সুরসুরি লাগছিলো। এভাবে কেউ জড়িয়ে ধরে। একদম হাড় মাংস এক করে দিচ্ছিলেন এক্ষুনি!’

‘চুপ একদম কোনো কথা না। যাও ড্রেস চেঞ্জ করে নাও। আমি অপেক্ষা করছি।’
বিউটি ড্রেস চেঞ্জ করে এলো। সে অজু করে এসে সুপ্রিয়কে বললো অজু করে নিতে। তারা নামাজ পড়বে। তারপর যাবে। অজু শেষ করে স্বামী স্ত্রী দুজনেই নামাজ পড়ে নিলো। নামাজ শেষ করে বললো, ‘চলুন!’
‘সুপ্রিয় কোনো কথা না বলে সবাইকে বলতে তার সায়রের দাদীকে বলে বিউটিকে নিয়ে বের হলো হসপিটালের উদ্যেশ্যে। গাড়িতে বসে বিউটি বললো, ‘একটা আবদার করবো?’

‘কি?’
‘মিনহাজ স্যারের বাসায় যায় একটু?’
সুপ্রিয় শুধু একবার বিউটির মুখের দিকে তাকালো। বিনাবাক্য ব্যয়ে চললো মিনহাজের বাসার উদ্যেশ্যে।
বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে অনবরত কলিংবেল চাপলো। একবার কলিং বেল বাজতেই দরজা খুলে গেলো। মিনহাজের চোখ মুখের করুণ অবস্থা। বিউটি আর সুপ্রিয়কে দেখে বললো, ‘আরে তোমরা? আজ না তোমাদের বিয়ে!’
বিউটি এগিয়ে গেলো। বললো, ‘আপনি যান নি বলে কি আমার আসা যাবে না?’

‘কেন যাবে না। এভাবে বলো না প্লিজ। প্লিজ কাম!’
বিউটি আর সুপ্রিয় ভেতরে গেলো।
‘এবারে বলুন, কি অবস্থা আপনার! সুমন্ত আর নিহাতের কি অবস্থা?’
‘আমি ভালো আছি। সুমন্তকে ঘরে আটকে রাখতে হয়নি সে এমনিতেই বাইরে যা-ওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। আর নিহাতকে ওর মাকে ছাড়া সামলানো দায় হচ্ছে। বাচ্চা ছেলে, ও তো আর সবটা বোঝে না।’

‘একটা বিয়ে করে নিন। আমাদের অফিসের যে মেয়েটা আছে না? রিমি? ওঁকে বিয়ে করুন। মেয়েটা
খুব ভালোবাসে আপনাকে। আমার বিশ্বাস সে আপনার কথার বাহিরে কোনো কথা বলবে না। এটা আমার আপনার কাছে শেষ চাওয়া বলতে পারেন।’

মিনহাজের চোখ টলমল করছে। সে অপ্রাকৃতস্থ ভাবে হাসলো। সুপ্রিয় আর বিউটি উঠে দাঁড়ালো। বিউটি একটু এগিয়ে গেলো, সুপ্রিয় পেছন থেকে মিনহাজের কাছে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলো। মিনহাজ ক্ষনিকের জন্য যারপরনাই অবাক হয়ে যায়। পরক্ষণেই সুপ্রিয়র পিঠে হাত রাখলো। সুপ্রিয় বললো, ‘নিজের জীবনটা গুছিয়ে নিও ভাই। রিমি মেয়েটা সত্যিই ভালোবাসে তোমাকে!’

‘তোমরা সুখে থেকো সুপ্রিয়! আমার দোয়া সব সময় তোমাদের সঙ্গে রয়েছে। তবে বিয়েটা, আমার দ্বারা হবে না। এক মনকে নিয়ে আর কত টানা হেচড়া করবো?’
সুপ্রিয় মাথা নত করলো। আর কিছু বললো না। বিউটি আর সুপ্রিয় চলে এলো। মিনহাজ দু-চোখ মুছে অন্য দিকে তাকালো। মনে মনে বললো, ‘ এই মন, এই দেহ, এই প্রাণ, সবকিছুরই অধিকার আমি তোমায় দিছিলাম বিউটি। এই জায়গা টা আর কারোর জন্য না। কারোর জন্য না। কেউ পাবে না। আর কাউকে তো তোমার অধিকার দিতে পারবো না।’

পরিশিষ্ঠঃ
‘আরেকটা আবদার করবো?’
‘আবার কি?’
‘আপনার সেই প্রিয় জায়গায় যাবো। নিয়ে যাবেন?’
সুপ্রিয় শক্ত চোখে তাকালো। বিউটি মিষ্টি হেসে বললো, ‘প্লিজ! শেষ ইচ্ছে। আমার কেন যেনো মনে হচ্ছে, আমি আর কখনোই যেতে পারবো না ঐ জায়গায়, আজকে না গেলে।’
সুপ্রিয় কঠিন মুখে সেই স্থানে গাড়ি নিয়ে গেলো। বিউটির ভেতরটা কেমন যেনো করছো। সে অসুস্থতা গায়ে মাখলো না। সে দোলনায় চেপে বসলো।

‘শুনুন না, সেদিনের মতো পাতার ফুল বানিয়ে দিন প্লিজ!’
সুপ্রিয় চুপচাপ ফুল বানিয়ে দিলো। বিউটি আনন্দে সেগুলো দিঘির জলে ভাসালো। তম্বন্ধেই বিনা মেঘে, বিনা বজ্রপাত, বিনা আমন্ত্রণে ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হলো। বিউটি আর সুপ্রিয় দৌড়ে সেখানে উঠানো এক তলা বাড়িতে উঠে পরলো। এই বাড়িটাও সুপ্রিয় বানিয়েছিলো বিউটির আর তার জন্য। তাদের একান্ত সময় কাটাবে বলেই বানানো হয়েছে বলা যায়।

বিউটি খাটের উপর বসে পা দুলাচ্ছে আর মিটিমিটি হেসে সুপ্রিয়র মুখোভাব দেখছে। হঠাৎই বিউটি মিষ্টি ঝংকার তুলে খিলখিল করে হেসে উঠলো। বৃষ্টির শব্দের সঙ্গে এক অপরূপা নারীর হাসির ছলকানিতে যেনো সবকিছুকে আরও আকর্ষণীয় লাগছিলো। সুপ্রিয় সেই হাসিতে আটকে গেলো। ক্ষনে ক্ষনে সেই হাসির শব্দ ঘরের প্রতিটি কোণায় বাড়ি খাচ্ছে। বিউটি হাসি থামিয়ে বললো,

‘শোবেন না?’
‘নাহ!’
‘এভাবে রাত জেগে বসে থাকবেন? সুপ্রিয় ভাই, আপনার সুকেশিনী সব সময় আপনার সঙ্গে থাকবে। আমার শেষ সম্বল, শেষ স্মৃতি রোমন্থন করে রেখে গেলাম আমার ডায়েরিতে। আমি না থাকলেও ডায়েরি টা আপনাকে সঙ্গ দেবে।’

‘তুই চুপ করবি? আবার আজেবাজে কথা? আমি তোর কিছুই হতে দেবো না। আগামীকাল ভোরে আমাদের ফ্লাইট ভুলে গেলি?’
‘এতো আয়োজন করে তো লাভ নাই। আমার শেষ সময় ঘনিয়ে এসেছে। আমি বুঝতে পারছি।’

‘থাপ্পড় দিয়ে দাঁত কপাটি নাড়িয়ে দিবো। এতো সব তোকে বুঝতে হবে না, আমাদের বুঝতে দে।’
‘আচ্ছা ওতো রাগ করছেন কেন? আসুন, আমার কাছে আসুন। এত দূরে কেনো? ঝুমঝুম করে বৃষ্টি হচ্ছে, ঠান্ডা বাতাস বইছে। আপনার কি ভয়ংকর কিছু করতে ইচ্ছে করছে না?’
‘নাহ!’ সুপ্রিয় গাল ফুলিয়ে বারান্দায় অগ্রসর হলো। বিউটি উঠে গিয়ে সুপ্রিয়কে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। ফিসফিস করে বললো,

‘সত্যিই? আম্ম….!’
সুপ্রিয় সামনে ঘুরলো। বিউটির কথা শেষ হলো না। আগ্রাসী চুম্বনে তার দু-ঠোঁট আবদ্ধ করে নিলো তার ঠোঁটে। টপটপ করে চোখের পানি পড়ছে সুপ্রিয়র চোখ থেকে। ছেলেদের নাকি কাঁদতে নেই। কিন্তু সে তো কাঁন্না নিবারণ করতে পারছে না। ভেতরটা খাঁ খাঁ করছে। এটা সে কিভাবে বুঝাবে?

প্রাণ প্রিয় স্ত্রীর এই অবস্থায়, প্রিয়তমা নারীর ভয়ংকর অসুখের তাড়নায় ভেতরটা যে তার চুড়মার হয়ে যাচ্ছে। প্রতিনিয়ত গুমড়ে গুমড়ে মরে যাচ্ছে সে।
বিউটিকে ছেড়ে দিয়েছে সুপ্রিয়। আবার ঘুরে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে সে। লজ্জায় বিউটির মুখ লাল হয়ে উঠলো। মাথা নুইয়ে চুপ করে রইলো। সুপ্রিয় নিজেকে সামলে আবারও সামনে ঘুরলো। বিউটিকে লজ্জা পেতে দেখে বিউটির ঠোঁটে আবারও চু’মু দিলো। পরপর অনেক গুলো চুমুতে বিউটির মুখে। বললো,

‘তোকে এত সুন্দর লাগছে কেনো? আমি অন্য দিকে মনোনিবেশ করতেই পারছি না।’
বিউটির লজ্জার পরিমাণ আরো বেড়ে গেলো।
দাঁত মুখ খিঁচে বারান্দা থেকে ছুটে এসে বিছানায় বসলো। দু-চোখ বন্ধ করে, চাদর খামচে ধরলো। পেছনে পেছনে সুপ্রিয়ও এলো। বিউটি তার অস্তিত্ব অনুভব করে আড়ষ্ট হয়ে বললো,
‘আগে বুঝি আমি সুন্দর ছিলাম না, সুপ্রিয় ভাই?’

‘উমম আমি তাই বলেছি? আমার বউকে সব সময় সুন্দর লাগতো। সেই ছোট্ট বেলায় তোকে আমার মনের কুঠুরিতে বসিয়েছিলাম। আজও সেই স্থান অনড় রয়েছে। কিন্তু আজকে বেশিই আকর্ষণীয় লাগছে। আমি কিছুতেই নিজেকে…!’
বিউটি চুপ করে রইলো। কয়েক মুহূর্ত বাদে সুপ্রিয় ফিসফিস করে বলে উঠে,
‘আমার মস্তিষ্ক খুবই অন্যায়, ভয়ংকর কিছু করার ইঙ্গিত দিচ্ছে। আমি নিজেকে সামলাতে পারছি না। তুই অসুস্থ আর আমি….!’

‘স’স’সশিহ! আজ, এখন, এই মুহুর্তে কোনো আজেবাজে কথা না। কোনো দুঃখের কথা না। শুধু সুখের আলাপ করুন! শুধুই সুখের। আমার বার বার মনে হচ্ছে আর সময় পাবো না। এই সুন্দর দিনটা আর পাবো না। যদি পায় ও এতো সুন্দর হবে না সেই দিন।’

‘তুই কি জানিস? তোর সব কিছু আমাকে ম্যাগনেটের মতো আকর্ষণ করছে। তোর নাক,ঠোঁট, চোখ, হাসি, গোলাপি, হাসির সঙ্গে তোর লজ্জা রাঙা গাল সবকিছু বিশেষ ভাবে আমাকে টানছে। বিশেষ করে তোর ঘাড়ের তিলটা।’
কথাগুলো বিউটির কানে পৌঁছাতেই তার শরীর কা’টা দিয়ে উঠলো। এত লজ্জা এর আগে পায় নি সে। মনের উথালপাথাল ঢেউকে সে থামাতে পারছে না। চাইছেও না সে এই ঢেউ থামুক। তার ভালো লাগছে। সে নিজেকে ধাতস্থ করে বিছানায় শুয়ে পরলো। ঘোরগ্রস্থ কন্ঠে বললো,’ আজ তো কোনো বাঁধা নেই। আজ সব বাঁধা, সংশয়, বিবাদ সবকিছুই ঘুচে গেছে। এতো সংকোচ কেন তবে? আমি অপেক্ষা করছি সুপ্রিয় ভাই!’

কথাটা বলেই বিউটি দাঁতে জিব কা’ট’লো। সে কি ভুল ইঙ্গিত করলো? সুপ্রিয় বিছানায় বিউটির পাশে শুতে শুতে বললো,’ কেন এমন অন্যায় আবদার করছিস? এই চেনা অজানা ঝড় কেন তুলছিস? আমি তো নিজেকে সামলে নিচ্ছি! তুই অসুস্থ। সব কিছুর উর্ধ্বে তুই। তুই ছাড়া আমার কাছে অন্য কোনো কিছুর দরকার নেই। শুধু তোর ভালো থাকাটা ইম্পর্ট্যান্ট। আমি অনেক কষ্টে নিজেকে দমিয়ে রেখেছি। ভালোবাসার মানুষটার থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখাটা যে কতটা কষ্টের তুই বুঝবি না।’

‘আমি কি বলেছি নিজেকে দমিয়ে রাখুন? একই কষ্ট কি আমি পাচ্ছি না, সুপ্রিয় ভাই?’
ব্যাস! সুপ্রিয় আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। চোখ বন্ধ রেখেই গা এলিয়ে দিলো বিউটির উপর। বিউটি কাঁপছে, গলা শুকিয়ে আসছে তার। বিউটিকে আগলে, ডান হাতের বাহুতে জড়িয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো সুপ্রিয়। এখন সে বিউটির কম্পন স্পষ্ট টের পাচ্ছে। ধীরে ধীরে বিউটির কানের কাছে তার মুখ নিয়ে এলো। তপ্ত নিঃশ্বাস উপচে পড়ছে বিউটির রেশম কালো কেশে। সাথে সাথে শরীরের কম্পন দ্বিগুন গতিতে বেড়ে গেলো বিউটির। দুই হাতে খামচে ধরলো সুপ্রিয়র টি’শার্ট। সুপ্রিয় অত্যন্ত ধীর গলায় বললো,

‘আমার যে ভীষণ তৃষ্ণা পেয়েছে। সেই তৃষ্ণা নিবারণ করতে আমার তোকে লাগবে। অনুমতি পাবো কি?’
বিউটি মুখ লুকালো সবচেয়ে নিরাপদ বুকটাতে। তার সুপ্রিয় ভাইয়ের বুকে। পিঞ্জিরাতে যেমন পাখিকে বন্দি করে রাখা হয় সেভাবেই গুটিশুটি মে’রে সে তার প্রাণ প্রিয় স্বামীর বুকে মুখ লুকালো।

রাত দুটোর দিকে হঠাৎই বিউটির শ্বাস কষ্ট শুরু হলো। জ্বর বাড়লো। সে কিছুতেই সুপ্রিয়র বাহু বন্ধনী থেকে বের হতে চাইলো না। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগে প্রাণপ্রিয় স্বামীর মুখের দিকে তাকালো। পুরোটা সময় সে নিজের কষ্টকে যে কিভাবে লুকিয়ে রেখেছিলো একমাত্র সে জানে। নিখুঁতভাবে ভাবে অভিনয়ের সঙ্গে সে সুপ্রিয়কে সামলেছে। সে তার হাতের ডায়েরি খানা চেপে ধরলো। প্রাণের সুপ্রিয় ভাইয়ের বুকে শেষ বারের মতো ওষ্ঠ ছুঁয়ে দিলো। ইশ কি সুন্দর ঘুমাচ্ছে মানুষটা। এতো শান্তির ঘুম বোধহয় সে আর কখনোই আসেনি। বিউটির দু-চোখ বন্ধ হলে এলো। তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। ভীষণ। মৃ’ত্যু বুঝি এতোটাই যন্ত্রণার?

‘সুপ্রিয় ভাই, কি হয়েছে? মন খারাপ?’
‘বিয়ের এতো বছর হয়ে গেলো এখনো ভাই বলা ছাড়লি না? এই তোর জন্যই আমার মেয়ে আমাকে মা’মা ডাকছে। যাহ সর।’

বিউটি হেঁচকি তুলে কাঁন্না জুড়ে দিলো সুপ্রিয়ির ধমকে। চোখের পানি, নাকের পানি সব এক করে ফেলছে। ইতোমধ্যে সুপ্রিয়র শার্টখানার বিচ্ছিরি হাল করেছে।
‘এই বোকা মেয়ে,কাঁদছিস কেনো?’
বিউটি সুপ্রিয়র শার্টে স্বর্দি মুছে দিলো। নাক টেনে টেনে বললো,
‘আমার ইচ্ছা হয়েছে তাই প্রাণ ভ’রে কাঁদছি।’

‘তো দূরে গিয়ে কাঁদ। আমার শার্ট নোংরা করছিস কেন?’
‘আপনার কি সমস্যা, এটা আমার স্বামীর শার্ট। আমি শতবার নষ্ট করবো আপনার কি?’
‘সর আমাদের মেয়ে দেখছে। ইশ, এখন তো দেখছি তোর লজ্জা নাই। আগে তো আমাকে ঠোঁট কা’টা বলতি। লাজ লজ্জা কি সব ধুঁয়ে ফেলেছিস নাকি পঁচা পুকুরের পানিতে?’
‘ইশ, কি কথার ধরণ। বিয়ের পর সব মেয়েরি লজ্জা টজ্জা সব চলে যায়। বুঝলেন?’
‘আচ্ছা বুঝলাম।’

হঠাৎই শব্দে সুপ্রিয় পেছনে ঘুরে দাঁড়ালো। কাঙ্ক্ষিত ব্যাক্তিকে দেখে হাসলো। বললো, ‘আরও মঞ্জু, কখন এলে?’
‘এই তো মাত্রই।’
সুপ্রিয় এগিয়ে এলো। সাবধানী গলায় বললো, ‘আগামী কাল আমাদের বিয়ের পাঁচ বছর পূর্ন হবে। শুনো তোমার ভাবিকে সারপ্রাইজ গিফট দেবো। ও যেনো কিচ্ছু টের না পায়। তুমি চুপিসাড়েই সব কিছু অ্যারেঞ্জ করবে। বড় একটা কেক আনাবে, কেকের উপর লিখবে,’সে আমার সুকেশিনী। আমার সুকেশিনীকে স্পেশাল ফীল করাতে হবে। যেভাবেই হোক। কি পারবা না?’

‘পারবো ভাই।’
‘আর শুনো, তরুশিকেও তো কাল কাল স্কুলে ভর্তি করাতে হবে। তুমি প্লিজ এই দিকটাও দেখবে!’
‘অবশ্যই দেখবো ভাই!’
সুপ্রিয় আবার গিয়ে ঘাটে বসলো। বিউটি চোখ পিটপিট করে তাকালো। বললো, ‘কি কথা হচ্ছিলো?’
‘কই কিছু না তো। কি কথা হবে?’
‘কাল কি আছে মনে আছে?’

‘কি মনে থাকবে?’
‘কিছুই মনে নেই?’
‘আছে!’
‘কি?’
‘কাল আমাদের মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করাবো।’
বিউটি মুখ গোমড়া করে বললো, ‘তরু, তোর বাপের সঙ্গে কথা বলবি না!’
‘বাপ না মামা!’

তরুর উত্তরে সুপ্রিয় মুখ গোমড়া করলো। বিউটি খিলখিল করে হেসে উঠলো। সেই প্রথম দিনের মতো ঝংকার তুললো বিউটির হাসি। সঙ্গে তরুশিও হেসে উঠলো। মা মেয়ের খিলখিল হাসিতে মুখরিত হলো চারপাশ। বিউটি আর তরুশি দোলনায় চেপে বসলো। সুপ্রিয় হেসে দোল দিলো। মা মেয়েকে অগ্রাহ্য করার অধিকার কি তার আছে? গর্দান যাবে না?
পুনঃশ্চঃ

এরকম নানান ধরনের বাক্যলাপ সুপ্রিয় সর্বক্ষন করে যায়। সুপ্রিয়র থেকে সবাই দূরে গেলেও দূরে যায়নি শুধু মঞ্জু। এই নিড়লে, এই নির্জন স্থানে সে সুপ্রিয়র সঙ্গী। উঁহু খালি চোখে সে একমাত্র হলেও সুপ্রিয়র কল্পনায় আরও দুজন আছে। একজন তার স্ত্রী আর একজন তার কন্যা। মঞ্জুও বাস্তবে দাঁড়িয়ে সেই কল্পনায় অংশ নিয়েছে। সাধ দিয়েছে সুপ্রিয়র। দূর থেকে সে সুপ্রিয়র প্রতিটি কার্যক্রম দেখে। তাকে পাহারা দেয়।

সে আমার সুকেশিনী পর্ব ৩১

ভালবাসা যেমন মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে, আবার সেই ভালোবাসা মানুষকে জীবন্ত লাশ বানিয়ে দেয়। এই সবটাই সুপ্রিয় ভাইয়ের কল্পনা তার সুকেশিনীকে ঘিরে। বিউটির ডায়েরিতে যা কিছু লেখা আছে তার সবটা ঘিরে, সুপ্রিয় কল্পনায় খুঁজে পাই তার বিউটিকে। সে কল্পনায় সুখি হয়েছে, সুন্দর একটা সংসার বেঁধেছে তার সুকেশিনীর সঙ্গে।

সমাপ্ত