সে আমার সুকেশিনী পর্ব ৩০

সে আমার সুকেশিনী পর্ব ৩০
রাউফুন

মিনহাজের বাড়িতে পুলিশের গাড়ি। মিনহাজ যারপরনাই অবাক হয়ে উপর থেকে দেখলো সেটা। সকাল সকাল তার বাড়িতে পুলিশ কেন? সুমন্ত আবার কিছু করেছে নাকি? সে তড়িঘড়ি করে নিচে নামলো এবং সরাসরি সুমন্তর কাছে গেলো। এক দিনের মধ্যে তো আর বিউটির বলা সেই জ্বেল ঘরে তৈরি করা সম্ভব নয়।

সময়ের ব্যাপার এখানে। সুমন্তর ঘরে গিয়ে দেখলো সুমন্ত ঘুমাচ্ছে। মিনহাজ সেসব পরোয়া করলো না। ওর কলার চেপে ধরে দাঁড় করালো। ঘুমন্ত, সুমন্ত তখনো ঘুমে কাতর। হকচকিয়ে যাওয়া দৃষ্টি কোনো ভাবে স্থির করলো মিনহাজের উপর।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘হঠাৎ এরকম করার কারণ কি মামা? আমার কলার ধরছো কেন? আমি তো এখন বদলে গেছি তাহলে!’
‘তুই এমন কি করেছিস যে বাসায় পুলিশ আসছে?’
‘কই আমি কিছু করিনি তো!’
এর মধ্যে রাহেলা চেঁচামেচি শুনে নিচে আসলো।
‘কি হয়েছে মিনহাজ?’

‘বুবু ওঁকে জিজ্ঞেস করো, ও কি করেছে? আমি এক্ষুনি দেখলাম আমার বাড়িতে পুলিশের জীপ ঢুকছে।’
রাহেলার বুক ধ্বক করে উঠলো। সে ঘামতে শুরু করলো। হঠাৎই বাড়িতে পুলিশ কেন?
সুমন্ত নিজের মায়ের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত ভাবে হাসছে। সুমন্তকে হাসতে দেখে আরও আক্রোশে ফেটে পড়লো মিনহাজ। থাপ্পড় বসিয়ে দিলো গালে। সুমন্ত তবুও হাসছে। সে হাসতে হাসতেই বললো, ‘মামা আজকে আমি কিছু করিনি, বিশ্বাস করো। তবে আমার মনে হচ্ছে আজ অনেক বড় কিছুর মুখোমুখি হবে তুমি!’

রাহেলা ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লো। সুমন্তকে সে চেনে, সুমন্ত আর যায় হোক মিথ্যা কথা বলে না। সে এখন এমন কোনো কিছুই করেনি। যদি করতো তবে স্বীকার করতো অকপটে। আচ্ছা পুলিশ তাকে ধরতে আসছে না তো? না তা কিভাবে সম্ভব? তার ব্যাপারে কোনো ভাবেই তো জানা সম্ভব না! মুসা আর আলী কি এতো বছর পর ধরা পড়লো তবে? ওঁরা স্বীকার করে নাই তো? রাহেলার সর্বাঙ্গে কঁম্পন শুরু হয়েছে।

তম্বন্ধে কলিংবেল বেজে উঠলো। মিনহাজ সুমন্তকে ছেড়ে দিয়ে দরজা খুলতে গেলো। রাহেলা চললো উপরে। সুমন্ত আবারও বাকা হাসলো। মায়ের ঘাবড়ে যাওয়া টা তার নজর এড়াইনি। সে এখন ঠিক বুঝতে পারছে তার মা কি করবে!

রাহেলা পুরো ঘর, ড্রয়ার তন্নতন্ন করে খুঁজলো। নাহ কোথাও নেই ডায়েরিটা। সে কপাল চাপড়ালো। তার মানে এটা কেউ সরিয়েছে। কিন্তু কে? কে করলো এই কাজটা? তবে কি সত্যিই সে ধরা পড়ে গেলো? রাহেলা দরজায় খিল এঁটে বসে পরলো ফ্লোরে।

পুলিশরা ড্রয়িংরুমে বসে আছে। মিনহাজ সবচেয়ে বেশি অবাক হয়েছে পুলিশের সঙ্গে সায়রকে দেখে। সায়র পুলিশ এনেছে তার বাড়িতে? কি শত্রুতা তার সঙ্গে এই ছেলেটার? অনেকক্ষণের মৌনতা ভেঙে পুলিশ অফিসার জিজ্ঞেস করলেন,

‘মিষ্টার মিনহাজ আহমেদ! মিসের কাকনকে ডাকুন। আমরা উনার কাছে এসেছি!’
‘স্যরি, কাকন নামের তো এখানে কেউ এখানে থাকে না। আপনারা বোধহয় ভুল জায়গায় চলে এসেছেন।’
‘উঁহু উনারা সঠিক স্থানেই এসেছেন!’

‘মিষ্টার সায়র হোশেইন, আপনার তো আমার সঙ্গে ব্যাক্তিগত কোনো শত্রুতা নেই। তাহলে আপনি কেন আমার সঙ্গে এমন করছেন?’
‘আপনার সঙ্গে শত্রুতা নেই তো! সত্যিটা জানতে হবে আপনাকে।’
‘সত্যি? কিসের সত্যি?’

‘বলবো সব বলবো। আপনি এক কাজ করুন, আপনার বোন রাহেলাকে ডাকুন!’
‘নাহ ডাকবো না। কি হয়েছে আগে বলুন, না হলে ডাকবো না।’
‘ডাকতেই হবে। আপনি আমাদের ইনভেস্টিং এর সময় বাঁধা দিতে পারেন না। ডাকুন!’

অগত্যা বাধ্য হয়েই মিনহাজ হাঁক ছেড়ে ডাকলো রাহেলাকে। ডাক শুনে হকচকিয়ে উঠলো রাহেলা। মিনহাজ তাকে ডাকছে! কেন ডাকছে? বেশি দেরি করলে সন্দেহ বাড়বে। তাই দ্রুত নিচে যেতে হবে। সে নিচে নেমে এলে সুক্ষ্ম ভাবে পরখ করলো পুলিশ অফিসাররা। সঙ্গে মহিলা কন্সটেপল। রাহেলা দুরুদুরু বুকে নিচে তাদের সবার সামনে এসে দাঁড়ালো। দরজার আড়াল থেকে সবটা দেখে সুমন্ত আনন্দ পাচ্ছে। মায়ের ভীত-সন্ত্রস্ত, আঁটসাঁট হওয়া চেহেরায় বেরিয়ে আসায় উল্লাস হচ্ছে!

‘মিস কাকন ইউ আর আন্ডার এরেস্ট!’
রাহেলা ভেতরে ভেতরে নার্ভাস হলেও ফেস স্বাভাবিক রেখে বললো, ‘স্যরি? আমি রাহেলা। আপনি কাকন কাকে বলছেন?’

সুপ্রিয় মাথা চুলকে হাসলো। রাহেলার এখনো পিঠ বাঁচানোর অভিনয় দেখে সুপ্রিয় আবারও হাসলো! অদ্ভুত সেই হাসি। সেই হাসি আস্তে আস্তে অট্টহাসিতে পরিণত হলো। রাহেলার সামনে এক পা এক পা করে এগিয়ে গেলো সে। খুবই শীতল কণ্ঠে প্রশ্ন করলো, ‘আপনি কাকন নামের কাউকে চেনেন না তাই তো!’

‘ন-ন-নাহ!’
‘তুঁতলাচ্ছেন কেন তবে? ওহ্ না, আপনার মুখে ভয় স্পষ্ট? ভয় পাচ্ছেন কেন? আপনি কি কিছু করেছেন?’
‘হাউ ডেয়ার ইউ সায়র? তোমার সাহস হয় কিভাবে আমার বাড়িতে দাঁড়িয়ে থেকে আমার বুবুকে ইনসাল্ট করার।’ মিনহাজ হুংকার দিয়ে বলে উঠলো।

‘শশশশিহহহ্! একটাও কথা না মিষ্টার মিনহাজ। আমাকে কথা বলতে দিন। তো, সুপ্রিয় নামের কাউকে মনে আছে মিসেস কাকন? ওহ্ স্যরি মিসেস রাহেলা!’
মিনহাজ যারপরনাই অবাক, আশ্চর্য হয়ে তাকালো সায়রের দিকে। এই ছেলেটা এই নাম জানলো কিভাবে? যদি নামটা কারার থেকে শুনেও থাকে তবে রাহেলা বুবু যে সুপ্রিয়র নাম জানেন, সেটা জানলো কিভাবে সায়র?
‘তুমি কি বলতে চাইছো পরিষ্কার করে বলবে?’

‘মিসেস রাহেলা আপনার একটা পার্সনাল ডায়েরি আমার কাছে। এবার আপনি এই ডায়েরি সম্পর্কে কি রকম বক্তব্য রাখতে চান?’
রাহেলা দরদর করে ঘাঁমছে। ভয়ে অন্তরাত্মা কেঁপে
উঠলো রাহেলার। এবারে বাঁচার কোনো পথ নেই। তাকে স্বীকার করতে হবে সবটা।

পুলিশ অফিসার রাহেলাকে প্রশ্ন করলেন, ‘মিসেস কাকন, আমরা এই ডায়েরি পড়েছি। সবটা কি সত্যি? নাকি আরও অন্য কোনো গল্প বলতে চাইবেন আপনি? মিষ্টার সায়র বলছেন, আপনার সঙ্গে হ্যান্ডরাইটিংও ম্যাচ্ করবে। আশা করছি, আমরা হতাশ হবো না।’

রাহেলা জানে এখন বাঁচার পথ নেই। তাকে সব স্বীকার করতে হবে।
‘আপনারা যা পড়েছেন তার সবকিছুই সত্যি! তবে আমার একটা প্রশ্ন আছে, সায়রের কাছে আমার এই ডায়েরি পৌঁছালো কিভাবে?’

‘সেটা আপনার না জানলেও চলবে। চলুন আপনি আমাদের সঙ্গে থানায়!’
পুলিশ অফিসার রাহেলাকে এরেস্ট করলো। মিনহাজের মাথা ভোঁ ভোঁ করে ঘুরছে। রাহেলাকে নিয়ে যাওয়ার সময় বাঁধ সাধলো মিনহাজ। টলমলে পায়ে এগিয়ে গিয়ে বলল,

‘রাহেলা বুবু দাঁড়িয়ে যাও। কোন সত্যি ডায়েরিতে লিখে রেখেছো? আর কি-ই বা রহস্য? কে তুমি? তোমার আসল নাম কি? কি অপরাধ করেছো তুমি বুবু? আমাকে বলো। যদি তুমি নিরপরাধ হও আমি তোমাকে মুক্ত করবো। কেউ তোমাকে জ্বেলে পাঠাতে পারবে না! আর যদি সত্যিই অপরাধ করে থাকো, সেটা কি? আর সুপ্রিয় সম্পর্কে যেসব বলেছো সব কি মিথ্যা না সত্যি? সুপ্রিয় কে হয় তোমার?’

রাহেলা এতো এতো প্রশ্নের উত্তর দুলো দুটো লাইনে।
নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললো,
‘আমার নাম কাকন! সুপ্রিয় আমার স্টেপ ব্রাদার ছিলো। বাকিটা ডায়েরি পড়লে জানতে পারবে! ডায়েরির শেষ পৃষ্ঠায় তোমার জন্য দুটো লাইন লিখেছি পড়ো! খোদা হাফেজ!’

রাহেলাকে পুলিশ নিয়ে চলে গেলো। এখনো সুপ্রিয়র কাছে রাহেলার ডায়েরিটা। পরে পুলিশকে বুঝিয়ে দেবে সে এভিডেন্স হিসেবে! সুপ্রিয় বিষন্ন, ভগ্নহৃদয়ে বসে থাকা মিনহাজকে ডায়েরিটা এগিয়ে দিলো। মিনহাজ একবার সুপ্রিয়র দিকে তাকিয়ে ডায়েরিটা হাতে নিলো। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে ডায়েরি পড়া শুরু করলো। সায়র তার সামনের একটা সোফায় বসে রইলো।

সুমন্ত মায়ের প্রস্থান দেখেই দরজা আটকে দিয়েছে। ভাগ্যিস নিহাত স্কুলে চলে গেছিলো৷ স্কুল থেকে এসে বেচারা মাকে না পেলে কি হবে ভাবতেই মিনহাজের সর্বাঙ্গে শিরশিরানি অনুভব হলো। প্রায় অনেকটা সময় নিয়ে পড়লো মিনহাজ ডায়েরিটা। তার চোখ জলে ভর্তি। সে শুধু সায়রের দিকে একবার তাকিয়ে বললো, ‘তোমার কিসের দায় সায়র? তুমি রাহেলা বুবুকে ধরিয়ে দিলে কেন?’

‘আপনার মতো এমন বুদ্ধিমান, বিচক্ষণ মানুষকে সবটা ভেঙে বলতে হবে? আপনার কি মনে হয়? আমি কে?’
‘তুমিই কি তবে সুপ্রিয়?’
সুপ্রিয় কিছু বললো না। সে উঠে দাঁড়ালো।
‘ডায়েরিটা দিন। পুলিশের কাছে জমা দিতে হবে!’
‘আমার শেষ পৃষ্ঠার লেখাটা পড়া হয়নি!’
মিনহাজ পৃষ্ঠা উল্টালো। সেটুকু সময় দাঁড়ালো সুপ্রিয়।

“ভাই মিনহাজ, পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমি তোমার কাছে চির ঋনী। আমি কখনোই তোমার ক্ষতি চাইনি। আমি সত্যিই চেয়েছিলাম বিউটিকে তোমার কাছে এনে দেবো। সেজন্যই তোমাকে সুপ্রিয়র ভূমিকায় অভিনয় করতে বলেছিলাম। ক্ষমা করে দিও আমাকে, তোমাকে এতো এতো মিথ্যার আড়ালে রাখার জন্য। আমি যদি কখনো না থাকি, সুমন্ত আর নিহাতকে দেখে রেখো।

সুমন্ত ওতোটাও বা’জে ছেলে নয়৷ ওঁকে আমিই এই পথে এনেছি। তুমি ওঁকে তোমার মতো করে মানুষ করো। তোমার কাছে আরও ঋনী হয়ে গেলাম। আমাকে ঋণী করে দিলে আবারও ভাই। শুধু একটা কথা, এতো এতো মিথ্যার মাঝেও তোমার প্রতি আমার ভালোবাসাটা সত্যি। বড় বোনের ভূমিকায় অভিনয় করতে করতে সত্যিই কবে যে তোমার বড় বোন হয়ে উঠলাম বুঝতেই পারিনি৷ আবারও তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি।”

মিনহাজ শেষটুকু পড়া শেষ করেই সুপ্রিয়কে ডায়েরি ফিরিয়ে দিলো। সুপ্রিয় সঙ্গে সঙ্গে প্রস্থান ঘটালো। তার খুব ইচ্ছে করছিলো মিনহাজকে জড়িয়ে ধরে তাকে স্বান্তনা দিতে। কিন্তু তা আর হলো না৷ সকাল থেকে বিউটির খবর নেওয়া হয়নি। ওঁকে একটা কল করা দরকার। সে যেতে যেতে বিউটিকে কল করলো। বিউটির ফোন বাজতে বাজতে কে’টে গেলো।

কাল রাতের পর থেকে আজকের কোনো ঘটনায় বিউটি জানে না। সে যে রাতটা কিভাবে পার করেছে একমাত্র সেই জানে। তাকে উদ্ভ্রান্তের মতো লাগছিলো। কালকের সেই ছাই রঙা শার্ট খানা এখনো রয়েছে তার শরীরে। এই শার্টটা বিউটির অত্যন্ত অপ্রিয় শার্ট। গতকাল পাগলী মেয়েটার ওরকম কথা শুনে সে পা’গ’লের মতো ছুটে গেছিলো তাদের বাড়িতে। সেখানে যেতেই মেয়ের প্রথম কথা,
‘আপনি আবারও সেই বিশ্রি শার্ট টা পড়েছেন?’

মেয়েটা এতো চুজি, কিভাবে যে মেয়েটাকে সে সামলাবে তার পায়তারা করতে করতে জীবন যাবে। সুপ্রিয় কিঞ্চিৎ হাসলো। আজকে তার মনে হচ্ছে অনেক বড় একটা বোঝা তার কাঁধ থেকে নেমে গেছে। সে মুসা আর আলীকে ছাড়বে না। দিনের পর দিন ওঁরা তিঁলতিঁল করে তার কাছেই ম’র’বে। নিস্তার নেই ওঁদের।

সে আমার সুকেশিনী পর্ব ২৯

যাদের কারণে সে আজ এতিম তাদের কিভাবে সে ছাড়তে পারে? পঞ্চম বারের বার বিউটি কল রিসিভ করলো। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো বিউটির ফোন অন্য একজন রিসিভ করে কথা বলছে। অপরপ্রান্ত হতে এমন কিছু বাক্য শোনালো যাতে সুপ্রিয় দ্বিতীয় বারের মতো শকড হয়ে গেলো।

সে আমার সুকেশিনী পর্ব ৩১