সে আমার সুকেশিনী পর্ব ৩১

সে আমার সুকেশিনী পর্ব ৩১
রাউফুন

শেষ রাত থেকে হার কাঁপানো জ্বর হানা দেই বিউটির শরীরে। জ্বর শরীরে বিছানা ছেড়ে উঠে কোনো রকমে দরজাটা খুলে রেখে এসেছিলো সে। যেনো গুরুতর কিছু হলে দরজা ভাঙতে না হয়। দরজা খুলে তারপর আবার শুয়ে পড়েছিলো সে। এরপর সে কখন জ্বরে অজ্ঞান হয়েছে জানে না। জ্ঞান ফেরার পর চোখ খুলেই দেখে সে হসপিটালে। এর মধ্যে ডক্টর জানিয়েছে তার সমস্ত টেষ্টের রিপোর্ট কি! গত সপ্তাহের টেষ্টের রিপোর্ট এখন হাতে পেয়েছে ।

আলুথালু কঁম্পনরত পায়ে, ছুটে এসেছে সুপ্রিয়। তার এলোমেলো আউলা ঝাউলা বাবরী চুল আরও এলোমেলো হয়ে গেছে। তার সম্পুর্ন মুখের আদল পাংশুটে বর্ণ ধারণ করেছে। একের পর এক ধাক্কা সামলানো যে দায় হয়ে যাচ্ছে তার। আর ঠিক কি কি হাঁরানোর বাকি আছে তার জীবন থেকে? যাদেরকে সে অত্যন্ত বেশি ভালোবেসেছে, সবাই তো এঁকে এঁকে এভাবেই তার থেকে দূরে চলে গেছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তার এই ছন্নছাড়া ভাবটা কাটানোর চেষ্টা করলো সুপ্রিয়। হাত দিয়ে চুল ঠিক করে, শার্টের কলার টেনে ঠিক করে নিলো। ঠোঁটে এক চিলতে হাসি রাখলো জোরপূর্বক। কোনো ভাবেই বিউটিকে স্ট্রেস দেওয়া যাবে না। তাকে নরমাল রাখতে হবে সবকিছুই। সে দরজাটা ঠেলে বিউটির কেবিনে প্রবেশ করলো। বিউটি কারোর পদধ্বনি শুনেও বন্ধ চোখ জোড়া খুললো না।

তার চোখ খুলে দেখে বলার প্রয়োজন নেই মানুষটা কে? এই মানুষটার প্রতিটি পদক্ষেপ তো তার চেনা। একদম মুখস্থ। তার নিঃশ্বাসের শব্দ, পদধ্বনি, তার উপস্থিতিতে হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া। তাতেই সে অনুভব করেই বলে দিতে পারবে, নিঃসন্দেহে মানুষটি তার সুপ্রিয় ভাই। এই যে এখন সুপ্রিয় ভাই এখানকার একটা টুলসে বসলো। নিশ্চয়ই হাতে একগাদা ফল আর দইয়ের হাড়ি। দই তো তার প্রিয়।

সুপ্রিয় সবকিছু রেখে কিছু বলবে তার আগেই শুনলো ভাঙা গলায় বলা বুলি!
‘আসতে এতো দেরি হলো কেন সুপ্রিয় ভাই?’
‘এমনি! কিছু খেয়েছিস? খেলেও কিছু করার নেই।আমি ফল কেটে দিই, খাবি! দই এনেছি, তোর প্রিয় না দই?’

‘এতো কিছু কিভাবে খাবো। একটু আগেই মা নিজে হাতে ভাত খাইয়ে দিয়েছে। জানেন, কাল রাতেই আম্মা আমাকে চ’ড় মে’রে’ছে। আর আজ-ই
কেমন আদর করছে। ওঁরা ভেবেছে আমি আমার ভয়ানক অসুখের কথা জানি না। আপনিও তাই ভাবছেন না?’
‘নাহ, আমি জানি তুই জানিস!’

সুপ্রিয় মাথা নত করে বসে রইলো। হাতে একটা আপেল নিতে ছু’রি দিয়ে কা’ট’তে লাগলো।
‘আপনি জানতেন?’
‘উঁহু তোকে দেখেই বুঝেছি।’

‘আপনি একবারও আমার চোখে চোখ রেখে কথা বলছেন না কেন? আমি কি দেখতে এতোটাই বা’জে হয়ে গেছি?’
‘সব সময় উলটা পালটা চিন্তা তোর না? ফল গুলো ধর। চুপচাপ লক্ষী মেয়ের মতো খেয়ে নে!’
‘আগে বলুন, আপনি এমন গম্ভীর হয়ে আছেন কেন? আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে এ,এম,এল আমার না আপনার হয়েছে।’

‘এ,এম,এল কি?’
‘সেকি আপনি জানেন না?’
‘নাহ।’

‘এটা হচ্ছে এক ধরনের ব্লাড ক্যান্সার। ফুল ফর্ম একুউট মাইলোব্লাস্টিক লিউকেমিয়া। মাইলোব্লাস্টিক লিউকেমিয়া দুই রকমের হয়। মাইলোমনোসাইটিক এবং পিউর মনোসাইটিক! আমি লাস্ট স্টেজে আছি, শরীরের প্রতিটি হাড় একদম ঝাঝড়া হয়ে গেছে। শুরু থেকেই জ্বর ছাড়া কোনো সিমটমজ দেখা যায়নি তো তাই সবটা নরমালি নিয়েছি। এই যে এতো এতো বক বক করি, এটা আমার অসুখের-ই একটা অংশ৷ এটা কিন্তু আগে বুঝিনি। আমি যদি আরোও আগে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতাম তবে নাকি আমার অসুখ সেরে যাওয়ার সম্ভাবনা নাইন্টি পার্সেন্ট থাকতো। আর এখন এক পার্সেন্ট!’

‘আর কোনোও সিমটমজ দেখা যায়নি তোর মধ্যে?’
‘বুঝতে পারিনি। নন স্পেসিস্ফিক হিসেবে জ্বর , শরীর দূর্বলতা থাকতে পারে। আরও এই ক্যান্সারের সিম্পটম হিসেবে ওজন কমে যাওয়া , মুখে রুচি নষ্ট হয়ে যাওয়া , হাড়ে ব্যাথা হওয়া, লিম্ফ নোড ফোলা , নাক ও মাড়ি দিয়ে রক্ত পড়া।

মেটাস্ট্যাসিস এর সিম্পটম অরগান হিসেবে নির্ভর করে। যতই খরুচে ব্যাপার হোক, সাকসেস রেট কিন্তু খুব বেশী না। কারন গ্রাফট রিজেকশন, ইনফেকশন ইত্যাদি ট্রান্সপ্লান্ট ফেইলুরের মূল কারন! আমার জ্বর করলে হাড়ে ব্যথা করতো তবে গায়ে মাখিনি। আর আমার ব্লাড গ্রুপ এ নেগেটিভ। এই ব্লাড গ্রুপের সঙ্গে সেলস ম্যাচ্ হওয়ার চান্স ওয়ান পার্সেন্ট৷ ডক্টর বলেছে ব্যোন ম্যারু ট্রান্সপ্লান্টের মাধ্যমেও লিউকেমিয়া ক্যান্সার থেকে মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। আমার কথা শুনতে কি বিরক্ত লাগছে আপনার?’

‘লাগছে!’
‘আপনি এমন ছোট ছোট কথায় উত্তর দিচ্ছেন কেন? শুনেন, আমার কি ইচ্ছে ছিলো জানেন? ইচ্ছে ছিলো আমি যেনো মৃ’ত্যুর আগে হলেও আপনার দেখা পাই। শেষ নিঃশ্বাস অব্দি অপেক্ষা করতাম আমি। আমার বিশ্বাস ছিলো আপনি আসবেন। এসেছেন। আপনি আমার পাশে বসে থাকবেন, আর আমি আপনার পানে চেয়ে শেষবারের মতো দেখে যাবো। ভালোবাসার সুখটা বোধহয় আমার কপালে থাকতে চাইছে না বুঝলেন। আচ্ছা, আমি ম’র’লে কি আপনি কাঁদবেন? ইশ, আপনি আমার জন্য কাঁদবেন আর সেটা আমি দেখতে পারবো না!’

‘বিউটি!’ সুপ্রিয় মৃদু ধমকে উঠলো।
‘আচ্ছা চুপ করলাম। বিদেশে যাদের এই ধরনের ভয়াবহ ব্লাড ক্যান্সার হয়, তখন কি করা হয় জানেন?’
‘কি?’

‘সাইকিয়াট্রিস্টরা দিনের পর দিন সেই রোগীর সঙ্গে কথা বলে। তাদেরকে নিজের মৃ’ত্যু’র জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত করে। মৃত্যুর জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুতি চলে, হাস্যকর না?’
‘তুই কি একটু চুপ করবি? এসব কি আজেবাজে কথা বলছিস? দেখতে পাচ্ছিস না বিরক্ত হচ্ছি?’
‘আপনাকে বিরক্ত করতে ভালো লাগছে। এরপর তো আর সময় সুযোগ নাও পেতে পারি। সুপ্রিয় ভাই?’
‘হু?’

‘আমি আপনাকে একদিনের জন্য হলেও বিয়ে করতে চাই! আমার অসুখের জন্য বাড়ি থেকে বিয়েটা দিতে চাইবে না এখন। কারণ তারা আমাকে বিদেশে নেওয়ার জন্য তোরজোর শুরু করেছে। কিন্তু আমার মন কি বলছে জানেন? মন বলছে আরও দেরি করলে আপনার আর আমার বিয়েটা হবে না। আপনি কাজি অফিসে সবকিছু ব্যবস্থা করে রাখবেন। আমি হসপিটাল থেকে লুকিয়ে সেখানে যাবো। আব্বু কোনো ভাবেই যেতে দেবে না, জানেন তো! বিয়ে শেষ করে আবার আমাদের বাসর জাগতে হবে। আপনি জানেন, আমার বাসর রাত নিয়ে কত স্বপ্ন ছিলো? ইশ, সব জলাঞ্জলী গেলো।’

‘হু ঠিক আছে, তোর স্বপ্ন পুরণ হবে।’
‘কখন থেকে ছোট ছোট উত্তর দিচ্ছেন। আমাকে শুনতে আপনার এতোই বিরক্ত লাগছে? যান এখনি চলে যান। লাগবে না আমার।’
‘চলে যাবো?’
‘হ্যাঁ যান!’
সুপ্রিয় উঠে দাঁড়ালো। প্রস্থানের জন্য পা বাড়াবে তখনই বিউটি বললো, ‘সব প্রেমিকেরই একটা ইচ্ছে থাকে, কি বলেন তো?’
‘কি?’

‘তাদের প্রেমিকার চুল স্পর্শ করতে চাওয়ার ক্ষীন ইচ্ছে। আপনি তো আমার চুল ভালোবেসে কখনোই ছুঁয়ে দেখেন নাই। আসেন এদিকে, আমার চুল স্পর্শ করেন। স্পর্শ করতে বলার কারণ কি জানেন? আমার কেমোথেরাপি শুরু হলে মাথার চুল থেকে শুরু করে ভ্রু সব পড়ে যাবে। দেখা গেলো আমার মাথা কামিয়ে ফেলতে হচ্ছে! হতেই পারে এটা আমার চুলে আপনার শেষ স্পর্শ!’

সুপ্রিয় কাঁপা কাঁপা হাতে বিউটির মাথার চুল স্পর্শ করলো।
‘আচ্ছা, আমাকে অনেক বাজে দেখাবে তাই না? যখন মাথায় চুল থাকবে না।’
‘বেশি কথা বলিস না, ঘুমো।’
‘আপনি পাশে বসে থাকবেন নাকি? আপনি এখন চলে যান। আমার মাথা ধরেছে!’
‘আচ্ছা।’
‘ওও একটা কথা ভুলে গেছি।’
‘কি কথা?’

‘এই যে আপনি আবারও সেই বিশ্রি রঙের ছাই রঙা শার্ট পড়েছেন। আমি না বারণ করেছিলাম পড়তে? এখানে টেবিলে একটা পাঞ্জাবি আছে, আপনার জন্য কিনেছিলাম। ঐটা একবার পড়ে আসুন তো৷ দেখি কেমন লাগে।’
সুপ্রিয় কোনো কথা না বলে পাঞ্জাবি টা নিয়ে ওয়াশরুমে গেলো। ভেতরে গিয়ে পাঞ্জাবিটা বুকের সঙ্গে চেপে ধরলো আর চোখের জল ফেললো। বিউটির সামনে নিজেকে শক্ত দেখালেও, আড়ালে তো পারছে না। বেশি দেরি করলে আবার বলবে, ‘একটা পাঞ্জাবি পড়তে এতক্ষণ লাগে?’ সুপ্রিয় মুখে পানি ছেটালো। রুমালে মুখ মুছে বাইরে বের হলো।

বিউটি একটু অপ্রস্তুত হয়ে খুব সন্তর্পণে নিজের চোখের জল আড়াল করলো। হাসি মুখে তাকিয়ে রইলো সুপ্রিয়র দিকে।
‘ভালো লাগছে?’

‘খুব সুন্দর লাগছে। কার পছন্দে কেনা পাঞ্জাবী খানা দেখতে হবে তো!’ বিউটি হেসে বললো!
মেজেন্টা কালারের পাঞ্জাবী খানা সুপ্রিয়র গায়ের সঙ্গে একদম মানানসই! দু-চোখের তৃষ্ণা যেনো মিটছে না বিউটির।

সুপ্রিয়র দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে রইলো সে। ভেতরটা ছাড়খাড় হয়ে যাচ্ছে তার। বাবা, মা ভাই, ভাবি, বন্ধু সবাই তাকে দেখে গেছে। যখন থেকে তার অসুখের কথা শুনেছে তখন থেকেই৷ সবার তার প্রতি দেখানো ভালোবাসাকে সহানুভূতি মনে হচ্ছিলো। প্রাণ প্রিয় বান্ধবী আড়াল থেকে দেখে গেছে সে খেয়াল করেছিলো। বিউটি চোখ বন্ধ করে বললো,

‘সুপ্রিয় ভাই আপনি চলে যান এখন!’
‘আচ্ছা!’
সুপ্রিয় চলে এলো। চিনচিন ব্যথাস্থানে পাঞ্জাবীর বাম পাশে হাত চেপে ধরলো সে। বুক পকেটে হাত চেপে ধরতেই বুঝলো বুকপকেটে কিছু একটা রয়েছে। সে সন্তর্পণে বের করলো। দূর্বল পায়ে হেঁটে হেঁটে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে সোজা তার প্রিয় দিঘির পারে চলে গেলো। যেতে যেতে সহস্রাধিক বার সে চিঠিখানা পড়লো।
প্রিয় সুপ্রিয় ভাই,

‘ইশ সু বাদ দিলেই তো প্রিয় হয়। তবে প্রিয় সম্বোধনই থাক? মনের সুখ, অসুখ, হিংসে, আফসোস, যদি শরীরে সঞ্চারিত হতো, তবে মানুষকে নেহাৎ ক্যামেলিয়ান বলা যেতো ! ভাবাবেগময় অনুভূতি ভিন্ন ভিন্ন রঙে প্রকাশ পেতো! ভালোবাসি শব্দটা একসাথে অনেক কিছুকে প্রকাশ করে কারো প্রতি যত্ন ও ভালোবাসা কাউকে মন থেকে চাওয়াও ভালোবাসা! আমি আপনাকে মন থেকে চেয়েছিলাম বলেই হইতো আপনার দেখা পেলাম। আমার কোনো আফসোস নেই, অ-সুখ নেই, হিংসে নেই, আছে কেবলই সুখ। আপনাকে দু-চোখ ভরে দেখার সুখ। আপনার মাঝে বেঁচে থাকার সুখ। আপনি আপাদমস্তক মানুষটাই আমার সুখ!’

ইতি
আপনার সুকেশিনী!
সুপ্রিয় বুক পকেটে চিঠি রেখে, দোলনায় চেপে বসলো। তক্ষুনি তার মনে হলো বিউটিও তার পাশে বসে আছে। বিউটির শরীর থেকে বকুল ফুলের কড়া ঘ্রাণ এসে তার নাকে তাল খেলো। সে বুক ভরে নিঃশ্বাস টেনে নিলো।

সে আমার সুকেশিনী পর্ব ৩০

বাগানের সর্বত্র, দিঘির পাড়ে, প্রতিটি স্থানে বিউটির খিলখিল হাসির আওয়াজ পেলো। তার নুপুরের রিনিঝিনি আওয়াজ যেনো চারিপাশে করতাল করছে। এই তো দিঘির ঐপাশেই বিউটি তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। একটু নৈকট্যে গেলেই স্পর্শ করা যাবে বিউটিকে। সুপ্রিয় ভ্রমের মধ্যেই দিঘির জলে নেমে সামনে এগোতে লাগলো।

সে আমার সুকেশিনী শেষ পর্ব