সে আমার সুকেশিনী পর্ব ৬

সে আমার সুকেশিনী পর্ব ৬
রাউফুন

আজ শুক্রবার। প্রতি বন্ধের দিনে বিউটি বাজারে গিয়ে নিজের পছন্দ মতো বাজার করে। সবার পছন্দের কিছু না কিছু কিনে বাড়ি ফিরে৷ আজকেও তার ব্যাতিক্রম হয়নি।
হাত ভর্তি বাজারের ব্যাগ নিয়ে বাজার থেকে বেরোচ্ছে বিউটি। এখান থেকে বেরোনো অব্দি এই ব্যাগ দুটো টেনে মেইন রাস্তা অব্দি নিয়ে যেতে হবে। কি একটা বাজে অবস্থা।

দুই হাতে বাজারের ব্যাগ, কাঁধে হ্যান্ড ব্যাগ, বার বার হ্যান্ড ব্যাগ কাঁধ থেকে নেমে কনুইয়ের দিকে চলে আসছে। বিউটি বিরক্ত হলেও সামলে নিচ্ছে বার বার। আবারও বাজার থেকে বেরোনোর আগে লিষ্ট মেলানোর জন্য একটা পরিষ্কার, শুকনো জায়গায় ব্যাগ দুটো রাখলো। ব্যাগের ভেতর দেখে দেখে একটা একটা করে লিষ্ট মিলিয়ে নিলো।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

লিষ্ট ব্যাগে রেখে সে বাজারের ব্যাগ আবার তুলতে গিয়ে দেখলো বাম পাশে দুটো ব্যাগের একটাও নেই। আঁতকে উঠলো সে। এত্তো গুলো দিন থেকে সে বাজার করছে এমন ঘটনা কখনো ঘটেছে কিনা সন্দেহ। বিউটি ভালো ভাবে দেখতেই, দেখলো তার ব্যাগ দুটো কোনো একজন পুরুষ মানুষ হাতে তুলে নিয়ে হাঁটতে শুরু করেছে। কালো জিন্স, সিল্কের পোলো শার্ট পরনে।

হাঁটার গতির সঙ্গে মানুষটার শরীরের ঢিলেঢালা শার্টটাও দুলছে। পেছন থেকে দেখেও বুঝলো লোকটা ভদ্রলোক। কোনো ভদ্র ঘরের সন্তান৷ লোকটা বেশি দূরে যাওয়ার আগে বিউটি চিৎকার তীব্র করে বললো, ‘এই লোক, এই বাজার চোর লোক, দাঁড়িয়ে যাও। আজকে তোমার একদিন কি আমার একদিন৷ দাঁড়িয়ে যাও, চোর কোথাকার।’

সায়র হাঁটা থামিয়ে দিলো। বিউটি প্রায় দৌঁড়ে এসে সায়রের হাত থেকে ব্যাগ দুটো ছিনিয়ে নিতে চাইলো। কিন্তু সেই মুহুর্তে সে পরিচিত পারফিউমের স্মেল পেলো৷ এই স্মেল টা তার চেনা। এটা তো তার সাথে বিয়ে হওয়া লোকটার পারফিউমের স্মেল। তার হাত থেমে গেলো। সায়র ব্যাগ সরিয়ে নিলো সাথে সাথে। হাঁটতে হাঁটতে বললো, ‘এই ব্যাগ দুটোর এতো ওজন,আমারই হাতে কুলাচ্ছে না। আর আপনি এগুলো নিয়ে হাঁটছিলেন কিভাবে?’

‘আপনি কোন সাহসে আমার বাজারের ব্যাগে হাত দিয়েছেন? আশ্চর্য, এটা কোন ধরনের ভদ্রতা! না বলে না কয়ে এভাবে কারোর জিনিসে হাত দিতে নেই জানেন না?’
‘আপনি আমাকে চিনেছেন?’ সায়র শুধালো।
‘না চেনার কি আছে?’

‘আপনি এখনো আমার দিকে ফিরেও দেখেন নি। না দেখে চিনলেন কিভাবে তবে?’
‘আম্ আপনার পারফিউম স্মেল!’
‘ওমা গো, কি বলেন? যাকে বিয়েই করতে চাইছেন না, তার পারফিউমের স্মেল মনে রেখেছেন?’
‘মনে রাখতে হয় না, একজন প্রখোর বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ খুব সহজেই মানুষের গন্ধ, কথা বার্তার ধরণ, আচার আচরণে, পায়ের শব্দেও মানুষকে রেকোগনাইস করতে পারে।’

‘আপনি নিজেকে প্রখর বুদ্ধি সম্পন্না বলছেন?বাহ ভালো। আপনি আমাকে সেভাবে চেনেনই না, কিন্তু পারফিউম এর গন্ধে চিনে ফেললেন৷ প্রখর বুদ্ধিই বটে। তাছাড়া এই একই পারফিউম অনেকেই ব্যবহার করে, আমি অন্য কেউও হতে পারতাম তাই না?’

‘আশ্চর্য,পারফিউম স্মেল একই হলে-ও সে নিশ্চয়ই আমার পরিচিত হতো না। কেননা পরিচিত কেউ বলেই তো ব্যাগ হাতে নিয়েছে। আপনি তো আর পালাচ্ছেন না। এটুকু বুদ্ধি আমার আছে।’
‘কে যেনো আমাকে চোর, চোর ডেকে থামাচ্ছিলো?’
বিউটি একটু লজ্জা পেলো৷ সাথে একরাশ রাগ, আর বিরক্ততে বললো,’ বাই এনি চান্স আপনি কি আমাকে ফলো করছেন মিষ্টার সায়র হোশেইন?আল্লাহর দহাই লাগে আমার ব্যাগ দিন। আমি বলিনি আপনাকে সাহায্য করতে। দিন আমার ব্যাগ দিন!’

সায়র এগোতে এগোতেই বললো,’ আপনাকে একটা জোকস শুনাচ্ছি৷ আমি শিওর এই জোকসটা শুনলে আপনি না হেসে পারবেন না। রাগ একেবারে জল হয়ে যাবে।’
বিউটি কটমট করে তাকালে সায়র ভোলা ভালা হাসি দিলো। হাসতে হাসতেই বললো, আমি তখন ক্লাস নাইনে পড়ি বুঝলেন? রসায়ন, পদার্থবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, মানে সব বিজ্ঞানের খেলা। এই বিজ্ঞান পড়তে পড়তে নাজেহাল অবস্থা। বিশেষ করে পদার্থবিজ্ঞান। তো একদিন ক্লাসে স্যারকে বললাম,

“স্যার বিজ্ঞানীরা এসব কেন নতুন নতুন প্রযুক্তি, সূত্র তৈরি করেছে। এসব না করলেও তো হতো। কত সুন্দর শান্তিতে থাকতাম। পড়াশোনার মতো কষ্ট করতে হতো না।”
স্যার হেসে উত্তর দিলেন, ‘কি হতো শুনতে চাও তোমরা?’
‘হ্যাঁ স্যার!’
‘ঠিক আছে, এই সায়র হোশেইন তুই প্রশ্ন করছিস তাই তো?
‘হ্যাঁ স্যার।’

‘তাইলে শোন। বিজ্ঞানীরা যদি নতুন নতুন প্রযুক্তি, এসব বিজ্ঞানের কোনো কিছুই তৈরি না করতো, পড়াশোনার বিষয় টা যদি না থাকতো তবে তুই জঙ্গলে থাকতি। আদীম কালের মানুষের মতো কাচা মাংস খেতি, মাথায় এত্তো লম্বা লম্বা চুল থাকতো। রান্নার জন্য চাল পেতি না। কলা পাতা পরে ঘুরে বেড়াতে হতো। যখন কলা পাতা পরে ঘুরতি তখন কি হতো বল তো সায়র?’

‘স্যার কলা পাতা তো পরতে গেলেই ছিড়ে যেতো।’
‘নাহ, শোন কি হতো, সামনে তুই দৌঁড়াতি, পেছনে গরু ছাগল দৌঁড়াতো। এরপর তোর পরনের কলা পাতা খেয়ে ফেলতো। আর কলা পাতা খেলে কি হতো?
‘কি হতো?’ সবাই উচ্চস্বরে জিজ্ঞেস করলো। লজ্জায় তখন আমাফ ম’রি ম’রি অবস্থা। আমি মাথা নত করে ছিলাম। তখন তাকে স্যার আমাকে আরও লজ্জা দিতে বললেন,

‘সায়র তোর সম্মানের ফালুদা হতো। তোর সামনে পিছে মানুষের ভীর লেগে যেতো, সবাই তোর টুন টুন দেখতো, ঠিক আছে?’
সমস্বরে হেসে উঠলো সকলে। হাসতে হাসতে বললো, ‘ঠিক আছে স্যাএএএএএর।’
সায়র আগের কথা বলতে হেসে ফেললো স্বশব্দে। কিন্তু বিউটি হাসলো না। সায়র মুখ গোমড়া করে বললো, ‘চলুন তো বাজারে যাবো।’

বিউটি ভ্রু কুচকে সামান্য তাকালো। তবে সায়রের মুখের দিকে না, ব্যাগের দিকে। একবার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো টুনটুন কি? তবে সে তা করলো না। কড়া কন্ঠে বললো, ‘আমার বাজার করা শেষ, আপনার প্রয়োজন হলে যেতে পারেন।’
‘আমার না আপনার প্রয়োজন!’

‘আমার প্রয়োজন!’ বিউটি অবাক হলো। সায়র মেইন রাস্তায় দাঁড়িয়ে পরলো। রসিকতা করে ঠাট্টার স্বরে বললো,’ আপনার জন্য খাটি মধু কিনবো। রোজ সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা, রাতে আপনি চারবার মধু খাবেন। আপনি চাইলে আরও বেশি খেতে পারেন। মধু খেলে যদি এই তেঁতো মুখ থেকে মধুর মধুর কথা বের হয়!’

বিউটি রাগে গজগজ করতে করতে একটা রিকশা ঠিক করলো। সায়রের থেকে ব্যাগ নিতে গেলে সে নিজেই ব্যাগ রিকশায় রাখলো। ব্যাগ ধরে এক পাশে বসে পরলো। বিউটি তখন রাগে ফেটে যাচ্ছিলো। তাতে অবশ্য সায়রের কিছু গেলো এলো না। সে বিউটির রাগকে পাত্তা না দিয়ে বললো, ‘আরে উঠুন, এখন রিকশা পাবেন না সহজে। উঠে পরুন! বেশি রাগ করলে নারীদের যে এতো অপরূপা লাগে আপনাকে না দেখলে বুঝতাম না।’

প্রায় দশ মিনিট দাঁড়িয়ে থেকেও আর কোনো রিকশা পেলো না। বিউটি কোনো রকম কথা না বলে চুপচাপ রিকশায় চেপে বসলো অল্প জায়গা নিয়ে৷ সায়র নিজের মতো বললো, ‘আপনি নাকি খুবই বকবক করেন, আজকে এতো চুপচাপ কেন? এদিকে আমিই সমান তালে প্যাঁচাল পেরে যাচ্ছি আর আপনি চুপচাপ। মানা যায়?’

বিউটি নিরুত্তর রইলো। রিকশা চলতে শুরু করেছে। সায়র আবার বললো,’ কাল রাতে ইংরেজি টাইপ বৃষ্টি হয়েছে জানেন?’
সরু চোখে সামনের দিকে তাকিয়ে রইলো বিউটি। সায়র বললো, ‘আমাদের স্যার বলতেন, ক্যাটস এন্ড ডগস এমন বৃষ্টিকে বলে ইংরেজি টাইপ বৃষ্টি। মানে ঝমঝম করে যে বৃষ্টি হয় সেটাকে ইংরেজিতে ক্যাটস এন্ড ডগস বৃষ্টি বলে। আমাকে এই প্রশ্নটা স্যার জিজ্ঞেস করলে কি বলেছিলাম জানেন?

বলেছিলাম, স্যার যে বৃষ্টিতে রাত তিনটার পর বিড়াল এবং কুকুর ভিজে ন্যাতা ন্যাতা হয়ে শুয়ে থাকে তাকে বলে ক্যাটস এন্ড ডগস বৃষ্টি! মানে ইংরেজি টাইপ বৃষ্টি! স্যার উত্তর শুনে বেদম পি’টু’নি দিলো। আচ্ছা আপনিই বলুন, ক্যাট মানে তো বিড়াল, আর ডগ মানে কুকুর। যেহেতু বৃষ্টি উল্লেখ করা হয়েছে উত্তরটাও এমনই হওয়া উচিত। তাই নয় কি বলুন? পরে অবশ্য জেনেছি, আসলে ঝমঝম বৃষ্টিকে ক্যাটস এন্ড ডগ বৃষ্টি বলে ইংরেজিতে। কিন্তু এটাকে কেন ক্যাটস এন্ড ডগস রেইন-ই বলে?’

সায়রের এমন বোকা বোকা কথা শুনে বিউটির হাসি পেলো খুব। এতো হাসি পেলো যে মুখ টিপে না চাইতেই হেসে দিলো। অবশ্য আগের ঘটনা শুনেও তার হাসি পেয়েছিলো। কিন্তু সে এই লোকের সামনে হাসবে না। ”পরে আবার ভেবে বসবে, তার কথায় আমি হেসেছি মানে আমি পটে গেছি।”

সায়রের নজর এড়ালো না বিউটির হাসি৷ এই তো সে পারছে। যে মানুষ বকবক করে তার কাছে গিয়ে তার থেকেও বেশি বকবক করতে হয় তবে সে উপলব্ধি করতে পারে সে কতটা বেশি কথা বলে। সে চাইছে বিউটি তার সঙ্গে সহজ হোক। বিউটিকে ভেতর থেকে জাগাতে চাইছে সে।

আর এটা সে করেই ছাড়বে। এতো দিন সে বিউটিকে আড়াল থেকে অবলোকন করতো। সায়র আবার বকবক শুরু করলো। বিউটি এক পর্যায়ে সায়রের বকবক সহ্য না করতে পেরে কি ভেবে যেনো আকস্মিক ভাবে তার বুকে হাত দিয়ে ধাক্কা দিলো সায়রকে৷ রিকশা ততক্ষণে বিউটিদের বাড়ির সামনে এসে স্লো হয়েছিলো। সায়র ধাক্কা সামলাতে না পেরে পরে গেলো রিকশা থেকে। কোমড়ে ব্যথা নিয়ে কথা বলতে ভুলে গেলো সে। বিউটি তাকে ছুঁয়েছে যে। প্রথম স্পর্শ!

সে আমার সুকেশিনী পর্ব ৫

বিউটি যেতে যেতে আশ্চর্য হলো,আজকে সায়রের সঙ্গে দেখা হওয়া পর একবারও সুপ্রিয় ভাইয়ের কথা মনে পরে নি তার। এমন তাজ্জব ঘটনা ঘটলো কি করে? আশ্চর্য,তবে কি এই লোকটার সান্নিধ্য তাকে তার সুপ্রিয় ভাইয়ের দিকে আলাদা করবে? সায়রের উপস্থিতি কেন সুপ্রিয় ভাইকে ভুলিয়ে দিলো তাকে? বিউটি অস্থির হয়ে ব্যাগ হাতে বাড়ির গেট খুললো।

সে আমার সুকেশিনী পর্ব ৭