কোন কাননের ফুল গো তুমি শেষ পর্ব 

কোন কাননের ফুল গো তুমি শেষ পর্ব 
মুন্নি আক্তার প্রিয়া

রূপককে রাগ দেখিয়ে কোনো লাভ হলো না। সে যেন থোড়াই পরোয়া করে মিতুলকে। রূপকের শক্তির সাথে পেরে ওঠার শক্তিই বা কোথায় মিতুলের। এই ধ্রুব সত্যি উপলব্ধি করতে পেরেই যেন শান্ত হয়ে গেল সে। রূপক ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,

“রাগ করেছ?”
মিতুল বলল,
“রাগ করব কেন?”
“এই যে আদর করছি তাই।”
“বর তার বউকে আদর করবে এতে রাগ করার কী আছে?”
রূপক হেসে পরপর তিনটা চুমু দিল মিতুলের গালে। চার নম্বর চুমুটা ঠোঁটে দিয়ে বলল,
“এমন পুতুলের মতো বউ রেখে আমি চীনে ফিরে যাব কী করে বলো তো?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মিতুলের মনটাই খারাপ হয়ে গেল এবার। এতক্ষণ সে রূপকের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেও, এবার সে মুখ ফিরিয়ে নিল। রূপক বুঝতে পেরে মিতুলের দু’গালে হাত রেখে মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,
“এদিকে তাকাও।”
“হু, বলুন শুনছি।”
“শুধু শুনলে তো হবে না। আমার দিকে তাকাতে হবে। তাকাও।”

মিতুল তাকাল। তার চোখ ছলছল করছে। রূপক এবার ওর পাশে শুয়ে মিতুলের মাথাটা নিজের বুকের ওপর রেখে বলল,
“মন খারাপ কেন করে আমার বউটা?”
মিতুল রূপককে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আমার কষ্ট হচ্ছে খুব।”
“ধুর পাগলি! এইটুকুতেই কষ্ট পেলে হবে? আমি তো আর সারাজীবনের জন্য যাচ্ছি না। পরীক্ষাটা দিয়ে রেজাল্ট বের হলেই আবার চলে আসব।”

“তবুও মন তো আর মানে না।”
“মনকে তো বোঝাতে হবে জান। ধৈর্যের ফল মিষ্টি হয় জানো না?”
মিতুল নাক ফুলিয়ে বলল,
“ফল মিষ্টি না হলে ধৈর্যের গাছই কেটে ফেলব আমি।”
রূপক হো হো করে হেসে উঠল। মিতুলের কপালে চুমু খেয়ে বলল,

“মিষ্টি হবে না মানে? হতেই হবে। বিয়ে করেছি কি আর এমনি এমনি? কোনো রিস্ক নিতে চাইনি। তোমাকে হারানোর ভয় বুকে নিয়ে চীনে ফিরে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। এজন্যই শুধু আংটি বদলে আমি ক্ষান্ত হইনি।”
“হু, এখন আমি যেমন আপনার পার্মানেন্ট, আপনিও আমার পার্মানেন্ট মানুষ।”
“তা তো অবশ্যই।”

“আচ্ছা শুনুন, চীনে গেলে তো চাচ্চুর বাসাতেই থাকবেন তাই না?”
“হ্যাঁ, কেন?”
“আপনার ঐ কাজিনের থেকে দূরে দূরে থাকবেন।”
রূপক হেসে বলল,
“কেন? তোমার হিংসে হয়?”
“তো হবে না?”

“না, আমার মিতুল ফুলের হিংসে করার কোনো কারণ নেই। তাছাড়া ও অনেক ভালো মনের। সেটা তো তুমি জানোই।”
“জানি। কিন্তু তবুও মেয়েদের মন। আপনি বুঝবেন না।”
“বুঝি অবশ্য একটু হলেও। মেয়েরা অনেক হিংসুটে হয় তাই না?”
“সব ব্যাপারে না। নিজের মানুষের ব্যাপারে হয়। আচ্ছা আপনাদের হিংসা হয় না?”
“হবে না কেন? অবশ্যই হয়। তবে তোমরা যেমন প্রকাশ করো আমরা সেরকম পারি না।”

মিতুল চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। নওশাদের বিষয়টা রূপককে জানাবে কিনা বুঝতে পারছে না। তবে মিতুলের মনে হচ্ছে শেয়ার করলে হয়তো ভালো হবে। আরেক মনে ভাবল আগে রিনভীর সাথে এটা নিয়ে আলোচনা করবে। মিতুলের ভাবনা-চিন্তার মাঝেই রূপক উঠে বসল। হাত ঘড়িতে সময় দেখে বলল,
“আমি বাসায় যাচ্ছি। তুমি কি এখন যাবে নাকি পরে যাবে?”

“মাত্রই তো এলাম।”
“ঠিক আছে। তুমি তাহলে পরে এসো। কিন্তু বেশি দেরি কোরো না।”
“আচ্ছা।”
মিতুলের কপালে, গালে, ঠোঁটে চুমু খেয়ে রূপক চলে গেল। মিতুল ফোন হাতে নিয়ে দেখল কয়েক সেকেন্ড পরই নওশাদ কল কেটে দিয়েছিল। সে এবার কল ব্যাক করল। রিং হয়ে কেটে যাওয়ার পরও নওশাদ রিসিভ করেনি। সেও আর কল দেয়নি। ফোন রেখে দেবে সেই মুহূর্তে নওশাদের কল এলো। মিতুল ফোন রিসিভ করে সালাম দিল। নওশাদ সালামের উত্তর নিয়ে বলল,

“কেমন আছো?”
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?”
“আমিও ভালো আছি। কোথায় আছো?”
“বাসায়। কেন?”
“শুনলাম বিয়ে হয়েছে নাকি তোমার?”
“হ্যাঁ।”

“দাওয়াত তো পেলাম না। আমার বিয়েতেও এলে না। আবার নিজের বিয়েতেও দাওয়াত দিলে না। ব্যাপার কী বলো তো? মনের মধ্যে এখনো রাগ পুষে রেখেছ নাকি?”
“সেরকম কিছু নয়। বিয়ে তো অনুষ্ঠান করে হয়নি। আর বলা চলে একদম হুট করেই হয়ে গেছে। আমি নিজেই জানতাম না।”

“বলো কী! দেখতে এসে বিয়ে নাকি?”
“না। সে আমার পরিচিত। বাড়িওয়ালার ছেলে।”
“আমি কি তাকে চিনি?”
“দেখেছিলেন আমার সাথে ক্যাফেতে।”
“ওহ আচ্ছা। তুমি তাহলে রিলেশনশিপে ছিলে?”

“না। দুজন দুজনকে পছন্দ করতাম। তখন অবশ্য আমাদের মাঝে ভালোলাগাটাও ছিল না। পরে হয়েছে। আর যখন ভালোবেসে ফেলেছি দুজন তখন পরিবার বিয়ে দিয়ে দিয়েছে।”
“যাক, খুবই ভালো খবর। আমি রায়ার পোস্ট দেখে জানলাম যে তোমার বিয়ে হয়েছে। সত্যিই হয়েছে কিনা জানার জন্য ফোন করেছি। তোমাদের দুজনের জন্য অনেক অনেক দোয়া এবং শুভকামনা রইল।”
“থ্যাঙ্কিউ। পরে যখন অনুষ্ঠান হবে তখন অবশ্যই আপনাকে দাওয়াত দেবো।”
নওশাদ হেসে বলল,

“ঠিক আছে। তোমার ম্যাডাম তোমার সাথে কথা বলতে চায়। বলবে?”
মিতুলের আনইজি লাগলেও মুখের ওপর না করতে পারল না। তবে চৈতি খুবই হাসি-খুশি ও ফ্রি মাইন্ডের হওয়ায় মিতুলের জড়তা কেটে যায়।দুজনেই বেশ অনেকক্ষণ কথা বলল। মিতুলের এটা ভেবে ভালো লাগছে যে, নওশাদ খুব ভালো মনের একটা বউ পেয়েছে। সারাজীবন যেন দুজনে একসাথে এভাবে ভালো থাকে এটাই কায়মনোবাক্যে দোয়া করে সে।

মিতুলের আর রূপকদের ফ্ল্যাটে যাওয়া হলো না। শ্বশুর বাড়ির সবাইকে দাওয়াত করা হয়েছে। সবাই আজ ওদের বাসায় খাবে। রিনভীর পরিবারকেও দাওয়াত করা হলো। সবাই একসাথে হওয়াতে পুরো বাড়ি একদম জমজমাট হয়ে গেছে। নিজের দুই বান্ধবী আর তিশাকেও মিতুল বাড়িতে ডেকে নিয়েছে। অনিক এজন্য মহাখুশি। মিতুলকে আলাদা ডেকে নিয়ে এজন্য সে চকোলেটও দিয়েছে। মিতুল হেসে বলে,

“এটা কি ঘুষ ছিল?”
“না, না। খুশি হয়ে দিলাম তোমাকে।”
“বুঝি তো সবই আমি। কিন্তু এসবের দরকার ছিল না। আমি তো আর বাচ্চা না।”
“বিয়ে হয়েছে বলে তুমি বড়ো হয়ে গেছ নাকি? তুমি বাচ্চাই।”
“মোটেও আমি বাচ্চা নই।”
“তাই? চলো তাহলে প্রমাণ হয়ে যাক।”

অনিক রূপককে ডেকে আনল। তিশা, রায়া, আর্শি আর টুম্পাও আছে এখানে। অনিক গম্ভীর হওয়ার ভান ধরে বলল,
“ভাই, আপনিই বলেন আপনার বউকে কি বড়ো মনে হয়?”
রূপক হেসে বলল,
“এই প্রশ্ন কেন?”
“ওকে চকোলেট দিয়েছি বলে আমাকে বলতেছে ও নাকি বড়ো হয়ে গেছে। ওকে দেখলে কেউ বড়ো বলবে?”
রূপকও আহাজারি করার ভান ধরে বলল,

“না রে, ভাই। এজন্যই তো ভয়ে আছি। মানুষ আবার বাল্যবিবাহ করেছি বলে পুলিশকে না আবার কল করে।”
রুম জুড়ে হাসির ধুম পড়ে গেল। শুধুমাত্র মিতুলই কেবল কটমট করে তাকিয়ে আছে রূপকের দিকে। রূপকের ভীষণ মজা লাগছে মিতুলের রাগী রূপটা দেখে। অবশ্য এই মজার ফল তাকে ভোগ করতে হলো রাতে ঘুমানোর সময়। মিতুলকে ছোঁয়া তো দূরে থাক, আশেপাশেই ঘেঁষা যাচ্ছিল না। ছুঁতে গেলেই দূরে ছিটকে যাচ্ছে। রাগে ফুঁসে উঠে বলতেছে,
“খবরদার! আমাকে ছোঁবেন না।”

“সেকি! কেন? আমার বউকে আমি ছোঁব না তো কে ছোঁবে?”
“কেউ না। আপনিও না। বাচ্চা মেয়ে বিয়ে করেছেন না? বাচ্চার সাথে এসব অ’শ্লী’ল’তা চলবে না একদম।”
“তুমি এখনো ওটা নিয়ে পড়ে আছো? আমি তো মজা করেছিলাম।”
“কিন্তু আমি সিরিয়াস।”

“আচ্ছা তোমাকে দেখতে বাচ্চা বাচ্চা লাগলে আমরা কী করব? এখনো তো সময় আছে। অনার্স শেষ হলে নিশ্চয়ই তোমাকে দেখতে বড়ো লাগবে তখন।”
“তাই? বেশ তো! তখনই না হয় ছোঁবেন। আমি টুম্পার রুমে যাচ্ছি।”
রূপক দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“কেন?”

“আপনার সাথে ঘুমাব না আমি।”
“সমস্যা নেই। না ঘুমালে না ঘুমাবে। এমনিতেই নতুন বিয়ে হয়েছে আমাদের। এত ঘুমানোর তো দরকার নেই। তুমি না হয় আমার সাথে জেগেই থাকো।”
“একদম বাজে কথা বলবেন না বলে দিচ্ছি।”
“বাজে কথা আবার কী বললাম? যা বললাম সত্যিই তো বললাম।”
“আপনি পথ থেকে সরে দাঁড়ান।”

রূপক সরল না। বরং মিতুলকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে মুখ গুঁজল। চুমু খেয়ে কোলে করে বারান্দায় নিয়ে গিয়ে দাঁড় করাল। মিতুল নিশ্চুপ। রূপক পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আমি তো তোমাকে আদর করে, ভালোবেসে তোমাকে বাচ্চা বলে ডাকি। তুমি বোঝো না?”
“তাই বলে ওদের সামনেও?”

“তাতে কী? ওরা তো দূরের কেউ নয়। তোমার, আমার পরিচিত কাছের মানুষ।”
মিতুল চুপ করে রইল। রূপক বারান্দার বেলীফুলের গাছ থেকে একটা ফুল ছিঁড়ে মিতুলের কানে গুঁজে দিয়ে বলল,
“আমার ব্যক্তিগত বাচ্চা ফুল, আমি তোমাকে ভালোবাসি।”
মিতুল হেসে ফেলল। রূপকের হাত জড়িয়ে ধরে গালে চুমু খেয়ে বলল,
“আমিও তো ভালোবাসি। অনেক বেশি।”

দুজনেই চুপ করে রইল অনেকক্ষণ। মিতুল অনেক ভেবে-চিন্তে অবশেষে নওশাদের কথা বলে দিল। শিহাবের সাথে সেদিন রেস্টুরেন্টে হওয়া কথাগুলোও বলল রূপককে। রূপক শান্ত প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে বলল,
“তুমি তো রূপক কাননের ফুল।”
মিতুল হেসে ফেলল। রূপক বলল,
“একটা গান শোনাই?”
“অবশ্যই।”

“যদিও আমার গানের গলা ভালো না। কিন্তু এই মুহূর্তে গানটা শোনাতে ইচ্ছে করছে।”
“বলুন না।”
রূপক মিতুলকে আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে গান গাইতে শুরু করল,

“কোন কাননের ফুল গো তুমি
কোন আকাশের চাঁদ গো তুমি,
কোন রাখালের মধুর বাঁশির ঘুম।
ও জ্বালাইলা আগুন বুকে
জ্বালাইলা আগুন,
জ্বালাইলা আগুন বুকে
জ্বালাইলা আগুন।
কোন ফাগুনের কোকিল তুমি
কোন নয়নের কাজল তুমি
ভ্রমর হয়ে করো যে গুনগুন।
ও জ্বালাইলা আগুন বুকে
জ্বালাইলা আগুন,
জ্বালাইলা আগুন বুকে
জ্বালাইলা আগুন।

ইচ্ছা করে তোমায় ধরে বন্দি করে রাখি
একটি বারে হও না কন্যা আমার খাঁচার পাখি,
জীবন দিলাম, যৌবন দিলাম
নাই যে কিছু বাকি।
দিবানিশি তোমার স্বপন আমার মনে আঁকি,
যেদিন তোমায় প্রথম দেখি
সেদিন থেকেই আমি একি
তোমার প্রেমে হয়ে গেলাম খু’ন।
ও জ্বালাইলা আগুন বুকে
জ্বালাইলা আগুন,
জ্বালাইলা আগুন বুকে
জ্বালাইলা আগুন।

দশ গেরামের মানুষ ডাইকা বলতে ইচ্ছা করে
তোমার প্রেমে ম’রা’র আগে গেছি আমি ম’রে,
এত পরে আইলা
কেন আগে আইলা না,
আমার মনের ঠিকানা কি খুঁইজা পাইলা না।
আমি ছিলাম মরুভূমি
বৃষ্টি হইয়া আইলা তুমি,
ঝরা বনে আনলা যে ফাগুন।
ও জ্বালাইলা আগুন বুকে
জ্বালাইলা আগুন,
জ্বালাইলা আগুন বুকে
জ্বালাইলা আগুন।
কোন কাননের ফুল গো তুমি…”

মিতুল রূপকের দিকে ঘুরে দাঁড়াল। গলা জড়িয়ে ধরে রূপকের পায়ের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ঠোঁটে আলতো করে চুমু খেল। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“রূপক কাননের ফুল গো আমি।”
রূপকও হেসে জড়িয়ে ধরল মিতুলকে।

কোন কাননের ফুল গো তুমি পর্ব ২১

বিঃদ্রঃ এই গল্পে যতটা গ্যাপ এসেছে ততটা গ্যাপ হয়তো অন্য কোনো গল্পে পড়েনি। এজন্য হয়তো অনেক পাঠকই রেগে আছেন। কিন্তু ইচ্ছের বিরুদ্ধে যে চাইলেও দু’লাইন লেখা যায় না এটা হয়তো অনেক পাঠকই জানেন না। রাইটিং ব্লক ভীষণ খারাপ জিনিস। যাই হোক, অনেক অপেক্ষার পর গল্পটি শেষ হলো। যারা এতদিন সাথে থেকেছেন, অপেক্ষা করেছেন, সাপোর্ট করেছেন তাদেরকে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে ভালোবাসা জানাই। গল্পটি কেমন লেগেছে অবশ্যই দুই লাইনে হলেও বলে যাবেন। আপনাদের মতামত, মন্তব্য আমার লেখার অনুপ্রেরণা।]

(সমাপ্ত)