মধুমাস পর্ব ৩৬

মধুমাস পর্ব ৩৬
জাকিয়া সুলতানা ঝুমুর

ভোরের উজ্জ্বল আলো জানালার পর্দা ভেদ করে রুম আলোকিত করে দিচ্ছে,প্রসস্ত বুকে পরম ভরসায় শ্যামা শুয়ে আছে।যে সজাগ আছে কিন্তু ইচ্ছে করেই মিষ্টি পুরুষটার বুক থেকে সরে যাচ্ছে না,বরং সরে যাওয়ার বদলে ক্ষনে ক্ষনে ঘোরলাগা চোখে ফিরোজকে দেখছে।এই পুরুষটা ভিষণ মিষ্টি,উনার সাথে মিশে শ্যামার এটাই ধারনা হয়েছে।
সে লোমস বুকে নাক ঘষে দেয়,টুপটাপ চুমু খায়।ফিরোজ নড়েচড়ে চোখ বন্ধ করেই বললো,

“এতো আদর করছো কেনো?”
ফিরোজ জেগে আছে জানতে পেরে শ্যামা খানিক লজ্জা পায়,তার পাগলামি তাহলে সবই উপভোগ করেছে।ফিরোজ হাত দিয়ে ধাক্কা দিয়ে তাকায়।শ্যামা আস্তে করে বললো,
“এমনিই।আদর করতে ইচ্ছে করছে তাই।”
ফিরোজ চোখ বন্ধ করে আবার বললো,
“এতো আদর করোনা সমস্যা আছে।বুঝেছো?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

শ্যামা হেসে দেয়।আস্তেধীরে উঠে বসে।নিজের দিকে তাকিয়ে লাজুক হাসে তারপর ফ্রেশ হওয়ার উদ্দেশ্যে বাথরুমে চলে যায়।কিছুক্ষণ পরে রুমে এসে ফিরোজকে দেখে নিজেকে পরিপূর্ণ লাগে।আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে,ভালোবাসার মূহুর্তে ফিরোজের পাগলামি বাড়ে আর এরই ছাপ তার গায়ে পড়েছে।ভালোবাসার চিহ্ন শ্যামা ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে,আশ্চর্যজনকভাবে তার একটুও ব্যাথা,

অসস্থি কিংবা খারাপ লাগা হচ্ছে না বরং এগুলো দেখে ভিষন ভালো লাগছে সুখে সুখে রঙ্গিন প্রজাপতির মতো উড়াউড়ি করতে মন চাইছে।আচ্ছা মেয়েদের প্রথম কি এমনই ভালো লাগা কাজ করে।নাকি সে তার মধুরাজাকে পেয়েছে বলেই এমন হচ্ছে?কি জানি শ্যামা এতোকিছু ভাবে না সে তার সুখটা উপভোগ করে।পেছনে প্রণয়পুরষের ছোঁয়া পেয়ে তাকায়।ফিরোজ তার দিকেই তাকিয়ে আছে।শ্যামা চুলে হাত বুলিয়ে বললো,

“ঘুম ভাঙ্গলো আমার মধুরাজার?”
“মধুরানী পাশে না থাকলে ঘুমও পাশে থাকে না।”
“আমার কি আরো কিছুক্ষণ থাকা উচিত ছিলো?”
ফিরোজ শ্যামার গালে নিজের গাল মিশিয়ে দাঁড়িয়ে আয়নায় তাকিয়ে আদুরী কন্ঠে বললো,

“হুম।সারাটাদিন।”
“নতুন বউ এতোক্ষন শুয়ে থাকবে?”
“থাকুক না।”
“আচ্ছা অন্যএকদিন।”
“আজ কি সমস্যা?”
“আজকে তাড়াতাড়ি বেরোনো উচিত।”
ফিরোজ শ্যামার হাতের উল্টোপিঠে চুমু দেয়।পরম যত্নে নিজের সাথে আগলে রাখে।শ্যামা বললো,

“এতো আদর করেন কেনো? ”
ফিরোজ শ্যামাকে তার দিকে ফিরায়।
“তুমি আমাকে পাওয়ার জন্য যতো আ,ঘাত সহ্য করেছো তার দূর করার জন্য সারাজীবন ভর আদর করলেও তা কমবেনা।আমার জীবনটা সুখে সুখে পরিপূর্ণ করার জন্য ধন্যবাদ,সারাজীবন আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবো।”
“আপনাকে কাছে পেয়ে সত্যিই কোনো আ,ঘাতের কথা মনে পড়ছেনা।মনে হচ্ছে আমি এক সুখের সাগরে জাহাজে ভেসে বেড়াচ্ছি।”

শ্যামার কথায় ফিরোজ হাসে।
“আমি তোমাকে সুখে রাখবো শ্যামা।সুখে রেখেই সারাজীবন কাটিয়ে দেবো।”
শ্যামা আহ্লাদী গলায় বললো,
“আমি এভাবেই সারাজীবন কাটাতে চাই,সারাটা জীবন।”

সময় কারো জন্য অপেক্ষা করে না।সময় সময়ের গতীতে ছুটে চলে।মানবকে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে ছুটতে হয়।শ্যামা আর ফিরোজও সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে ছুটে যায়,এই সময় তাদের অনেক কিছু শিক্ষা দিয়েছে।মানুষের কথা,অপমান কতো রকমের হতে পারে তা দুজনে খুব ভালোজানে।

সবাই মুখে কিছু না বললেও তারা দুজনেই বুঝতো যে সবাই তাদের প্রতি নাখোশ।কিন্তু এই নাখোশ এর সর্বোপরি খোশ হয়ে গেলো যখন শ্যামা ফুটফুটে এই পরীর জন্ম দিলো।সারা ঘরের গোমটভাব যেনো নিমিষেই দূর হয়ে গেলো।ছোট পরীটার নাম শানায়া।শানায়াকে পেয়ে যেনো সবাই নতুন করে আনন্দের খোরাক পেলো।সারাদিন সবাই আদরে আদরে ভরিয়ে রাখে,কোল থেকে নামার সুযোগ পায় না।

শ্যামা মুগ্ধ হয়ে মেয়ের প্রতি সবার ভালোবাসা দেখে।রোজিনা বেগম তাকে কখনোই পছন্দ করেননি কিন্তু বাবু হওয়ার পরে যেনো উনি পালটে গেলেন।এখন তাকে খুব ভালোবাসে,নরম চোখে দেখে।আর উনি শানায়ার জন্য এতোটা পাগল যে কেউ দেখলে কখনোই ভাবনে না উনিই একসময় শ্যামার সাথে খারাপ আচরণ করতো কিংবা সৎ দাদী।সারাটাক্ষন শানায়াকে উনার কাছেই রাখবে।মোহাম্মদ আলী যতোক্ষণ বাসায় থাকবে ততোক্ষণ উনার কাছে শানায়া থাকবে।শ্যামা আর ফিরোজ মুগ্ধ হয়ে বাবা মায়ের পরিবর্তন লক্ষ করে।

এতো কষ্টের পরেও তারা নিজেদের জায়গায় ঠিক ছিলো একটিও পিছু হটেনি কিংবা কাউকে কটু কথা বলেনি।রাগী ফিরোজ এখন এতোটাও রাগী নেই, শ্যামার দুষ্টু মিষ্টি শাসনে সে খানিকটা শান্ত স্বভাবের হয়ে গিয়েছে।সে এখনো তার মধুরানীকে ঠিক আগের মতোই ভালোবাসে।বছরের পর বছর চলে যাচ্ছে অথচ তাদের দুজনের ভালোবাসা আংশিক পরিমানও কমেনি।এই পাঁচ বছরে শ্যামা অনেক বদলেছে।দুষ্টু,খামখেয়ালিপনা ছেড়ে হয়েছে ভিষণ দায়িত্বশীল এক নারী।যার কিনা স্বামীর-সন্তানের পাশাপাশি সবার দিকেই নজর।সবাইকে ভিষণ যত্নে নিজের উপর সদয় করে নিয়েছে।পরিবারের প্রত্যেকটা সদস্য তার উপর খুশী।শ্যামাকে ছাড়া এখন ঘরে কিছুই হয় না।

বাবার বাড়িতে কেউ কখনো বলেনা যে প্রেম করে বিয়ে করে ভুল করেছে।কারন উনারাই নিজ চোখে মেয়ের সুখ দেখেছে৷ ফিরোজকে সবাই খুব পছন্দ করে।স্বপন ইসলাম ফিরোজকে জিজ্ঞেস না করে কিছুই করে না।উনি প্রত্যেক কাজে ফিরোজের মতামতকে বেশী প্রাধান্য দেয়।শ্যামার থেকেও বেশী ফিরোজকে সবাই ভালোবাসে।শানায়া দুনিয়াতে আসার পর থেকেই যেনো সবাই সব পুরোনো কথা ভুলে গিয়েছে।

রিপন আর ফিরোজের কোনো বিরোধ নেই, বরং দুজনকে’ই মাঝে মাঝে চায়ের দোকানে আড্ডারত অবস্থায় দেখা যায়।শ্যামা বিয়ের প্রথম প্রথম অপরাধবোধ করতো,এখনো করে।সে জানে তার আব্বা আম্মা এই বিয়েতে কষ্ট পেয়েছে।মেয়ের দিকে তাকিয়ে হাসিখুশি থাকলেও মনের সুপ্ত কষ্টের কথা সে বুঝতে পারে।শ্যামা বাবার বাড়ি যায়।সন্ধার পরে স্বপন ইসলাম শানায়াকে নিয়ে বসে খেলছিলো।শ্যামা তার আব্বার পাশে বসে বললো,

“আব্বা কিছু কথা ছিলো।”
স্বপন ইসলাম মেয়ের দিকে তাকায়।মেয়েটা সুখেই আছে উনি।যেমন ভেবেছিলেন তেমন কিছুই হয়নি।
“কি কথা?”
“আব্বা আমাকে ক্ষমা করে দিয়েন।”
“কেন রে মা!”
“আমি শানায়ার বাবাকে বিয়ে করার জন্য আপনাদের কতো কষ্ট দিয়েছি,অবাধ্য হয়েছি।আমি জানি আপনারা মুখে না বললেও কষ্ট পেয়েছেন।আমি এই বোঝা বয়ে বেড়াতে পারছিনা আব্বা।আপনি আমাকে বলুন যে ক্ষমা করেছেন তা না হলে আমি শান্তি পাচ্ছি না।”

এসব কথা বলতে বলতে শ্যামা কেঁদে দেয়।তার কান্নার শব্দে ঘরের সবাই এসে উপস্থিত হয়।মেয়ের কান্নার বিষয় জানতে পেরে ফাতেমা বেগমও কেঁদে দেয়।চার বছরের শানায়া সবার কান্না দেখে ভয় পেয়ে যায়।সে হাত বাড়িয়ে তার মামিমার কোলে চলে যায়।স্বপন ইসলামের চোখ জ্বালা করে উঠে।মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললো,
“আরে কাঁদিস কেনো?পাগল মেয়ে।”
শ্যামা মাথা নেড়ে বললো,
“আগে বলেন আমাকে ক্ষমা করেছেন।”

“সত্যি বলতে প্রথম খুব কষ্ট পেয়েছিলাম।এতো খারাপ লাগছিলো যে নিজেকে স্বাভাবিক করতে সময় লেগেছে।তারপর আমার চিন্তাধারা সম্পূর্ণ ভুল করে ফিরোজ তোকে ঠিক রানীর মতোই রাখছে।আর ফিরোজও ভালো ছেলে তারপর থেকে মনে হলো আমার মেয়ে ভুল কাউকে নিজের জীবন সঙ্গী করেনি।এখন আমার চোখে ফিরোজ সু-পাত্র।আমি তোকে কবেই ক্ষমা করে দিয়েছি।আজকে তুই নিজেই অনুতপ্ত হয়ে আমার কাছে ক্ষমা চাওয়াতে প্রাণ ভরে দোয়া করে দিলাম।”
শ্যামার মাথায় ফাতেমা বেগম হাত বুলিয়ে বললো,

“পাগল মেয়ে। তুই এখনো এসবেই পরে আছিস!আমার কাছে তো এখন তোর থেকেও বেশী ফিরোজকেই মায়া লাগে।”
মায়ের কথায় শ্যামা হেসে ফেলে।তার মাথা থেকে যেনো হাজার মণ ওজনের বোঝা নেমে যায়।পরম শান্তিতে তার রুমে আসে।

রাত দশটার দিকে ফিরোজ আসে।খাওয়াদাওয়া শেষ করে রুমে আসতেই শানায়া বাবার কোলে চলে যায়।বাবার সাথেই তার যতো খুনশুটি।ফিরোজের কাছে মনে হয় এই ছোট বাবুটা তার জীবন।একটা দিন চোখের আড়াল হলে বুকটা খালি খালি লাগে।শানায়া দেখতে একদম ফিরোজের মতো হয়েছে।ধবধবে ফর্সা,আর ফিরোজের মতোই বলিষ্ঠ দেহের গড়ন।শ্যামা বাবা মেয়ের দিকে তাকিয়ে গাল ফুলিয়ে বললো,

“আমি পেটে নিয়েছি,অথচ বাবা বলতেই জানপ্রান।”
শানায়া আধো আধো গলায় বললো,
“বাবা আমার জান,কলিজা।”
“আর আমি?”

শানায়া বাবার সাথে মিশে যায়।মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
“তুমি আমার আম্মু আর এটা আমার ছেলে।”
মেয়ের কথায় ফিরোজ হো হো করে হেসে উঠে।শ্যামা বললো,
“খুব হাসি আসছে তাই না?মেয়েটাও একদম বাপের মতো হয়েছে।”
ফিরোজ বললো,

“হবে না! বাপ ক্যা বেটি,সিপাহীকা ঘোড়া।”
কিছুক্ষণ পরে শানায়া ঘুমিয়ে যায়।ফিরোজ শ্যামাকে কাছে টেনে বললো,
“এমন একটা রাজকুমারী জন্ম দেয়ার জন্য ধন্যবাদ রানী।আগে দেখতাম বাবা মা তাদের সন্তানকে কতো ভালোবাসে আমি সত্যিই এর মূল্য বুঝতাম না কিন্তু শানায়া আমার কোলে আসার পর থেকে আমার মনে হচ্ছে এটাই আমার মা, আমার জীবন।ও যখন আমাকে বাবা বাবা বলে ডাকে তখন এতো সুখ লাগে, সুখে বুকটা ভরে যায়।”
শ্যামা ফিরোজের দিকে তাকিয়ে বললো,

“আমার’ও।”
“তুমি আসলেই আমার রানী,যার কারণে আমার জীবন ধন্য,পরিপূর্ণ।”
প্রশংসা শুনতে সবারই ভালো লাগে।শ্যামারও ভালো লাগছে।সে মাথা নেড়ে বললো,
“আচ্ছা।”
“ওই লাল শাড়িটা পড়োনা।আজকে পূর্ণিমা।”
“বাবু উঠে যাবে।”
“উঠবেনা।পড়ো তো।”

শ্যামা আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ সেজেগুজে যায়।তারপর ফিরোজের কথামতো বেরিয়ে পরে।দুজন হাতে হাত রেখে রাস্তায় হাটে।পরিচিত পুকুরপাড়ে গিয়ে দাঁড়ায়।পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় চারপাশ চকচক করছে।ফিরোজ শ্যামাকে বললো,
“এখানে দাঁড়িয়েই প্রথম আমাকে মনের কথা বলেছিলে।”
“হুম,সব মনে আছে।”
“আমার সাহসী নারী।এমন সাহস করে বলেছিলে বলেই তো জীবনের ছন্দ বদলালো।”
“আচ্ছা।”

“ধন্যবাদ আমার মধুরানী।”
“বারবার এতো কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবেন না তো।”
“কেনো করবোনা? প্রিয় নারীর কাছে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশে কোনো দোষ নেই।”
“আমিও তো তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ।আর এই কৃতজ্ঞতা এতো পরিমান যে বলে শেষ করা যাবে না।”
“আচ্ছা।”

চাঁদের আলোয় দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকে।ফিরোজ মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার রানীকে দেখছে।প্রিয় পুরুষের চোখে তার প্রতি মুগ্ধতা শ্যামাকে খুশী করে তুলে।ফিরোজ শ্যামাকে বুকে জড়িয়ে নেয়।দু-হাত দিয়ে মুখটা ধরে অধরে অধর মিলায়।পূর্ণিমার নিঝুম রাত,ঠিক প্রথম দিনের মতো শ্যামা কেঁপে উঠে,দু’হাতে আঁকড়ে ধরে তার ফিরোজকে।কিছুক্ষণ পরে দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠে।ফিরোজ একটা কদম গাছে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়।শ্যামা তার বুকে মাথা রেখে দাঁড়ায়।ফিরোজ পরম যত্নে শ্যামাকে আগলে ধরে,আদর নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।ফিরোজের এই সামান্য যত্ন গুলো শ্যামাকে খুব সুখ দেয়।সে বললো,

মধুমাস পর্ব ৩৬

“তুমি আমার সুখ।তুমি আমার সস্থি।”
ফিরোজ মুচকি হাসে।চাঁদের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আরো সহস্র পূর্ণিমা তোমার সাথে কাটাতে চাই বউ।এত্তো এত্তো ভালোবাসা এখনো যে বাকী।”
কদম গাছের নিচে পরম ভালোবাসায় মিশে থাকে সুখী দম্পতি।চাঁদ, তারা, হেসে হেসে তাদের ভালোবাসা দেখে।পৃথিবীর সবাই এমন সুখে থাকুক।
মধুরাজা মধুরানীর ভালোবাসা অটুট থাকুক আজীবন।

‌‌‌‌‌‌সমাপ্ত