মধুমাস পর্ব ৩৪

মধুমাস পর্ব ৩৪
জাকিয়া সুলতানা ঝুমুর

দুপুরে যে পাত্রপক্ষ শ্যামাকে দেখতে আসবে তাদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।পাত্র স্বপন ইসলামের প্রাক্তন ছাত্র,সে মোটামুটি সবই জানে,তাই এইবার আর বিয়ে ভাঙ্গার কোনো কারণ নেই।স্বপন ইসলাম উনাদের অপেক্ষায় আছেন।তখনি আগমন ঘটে মোহাম্মদ আলীর।উনাকে দেখে মুখের ভাব কঠিন হয়,মুখে কিছু কথা চলে এলেও তা মুখ ফুটে বলেনা কারণ উনি একা নয় উনার পাশে সাবেক চেয়ারম্যান আর ওসি সাহেবও এসে দাড়িয়েছেন।আর এ সব কিছুর কালপ্রিন্ট যে সে হাতে ফলের প্যাকেট নিয়ে স্বাভাবিক ভাবে দাঁড়িয়ে আছে।চেয়ারম্যান সাহেব স্বপন ইসলাম আর রিপনের দিকে তাকিয়ে বললো,

“কি ব্যাপার স্বপন ভাই!ভেতরে যেতে বলবেন না, নাকি?”
স্বপন ইসলাম ভদ্রতাসূচক হাসে।রিপন তার আব্বার মনোভাব বুঝতে পেরে জলদি বললো,
“আসেন কাকা,ঘরে আসেন।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

স্বপন ইসলাম চুপচাপ নিজের রুমে চলে যায়,এইসময় উনি মোহাম্মদ আলীকে আশা করেননি।এসেছে এসেছে আবার সাথে লোক ধরে নিয়ে এসেছে।যেনো না ফিরাতে পারে।
উনাদের মতো ফাতেমা বেগম আর শান্তাও অবাক।ফিরোজের দেয়া ফলমূল আর মিষ্টান্নের বাহার দেখে মনে হচ্ছে আজকে রাজী না করিয়ে যাবে না।দুজনেই চিন্তায় আছে।
রিপন কি বলবে কিংবা এইমুহূর্তে তার কি বলা উচিত তা বুঝতে পারছে না।চেয়ারম্যান সাহেব পরিবেশ হালকা করতে গলা খাকারি দিয়ে বললো,

“রিপন!তোমাদের বাড়িতে কেউ আসার কথা নাকি?”
রিপন যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচে।
“হ্যাঁ।আমার ছোটবোনকে দেখতে আসার কথা। ”
“তার বোধহয় আর দরকার নেই।”

রিপন চুপ করে থাকে।মোহাম্মদ আলীর এতো খারাপ লাগছে যে উনি কথা বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছেন না।স্বপন ইসলামকে করা অপমানগুলো যেনো গায়ে শুলের মতো ফুটছে।স্বপন ইসলাম কোনো কথা না বলে চলে যাওয়াতে যেনো অপমানের ঘা আরো গভীর হয়।নিজের বিবেক তার ভুলগুলো যেনো হাতের আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে।এতোটা বাড়াবাড়ি করা ঠিক হয়নি,কোনো বাবাই চাইবেনা মেয়ে প্রেম করুক কিংবা বাবা মায়ের অবাধ্য হোক কিন্তু উনি এই সবগুলো দোষ স্বপন ইসলামের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন অথচ উনি সম্পূর্ণ নিরপরাধ।এখন কি করা যায়?উনাকে দেখে যা মনে হলো সহযে মানবেনা।মোহাম্মদ আলী রিপনকে বললো,

“রিপন শোন।”
রিপন বিষ্ময়ে উনার দিকে তাকায়।বর্তমানে তাদের ঘরে বসে থাকা মোহাম্মদ আলীর কন্ঠস্বর খুবই নরম অথচ মাস কয়েক আগে উনিই এই বাড়িতে অহংকারী কথাগুলো বলে গিয়েছিলেন।তাকে তাকাতে দেখে মোহাম্মদ আলী বললো,
“আমরা এখানে আসার কারণটা নিশ্চয়ই তোমরা বুঝতে পেরেছো?”
রিপন মাথা নেড়ে বললো,

“জ্বী।”
“স্বপন ভাইকে ডাকো,কথা বলি। ”
ওসি সাহেব বললো,
“মনে রাগারাগি না রেখে সরাসরি কথা বলে সমাধানে আসাই বুদ্ধিমানের কাজ। যাও তোমার বাবাকে ডাকো।”
রিপন দ্রুত তার আব্বার রুমে যায়।তার পিছুপিছু ফাতেমা বেগম আর শান্তাও যায়।স্বপন ইসলাম রাগে কিড়মিড় করছে।রিপন গিয়ে বললো,

“আব্বা আপনাকে ডাকে।আসেন।”
উনি দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
“শ্যামারে আমার কাছে আন,আমি ওরে এখন জ,বাই করবো।”
“মাথা ঠান্ডা করেন আব্বা,এখন এসব বলে কি লাভ?মেয়ে বিয়ে দেবেন না?এই কয়মাস কি কম চেষ্টা করেছেন? একটা ছেলেপক্ষ কি রাজী হয়েছে?”

“এতো অপমানের পরে ওই বড়োলোকের সাথে আত্মীয়তা করার প্রশ্নই আসে না। ”
“আচ্ছা করেন কি না করেন সেটা পরে দেখা যাবে, এখন আসেন।”
“তুই যা।আমি যাবোনা।”
“আব্বা জেদ করেন না তো।”
“যা,আর একটা কথাও বলবি না।”

রিপন নত মস্তিষ্কে বেরিয়ে যায়।ফাতেমা বেগম এতোদিন মেয়েকে কম মা,রেননি,কম বুঝাননি কিন্তু মেয়ে যানো এক কথায় আটকে আছে।এতোদিন যা হওয়ার হয়েছে এখন যেহেতু ছেলের বাবা নত হয়ে মেয়ে নিতে এসেছে তাহলে আর না করার কি দরকার?মেয়ের রিজিক থাকলে যাবে।এতোদিন তো বিয়ে দেয়ার জন্য কম চেষ্টা করা হয়নি আর কেন বিয়ে হয়নি এটা সবারই জানা তাহলে আর কি করার আছে?মেয়েকে মানাতে পারলে না হয় অন্যকথা বলা যেতো কিন্তু মেয়ে যে ফিরোজ বলতেই রাজী!ফিরোজের জন্য জান দিতেও প্রস্তুত।কিন্তু ফিরোজের আব্বা যে উনাকে।অপমান করেছে এটা ঠিক এতোটা না বললেও পারতো।উনি বললেন,

“শোনেন,উনারা বসে আছে।”
“থাকুক।”
“আপনি না গেলে ব্যাপারটা খারাপ দেখায়।”
“সব নষ্টের মূল তুমি,মা হয়ে মেয়েকে সামলাতে পারোনি।”
“এসব বলে লাভ কি?যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে।”

“আমি যাবো না।আর মেয়েও বিয়ে দেবো না।তোমার মেয়ের ইচ্ছে হলে বলো এখনি চলে যেতে।”
“কি বলেন এগুলা?সসম্মানে নিতে এসেছে ভালো লাগছে না?নাক কান কেটে চলে গেলে ভালো লাগতো?”
“চলে যাক।”

“এতো কথা বইলেন না।ছেলের বাবা মাথা নত করে এসেছে,আসেন।”
“কিসের নত করা?ওই লোকটা খুব খারাপ হয়তো ছেলের চাপে পরে এসেছে পরে আসল রূপ বেরোবে।”
ফাতেমা বেগম চুপ করে থাকে।স্বামীকে নড়ানো সম্ভব না বুঝে একপাশে দাঁড়িয়ে থাকে।
রিপনকে বিমর্ষ মুখে আসতে দেখে সবাই বুঝতে পারে স্বপন ইসলাম আসেনি।সবাই চুপ করে বসে থাকে।কিছুক্ষণ পরে মোহাম্মদ আলী উঠে দাঁড়ায়।

“তোমার আব্বার রুম কোনটা?”
রিপন অবাক হলেও তা প্রকাশ করে না।হাত দিয়ে তার আব্বার রুম দেখিয়ে দেয়।
“স্বপন ভাই,আসবো।”
ফাতেমা বেগম দরজা খুলে দেয়।স্বপন ইসলাম দাড়িয়ে যায়।মোহাম্মদ আলী যে সোজা রুমে চলে আসবে তা কল্পনাও করেননি।
মোহাম্মদ আলী নিজের অহংকার দূরে রেখে এগিয়ে যায়।

“ভাই,আগে যা বলেছি;করেছি সব ভুলে যান,আমার ভুল হয়েছে,শ্যামাকে আপনার কাছে নিজের মেয়ে করে নিতে এসেছি,ফিরিয়ে দেবেন?”
স্বপন ইসলাম চুপ করে থাকে।মোহাম্মদ আলী আবার বলেন,

“আমার ছেলেটা জনমদুঃখী।মা চলে যাওয়ার পরে ছেলের কথা ভেবে আবার বিয়ে করলাম কিন্তু সে দুঃখই পেলো।সারাটা জীবন ছেলের দুঃখ দেখেই গেলাম।সে এখন তার সুখ হিসেবে শ্যামাকে চেয়েছে।আমি নিজেও দেখেছি শ্যামাকে ছাড়া ফিরোজ কতো ভঙ্গুর।আমি আমার ছেলের সুখ নিতে চাই ভাই।আবারো বলছি আগে যা বলেছি আমার ভুল হয়েছে।আমার ক্ষমা করে দিন।”

স্বপন ইসলাম নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেনা।এই মানুষটাই তেজী গলায় কঠিন কথাগুলো বলেছিলো আর আজকে মনে হচ্ছে সব পালটে গিয়েছে।উনাকে কিছু না বলতে দেখে মোহাম্মদ আলী স্বপন ইসলামের হাত ধরে বললো,
“মেয়েটাকে দিয়ে দেন ভাই,আমি সারজীবন ঋণী থাকবো।”
স্বপন ইসলাম আর শক্ত থাকতে পারে না।মাথা নেড়ে বললো,
“চলেন।”

দুজনকে একসাথে আসতে দেখে সবাই খুশী হয়।চেয়ারম্যান সাহেব বললো,
“তা স্বপন ভাই আপনার মেয়ের জন্য আমার ছোটভাই ফিরোজকে কেমন লাগে?”
স্বপন ইসলাম চোখ ঘুরিয়ে ফিরোজের দিকে তাকায়।ফিরোজ আত্মবিশ্বাসী চোখে উনার দিকে তাকিয়ে আছে।
“ভালোই।”
“তাহলে আমরা কথা আগাই?”
“জ্বী।”

ওসি সাহেব বললো,
“কিসের কথা আগানো,মেয়ে না দেখে কথা আগায় কিভাবে?”
রিপন গিয়ে শ্যামাকে নিয়ে আসে।

ঘরে পরার সাধারণ কাপড়েও শ্যামাকে সুন্দর লাগছে।অতিরিক্ত মা,রার কারণে মুখটা ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে।এতোক্ষন রুম থেকে সব শুনেছে, সব দোয়া পড়ে আল্লাহর কাছে সমাধান চেয়েছে।দুরুদুরু বুকে চুপটি করে চেয়ারে বসে থাকে।মোহাম্মদ আলী পকেট থেকে পাঁচ হাজার টাকা বের করে শ্যামার হাতে গুজে দেয়,ছেলের পছন্দের মেয়েকে খালি হাতে দেখবেন কি করে?ফিরোজ বারবার তাকাচ্ছে,মে রে মেয়েটার কি হাল করেছে সেটাই ভাবছে।
মোহাম্মদ আলী বললো,

“তাহলে আগামী মাসের এক তারিখে বিয়ের তারিখ ঠিক করা হোক,ওইদিন শুক্রবার,সবার সুবিধা হবে।”
ফিরোজ বললো,
“না,কালকের পরের দিনও শুক্রবার আমি ওইদিনই বিয়ে করবো,এতো লম্বা তারিখের দরকার নেই।”
ফিরোজের নিলজ্জতায় সবাই অবাক হয়।শ্যামা লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে চায়,এখনো তার মনে হচ্ছে সে স্বপ্নে আছে কিন্তু ফিরোজের নির্লজ্জ কথায় মনে হচ্ছে বাস্তবেই আছে।ফিরোজের কথা শুনে মোহাম্মদ আলী ছেলের দিকে তাকায়।ফিরোজ তার আব্বার চোখের দৃষ্টি অনুসরন করে বললো,

“শুভ কাজে দেরী করা ভালো না আব্বা।”
চেয়ারম্যান সাহেব রসিক মানুষ উনি ফিরোজের কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠে।মুহূর্তেই উনার হাসির রেশ উপস্থিত সবার ঠোঁটের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে।স্বপন ইসলাম বললো,
“তাহলে।সামনের শুক্রবারেই বিয়ে।”

মধুমাস পর্ব ৩৩

ফিরোজ উঠে যায়।চুপচাপ বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়।অবশেষে তার রানীকে জয় করার পথে।খুশীতে ডান চোখ থেকে টুপ করে এক ফোঁটা গরম পানি গাল বেয়ে গড়িয়ে পরে।রুমে শ্যামার বুকটা ভার লাগে,চোখ জ্বালা করে ফিরোজের মতোই পানির রেখা গালে নামে।

মধুমাস পর্ব ৩৫