মধুমাস পর্ব ৩৩

মধুমাস পর্ব ৩৩
জাকিয়া সুলতানা ঝুমুর

শ্যামা শব্দ করে টেবিল থেকে মাটিতে পড়ে যায়।এক থাপ্পড়েই ঠোঁট কেঁটে র,ক্ত আসে।ফাতেমা বেগম হিং,স্রবাগিনীর মতো শ্যামাকে চেপে ধরে বললো,
“মোবাইল! মোবাইল পেয়েছিস কোথা থেকে?কে দিয়েছে?”
শ্যামা হাফসাফ করে,এমন করে চেপে ধরাতে শ্বাস নেয়াতে ব্যাঘাত ঘটে।চোখ উলটে আসতে চায়।ফাতেমা বেগম মেয়েকে ছেড়ে দেয়।

“কে দিয়েছে?”
শ্যামা ঘনঘন শ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলে নেয়।এমন অবস্থায় ধরা পড়েছে যে আর লুকিয়ে কোনো লাভ নেই।সে বললো,
“ফিরোজ।”
“কবে দিয়েছে।”
শ্যামা মিথ্যা বললো,
“গতোকাল।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“তুই এখনো ফিরোজের সাথে সম্পর্ক রেখেছিস এটা ভাবতেই অবাক লাগছে।”
শ্যামা চুপ করে থাকে।কিন্তু ফাতেমা বেগম চুপ থাকেনা এলোপাতাড়ি মা,রতে থাকে,
“কি মুখ দিয়ে কথা আসে না?”

শ্যামার আর্তনাদ,না মা,রার আকুতি কোনো কিছুতেই উনার মন নরম হয় না। কিছুক্ষণ পরে শ্যামাকে আর চিৎকার এবং নড়াচড়া করতে না দেখে উনি নিজেই থামে।হাত দিয়ে গালে আলতো থাপ্পড় দিয়ে আহাজারি করে চিৎকার করে বললো,
“ও রিপন রে!আমি আমার শ্যামারে মে,রে ফেলেছি।ও রিপন।”

স্বপন ইসলাম আর রিপন এসে অবস্থা দেখে পরিস্থিতি কি তা বুঝতে পারে।এমন শান্ত হয়ে যাবার পরে এই ঝড় যেনো সবাইকে অবাক করে দিয়ে যায়।রিপন এগিয়ে শ্যামাকে কোলে নিয়ে বিছানায় শুয়িয়ে দেয়।শান্তা পানি আনতে ছুটে যায়,সে শ্যামাকে দেখতে না পারলেও বারবার শ্যামার এমন করুন পরিনতি তাকে কষ্ট দিচ্ছে।বুঝতে পারে শ্যামার জন্য বুকে মায়া জন্মেছে।

টেবিলের উপর মোবাইলটা দেখে সবাই মূল কারণ উদঘাটন করতে সক্ষম হয়।এতো শাষণের পরেও মেয়ে এক কদম পিছায়নি!এই মেয়েকে অন্য কোথাও কি করে বিয়ে দেবে?স্বপন ইসলাম বললো,

“কালকের মধ্যে ওই অবাধ্য সন্তানকে আমি আমার বাড়ি থেকে বিদায় করতে চাই।আমি আজকেই পাত্র খুঁজে আনবো।”
উনার কথায় কেউ কোনো কথা বলেনা।শ্যামা তখন পিটপিট করে তাকাচ্ছে।বাড়ির আবহাওয়া যে সাহারা মরুভূমির মতো উত্তপ্ত তা চোখ না খুলেই বুঝতে পারে।তার জন্য এবার দ্বীগুন তোড়জোড় করে পাত্র দেখা হবে অথচ সে বিবাহিত।আচ্ছা বিয়ের কথা প্রকাশ করে দেয়া কি উচিত? এতে কি ভালো হবে?কিন্তু এতো বড়ো একটা কথা ফিরোজের সিদ্ধান্ত ছাড়া জনসম্মুখে প্রকাশ করা ঠিক হবে না,কিংবা এখনো সময় আসেনি।

সবাই চলে গেলেও শান্তা যায় না।শ্যামার মাথার পাশে বসে বললো,
“শ্যামা! তোর কি বেশী খারাপ লাগছে?”
শ্যামা কিছু না বলে চুপ করে থাকে।শান্তা আরো কিছু বলাতে শ্যামার কান্নারা দলা পাকিয়ে গলা ঠেলে বেড়িয়ে আসে।শান্তার কোমড় জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে উঠে,আস্তে করে বললো,

“ভাবী।ফিরোজকে ছাড়া আমি সত্যিই বাঁচবোনা।তুমি সবাইকে বুঝাও।”
শান্তার খারাপ লাগে।ভালোবাসায় কি এমন যা,দু আছে যে সবাই এমন পাগল হয়ে যায়!সে কখনো প্রেম করেনি তাই এই যাদুবলের শক্তি বুঝে না।আসলে যে প্রেম করে সেই বুঝে এর মর্ম,নাকি সবাই তাদের দিকটাই বুঝে।
“আমার কথা কেউ শুনবেনা।”

শ্যামা নিজেও তা জানে।এখন ফিরোজকে খবর দেয়া জরুরি।সে উঠতে চায়।শান্তা বললো,
“কি?”
“আমার মোবাইলটা।”
“তোর ভাই নিয়ে গিয়েছে।”
শ্যামা আবার শুয়ে পরে।শান্তা বললো,
“এতোই যখন ভালোবাসিস তাহলে এখানে পরে না থেকে ফিরোজের কাছে চলে যাচ্ছিস না কেনো?”
“পালিয়ে যাওয়ার কথা বলছো?”
“হ্যাঁ।”

শ্যামা চুপ করে বসে থাকে,পালানোর হলে তো সেই কবেই পালাতো।হঠাৎ কোথা থেকে ফাতেমা বেগম ছুটে আসেন।হাতে একটা কাঁচের শিশি।
শ্যামাকে দেখিয়ে বললো,
“এইবার যদি বিয়ে করার ক্ষেত্রে কোনো ঝামেলা পাকাস তাহলে আমি আর তোর আব্বা এই বি,,ষ খেয়ে ম,,রে যাবো।তারপর তুই শান্তিতে বিয়ে বসিস।”

মায়ের কথায় শ্যামা স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে।বুকটা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়।নিজেকে এতো অসহায় লাগে।শরীরের যন্ত্রণায় চোখ বুজে আসে,বন্ধ চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে ফোটায় ফোটায় পানি,যে পানির সাথে মিশে আছে হাজারো কষ্ট।
ফিরোজ সব শুনেছে।সে এতোক্ষণ ফোনের লাইনে ছিলো।শ্যামার আর্তনাদ তার বুকটা ছিদ্র করে দিয়েছে।যে করেই হোক মেয়েটাকে নিজের কাছে আনতেই হবে।সে এখন বাড়ির পথে ছুটে যাচ্ছে।তার আব্বাকে যেভাবেই হোক রাজী করাতে হবে।

বাড়ি এসে দেখে স্বপন ইসলাম সোফায় বসে স্ত্রীর সাথে কি নিয়ে যানো আলাপ করছে।ফিরোজকে দেখে দুজনেই তাকায়।অতিরিক্ত টেনশনের কারণে তার চেহারার লাবন্যটা হারিয়ে গেছে,মানষিক চাপ যেনো ফর্সা মুখ ফুড়ে প্রকাশ পাচ্ছে।ফিরোজ কিছু না বলে সোজা মোহাম্মদ আলীর পায়ের কাছে বসে।ফিরোজের এমন কাজে দুজনে অবাক হয়।মোহাম্মদ আলী কিছু বলার আগে ফিরোজ বললো,

“আব্বা!আপনি কি চান না আমি বেঁচে থাকি?”
ছেলে যে খুব টেনশনে আছে তা বুঝতে কষ্ট হলোনা,উনার পায়ের কাছে বসে মিনতি করছে মানে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে।

“কি হয়েছে?তুই আমার ছেলে আমি কেনো চাইবো তুই ম,,রে যা বল।”
“যদি চান বেঁচে থাকি তাহলে শ্যামাকে আমার কাছে এনে দিন।”
এই কথাটা বলতে বলতে ফিরোজের গলা ধরে আসে।
“কি বলছিস?”
“আমি শ্যামাকে ছাড়া নিজেকে ভাবতে পারি না আব্বা।ওর বিয়ে ঠিক হয়ে যাচ্ছে,অন্যকোথাও বিয়ে হলে আমি ম,রে যাবো।”

স্বপন ইসলামের বুকটা মুচড়ে উঠে।ফিরোজ উনার প্রথম সন্তান।এই সন্তানের মুখেই প্রথম বাবাডাক শুনেছে।অনেকদিন যাবত শ্যামাকে নিয়ে ফিরোজের আবদার উনি উপেক্ষা করে গিয়েছে ফিরোজের কষ্ট দেখেও দেখেননি,অতি আদরের সন্তানের চাওয়া অবহেলায় দূরে সরিয়ে রেখেছে এই সব করেছে ফিরোজের ভালোর আশায়,আসলে কোনো বাবা মা তার সন্তানের খারাপ চায় না,ভালোটাই চায়।

উনিও ভালোটাই চেয়েছিলেন কিন্তু হলো কি?ছেলে এই মেয়ের জন্য পা,গলপ্রায়।ঠিকমতো খায় না, বাড়ি আসে না,এমনকি বাবা ছেলের মাঝে আগের মতো আলাপও হয় না,এটাকে ভালো করা বলে?ভালো করতে গিয়ে কি খারাপ করে ফেললেন?উনি ফিরোজের দিকে তাকিয়ে দেখেন তার গাল বেয়ে পানির রেখা।ছেলে কি কাঁদছে?পুরুষ মানুষ সামান্য কষ্টে কাঁদেন না উনার ছেলে কাঁদছে তাহলে সে কঠিন সময়ে আছে।

“তুই কি আসলেই শ্যামাকে বিয়ে করতে চাস!”
“চাই।”
“দেখ,তোর লাইফে এর চেয়েও ভালো কেউ আসতে পারে এই যোগ্যতা তোর আছে।”
“আমি ভালো কাউকে চাই না।এই মেয়েকেই চাই।”
“আচ্ছা।”

“আপনি স্বপন কাকার কাছে গিয়ে বলেন।”
“কি বলবো?”
“উনার মেয়েকে নিজের পুত্রবধূ করে নেবেন।”
রোজিনা বেগম হিসহিস করে বললো,
“কতো শখ।আপনি এর কথা শুইনেন না।”
স্বপন ইসলাম রোজিনা বেগমের দিকে তাকিয়ে ধমক দিয়ে বললো,

“তুমি চুপ থাকো।যতো নষ্টের গোড়া তুমি।মহিলা মানুষ মহিলার মতো থাকবে,এতো পকপক করো কেনো?”
মোহাম্মদ আলী উঠে রুমে চলে যায়,রোজিনা বেগম অন্যদিকে চলে গেলে ফিরোজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফ্লোরে বসে থাকে।
ঘরের এক কোনে দাঁড়ানো ফারিয়া তার ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে।সে সবচেয়ে বেশী তার ভাইকে ভালোবাসে।এই ভাইয়ের এমন ভঙ্গুর দশা তার সহ্য হয় না।সে এগিয়ে আসে হাটুমুড়ে বসে ভাইয়ের পাশে।ফারিয়াকে দেখে ফিরোজ বললো,

“আমার জীবনে কোনো সুখ নেই,কেউ চায়না আমি সুখী হই।”
“তুমি সুখী হবে ভাইয়া।”
“কিভাবে হবো?শ্যামাকে না পেলে সুখী হবোনা।ওর মতো ভালো আমাকে কেউ বাসবেনা।”
“আব্বা বোধহয় মেনেছে।”
“কিভাবে বুঝবো? চল আবার আব্বার রুমে যাই।”

ফিরোজ চাইলে শ্যামাকে নিয়ে আসতে পারে,কারো সাধ্যি নেই আটকানোর কিন্তু সে চায় সম্মান,বউ সম্মানের জিনিস এমন কাজ করে বউয়ের সম্মান কমানোর কোনো মানে হয় না।তাইতো তার আব্বার কাছে মিনতি করা,উনাকে মিনতি করে যদি মানানো যায় তাহলে মিনতি করতে সমস্যা কি তারই তো আব্বা।সে চাইলে বিয়ের কথাটা প্রকাশ করে সবাইকে ধরাশায়ী করাতে পারে কিন্তু সে চাচ্ছে সবাই যদি এমনি মেনে যায় তাহলে এই গোপন কর্ম গোপন থাকুক তা আর প্রকাশের দরকার কি!সে আবারো তার আব্বার কাছে যায়।প্রিয়তমাকে সসম্মানে ঘরে তুলার জন্য একটু বেহায়া,নিলজ্জ হওয়াই যায়,তাছাড়া শ্যামা যা সহ্য করছে তার কাছে এগুলো কিছুইনা।মোহাম্মদ আলী কিছু একটা ভাবছিলেন ছেলে মেয়েকে দেখে বললো,

“কি?”
ফিরোজ বললো,
“আব্বা,”
“আমি বুঝেছি।”
ফারিয়া মোহাম্মদ আলীর কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।

“আব্বা,আমাকে নিয়ে কেউ তোমাকে কথা শুনালে কি তোমার খারাপ লাগতো না?কিন্তু তুমি স্বপন কাকাকে অপমান করেছো।এবার গিয়ে সব মিটমাট করে নাও।আমার ভাইটা সারাজীবন কষ্টে আছে এবার একটু সুখের দেখা পেতে দাও।”
মোহাম্মদ আলী নিজেও জানে স্বপন ইসলামকে উনি বেশ অপমান করেছেন কিন্তু তখন অহংকার এ অন্ধ ছিলেন এতোকিছু ভাবার সময় হয়নি।এখন মনে হচ্ছে জল গুলা না করে আগেই পানি পান করার দরকার ছিলো তাহলে আর এতোকিছু হতোনা।উনি ফিরোজের দিকে তাকায়।

“তুই কি চাস আমি প্রস্তাব নিয়ে যাই?”
ফিরোজ মাথা নাড়ে।মোহাম্মদ আলী বললো,
“যা,কালকে দুপুরে শ্যামাদের বাড়িতে যাবো।”
ফিরোজ খুশী হয়ে তার আব্বাকে জড়িয়ে ধরে,এবার মোহাম্মদ আলী আর কুট,নৈতিক হাসি হাসে না বরং ছেলের খুশীতে নিজেও খুশী হয়।

পরের দিন সকালে মোহাম্মদ আলী হরেক রকম ফলমূল এনে বাড়িতে রাখে।ছেলে যেখানে নিজের সুখ খুঁজে পায় সেখানেই যাক,সংসার সে করবে তাহলে উনি কেনো বাধা দেবে?এই বোধটা আসাতেই তার ভালো লাগছে।তাই হাসিখুশি মুখেই সব কাজকর্ম করছে।কিন্তু মনে মনে ভাবছে স্বপন ইসলাম কিনা আমার অপমান করে দেয়।

বারোটার দিকে সবাই শ্যামাদের বাড়ির উদেশ্যে বেরিয়ে পরে।আগেরবার ফিরোজ তার আব্বাকে একা একা পাঠিয়ে ভুল করেছিলো তাই এবার আর সে ভুল করতে ইচ্ছুক না।মোহাম্মদ আলীর সাথে ফিরোজ,বর্তমান ইউপি চেয়ারম্যান আর থানার এসপি যাচ্ছে।ফিরোজের ইচ্ছে কোনোভাবেই যেনো উনারা না করার সুযোগ না পায়।এসপি ফিরোজকে চিন্তিত্ব মুখ দেখে বললো,

মধুমাস পর্ব ৩২

“ফিরোজ ভাই,এতো চিন্তা করছেন কেনো?মেয়ে যেহেতু পছন্দ হয়েছে তাহলে আর চিন্তার কিছু নেই।উনারা আপসে মেয়ে না দিলে উঠিয়ে নিয়ে আসবো,আপনার জন্য পুলিশ থেকে না হয় একটু গু,ন্ডামি করলাম।”
উনার কথায় উপস্থিত সবাই হু হু করে হেসে উঠে।

মধুমাস পর্ব ৩৪