ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৪৮ শেষ অংশ

ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৪৮ শেষ অংশ
সাইয়্যারা খান

অবিন্যস্ত ভাবে হসপিটালের করিডরে বসে আছে আদ্রিয়ান। সবসময়ের গোছালো লোক’টা আজ বড্ড অগোছালো। চোখগুলো এখন তাকিয়ে থাকতেও দ্বিধা করে। আর কত কাঁদবে আদ্রিয়ান একজন পুরুষ হয়ে? কত কাঁদা যায় আর?

দুনিয়ায় সামনে যা কাঁদে তাতেই লোকজন হাসে হয়তো, একজন পুরুষ যতটা ভেঙে এতটা কাঁদা যায় ঠিক ততটাই কাঁদছে এখন আদ্রিয়ান। রাতে’র কান্না হয়তো কেউ দেখে না কিন্তু দিনের করা কান্নাগুলোর সাক্ষী এই বাইরের মানুষগুলো।
একমনে সামনের কেবিনের দিকে তাকিয়ে আছে আদ্রিয়ান। একবারও দৃষ্টি নড়চড় হয় নি। গতরাতে’র কথা মনে হতেই বুকে চাপ অনুভব হচ্ছে ওর। কেমন জ্বালাপোড়া করে বুকে। চোখ বুজে আবারও ডুবে গেলো আদ্রিয়ান নিজের সাথে হয়ে যাওয়া তিক্ত ঘটনাতে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

গতরাতে রোদের ঐ অবস্থা দেখেই অস্থির হয়ে পড়ে আদ্রিয়ান। দিকবিদিকশুন্য হয়ে ডাক লাগায় আরিয়ান’কে। রোদ তখন জ্ঞান হারা ছিলো যা আরিয়ান ধারণা করে। অত রাতে তো ডাক্তার ও ছিলো না হসপিটালে। না পেরে ড.মিহা’কে কল করানো হয় রাদের মাধ্যমে। খবর পেয়েই ছুটে আসে ড.মিহা। রোদের পরিবারের সবাই ও অত রাতে ছুটে হসপিটালে।

তিশা আর রুদ্র ছিলো জাইফার সাথে। ছোট রুদ্র ও কেঁদেছে সারারাত। তার আদরের বোনের সাথে যে খারাপ কিছু হয়েছে তা ভালোই ধারণা করেছিলো রুদ্র। রোদকে নিয়ে তখনই আসা হয় হসপিটালে। গাড়িতে একটা বার ও কোন পাগলামি করে নি আদ্রিয়ান। শুধু র*ক্তাত্ত রোদকে বুকে নিয়ে সারা মুখে আদর করে আল্লাহ’কে ডেকেছে। ভেতরের সকল ঝর, সকল আতঙ্ক তা কেবল চোখ বেয়ে বেয়ে পড়েছে।

হসপিটালে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সকল কিছু রেডি ই পেয়েছিলো ওরা। রাদ’রাও ছিলো সেখানে। বোনের ঐ অবস্থায় রাদ দৌড়ে আসে গাড়ির কাছে। আদ্রিয়ান তখন ভীষণ দূর্বল হয়ে ছিলো। ভারী রোদকে তুলে হাটতে পারবে বলে সাহসে হয়তো কুলাচ্ছি না। রাদ শক্ত করে বোনকে কোলে তুলে নেয় ততক্ষণে স্ট্রেচার আসলেও পাত্তা না দিয়ে ওভাবেই ভেতরে ছুটলো ওরা। ড.মিহা রোদকে চেক করেন। অবজার্ভ করেন প্রায় ঘন্টা খানিকের উপরে৷

অবশেষে রাত চারটার দিকে কেবিন থেকে বের হন তিনি। আদ্রিয়ান সহ বাকিরাও নড়েচড়ে বসলো। আদ্রিয়ান উঠার চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না।শরীরের সাথে লড়াই করে উঠতে নিলেই ধপ করে আবার বসে পরলো। ওর অবস্থা দেখে আরিয়ান তারাতাড়ি ওকে ধরে বললো,

— আদ্রিয়ান ঠিক আছিস?
— হু।
ড.মিহা অবাক হয়ে তাকায় আদ্রিয়ানের দিকে। আজ-কালের যুগেও এমন স্বামী হয় বলে জানা ছিলো না ওর। স্ত্রী’র ব্যাথায় সবাই যেখানে নিজেকে ব্যাথিত দেখায় সেখানে আদ্রিয়ান ভিন্ন। লোকটা নিজেই নেতিয়ে যায়। অবস্থা বুঝে এগিয়ে এলো ড.মিহা। আদ্রিয়ান চোখ তুলে তাকাতেই তিনি বলে উঠলো,

— মি.জোহান,আলহামদুলিল্লাহ ফিটাস দুটো’ই ঠিক আছে।
— আ…আমার র…রোদ?
ড.মিহা চোখে আসস্ত করলেন। হলো না আদ্রিয়ানের। ও শুনতে চায়। তাই ড.মিহা বলে উঠলো,
— আলহামদুলিল্লাহ রোদও ঠিক আছে।
টুপ করে বা চোখ দিয়ে একফোঁটা পানি পরলো আদ্রিয়ানের। ড.মিহা বলা শুরু করলো,

— বার্তমানে প্রেগন্যান্সিতে ব্লিডিং হওয়া অল্প সল্প যদিও স্বাভাবিক তবুও সাত মাসে কারো হয় না সাধারণ। রোদে’র কেস আলাদা সেটা তো জানেন ই। নতুন করে কি আর বলব। ফিটাস দুটো গত কাল থেকেই রেসপন্স কমিয়েছে। আগেও বলেছি ছেলে’টা অতিরিক্ত দূর্বল। ওর ব্যাপারে কিছু বলতে পারছি না। মেয়েটা আলহামদুলিল্লাহ সবদিক দিয়েই ভালো রেসপন্স করছে। আর ব্লাড যতটা দেখা গিয়েছে ততটাও লিক হয় নি। সাদা ড্রেসে এমন দেখা গিয়েছে তবে তীব্র পেইন হওয়াতে রোদ ঘুমের মধ্যেই জ্ঞান হারিয়েছে। আপাতত সেলাইন চলছে। ভোর তো হয়েই গেলো। সেলাইনটা শেষ হোক তারপর সকালে একটা ইনজেকশন পুশ করিয়ে বাসায় নিয়ে যাবেন।

সবটুকু কথা সবাই শুনলো। আদ্রিয়ান আরিয়ানের উপর ভর দিয়েই উঠলো। আস্তে আস্তে হেটে কেবিনের দিকে গেলো। রোদটাকে না দেখলে এখন ভালোলাগবে না।
রাদ ওর মা’কে ধরে বসে আছে। মা সেই থেকে কেঁদেই যাচ্ছে। তার ছোট্ট রোদটা। এত ঝর কেন মেয়েটার উপর? কত বুঝালো বাচ্চাটাকে না রাখতে কিন্তু শুনলো না রোদ।

এখন এই কষ্ট গুলো পাওয়ার ছিলো বুঝি মেয়েটার? মনের ভীতর ভয়গুলো দানা বেঁধে আছে ওনার। এই বুঝি কিছু হয়ে যায় মেয়েটার। নিজের কাছে রাখতে চাইলেও রোদ আসবে না। কতকরে বললো কিন্তু রোদের একটাই কথা, “আমাকে ছাড়া ওনারা তিনজন থাকতে পারবে না”। হাজার হলেও আদ্রিয়ান তো আর মাসের পর মাস শশুর বাড়ী থাকার লোক না।

রোদ ঘুমাচ্ছে এখন অথচ সকলে তাকিয়ে আছে। আদ্রিয়ান রোদের হাত ধরেই বসে আছে। একটু পরপর কি মনে করে উঠে উঠে শুধু চুমু খায়। এটাই করে যাচ্ছে বারবার। ফজরের আজান হতেই কেবিন থেকে বের হয়ে সোজা মসজিদে চলে গেল। কারো সাথে কথা বললো না। ওর মনের অবস্থা হয়তো কেউ আন্দাজও করতে পারবে না।

রোদকে ডিসচার্জ করে বাসায় আনা হয়েছে। স্যালাইন দেয়াতে ডান হাতটা ফুলে এসেছে। এমনিতেই শরীর ভালো না তার মধ্যে নতুন করে হাতের জ্বালা। আদ্রিয়ান ফ্রেশ হয়ে রোদকে খায়িয়ে দিয়ে গিয়েছে। কথা বলে নি কোন। মিশি এসেছে রুমে হিচকি তুলতে তুলতে। রোদ হাত বাড়িয়ে ডাকতেই মিশি’র কান্নার সুর বাড়লো। রোদ ডাকলো,

— মিশি মা আমার,এখানে এসো। মাম্মা ডাকছি না?
মিশি চোখ ডললো। তাকালো পিটপিট করে। হাঁটু’র উপরে পড়া একটা বিড়াল প্যান্ট পড়ে এসেছে শুধু। মা ডাকতেই মিশি এলো। হাত বাড়িয়ে বিছানা’র চাদরটা শক্ত করে ধরে উঠে পরলো। রোদ হাসলো ওর দিকে তাকিয়ে। হাত তখনও বাড়িয়ে রাখা। মিশি ওর কাছে আসতেই রোদ ওকে বুকে টেনে নিলো।

মিশি আদর পেয়ে বিড়াল ছানার ন্যায় গুটিয়ে গেলো। রোদ চোখ বুজে নিলো। কতদিন ধরে মেয়েটাকে বুকে নেয়া হয় না ঠিকমতো। পেট বড় হওয়াতে কাঁত হয়ে মিশিটা’কে আগলে নেয়া হয় না। রাতে রোদে’র কাছে ঘুমানোর পরই জারবা অথবা মিশানের কাছে দিয়ে আসে আদ্রিয়ান। যদি পেটে আঘাত লাগে সেই ভয়ে। মিশিটা’র সাথে খেলাও হয় না। রোদ শব্দ করে মিশির মাথায় চুমু খেয়ে আদুরে গলায় বললো,

— মাম্মার কিশমিশ কাঁদছিলো কেন?
মিশি মায়ের বুকে মুখ ঘঁষে দিলো। পানিটুকু বুকে মুছার চেষ্টা করলো। মুখটা তুলে অভিযোগ করলো,
— তুমি ছিলে না কেন? মিশি মিসড মাম্মা।
রোদ দুই হাতে আগলে নিলো মেয়েকে। আদরে আদরে ভরিয়ে তুলতে তুলতে বললো,
— আর যাব না মা।
— সত্যি।
— একদম।

মিশান আদ্রিয়ানের পাশে এসে ঘেঁষে বসলো। আদ্রিয়ান তখন ক্লান্ত শরীরে তখন কাউচে এলিয়ে বসে ছিলো। সামনেই বেডে রোদ ঘুমচ্ছে। ইনজেকশন’টা পুশ করার ফল এটা। মিশিও এই অসময়ে মায়ের কাছে ঘুমিয়ে পড়েছে। আদ্রিয়ান অবশ্য মাঝখানে একটা কোলবালিশ রেখেছে যাতে রোদের শরীরে না লাগে।

মিশান আস্তে করে আদ্রিয়ানের বুকে মাথা রেখে জড়িয়ে ধরলো। আদ্রিয়ান মাথা তুললো না ওভাবেই ছেলেকে বুকের সাথে নিজেও জড়িয়ে নিলো। বেশ খানিকটা সময় ওভাবেই পার হলো। আদ্রিয়ান এবার মাথা তুললো। বুকের মধ্যে ভেজা অনুভব হচ্ছে ওর। ছেলেটা কাঁদছে। কেন জানি ছেলে-মেয়ে’র কান্না সহ্য হয় না ওর। একদমই না। উঠে মিশানের মাথায় হাত বুলালো আদ্রিয়ান। ছেলেটা একদম ছোট থেকেই এমন। আদ্রিয়ানের বুকে লেগে লেগে থাকত। এখনও তেমনই রইলো। আদ্রিয়ান মিশানকে উঠাতে উঠাতে বললো,

— মিশান দেখি কাঁদে না বাবা।
— মা কি এখন ঠিক আছে?
— আলহামদুলিল্লাহ বাবা ঠিক আছে।
— ওরা দুইজন?
— তোমার ভাই-বোন? ওরা ও ভালো আছে। শুধু তোমার ভাইটা একটু দূর্বল বাবা। দোয়া করো। ইনশাআল্লাহ তোমার ভাই ও ঠিক হয়ে যাবে।
— হু।
বলে মাথা তুলে অন্য দিকে ঘুরালো মিশান। বাবা’র সামনে কাঁদলো না। উঠে টেবিল থেকে খাবারটা এনে বাবার পাশে বসেই বললো,

— খেয়ে নাও। কিছু তো খাও নি।
— এখন না বাবা। তুমি খেয়ে নাও।
— উহু খেতে হবে। মেডিসিন আছে না তোমার? তুমি না খেলে মা বকবে পরে।
— কে শিখিয়েছে? মা?
— হু। দায়িত্ব দিয়েছে তোমাকে আর মিশি’কে দেখতে যতদিন না ভাই-বোন আসে।
বলেই রুটি ছিড়ে ডিমের সাথে বাবা’র মুখে তুলে দিলো মিশান। আদ্রিয়ান আগে ছেলের সেই হাতেই চুমু খেল। মিশান মিষ্টি করে একটা হাসি দিলো। বাবা’কে পুরোটা খায়িয়ে দিলো। মা তো বলেছে যাতে মিশান বাবা আর মিশির খেয়াল রাখে। এত বড় দায়িত্ব কি আর মিশান অবহেলা করতে পারে? উহু একটুও না।

একটা ক্যাফেতে বসে আছে দিশা। মন মেজাজা ভালো না। ঠোলা একটা বোরকা পড়ে এসেছে এখানে। গত রাতে যখন ও হসপিটালে গিয়েছিলো তখন রাতুলের নাইট ডিউটি ছিলো সেখানেই দিশা’কে দেখে সাইড থেকে রাতুল টেনে অন্য দিকে নিয়ে যায় রাতুল। দিশা চমকালেও কিছু বলে নি। রাতুল ওর হাত ধরে ওর দিকে তাকিয়ে বলেছিলো,
— দিশা? কবে থেকে কল করছি? বাসায় যাচ্ছি? কথা বলো না কেন আমার সাথে? কি দোষ আমার? পাগলের মতো ঘুরাচ্ছো তুমি? কি করব আমি?

— কিছু করতে হবে না। ছেড়ে দিন।
শান্ত স্বরে বলপছিলো দিশা। রাতুল নরম হয়েছিলো। দিশার গাল দুটো ধরে বলেছিলো,
— দিশা আমি জানি আমার ভুল হয়েছিলো। আমি সত্যি করে বলছি আমি তোমাকে আর কষ্ট দিব না। আর অবহেলা করব না। অনেক ভালোবাসব। আদর করব। প্লিজ ফিরে এসো না। আমি একা একা ম’রে যাচ্ছি যে। প্লিজ দিশা একটা সুযোগ দাও।

— এখন পরিস্থিতি ভালো না। হাত ছাড়ুন পরে কথা হবে।
— কাল কেন? বাসায় যাবে আমার সাথে তুমি। এই একমিনিট তুমি এখানে কেন?
— রোদের ব্লিডিং হয়েছে।
হাতটা আলগা হয়ে গিয়েছিলো রাতুলের। দিশা খেয়াল করেছিলো সেটা। রাতুল এতক্ষণে ভাবে নি যে দিশা এত ভোরে কি করছে এখানে। দিশা তাচ্ছিল্য হেসে বলেছিলো,

— আর কত? যাই এবার। খুব শিঘ্রই এই দোটানা থেকে মুক্তি দিব আপনাকে।
দিশা কথাটা বলে চলে যেতে নিলেই রাতুল ওর হাত চেপে ধরে নিজের কাছে টেনে বলেছিলো,
— আমি অস্বীকার করব না যে রোদের প্রতি কোন অনুভূতি নেই। প্রথম ভালোবাসা ছিলো আমার। সবাই রোদের অবস্থা দেখেছে তাই আফসোস করেছে কিন্তু আমাকে কেউ দেখে নি দিশা। বছরের ও বেশি সময় রাতগুলো নির্ঘুম কাটিয়েছি আমি। পাগল পাগল ছিলাম। সব তো জানো। তাহলে? তুমি কি রাদকে ভালোবাস না? বেসেছিলো তো? বুঝ তো? তাহলে?
সত্যি বলছি অবহেলা করব না। ফিরে এসো।

— অবহেলা সহ্য করার ক্ষমতা আছে আমার কিন্তু নিজের অসম্মান না। যেদিন নিজের ভুলটা বুঝতে পারবেন সেদিন নাহয় ভেবে দেখব।
বলেই দিশা সরে এসেছিলো। রাতুলের রিকুয়েষ্টেই এখানে আসা। কি নাকি বলবে ও।
রাতুল আসতেই দিশা বললো,

— তারাতাড়ি বলুন।
— কি খাবে?
— কিছু না।
— দিশা?
— বলুন।

ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৪৮

— আমাকে মাফ করে দাও। ঐ দিন রাতের জন্য সব তাইনা? আমি নিজের মধ্যে ছিলাম না দিশা। প্লিজ। আমি বুঝতে পারি নি। রোজ তো তুমি…. বাট ঐদিন। দিশা, আ’ম সরি।
দিশা অনির্মেশ চেয়ে রইলো। কি ই বা বলার আছে ওর?

ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৪৯