ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৪৯

ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৪৯
সাইয়্যারা খান

আজ নিজের বাসায় যাবে রোদ। কত মাস পর যাচ্ছে ভাবতেই খুশিতে লাফ দিতে মন চাইলো ওর কিন্তু পরিস্থিতি’র কবলে পরে তা আপাতত সম্ভব না। খুশিতে চোখ চিকচিক করে উঠলো যেন। রাদের বেবিটাকেও মাত্র দুইবার চোখের দেখা দেখেছে । ভিডিও কলে কি আর মন ভরে? উহু একদম ই না।

ভাতিজা’র আকিকাতেও যেতে পারে নি যদিও যাওয়ার কথা ছিলো কিন্তু রোদ হঠাৎ অসুস্থ হওয়াতে আর যাওয়া হয়ে উঠে নি। রাদও আবার কম যায় না বোন ফোন করে কান্না করাতে ঐ দিনই সাত দিনে’র ছেলেকে নিয়ে এসে রোদকে দেখিয়ে নিয়েছিলো রাদ। তারপর আজ দেখবে। নিজের বাসায় যাবে। আদ্রিয়ান নিয়ে যাবে আজ। রোদের শরীর ভালো যাচ্ছে গত তিনদিন ধরে। তাই বায়না ধরাতে আদ্রিয়ান রাজি হয়ে’ছে। আজই যাচ্ছে ওরা সাথে বাচ্চা’রা।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ঐ বাড়ীতেও সবাই খুশি এতদিন পর বাড়ীর মেয়ে আসছে বলে কথা। আদ্রিয়ান একটা ব্যাগে টুকটাক রোদের সারাদিনের মেডিসিন সহ যাবতীয় সকল প্রয়োজনীয় জিনিস গুছিয়ে নিলো। এরমধ্যেই মিশি আর মিশান হাজির। রোদ মিশির ড্রেসটা হাতে তুলে নিয়ে ওকে পরাতে পরাতে মিশান’কে বললো,

— আব্বু যাও রেডি হয়ে আসো।
— মা আমরা কি থাকবো?
রোদ আঁড়চোখে একবার আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে আবার মিশান’নের দিকে তাকাতেই মিশান বুঝলো প্রশ্ন’টা মা’কে নয় বরং বাবা’কে করা৷ উচিত তাই ঝটপট করে বললো,

— বাবা আমরা কি থাকব? আমি কি সাথে ড্রেস ও নিব।
— না বাবা থাকব না। মা’র শরীর ভালো না। রাতের দিকেই চলে আসব।
মিশান রোদের দিকে তাকাতেই দেখলো গাল ফুলিয়ে বসে বসে পা ঝুলাচ্ছে রোদ। মিশান ও মন খারাপ করে বেরিয়ে গেল। আদ্রিয়ান এগিয়ে এসে মিশি’কে কোলে তুলে নিয়ে বললো,
— মা যাও আরিয়ানা’কে দেখে এসো তো কি করে।

বলে নামাতেই মিশি ফুড়ুৎ। আদ্রিয়ান দরজা লাগিয়ে এগিয়ে এসে রোদের কাছে দাঁড়ালো। পাশেই রোদের ড্রেস রাখা। আদ্রিয়ান ওকে চেঞ্জ করাতে নিলেই রোদ মুখ ভেঙিয়ে বলে উঠলো,
— ঘুরে ফিরে পরাবেন তো ঐ মহিলাদের ঢোলা আলখাল্লা তাহলে এত ঢং কিসের?

আদ্রিয়ান শুনেও কিছু বললো না। অন্য ড্রেস পড়ালে রোদ নিজেই একটু পর অসস্তি’তে ভুগবে অথচ আবার এগুলো পড়তেও চায় না। আদ্রিয়ান হাতে নতুন একটা পোশাক নিয়ে রোদে’র কাছে এসে ওকে হেল্প করলো চেঞ্জ করতে। সুন্দর করে চুলগুলো একটা বেণী করে বড় একটা হিজাব পড়িয়ে দিলো। গাড়ি দিয়েই যাবে তাই বোরকার দরকার নেই আপাতত তবুও সেফটির জন্য এতবড় একটা হিজাব জড়িয়ে দিয়েছে আদ্রিয়ান। নিজেও রেডি হয়ে রোদকে ধরে উঠালো আস্তে করে। দরজা পর্যন্ত যেতেই মিশানও হাজির। সবার থেকে বিদায় নিয়ে বাচ্চা’দের নিয়ে শশুর বাড়ী রওনা হলো আদ্রিয়ান। সারা গাড়িতে রোদ কতটা এক্সাইটেড ছিলো তা ওর কথার প্রফুল্লতাতেই বুঝা গিয়েছে।

রোদরা পৌঁছেছে বেশ সময় হলো। আদ্রিয়ান আগেই ড্রাইভার দিয়ে শশুর বাড়ী ফলমূল সহ বাকিসব পাঠিয়ে দিয়েছিলো। হাজার হোক খালি হাতে তো আর আসা যাবে না। একটা মান সম্মান আছে না?
সবাই ব্যাস্ত রোদ আদ্রিয়ান আর মিশি,মিশান’কে নিয়ে। রোদের মা তো মেয়ে পেয়ে এতদিন পর যেন ছাড়ছেনই না। ওর বাবা ও বারবার জিজ্ঞেস করছে রোদ কি খাবে, মিশি-মিশান কি খাবে এইসব। আদ্রিয়ানের ও যত্ন আত্তিতে কমতি নেই। একবার রুদ্র একবার রাদ একবার চাচাতো শালা শালী পিছনে লেগেই আছে। বেশ ভালোই কাটলো সময়টা। রোদ মুখে আলুর পরটা ভরে খেতে খেতে তিশাকে জিজ্ঞেস করলো,

— দিশা আপু আসে না? বলো না যে আমি এসেছি তাহলেই আসবে।
তিশা একবার আশে পাশে তাকালো। সবাই সবার ধ্যানে মত্ত। রোদের পাশ ঘেঁষে বসে তিশা পইপই করে সব খুলে বললো রোদকে। আর দিশা যে গত দিনই শশুর বাড়ী ফিরেছে সেটাও জানালো। রোদের মনটা হঠাৎ ই খারাপ হয়ে গেল। দিশা,তিশা, ইশান যে ওর চাচাতো ভাই বোন তা কখনো ফিল করে নি রোদ। সেই বড় বোনের এমন অবস্থায় রোদ কষ্ট পেল ভীষণ। মনে মনে ভাবলো একবার কল করে কথা বলবে।

আদ্রিয়ান রোদের পাশেই বসে আছে। নড়ছেও না আর নাই রোদকে নড়তে দিচ্ছে। সবাই আঁড়চোখে ওদের দিকেই তাকাচ্ছে। আশেপাশে’র কয়েকজন চাচি এসেছে রোদকে দেখতে। রোদ কিছুটা বিরক্ত হওয়া কন্ঠে বললো,
— একটু এদিক ওদিক যান। এভাবে বউয়ের আঁচল ধরে বসে আছেন কেন হ্যাঁ? মানুষ কি ভাববে?
— যা ভাবার ভাবুক।
আদ্রিয়ানের সোজাসাপ্টা উত্তর। রোদ ও আর কিছু বললো না কারণ বলে লাভ নেই।

বাইরের সবাই চলে গিয়েছে। আপাতত বাচ্চা’রা খাচ্ছে। রোদের চিন্তা নেই ওর পরিবারের থাকতে মিশি-মিশানের চিন্তা করতে হয় না ওর কারণ ওর নিজের বাচ্চাদের ও নিজেই পায় না। সবাই যে যার মতো কথা বলতে ব্যাস্ত। হঠাৎ রোদের অল্প৷ সল্প খারাপ লাগতেই ও এত ভীর থেকে উঠে রুমে যেতে চাইলো। একা উঠে দাঁড়াতেই পাশে কারো অস্তিত্ব টের পেল। ও জানে কে এটা। আদ্রিয়ান রোদ’কে আগলে ধরে নিয়ে বললো,

— কি হয়েছে?
— মনে হচ্ছে ইউরিন লিক হচ্ছে।
— আচ্ছা ব্যাপার না। চলো রুমে।
বলে রোদকে ধরে ধরে রুমে নিয়ে এলো। চেঞ্জ করতে সাহায্য করলো। আদ্রিয়ান ওকে বেডে হেলান দিয়ে বসিয়ে বললো,
— বাইরে যাবে এখন?
— উহু। ভালোলাগছে না।
আদ্রিয়ান উঠে দরজাটা ভিরিয়ে এলো। হাতে রোদকে মালিশ করার তেলটা নিয়ে বেডে রোদের পা কোলে তুলে নিতেই রোদ অসহায়ের মতো বললো,

— প্লিজ আজকে লাগবে না। এককাজ করুন না আমাকে বুকে নিন একটু। ঘুমাবো।
আদ্রিয়ান পাত্তা দিলো না ওর কথায়। রোদের পায়ে আদ্রিয়ান হাত দিক এটা পছন্দ করে না রোদ তবুও রোজ রোজ আদ্রিয়ান ওর পায়ে তেল মালিশ করবেই করবে। অবশ্য পায়ের অবস্থা ও ভালো না তবুও আদ্রিয়ানের করা এই কাজটা কেমন অপছন্দ রোদের। আদ্রিয়ান ওর পায়ে সুন্দর করে ম্যাসেজ দিলো।

এই ফুট ম্যাসেজগুলো অবশ্য ওকে শিখতে হয়েছে। প্রেগন্যান্ট নারীদের জন্য আলাদা ম্যাসেজ থাকে। রোদ আরাম পেয়ে ঘুমিয়ে গেল একসময়। আদ্রিয়ান সময় নিয়ে রোদের দিকে তাকিয়ে থাকে। মা-বাবা হওয়াটা মোটেও সহজ কোন বিষয় না। রোদ-আদ্রিয়ান তো তা এখন হাড়ে হাড়ে টের পায়।
দরজা ভিরানো থাকায় মিশি তা ঠেলে ভেতরে ডুকে পড়লো। গুটিগুটি পায়ে রুমে ডুকেই বাবা’কে ডাকলো,

— বাবাই?
আদ্রিয়ান নিচে তাকিয়ে দেখলো মিশি দাঁড়িয়ে। জিজ্ঞেস করলো,
— আমার মা এখানে যে? খালামোনি কোথায় তোমার?
— মিশি মাম্মা চাই।

আদ্রিয়ান হাত বাড়িয়ে ওকে খাটে তুলে দিতেই মিশি ঘুমন্ত মায়ের বুকে নিজের জায়গা করে নিলো। আস্তে করে বুকে মাথা দিয়ে চুপ করে রইলো। আদ্রিয়ানের মাঝে মধ্যে একটু খারাপ ও লাগে। মিশিটা রোদ ছাড়া কিছু বুঝে না অথচ রোজ সকালেই মা ছাড়া নিজেকে অবিষ্কার করেই কেঁদে দেয় মেয়েটা। একটু পর মিশানও এলো। মূলত কোথাও গেলেই ওর মায়ের কাছে যেতে হবে একটু পর পর। মিশানও সুন্দর করে মা’য়ের মাথার কাছে হেলান দিয়ে বসে বাবার সাথে কথা বলছে।

বাইরে থেকে আদ্রিয়ানের মা আর বাবা আসছিলো আদ্রিয়ানের সাথে কথা বলার জন্য যাতে রোদকে কয়টা দিন এখানে রাখে কিন্তু দরজার সামনে দাঁড়িয়ে এত সুন্দর দৃশ্য দেখে আর কিছু বলতে পারলেন না তারা। আদ্রিয়ানের মতো স্বামী যে তাদের মেয়ে পেয়েছে তাতেই শুকরিয়া।

যদিও থাকার কথা ছিলো না তবুও রাতে থাকছে রোদরা। আদ্রিয়ান কিভাবে যেন রাজি হয়েছে আল্লাহ জানে। রোদ খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলো,
— আপনি রাজি হলেন কিভাবে?
— এভাবেই।
— কারণ নেই কোন?
— আছে তো।
— কি?
— ভালোবাসা।

রোদ খেতে খেতেই ঠোঁট মেলে হাসলো। একদফা আড্ডা হলো আবারও। রোদ ছোট্ট রুহানকে কোলে নেয়ার কত চেষ্টা করলো কিন্তু হলো না। এত উঁচু পেট তার মধ্যে একটা বাচ্চাকে কোলে তুলা সম্ভব হলো না কিন্তু তাতে কি? রাদ ছেলেকে কোলে নিয়ে বোনের পাশে বসে আছে। দিশা এসে দেখা করে গিয়েছে রোদের সাথে। রোদ কিছু বলতে চেয়েও পারে নি। দিশা ওকে আদর করে যেভাবে এসেছিলো সেভাবেই চলে গিয়েছে।

রাত হওয়াতে বাচ্চারা আগেই ঘুমিয়ে গিয়েছে। এখন প্রায় রাত ১ টা। আদ্রিয়ান রোদকে ধরে জোর করে রুমে নিয়ে এলো। এত রাত জাগবে অথচ আবার শেষ রাতে উঠে যাবে। তাই এনেছে রুমে। রোদ লাল হয়ে বসে আছে রাগে। আদ্রিয়ান দরজা লক করে ভিতরে এসেই ওয়াসরুমে ডুকলো। প্রায় আধ ঘন্টা লাগিয়ে ফ্রেশ হয়ে বের হতেই দেখলো রোদ ওর ফোন ঘাটছে। আদ্রিয়ান ভেজা টাওয়ালটা বারান্দায় মেলে দিয়ে রুমে এসে রোদের পাশে বসে বললো,

— কি করে আমার সোনাপাখি?
………..
— উহুম! উহুম! জান কি করছো?
এবারও রোদ উত্তর দিলো না। আদ্রিয়ান ঠোঁট কামড়ে হাসলো। আস্তে করে এগিয়ে এলো। কাছে। একদম কাছে। রোদের ঢোলা পোশাকের গলাটা বড় হওয়াতে পিঠের দৃশ্যমান অংশ বেশি। আদ্রিয়ান নিজের পুরু ঠোঁটের ছোঁয়া দিলো সেখানে। ব্যাস রোদ শেষ। বছর হয়ে এলো অথচ অনুভূতি গুলো এখনও নতুন ই রয়ে গেল। আদ্রিয়ান থামলো না বরং আরেকটু জ্বলাতে হাতের বিচরণ ঘটালো রোদের মাঝে। রোদ নড়েচড়ে বসলো। হাতের ফোনটা পাশে রেখে শুয়ার চেষ্টা করতেই আদ্রিয়ান ওকে আটকে ফিসফিস করে বললো,

— দুষ্ট বউ। এখন এসবের সময় না।
রোদ যেন এতেই তেঁতেঁ উঠলো। ঝটকা মে’রে আদ্রিয়ানের হাত সরিয়ে বললো,
— খারাপ লোক কোথাকার। সবসময় অসভ্য অসভ্য কথা। সরুন।
আদ্রিয়ান হাসছে। সরলো তো নাই বরং ঘেঁষলো একটু। রোদকে শুয়িয়ে দিয়ে পেট উন্মুক্ত করলো। কতক্ষণ বাচ্চাদের সাথে পাগলামি করলো। কি সব আলাপ আলোচনা করে বুঝে না রোদ। আদ্রিয়ান একসময় উঠে এলো। রোদের উপর হালকা ঝুঁকে মোহময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

— আজকে তোমাকে অনেক আদর করতে মন চাইছে রোদ।
রোদ হাত বাড়িয়ে আদ্রিয়ানের গাল ছুঁয়ে দিলো। আদ্রিয়ান সেই হাতে চুমু খেলো। এই মেয়েটাকে ও অতিরিক্ত ভালোবাসে। যে কোন পরিস্থিতিতেই রোদ আদ্রিয়ানের ডাকে সাড়া দেয়। আর কি স্ত্রী থেকে? এমন স্ত্রী ই বা কয়জন হয় আজকাল?
আদ্রিয়ান পাশে শুয়ে বুকে টেনে নিলো রোদকে। ওষ্ঠাধরে অনেকক্ষণ ভালোবাসা আদন-প্রদান করে বললো,
— আমার পাওনা রইলো আজকের রাত। পুষিয়ে নিব বাবুরা আসলে।
রোদ চুপ রইলো। আদ্রিয়ানের বুকের এই অদ্ভুত ধুকপুক ধুকপুক শব্দটা শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে গেল একসময়।

রাত এখন গভীর। রাতুল আজ নাইট সিফট থাকাতেও তা বাতিল করে বাসায় ফিরলো কারণ দিশা এসেছে। এত মাস পর বউ পাচ্ছে রাতুল।আসতেই দেখলো দিশা রুমে নেই। ভ্রু কুচকে এলো ওর। মনে মনে ভয় ও পেলো অল্প সল্প। দিশা কি আবার চলে গেল? আগে থাকতে তো রাতুল বাসায় আসতেই এগিয়ে এসে শার্টের বোতাম খুলে দিতো। সব এগিয়ে দিতো। এখন কি দিবে না?

এসব ভাবতে ভাবতেই রাতুল খেয়াল করলো ব্যালকনিতে লাইট অন। পা বাড়িয়ে সেখানে যেতেই দেখলো দোলনায় মাথা এলিয়ে ঘুমাচ্ছে দিশা। বুক জুড়ে শ্বাস টেনে নিলো রাতুল। দিশা আছে। যায় নি এখনও। এগিয়ে এসে সামনে থেকে দিশাকে দেখছে রাতুল। পেটে হাত রেখে ঘুমাচ্ছে দিশা। রাতুল ওকে পাজাকোলে তুলতেই জেগে উঠলো দিশা। মূলত চোখ লেগে গিয়েছিলো ওর। রাতুলকে ওকে এভাবে কোলে নিতে দেখতেই দিশা চমকে পেটে হাত রাখলো। আতঙ্কিত কন্ঠে বললো,
— আপনি কখন এলেন? নামান আমাকে।

রাতুল ওর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। পরপরই হেটে রুমে ডুকে ওকে নামিয়ে দিয়ে বললো,
— ব্যালকনিতে কেন ঘুমাচ্ছিলো?
— ঘুমাই নি। চোখ লেগে গিয়েছিলো। খাবেন না? যান ফ্রেশ হয়ে আসুন।
রাতুল ঠাই দাঁড়িয়ে রইলো। দিশা বুঝতে পারলো। এগিয়ে এসে রাতুলের পরিহিত শার্টের বোতাম খুলে দিলো। রাতুলের ঠোঁট জুড়ে তখন হাসি। দিশা শার্ট খুলে দিয়ে সরে গিয়ে বললো,

— ওয়াসরুমে টাউজার আর টাওয়াল রাখা আছে।
বলেই দিশা চলে গেল। রাতুলের ভিতরে তখন প্রশান্তির ছোঁয়া। দিশা স্বাভাবিক হচ্ছে। এবার রাতুল নিজেকে গুছিয়ে নিবে। একটা সুন্দর সংসার তো ওর ও চাই।

দিশা এখনও রাতুল’কে জানায় নি যে ও প্রেগন্যান্ট। ও চায় না সম্পর্ক শুধু মাত্র একটা বাচ্চা’র ভিত্তিতে টিকে থাকুক। রাতুল ওকে কতটা চায় তাই দেখবে দিশা। নিজেও স্বাভাবিক হচ্ছে যাতে রাতুলের সুবিধা হয়। দিলো দিশা একটা সুযোগ রাতুলকে। আসলে রাতুলকে না। নিজেকে। দিশা নিজেকেই সুযোগটা দিয়েছে। হয় এবার সংসার টিকবে নয়তো হারিয়ে যাবে স্রোতের বিপরীতে।

রোদকে আজ ডাক্তারের কাছে নিতে হবে। বাচ্চারা এখানেই থাকবে। রাদ বলেছে ওদের পরে গিয়ে দিয়ে আসবে তাই আদ্রিয়ান রোদকে রেডি করছে। বড় হিজাবটা পড়াতেই রোদ বললো,
— আজ না যাই। ভালোলাগছে না।
আদ্রিয়ানের মন চাইছে না আজ যেতে কিন্তু আজ রোদের রুটিন চেকআপ তারমধ্যে ইনজেকশন ও আছে সাথে গত দুই দিন আগের করা টেস্টের রিপোর্ট পাবে আজ। যেতে হবেই। আদ্রিয়ান ঝুঁকে রোদের কপালে চুমু খেয়ে বললো,

— যেতে হবে সোনা।
রোদও জানে উপায় নেই তাই পেট ধরে উঠে দাঁড়ালো। সবার থেকে বিদাই নিয়ে ওরা বেড়িয়ে গেল। সামনেই ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছে। রোদ আদ্রিয়ানের কাঁধে হেলান দিয়ে আছে। একটু পর পর মুখে আচাড় দিচ্ছে। আজ আবার বমি বমি পাচ্ছে ওর।
হঠাৎ পুরাণ ঢাকার পল্টনের দিকে হৈ চৈ শুনা গেলো। আদ্রিয়ান ভ্রু কুচকে ড্রাইভার’কে বললো,

— আজ কি কিছু হচ্ছে এখানে?
— আজ তো কোন সমাবেশ নেই।
ড্রাইভার কথাটা বলতেই আদ্রিয়ান লক্ষ করলো আশে পাশে অলরেডি কিছু বাসে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে কিছু ছেলে পেলে। ঘটনাটা এত দ্রুত ঘটলো যে কেউ কিছু বুঝতেই পারলো না। মুহূর্তেই চিৎকার চেঁচামেচি বাড়লো। আদ্রিয়ান দ্রুত বলে উঠলো,

— গাড়ি ঘুরান।
ড্রাইভার সেই সময়টুকু আর পেলো না ওরা। হঠাৎ বোমা হামলা হলো। পুলিশ ধরপাকর করছে। বিচ্ছিরি অবস্থা হয়ে গেল। রোদ প্রচন্ড ভয়ে আদ্রিয়ানকে খামচে ধরলো। আদ্রিয়ান কি করবে ভেবে পেলো না। গাড়ি থেকে নামা ও সেফ না আর গাড়িতে থাকাও সেফ না। এদিকে হঠাৎ গোলাগুলি শুরু হয়ে গেল। আদ্রিয়ান ভেবে পায় না এত বড় গেন্জাম হচ্ছে অথচ আগাম বার্তা বলে কিছু পায় নি ওরা। হঠাৎ রোদের পাশের দিকে জানালায় কেউ জোরে বাড়ি মারাতে রোদ জোরে চিৎকার করে উঠলো। আদ্রিয়ান ও ভয় পেয়ে গেলো৷ কি করবে? কোথায় যাবে ভেবে কুল পাচ্ছে না। গাড়ি ঘুরানোও সম্ভব না। ড্রাইভার তারাতাড়ি বলে উঠলো,

— স্যার গাড়ি থেকে নেমে যান। আগুন লাগিয়ে দিলে তখন কায়দা হবে না।
রোদ সমানে ঘেমে যাচ্ছে। আদ্রিয়ান এদিক ওদিক তাকালো। বের হয়েই বা কোথায় যাবে ও? হঠাৎ পাশেই একটা আধ খোলা দোকান দেখতে পেলো। কোনমতে রোদকে ধরে বের হতেই ড্রাইভার সাহায্য করলো। রোদকে নিয়ে সাটারের ঐ দিকে যাওয়ার আগেই আদ্রিয়ানের কপালে জোরে কোন পাথরের টুকরা এসে লাগলো।

গলগলিয়ে র*ক্তের ধারা ছুটলো। গুলাগুলির শব্দে এবার আদ্রিয়ান ভীষণ ভাবে ভয় পেয়ে যায়। রোদকে নিয়ে ওখানে ডুকার আগেই দোকানদার সাটার পুরো লাগিয়ে দিলো। ড্রাইভার এত ধাক্কালো খুললো না। আদ্রিয়ান ও অনবরত ধাক্কালো কিন্তু ভেতর থেকে খুললো না। ড্রাইভার পাশের ফাঁকা জায়গায় আদ্রিয়ানকে নিয়ে গেলো। রোদ কান্না করতে করতে আদ্রিয়ানের কপালে নিজের হিজাবটা চেপে ধরলো।

হঠাৎ এদিকেও হৈচৈ লেগে গেল। ড্রাইভার কোথায় গেল বুঝা গেলো না। এদিকে যে লোকজন আসছে তা বুঝাই যাচ্ছে। আদ্রিয়ান দুই হাতে রোদকে জড়িয়ে ধরে নিজে উল্টো দিকে ঘুরে রইলো যাতে আঘাত লাগলেও আদ্রিয়ানের লাগে। আল্লাহ’কে ডেকে যাচ্ছে দুজনই। হঠাৎ পায়ের সাথে বড় একটা ড্রাম ধাক্কা লাগায় আদ্রিয়ান রোদকে নিয়েই পড়ে গেলো। রোদ হয়তো ততটা ব্যাথা পায় নি কিন্তু আদ্রিয়ান পায়ে ভীষণ ভাবে ব্যাথা পেলো। রোদ নিজেও ব্যাথায় কিছুটা কুঁকড়ে উঠলো। আদ্রিয়ান নিজেকে ভুলে তারাতাড়ি ধরে বললো,

— সোনা ব্যাথা লেগেছে? কোথায় লাগলো? এই রোদ? পেটে লেগেছে?
রোদ মুখ কুচকে বললো,
— আপনার পায়ে?
— কিছু হয় নি। তাকাও।
রোদ কেঁদেই যাচ্ছে। আদ্রিয়ান পায়ে ভালোই ব্যাথা পেয়েছে। তবুও রোদকে নিজের কাছে বসিয়ে জড়িয়ে ধরে আছে। কোথাও আগুন লেগেছে তার ধুঁয়াতেও কাশি উঠে গেল দুজনেরই। চোখ মুখ লাল হয়ে গেল যেন। কাদুনে গ্যাস ছুড়েছে হয়তো। রোদ আদ্রিয়ানের বুকে মুখ গুজে পড়ে আছে। আদ্রিয়ান বুঝতে পারলো অবস্থা বেগতিক। হঠাৎ করে রোদ প্রচন্ড ব্যাথায় কেঁদে ফেললো। আদ্রিয়ান অস্থির হয়ে উঠলো। রোদের মাথাটা ধরে বললো,

— এই রোদ? এই কি হয়েছে? ব্যাথা করছে?
— অ….অনেক ব..ব্যাথা কর’ছে প…পেটে।
আর বলতে পারলো না রোদ জ্ঞান হারালো সেখানেই। আদ্রিয়ান রোদ’কে বুকে চেপেই কেঁদে ফেললো। একহাতে জোরে জোরে বন্ধ সাটারে আঘাত করতে লাগলো কিন্তু খুললো না কেউ। আদ্রিয়ান ধাক্কাতে ধাক্কাতে বলে উঠলো,
— ভাই খুলুন। ভাই একটা বার খুলুন। দয়া করুন। ভাই খুলুন না।
কেউ খুললো না। হঠাৎ এদিক দিয়েই দৌড়া দৌড়ি শুরু হলো। আদ্রিয়ান এই পা নিয়ে উঠার শক্তি পেলো না। হঠাৎ একজন লোককে এদিক দিয়ে যেতে দেখেই বলে উঠলো,

— ভাই ভাই দাড়ান।
লোকটা অস্থির হয়েই দাঁড়ালো একপল। আদ্রিয়ান আকুতি করে বললো,
— ভাই একটু সাহায্য করুন ভাই। দয়া করে একটু উঠিয়ে দিন। একটু বের হতে সাহায্য করুন।
লোকটা অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে চলে গেল দৌড়ে। ঐ যে জান বাঁচান ফরজ কাজ। লোকটা তাই করলো হয়তো। আদ্রিয়ান অবুঝের ন্যায় চিৎকার করে বলতে লাগলো,

— ভাই দয়া করে যাবেন না। আমার বউটা প্রেগন্যান্ট ভাই। দাঁড়ান। ভাই জমজ বাচ্চা হবে। তিনটা প্রাণ বেঁচে যাবে ভাই। ওকে একটু হাসপাতালে নিতে সাহায্য করুন।
আফসোস এত আকুতি মিনুতি শুনার মানুষ নেই সেখানে। আদ্রিয়ান শক্ত হাতে রোদকে বুকে চেপে রাখলো। মুখটাতে চুমু খেল বারবার। আবার পাগলের মতো ডাকলো,

— রোদ? রোদ? উঠো। হসপিটালে যাব না। উঠো।এই রোদ।
রোদের সাড়া নেই কোন। গুমড়ে কাঁদে আদ্রিয়ান। আজ অক্ষম ও। চরম ভাবে অক্ষম। শেষ বার চেষ্টা করলো উঠার। ব্যার্থ হলো। কপাল বেয়ে র*ক্ত ঝরেই যাচ্ছে। রোদের মাথাটা নিজের বুকে লুকালো আদ্রিয়ান যেন রোদটাকেই লুকিয়ে ফেলতে চাইছে। হঠাৎ বিকট শব্দ হলো। এদিকটাতেই বো*ম বি*স্ফো*রণ হয়েছে। হঠাৎ চারদিক নিঃস্তব্ধতার ছেঁয়ে গেলো।

ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৪৮

একদম শান্ত। বলা হয় কেউ বি*স্ফো*র*ণে মারা গেলে সে নিজে মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করার আগেই তার দেহ ছিন্ন বিন্ন হয়ে যায়। তাহলে কি রোদ আদ্রিয়ান ও মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করার সময় পেলো না? চারটা তাজা প্রাণ কি এই গলির মোড়ই ছিন্ন হলো? এতগুলো স্বপ্ন কি আজ কেবল স্মৃতি হয়ে রয়ে গেল? ভালোবাসার বুকেই বুঝি ভালোবাসার শেষ লিখা ছিলো?

ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৫০