ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৫০

ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৫০
সাইয়্যারা খান

হসপিটাল জুড়ে কান্নাকাটি লেগে গিয়েছে। ভালো ভালো বাসা থেকে তাঁজা দুটি প্রাণ বের হলো অথচ শুধু মাত্র সময়ের ব্যাবধাণে কি হয়ে গেল। বাইরের আলোটুকু ও যেন কারো জীবনে ফিকে পড়ে গিয়েছে। মাথা নিচু করে বসে আছে কেউ কেউবা কান্না করে যাচ্ছে।

আদ্রিয়ান হঠাৎ ঘুমের মধ্যেই কেঁশে উঠলো। হঠাৎ কাঁশতে কাঁশতে চোখ খুলার চেষ্টা করলো। আশে পাশে মানুষের অস্তিত্ব টের পেল কিন্তু চোখ খুলার চেষ্টা করতেই মাথা ব্যাথায় টনটনিয়ে উঠলো। হাত বাড়িয়ে কপালে রাখতেই মাথায় কারো হাতের স্পর্শ পেলো। বুঝলো এটা মায়ের হাত। আদ্রিয়ান ধরলো সেই হাত। চোখ খুললো রয়ে সয়ে। ঝাপসা দেখাতে বার কয়েক চোখ ঝাপটালো। বা হাত দিয়ে ডলে পরিষ্কার করতেই চোখের সামনে দৃশ্যমান হলো কিছু কান্নামাখা মুখ। কিছু চিন্তিত মুখ৷ আদ্রিয়ানের কাঁশি থামতে থামতেই রাতুল এগিয়ে এসে স্যালাইন চেক করে নার্সকে বললো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

— এটা শেষ হলেই খুলে দিও।
আদ্রিয়ান মুখ থেকে অক্সিজেন মাস্কটা খুলতে চাইলেই রাতুল বলে উঠলো,
— এটা এখন খুলবেন না।
আদ্রিয়ান শুনলো না। খুলে ফেললো মাস্ক। খুলতেই টেনে টেনে শ্বাস নিলো। বলে উঠলো,
— রো-দ কোথায়?
— পাশের কেবিনেই আছে।

রাতুল বলতে বলতেই আদ্রিয়ান স্যালাইনটা খুলে নিলো নিজের। চোখ দিয়ে পানি পরছে ওর। রোদটার কিছু হলো কি? ওর বাচ্চা দুটো? কেথায়? কোন অবস্থায়? ভাবতেই আদ্রিয়ান উঠলো ওমনিই পড়ে যেতে নিলো। পায়ে বোধ পাচ্ছে না ঠিকমতো। রাতুল তারাতাড়ি ধরে নিলো। সাথে আদ্রিয়ানের মা বাবা ধরলো। তখনই কেবিনে আরিয়ান এসে আদ্রিয়ানকে ওমন দেখেই দ্রুত কদমে এগিয়ে এসে বললো,

— আদ্রিয়ান ঠিক আছিস?
— রোদের কাছে নিয়ে চল। কোথায় ও?
কথাগুলো বলার সময় শ্বাস টেনে টেনে বললো আদ্রিয়ান। আরিয়ান ওকে অক্সিজেন মাস্ক পরতে বললেও শুনলো না। রোদটা’কে দেখতে হবে। আরিয়ান জানে থামাতে চাইলেও লাভ হবে না। শুধু সান্ত্বনা’র স্বরে বললো,
— ও ঠিক আছে। আয় আমার কাঁধে ভর দে।

আদ্রিয়ান আরিয়ানের কাঁধে ভর দিলেও তেমন একটা হাটতে পারল না। রাতুল এগিয়ে এসে পাশ থেকে সাপোর্ট দিতেই আদ্রিয়ান কিছুটা টেনে টেনে পা ফেলে হাটা ধরলো। বুকটা ধুক ধুক করছে ওর। ঠিক পাশের কেবিনেই রোদ শুয়ে আছে। মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো। গায়ে ফিকে রং এর পোশাক যেটা হসপিটাল থেকে দেয়া। দরজা খুলে যেতে চাইলেই আরিয়ান বলে উঠলো,

— এখন ডুকা যাবে না আদ্রিয়ান। তুই রেস্ট নিবি চল।
— উহু। ছুঁয়ে দেখব।
— দেখ আদ্রিয়ান তোর শরীর ভালো নেই। র*ক্ত ঝড়েছে পা আর কপাল থেকে। কোন কথা শুনতে চাই না এখন।
আদ্রিয়ান মানলো না। আরিয়ান তপ্ত শ্বাস ফেলে বললো,
— আয়।

দু’জনের সাহায্য আদ্রিয়ান’কে ভেতরে ডুকানো হলো। ফুলা ফুলা রোদের গালটাতে আদ্রিয়ানের ছুঁয়ে দিতে মন চাইলো কিন্তু পারলো না। হাত বাড়িয়ে শুধু মাথায় আদর করে দিলো। কিছুক্ষণ উঁচু হওয়া পেটটাতে তাকিয়ে রইলো। একা থাকলে নিশ্চিত আদ্রিয়ান উন্মুক্ত পেটে চুমু খেয়ে ছেলে-মেয়ের সাথে কথা বলতো। রাতুল নিম্ন স্বরে বললো,
— স্টেবল আছে এখন।
আদ্রিয়ান থাকতে চাইলো কিন্তু এবার আরিয়ান জোর করেই ওকে ধরে বের করে নিয়ে আসলো। কেবিনে বসতেই আদ্রিয়ান জিজ্ঞেস করলো,

— সত্যি করে বল। কিছু খারাপ হয় নি তো?
আরিয়ান কিছু বললো না। ড.মিহা আর ইয়াজ রিপোর্ট হাতে তখনই আদ্রিয়ানের কেবিনে ডুকলো। ইয়াজ এগিয়ে এসে কিছু জিজ্ঞেস করার পূর্বেই আদ্রিয়ান দুর্বল কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

— ড.মিহা আমার রোদ আর বাচ্চা দুটো ঠিক আছে?
ড.মিহা ঠোঁট কামড়ে কিছু ভাবলেন। লুকানোর কিছুই নেই। সব তো সামনেই হবে। তাই রয়ে সয়ে বললো,
— মি.জোহান আসলে আজকেই রোদের সি সেকশন করতে হবে।
চমকে তাকালো আদ্রিয়ান সহ কেবিনের বাকি সদস্যরা। রোদের মা কেঁদেই উঠলেন। আদ্রিয়ানের মা ওনাকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিচ্ছেন কিন্তু তাতে কি পোষায়? শুধু রাতুল,ইয়াজ আর আরিয়ান জানতো আগে থেকেই। আদ্রিয়ান আশ্চর্য কন্ঠে বললো,

— আজকে মানে? কিভাবে সম্ভব? মাত্র সাড় সাত মাস চলে।
ড.মিহা আদ্রিয়ান’কে শান্ত করতে চাইলো। বুঝানোর জন্য বললো,
— দেখুন ওর ভেতরে ধোঁয়া ডুকেছে বেশি। আপনার অবস্থাই ধোঁয়া’তে খারাপ হয়ে আছে সেখানে রোদ’তো প্রেগন্যান্ট। আজকে করতেই হবে উপায় নেই। ছেলেটার পজিশন উল্টে গিয়েছে। অনুমান করছি ওদের ভেতর ধোঁয়া ডুকেছে।

ফিটাসদের রেসপন্স কমেছে সাথে রোদের লিক করছে কিছুটা। আর সিজার করা হবে তা তো আগেই ভাবা ছিলো। আজ করা ছাড়া উপায় দেখছি না। আর এখন সাত মাসে ডেলিভারি হওয়া তো স্বাভাবিক যদিও রোদের কেস’টা কপ্লিকেটেড।
আদ্রিয়ান শুনে গেলো। ওর কানে বাজছে,” ছেলের পজিশন ঠিক নেই”, “রেসপন্স কম”। ছেলেটা শুরু থেকেই দূর্বল। বুকে চাপ অনুভব করলো আদ্রিয়ান। ওর সাইনের অপেক্ষাতেই ছিলো এতক্ষণ সবাই। আদ্রিয়ান শুধু জিজ্ঞেস করলো,

— রোদ আর বাচ্চারা ঠিক থাকবে না?
কি আকুলতা মিশ্রিত কন্ঠ। কে বলবে এই লোকটা এতটাই স্ট্রিং ছিলো যে কেউ কখনো ওকে নড়াতে পারে নি কোন পরিস্থিতি’তে অথচ আজ যেন ভেঙে যাচ্ছে আদ্রিয়ান। যাচ্ছে না বরং গিয়েছ। ইয়াজ আদ্রিয়ানের কাঁধে হাত রেখে বললো,
— ভাই চিন্তা করবেন না প্লিজ। ইনশাআল্লাহ ঠিক থাকবে সব।
আদ্রিয়ান কিছুই বললো না। শুধু অনুরোধের স্বরে বললো,

— আমি ওর পাশে থাকি?
মায়া হলো সবার কিন্তু থাকা যাবে না। যদি কিছু হয়ে যায় আদ্রিয়ান সহ্য করতে পারবে না। ড.মিহা ও অনুমতি দিলো না। আদ্রিয়ানকে রেস্ট নিতে বলা হলো। আদ্রিয়ান নিজেও দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। মাথার আঘাতটা একটু বেশিই। শুধু শুয়ার আগে বললো,

— আমাকে ডেকে দিস প্লিজ।
কথাটা বলেই চোখ বুজলো আদ্রিয়ান। অক্ষিপটে ভেসে উঠলো ঘটে যাওয়া বিভৎস ঘটনা।
তখন বি*স্ফো*র*ণ’টা হয়েছিলো নয়া পল্টনের দিকে। আদ্রিয়ানরা ছিলো পুরাণা পল্টনে। একটুর জন্য আল্লাহ বাঁচিয়েছেন। অনেকেই ক্ষত বিক্ষত হয়েছে। হতাহত হয়েছে বাট কেউ মা’রা যায় নি। এই পর্যন্ত খবর পাওয়া যায় নি। পরিস্থিতি আপাতত হাতের নাগালে আছে।

বাসা থেকে আদ্রিয়ান’রা বের হওয়ার পর পরই রাদ’রা খবর পায় সমাবেশ হবে। যেহেতু ওরা থাকে পুরাণ ঢাকায় তাই বিপদ বেশি। ইশান তৎক্ষণাত ওর শশুড়’কে কল করে কারণ ড্রাইভার এসে আদ্রিয়ানদের অবস্থা বলেছে। বৃদ্ধ লোকটাও বেশ আহত হয়েছে। সবাই একপ্রকার ভীত হয়ে যায়। স্পট থেকে উদ্ধার করা হয় ওদের। আদ্রিয়ান তখন সল্প জ্ঞানে ছিলো কিন্তু রোদ ছিলো জ্ঞানহীন।

গোটা একটা দিন কিভাবে যেন কেটে গেলো। কারো কাছে হয়তো দিনটা খুব দ্রুত কেটেছে। কারো কাছে কেটেছে এক যুগ সমান। অথচ সময়? সে তো নিজ গতিতেই অটল ছিলো। না বেড়েছে না কমেছে। বাইরে ঝিরিঝিরি শব্দ তুলে বৃষ্টি হচ্ছে। তনুটা ভেজালে মন্দ হবে কি? না হবে না। বর্ষার বৃষ্টি’তে জ্বর ঠান্ডা হবে না। একটু ভেজা মোটেও মন্দ না। তবে একা ভেজাটা মন্দই বটে। পাশে সঙ্গি দরকার। যে আপাতত নেই। নিশ্চিতে ঘুমাচ্ছে সে। নিষ্ঠুরতম সে। নাহলে এত পীড়া কেন দেয়?

একমনে কথাগুলো ভেবে যাচ্ছে আদ্রিয়ান। না চাইতেও দৃষ্টি ওর জানালার বাইরে। একটু পরই রোদ’কে ওটি’তে নেয়া হবে। এখন কিছুটা জ্ঞানে আছে ও তবে পুরোপুরি হুসে নেই। তখন পড়ে গিয়ে চাপটা পেটেই লেগেছিলো। বাচ্চাটা উল্টে আছে। আস্তে করে দেয়াল ধরে উঠে দাঁড়িয়ে গেল আদ্রিয়ান। ধীরে ধীরে পা টেনে কেবিন থেকে বের হলো। মাথা ব্যাথাটা কমছে না সাথে আবার পায়ের যন্ত্রণা। একা একাই বের হলো আদ্রিয়ান। মোটামুটি সবাই ই এখানে উপস্থিত। মুখ জুড়ে চিন্তার আভাস। আদ্রিয়ান রোদের কেবিনে ডুকে পড়লো। নার্স বাঁধা দিতে চাইলেও ইয়াজ না করলো। থাক না একটু। একটু রুলস ভাঙলে কি আর এমন হবে? লোকটা শান্তি পায় যাতে তাই করুক।

আদ্রিয়ান কোনমতে শেসরাতে শেসরাতে ভেতরে ডুকলো। রোদের পরণে হাটু সমান হসপিটালের পোষাক। মলিন মুখে শুয়ে আছে। আদ্রিয়ান কাছে এসে ওর মাথায় হাত বুলালো। কপালে চুমু খেল। কানে চুমু খেল। মুখ লাগিয়ে বললো,
— সোনা ভয় পাচ্ছো? বোকা পাখি আমার। কিচ্ছু হবে না। এই বউ? এই?
অল্প জ্ঞানে থাকা রোদ উত্তর করলো,
— হ…হু?

— ফিরে আসবে না? আসবে কিন্তু। আমি অপেক্ষায় থাকব। ছয়জন একসাথে থাকব। বড় বেড না অর্ডার করলাম। ছয়জন জায়গা হবে তাতে কিন্তু তুমি যদি ধোঁকা দাও তাহলে কিন্তু তোমার আগে আমি ওই লোহার খাটে দখল করব। একদম বলে দিলাম। তোমরা সামনে আমাকে নিয়ে গেলে বুঝবা কেমন কষ্ট লাগে। শুনো আসবা কিন্তু। আমি আমার রোদকে চাই। বুঝেছো?

— হ..হু।
— ভালোবাসি অনেক৷ জানো না?
— হা..ম।
— তাহলে সেই টানে ফিরে এসো। আমি দোয়া করব।
পরপর রোদের কান থেকে মুখ সরালো আদ্রিয়ান। সুন্দর একটা মিঠা চুম্বন করলো প্রিয় স্ত্রী’র ঠোঁটে। সরে গেল পেটের কাছে। চুমু খেল। আদর দিলো। আহ্লাদী কন্ঠে বললো,

— বাবা’র জান’রা বাবা অপেক্ষা করছি কিন্তু বাবাই’রা। আমার বুকে না আসলে আব্বু অনেক কষ্ট পাব। আমার সোনারা কি আব্বুকে কষ্ট দিবে? জানি তো দিবে না। ওয়াদা করেছো কিন্তু দুজন যে আমার বুকে আসবে। থাকবে। মা’কে দেখো কিন্তু। ভীতু তোমাদের মা। আর শুনো একদম ফাঁকিবাজি চলবে না। কোথাও যাওয়া চলবে না। সোজা মায়ের পেট থেকে আব্বুর বুকে। ঠিক আছে?

কাঁধে কারো স্পর্শে ফিরলো আদ্রিয়ান। আরিয়ান ওকে ধরে উঠিয়ে নিয়ে বললো,
— ওকে নিতে হবে। ওটি রেডি।
আদ্রিয়ান উঠলো। স্ট্রেচারে রোদকে যখন নেয়া হলো তখন রোদে’র হাতটা ধরে রেখেছে আদ্রিয়ান। শেষ পর্যন্ত পাশে থাকলো। যখন লাল রং টা ওটিতে জ্বলে উঠলো তখনই যেন বুকে আগুন জ্বলে উঠলো আদ্রিয়ানের। এই আগুন দেখা যায় না এটা শুধু পুড়ায় ভিতরে। জ্বালায়।
উঠে কেবিনে চলে গেল আদ্রিয়ান। ওযু করে নামাজে বসে পরলো। একটা চাওয়া কি খুব বেশি হয়ে যাবে? তিনটা প্রাণ একসাথে আসলে কি ক্ষতি?

করিডোর জুড়ে কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। আদ্রিয়ান ধীর পায়ে ওখানে আসতেই রোদের মা’য়ের আর্তনাদ শুনতে পেলো। রাদের বুকে পরে কাঁদছেন তিনি। বারবার বিলাপ করে বলছেন,
— আমি কেন বিয়ে দিলাম ওকে? আমার ছোট্ট রোদ? এই রাদ আমার মেয়ে’র কি হলো রে? আমার রোদটাকে ঠিক করে দে।

বুকে জ্বালা উঠলো আদ্রিয়ানের। আসলেই তো আজ যদি রোদের জীবনে আদ্রিয়ান না আসতো তাহলে রোদকে তো এই দিনটা দেখতে হতো না। আচ্ছা উনি কাঁদছেন কেন? রোদ’টার কি কিছু হলো?
এগুলো আদ্রিয়ান। ওর মা দৌড়ে এসে ঝাপিয়ে পড়লেন ছেলের বুকে। কেঁদে উঠলেন।
— আদ্রিয়ান রো…রোদ কেমন জানি করছে।

আপারেশনের মাঝ পথেই ওর জ্ঞান ফিরে এসেছে। ছটফট করছে। এনেস্থিসিয়া দিয়েও কাজ হচ্ছে না। পরিস্থিতি খারাপ থেকেও খারাপ হচ্ছে। গোল কাঁচটা দিয়ে এতটুকুই দেখতে পেলো আদ্রিয়ান। এরপর শান্ত হয়ে গেল রোদ। মনে হয় কাজ হয়েছে এনেস্থিসিয়ায়। ডান হাতটা দিয়ে নিজের বুকে ডলতে লাগলো আদ্রিয়ান। জ্বলছে এখানটায়। ইশ কি জ্বালা! আদ্রিয়ান কি দেখলো চোখ দিয়ে মাত্র? এটা দেখা বাকি ছিলো বুঝি?

মুখে কোন কথাই বলতে পারছে না ও। একটু হাত পা ছড়িয়ে কাঁদতে দরজার। তাহলে বুঝি বুকটা শান্তি পেত?
ওটি’তে ড.মিহা সহ দুজন গাইনোকলজিস্ট আছেন সাথে ইয়াজ,আরিয়ান আর রাতুল। তবুও ভরসা পায় না আদ্রিয়ান। কোনমতে শক্তি সঞ্চয় করে হাত উঁচিয়ে ওটি’তে ধাক্কা দিলো আদ্রিয়ান। বিরবির করে বলছে,
— খুলো।খুলো। আমার রোদ ডাকছে। আমাকে ডাকছে। খুলো। আমি ডুকি তাহলেই ও এমন করবে না।
আদ্রিয়ানের বাবা আর রাদ মিলে কোন মতে ওকে ধরে রাখলো। আদ্রিয়ান কি বিরবির করছে কেউ তেমন একটা বুঝতে পারছে না। এখন তো আদ্রিয়ানের অবস্থা দেখেই সবার কলিজা শুকিয়ে কাঠ।

দীর্ঘ দুই ঘন্টা পর একটা নবজাতকের কান্নার শব্দ পাওয়া গেলো৷ আচ্ছা কর্ণশীতল হওয়া কি এটাকেই বলে যেটা আদ্রিয়ানের হলো? এই শব্দের মতো কি কোন শব্দ হয়? নিজের অস্তিত্বে’র কান্নার শব্দ। হ্যাঁ আদ্রিয়ানের সন্তানের শব্দ। পা চালিয়ে সামনে গেলো আদ্রিয়ান। ওটি’র দরজা খুলা হলো। ইয়াজ একটা ফুলফুটে মেয়ে এনে আদ্রিয়ানের কাছে দিতে দিতে বললো,

— ভাই আপনার মেয়ে।
আচ্ছা আদ্রিয়ান যদি এখন খুশিতে পাগল হয়ে যায় তা কি খারাপ হবে? দ্রুত গতিতে ওর হৃৎস্পন্দিত হচ্ছে। হাতটা কাঁপছে। বুকে দুরুদুরু করছে। মাথা দুলিয়ে আওড়ালো,
— মাশাআল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ আমার মা।
কোলে তুলে বুকে জড়িয়ে নিলো। ওভাবে ই বললো,
— আমার রোদ?
— ভাই ছেলেটার পজিশন ঠিক নেই তাই সময় লাগছে।

এতক্ষণে সবাই জড়ো হয়ে গেল। ছোট্ট জান’টাকে দেখতে তারা খুবই আগ্রহী কিন্তু আদ্রিয়ান দেখালে তো? আদ্রিয়ান মেয়ে’র মুখে চুমু খেল। এতক্ষণে গলায় আটকানো শব্দ গুলো সুউচ্চ ধ্বনিতে ছেড়ে দিলো,
“আল্লা-হু আকবার -আল্লা-হু আকবার
আল্লা-হু আকবার -আল্লা-হু আকবার
আশহাদু আল লা-ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ
আশহাদু আল লা-ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ
আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লা-হ
আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লা-হ”

সবাই মুগ্ধ চোখে তাকিয়েই রইলো। ছোট্ট জান’টার ঠোঁটে তখন হাসি। এতটুকু বাচ্চা এভাবে হাসে? সাড়ে সাত মাসের বাচ্চা অথচ দেখে বুঝা যায় না। আদ্রিয়ান খেয়াল করলো ছোট্ট মেয়েটার গালে বেশ গর্ত করে টোল পড়ে একদম মায়ে’র মতো। আদ্রিয়ান আবারও বুকে নিয়ে নিলো। কাউকে ধরতে দিবে তো দূর ছুঁতেও দিলো না। দেখতেও না। যদি নজর লাগে? সেই ভয়। ইয়াজ আদ্রিয়ান’কে বললো,
— ভাই অবজারভেশনে রাখতে হবে।

আদ্রিয়ান দেড়ী করলো না। মেয়েটাকে দিয়ে দিলো। বুকের জ্বালা কমেছে। নেই বললেই হবে। ইয়াজ নার্সের কাছে দিলো বাচ্চাটাকে। আদ্রিয়ানের মন ভরে নি। মেয়েটাকে ছাড়তেই মন চাইছে না।
প্রায় দশ মিনিট পরই দৌড়াদৌড়ি লেগে গেল। ছেলে হ’য়েছে কিন্তু একদম ছোট। আদ্রিয়ান দেখে নি এখনও। সুযোগ পেলে তো? রোদের অবস্থা ও ভালো না।

ছেলের একেতো পজিশন ঠিক ছিলো না তারমধ্যে আগের থেকেই গ্রো ছিলো কম। ধুঁয়া ও ডুকেছে কিছুটা। শ্বাস নালিতে সমস্যা দেখা দিয়েছে। এখন হয়েছে সাড়ে সাত মাসে। হওয়ার পরই স্পেশাল কক্ষে রাখা হয়েছে অবজারভেশনে।বাঁচকে কি না বলা যাচ্ছে না।

তবে রেসপন্স খুবই কম। চিন্তিত সকলে। আল্লাহ আল্লাহ করে যাচ্ছে। রোদের অবস্থা খারাপ। দুইবার খিঁচুনি উঠেছে এই পর্যন্ত। কোনমতে সামাল দেয়া যাচ্ছে না। আদ্রিয়ান বাইরেই পাগলের মতো করছে৷ এদিক ওদিক ছুটছে। কি করবে? ওর রোদের দেহ থেকে রুহ টাকে বের করার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছে আজরাইল কিন্তু পারছে না। ছটফটানি বন্ধ হচ্ছে না। এত সবক ওর সিলি ছুটে গেলো। ব্লি*ডিং হচ্ছে এতে খুব। আদ্রিয়ান পাগলের মতো কেঁদে যাচ্ছে। কে ওকে ধরে রাখবে? এই সামর্থ আছে কারো?
একজন স্বামী কতটা অসহায় হলে এভাবে কাঁদে আজ দেখলো সবাই।

রোদের আপাতত অবস্থা ভালো না। ডক্টর চেক করছে একটু পর পরই। র*ক্ত দেওয়া হয়েছে। এখনও আইসিইউতে চিকিৎসায় আছে। কখন কি হয় বলা যাচ্ছে না। এতসবও বঝি কম পরে গিয়েছিলো। হঠাৎ খবর এলো আদ্রিয়ানের মেয়েটার সাড়া নেই। পাগল প্রায় আদ্রিয়ান ছুটে এলো। বাচ্চা’টা খনিকের মেহমান ছিলো। ওর মেয়ে নেই আর। শুনেই এবার ভয়ংকর ভাবে গর্জে উঠলো আদ্রিয়ান। অবজারভেশনের দায়িত্বে থাকা ডক্টরের কলার চেপে ধরে পরপর সর্বশক্তি দিয়ে দুটো ঘুষি মারলো। হঠাৎ এত শক্তি দিয়ে আঘাতে ডক্টরের নাক দিয়ে গলগলিয়ে র*ক্ত ছুটলো। সবাই মিলে ধরে ছুটালো। আদ্রিয়ান বিভৎষ ভাবে গর্জে উঠলো,

— আমার মেয়ে। আমার মেয়ে সুস্থ ছিলো৷ আমি দেখেছি। ও সুস্থ ছিলো। আমার বুকে ছিলো। ওকে এনে দে। সবকটাকে জানে মে’রে ফেলব। পাগল পেয়েছিস আমাকে। ছাড় আমাকে। ছাড়!
পাগল হয়ে উঠলো আদ্রিয়ান। আরিয়ান মৃত বাচ্চাটাকে সাদা কাপড়ে প্যাচানো অবস্থায় নিয়ে এলো। আদ্রিয়ান ছুটে গিয়ে ছিনিয়ে নিলো নিজের বাচ্চাটাকে। চুমু খাচ্ছে বারবার। পাগলের মতো ডাকছে,

— মা? এই মা? এই? এই যে আব্বু। আমার আম্মা চোখ খুলেন। এই আম্মু এই যে আমি। তুমি না তাকালা। বাবা’কে দেখলা। হাসলা? কাঁদো বাবা’র জান। কাঁদো। এই যে বাবা…. ঘুম থেকে উঠো। কত ঘুমাবে বাবা’র জান?
কাঁদলো না আদ্রিয়ানের মেয়ে।মৃত বাচ্চা কিভাবে কাঁদবে? হয়তো বাবার বলা কথা রাখতেই বাবা’র বুকে এসেছিলো সে। নিজের ওয়াদা রেখেছে আদ্রিয়ানের ছোট্ট মেয়ে। বাবা’কে ফাঁকি দিয়ে যায় নি। বাবা বুকে আসতে বলেছিলো সে এসেছিলো। বাবা তার হাসি দেখতে চেয়েছিলো ছোট্ট মেয়েটা হেসেছিলো। ওয়াদা রেখেছে সে।

আদ্রিয়ান মৃত মেয়েটাকে বুকে নিয়েই দেয়াল ঘেঁষে বসে পরলো। দুই একজন বাদে বাকি কেউ এখনও দেখে নি। ছেলেটাও বাঁচবে কি না বুঝা যাচ্ছে না। তুলার স্তুপের উপর শুয়িয়ে রেখেছে কাঁচের দেয়ালের মাঝে। আর রোদ? তার ও তো ভরসা নেই। সবাই চলে যাবে। সবাই যাবে। আদ্রিয়ান’কে বড়সড় ফাঁকি দিবে।
যেই অপরিপক্ক ভ্রুণের শোকে কেঁদেছিলো শক্ত আদ্রিয়ান তারই হাতে কি না আজ তার পরিপূর্ণ সন্তান তাও মৃত। আহা কি বেদনাদায়ক ই না সেই পরিস্থিতি। কতটা নির্মম। নিষ্ঠুর।
আরিয়ান এসে ওর কাঁধে হাত রেখে বললো,

— আদ্রিয়ান ছোট বাচ্চা। দাফন করতে হবে। উঠ। পাগলামি করিস না। ছেলেটার কথা ভাব ভাই। উঠ।
— ওরা দুইজনও চলে যাবে। আমি একা হয়ে যাব না। মিশান মিশি’কে কি বলব? আমার ভুলের কারণে তিনটা প্রাণ চলে গিয়েছে।

— পাগলামি করিস না। বাচ্চাটাকে দে।
— না।
— আদ্রিয়ান…
— বললাম না দিব না। যা এখান থেকে।
— কষ্ট পাচ্ছে ও আদ্রিয়ান। এমন করিস না।
“কষ্ট পাচ্ছে” শব্দ দুটো বিঁধলো। আদ্রিয়ানের মেয়ে কষ্ট পাচ্ছে? এটা হতে দিবে আদ্রিয়ান?
উঠে দাঁড়িয়ে গেলো ও। মৃত মেয়ে’কে বুকে নিয়ে খোঁড়াত খোঁড়াতে সামনে হাটা দিলো। পিছনে ছুটলো বাকিরা।

ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৪৯

কারো কাছে দেয় নি আদ্রিয়ান ওর মেয়ে’কে৷ ছোট্ট একটা কবর খোঁড়া হয়েছে। সযত্নে আদ্রিয়ান ওখানে নিজের মেয়েকে শুয়িয়ে দিলো। শেষ বারের মতো চুমু খেয়ে আদর করে নিলো। ওভাবেই রয়ে গেল। উঠলো না। নড়লো না।
যেই বাবা’র বুকে রাজত্ব চালায় তার মেয়ে সেই বাবা’র বুকে তারই রাজকন্যা’র মৃত্যু বুঝি এতই সহজ? কতটা মৃত্যু যন্ত্রণা সম তা যার যায় সেই বুঝে। দীর্ঘ সময় পর ও যখন আদ্রিয়ান উঠলো না তখন খটকা লাগলো রাতুলের। আদ্রিয়ানের কাঁধে হাত দিয়ে উঠাতে উদ্যত হলেই চমকে গেল রাতুল। আরিয়ান চিৎকার করে ডেকে উঠলো,
“আদ্রিয়ান!”

ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৫১