অনেক সাধনার পরে পর্ব ১২

অনেক সাধনার পরে পর্ব ১২
অরনিশা সাথী

নুহাশকে এয়ারপোর্টে ছাড়তে এসেছে কিয়ান, নিবির আদিরা এবং ওদের ছয় বছর বয়সী ছেলে নির্ঝর। বাসা থেকে আসার সময় শাহানা বেগমের সে কি কান্না। নোমান সাহেব তো অভিমানে কথা’ই বলেনি নুহাশের সাথে। নুহাশ আসার সময় তিনি ঘরেই ছিলো।

নুহাশ গিয়ে নোমান সাহেবকে জড়িয়ে ধরে কাঁদার সময়ে’ও নোমান সাহেব আলতো করে নোমানের পিঠে হাত রাখেনি। ছেলের ব্যবহারে বড্ড অভিমান জমেছে তার। নুহাশ বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় নোমান সাহেব কান্নায় ভেঙে পড়েন। নোমান সাহেব এবং শাহানার সাথে নুহাশ, নিবিরের ছোট বেলার একটা ফ্যামিলি ফটো আছে যা সবসময় নোমান সাহেবের বিছানার পাশের ছোট্ট টেবিলে থাকে। নোমান সাহেব ফটো ফ্রেমটা বুকে জড়িয়ে অঝরে কাঁদেন। নুহাশ উনার বড্ড আদরের ছেলে। শুধু যে নোমান সাহেবের আদরের তেমনটা না। শাহানা আর নিবিরের’ও বড্ড আদরের। আদিরা’ও নিজের ভাইয়ের সমতুল্য মনে করে নুহাশকে। আদিরার সাথে নুহাশের অন্যরকম একটা সম্পর্ক। দেবর-ভাবী কম ভাই-বোনের সম্পর্ক বেশি।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

নুহাশ নির্ঝর’কে কোলে তুলে নিয়ে বললো,
–“আসছি বাবা? গুড বয় হয়ে থাকবে আর আম্মুর কথা শুনবে, মন দিয়ে পড়াশোনা করবে কেমন?”
নির্ঝর নুহাশের গলা জড়িয়ে ধরে বললো,
–“নির্ঝরের’র কষ্ট হচ্ছে চাচ্চু। তুমি যেও না, নির্ঝর তোমাকে যেতে দিবে না।”
নুহাশ মুচকি হেসে নির্ঝরের কপালে চুমু খেয়ে বললো,
–“চাচ্চু আসার সময় তোমার জন্য অনেক চকলেটস খেলনা নিয়ে আসবে, ওকে?”
নির্ঝর পরপর কয়েকবার চোখের পলক ফেলে মাথা নাড়ালো। নুহাশ নির্ঝরের গালে চুমু দিয়ে নিবিরের কোলে দিয়ে দিলো ওকে। নিবির একহাতে নুহাশকে জড়িয়ে ধরে বললো,

–“তোকে ভীষণ মিস করবো ভাই। নিজের খেয়াল রাখিস।”
–“আমিও মিস করবো তোমাদের। ভালো থেকো তোমরা আর নির্ঝর আর বাবা-মায়ের খেয়াল রেখো।”
কথাটা বলে নিবিরকে ছেড়ে দেয় নুহাশ। আদিরার সামনে গিয়ে নুহাশ দাঁড়াতেই আদিরা নুহাশের হাত ধরে কেঁদে দেয়। নুহাশ আদিরার চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো,

–“কাঁদছো কেন ভাবী? তোমরা সবাই এমন ভাবে কাঁদছো যেন আমি মরে যাচ্ছি।”
আদিরা নাক টেনে রাগান্বিত স্বরে বললো,
–“উল্টোপাল্টা বললে মার খাবা কিন্তু।”
নুহাশ হেসে বললো,

–“আচ্ছা আর বলছি না। সবার খেয়াল রেখো ভাবী।”
–“তুমি তাড়াতাড়ি ফিরে এসো প্লিজ। তোমাকে ছাড়া বাড়ি শূণ্য শূণ্য লাগছে এখনই।”
–“হু আসবো।”
–“অন্যের উপর অভিমান করে নিজের পরিবারকে দূরে না ঠেলে দিলে হতো না?”
–“সে যে আমার হৃদস্পন্দনের কারণ ভাবী। চোখের সামনে আমার প্রিয় মানুষটাকে তার প্রিয় মানুষের সাথে কি করে দেখি বলো তো?”

আদিরা কিছু বললো না। নুহাশ বললো,
–“এবার একটু হাসো? আমার প্রিয় মানুষদের চোখের পানি যে আমার সহ্য হয় না ভাবি। তাদের মুখে হাসি’টা দেখতে চাই আমি সবসময়।”
নুহাশের কথায় আদিরা হাসলো। নুহাশ কিয়ানের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই কিয়ান জাপ্টে ধরলো নুহাশকে। নুহাশের কাঁধে মুখ গুজে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। ছোট থেকে দুজনে একসাথে আছে। একে-অপরের সুখ দুঃখে দুজনে একসাথে ছিলো। কতশত স্মৃতি আছে দুজনের। নুহাশ কিয়ানের পিঠ চাপড়ে বললো,

–“তুই’ও কি বাচ্চা কিয়ান? সবাই মিলে কি শুরু করেছিস বল তো? আমি তো আর সারাজীবনের জন্য চলে যাচ্ছি না।”
–“কবে আসবি তুই?”
–“উমমম, তোর আর ফারিনের বিয়েতে থাকবো আমি পাক্কা।”
–“সে এখনো অনেক দেরি নুহাশ। তোকে ছাড়া কিভাবে চলবে আমার?”
–“সারাজীবন তো আর আমি থাকবো না। তাই এখন থেকেই অভ্যাস করে নে।”
কিয়ান আবারো জাপ্টে ধরলো নুহাশকে। নুহাশ আলতো হাসলো। কিয়ানের পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
–“যেতে হবে এখন।”

কিয়ান নুহাশকে ছেড়ে দাঁড়িয়ে চোখের পানি মুছলো। নুহাশ সবার থেকে বিদায় নিয়ে এয়ারপোর্টের ভিতর চলে গেলো।
নুহাশ সবার সামনে যতই হাসিখুশি দেখাক, ভিতরে ভিতরে যে ও নিজেও জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে। নিজের ক্ষতটা কাউকে দেখাতে পারছে না ও। যাওয়ার আগে শেষ বারের মতো রুজবার মুখটা’ও যে দেখতে পারেনি ও। শুধু কিয়ানের মাধ্যমে ফারিনের থেকে রুজবার একটা ছবি আনিয়েছে নুহাশ। যেটা সবসময় রাখবে ও নিজের কাছে। ছবিটা বের করে নিজের ওয়ালেটে রেখেছে নুহাশ। যখন ইচ্ছে হবে দেখবে নিজের না হওয়া ভালোবাসার মানুষটাকে।

সময় আর নদীর স্রোত কারো জন্য থেমে থাকে না। এর মাঝে আরো দুটো মাস পেরিয়েছে। নুহাশ আমেরিকায় স্টাডির পাশাপাশি ওর মামার বিজনেসেও যোগ দিয়েছে। প্রথম প্রথম বেশ কষ্ট হয়েছে পরিবার ছেড়ে ওখানে থাকতে কিন্তু সময়ের সাথে নুহাশ’ও সবটা মানিয়ে নিয়েছে।

আজ জারাফের সাথে রুজবার দেখা হবে। দীর্ঘ দুই মাস বাদে জারাফকে দেখবে ও। এতদিনও ভিডিও কলে কথা হয়েছে। কিন্তু সেভাবে জারাফ রুজবাকে সময় দিতে পারেনি। হয়তো বা কাজের খুব প্রেশার যাচ্ছে। কাল রাতে বাসায় ফিরেছে জারাফ। জারাফ বাসায় এসেছে শুনে রুজবা মরিয়া হয়ে উঠেছে জারাফের সাথে দেখা করার জন্য। তাই জারাফ জানিয়েছে আজ কলেজে যাবে ও। খুব খুশি আজ রুজবা। সময়ের আগেই রেডি হয়ে ফারিনকে ডাকতে গিয়েছে ও। অতঃপর ফারিন রেডি হলে দুজনে একসাথেই কলেজের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়।

কলেজে পৌঁছাতেই কিয়ানের সাথে দেখা হয় ওদের। কিয়ান হাসিমুখে এগিয়ে যায় রুজবা আর ফারিনের দিকে। রুজবা একগাল হেসে জিজ্ঞেস করলো,
–“কেমন আছেন কিয়ান ভাই?”
–“আলহামদুলিল্লাহ, তুমি?”
–“আমিও আলহামদুলিল্লাহ ভালো।”
এইটুকু বলে রুজবা ফারিনের কানের কাছে গিয়ে বললো,

–“তোরা কথা বল আমি আসছি? জারাফ আসবে আজ।”
ফারিন মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতেই রুজবা চলে গেলো। রুজবা যেতেই কিয়ান বললো,
–“কি বলে গেলো ও?”
–“জারাফ আসবে দেখা করতে, তাই চলে গেলো।”
পরবর্তীতে কিয়ান আর কিছু বললো না। কি বলবে? কাউকে জোর করে ধরে বেঁধে তো আর ভালোবাসানো যায় না।

মিনিট দশেক গড়াতেই জারাফ ক্যাফেতে এসে হাজির হলো। রুজবা আগে থেকেই বসে ছিলো ক্যাফেতে। জারাফ রুজবার পাশে গিয়ে বসতেই রুজবা জারাফের একটা বাহু জড়িয়ে ধরে জারাফের কাঁধে মাথা রেখে বললো,
–“ভীষণ মিস করেছি তোমাকে।”
–“আচ্ছা।”
–“শুধু আচ্ছা?”

–“তাহলে আর কি বলবো?”
রুজবা সোজা হয়ে বসে বললো,
–“তুমি মিস করোনি আমাকে?”
–“হ্যাঁ করেছি তো।”
রুজবা আবারো জারাফের কাঁধে মাথা রাখলো। জারাফ বললো,
–“কি খাবে বলো? ভারী কিছু অর্ডার দিবো?”
–“উহু। প্রচন্ড গরম, ঠান্ডা কিছু দিতে বলো।”
জারাফ একজনকে ডেকে এখানে দুটো কোল্ড কফি দিতে বললো। রুজবা বললো,

–“আজকাল তুমি বড্ড ব্যস্ত থাকো তাই না?”
–“না কেনো?”
–“তাহলে আগের মতো সময় দাও না যে।”
–“ও হ্যাঁ একটু বিজি থাকি রুজ। পড়াশোনা অফিস দুটোই সামলাতে হয়। তাই____”
–“আচ্ছা আচ্ছা বুঝেছি, এক্সপ্লেইন করতে হবে না।”

কিছুক্ষণ বাদে কোল্ড কফি দিয়ে গেলে দুজনেই খেতে শুরু করে। খাওয়ার শেষে জারাফের ফোন বেজে উঠে। জারাফের ফোন টেবিলেই রাখা ছিলো। রুজবা দেখলো ‘নিদ্রা’ নামের কেউ ফোন করেছে। জারাফ দ্রুত ফোন তুলে রিসিভ করে কানে নিলো। ওপাশ থেকে নিদ্রা বললো,

–“কোথায় তুমি?”
–“কেন?”
–“আমি একা বোর হচ্ছি, কাকি রান্না করছে জুহি’টাও স্কুলে। একা ভালো লাগছে না আমার।”
জারাফ ঘড়িতে সময় দেখলো। জুহির স্কুল ছুটি হবে চারটায়। এখন সবে বারোটা বাজে। জারাফ কি বলবে ভেবে পেলো না। পাশেই রুজবা বসে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জারাফের দিকে৷ মেয়েটা অনেকদিন পর জারাফকে এইটুকুন সময়ের জন্য কাছে পেয়েছে। এখন কি করে ওকে রেখে বাসায় যাবে জারাফ? রুজবার মুখের দিকে তাকালে যে জারাফের বড্ড মায়া হয়৷

অন্যদিকে নিদ্রা অনেক বছর পর গ্রামে এসেছে। জারাফের বাবার মৃত্যুর সময়’ও আসতে পারেনি। হসপিটাল থেকেই জারাফের বাবার মৃতদেহ দেখে বাড়ি ফিরে গিয়েছিলো ও। এতদিন বাদে এসেছে। অথচ বাসায় বসে একা একা বোর হচ্ছে। কি করা উচিত এই মূহুর্তে জারাফের ভেবে পাচ্ছে না ও। শেষমেশ ভাবলো বাসায় ফিরে যাবে। যে-ই ভাবা সেই কাজ। নিদ্রাকে বললো,

–“আসছি আমি।”
এইটুকু বলেই লাইন কেটে দিলো জারাফ। সাথে সাথেই রুজবা প্রশ্ন করলো,
–“কার ফোন ছিলো?”
–“কাজিন।”
–“ছেলে না মেয়ে?”
–“সন্দেহ করছো আমায়?”
–“এখানে সন্দেহের কথা আসছে কেন জারাফ? আমি শুধু জিজ্ঞেস করেছি।”
–“আচ্ছা বাদ দাও, বাসায় যেতে হবে আমার।”

রুজবা টলমলে চোখে তাকালো জারাফের দিকে। রুজবা তো স্পষ্ট দেখলো নিদ্রা নামে সেভ করা নাম্বার। তাহলে মেয়ে কাজিন বললেই পারতো জারাফ৷ এভাবে বলার কারণ খুঁজে পেলো না রুজবা। আজকাল জারাফের ব্যবহার রুজবাকে বড্ড কষ্ট দেয়। কাতর কন্ঠে বললো,
–“এতদিন পর দেখা হয়েছে, এখনই চলে যাবে?”
–“ইমারজেন্সি রুজ। দুদিন আছি তো গ্রামে। কাল দেখা করবো সময় নিয়ে কেমন?”

রুজবার মন খারাপ হয়ে গেলো। চোখে অশ্রু জমে গেলো মূহুর্তেই। মন খারাপ নিয়েই মাথা নাড়ালো রুজবা। জারাফ রুজবার কপালে চুমু দিয়ে কাউন্টারে গিয়ে বিল দিয়ে বেরিয়ে গেলো ক্যাফে থেকে। রুজবা ছলছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো ক্ষানিকটা সময়।

ক্যাফে থেকে বেরিয়ে একটা রিকশা ডেকে তাতে উঠে পরে জারাফ। রিকশা তার গন্তব্যের দিকে এগিয়ে চলছে। রিকশায় বসে জারাফ ভাবছে রুজবাকে কোনো ভাবে ঠকাচ্ছে না তো ও? মেয়েটা ওকে ভীষণ ভালোবাসে। জারাফও তো ভালোবাসে৷ তাহলে আজকাল এমন ব্যবহার করে কেন মেয়েটার সাথে? কেন রুজবাকে জানাতে পারে না বাসায় নিদ্রাকে নিয়ে বিয়ের কথা বলেছে ওর চাচা?

আর জারাফ পরিবার বা নিদ্রাকে কেন বলতে পারছে না ও রুজবাকে ভালোবাসে। নিদ্রাকে বিয়ে করা ওর পক্ষে সম্ভব না? জারাফ কি তবে দুই নৌকায় পা দিয়ে চলছে? রুজবার সাথে সম্পর্কে থেকে ওকে ঠকাচ্ছে আবার নিদ্রা বা পরিবারের কাউকে’ও ক্লিয়ার ভাবে কিছু না বলে নিদ্রাকে মই বানিয়ে সফলতার দিকে এগিয়ে নিদ্রাকে’ও ঠকাচ্ছে?

অনেক সাধনার পরে পর্ব ১১

একসাথে দুই দুইটা মেয়েকে কি তবে ঠকাচ্ছে জারাফ? নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করছে জারাফ। কিন্তু এসবের কোনো উত্তরই জারাফের কাছে এসে ধরা দিচ্ছে না। সারাজীবনের জন্য কাকে চায় জারাফ? নিদ্রাকে? নাকি রুজবাকে? এটা জারাফ নিজেও ভেবে পাচ্ছে না।

অনেক সাধনার পরে পর্ব ১৩