অনেক সাধনার পরে পর্ব ৪৮

অনেক সাধনার পরে পর্ব ৪৮
অরনিশা সাথী

–“আলহামদুলিল্লাহ কবুল।”
রাত্রি নামের মেয়েটা কবুল বলতেই ঘরোয়া ভাবে জারাফ আর রাত্রির বিয়ে সম্পন্ন হলো। জারাফের ইচ্ছে নেই ঘটা করে আয়োজন করে বিয়ে করার। শুধুমাত্র দুই পরিবারের লোকজন আর নিজেদের কাছে দু/এক জন মুরুব্বি এবং সাহিল ছাড়া আর কাউকেই বলেনি জারাফ। বিয়েটা রাত্রিদের বাসা থেকেই হয়। মাগরিবের আযান হয়েছে ঘন্টা খানেক হবে। রাত্রির মা, ভাবীরা খাবার দাবারের আয়োজন করছে। রাতের খাবার খেয়েই রাত্রিকে নিয়ে ফিরবে জারাফ আর ওর পরিবার।

ছাদে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে জারাফ। আজ আকাশে একটা তারা’ও নেই। চাঁদটাও বার বার মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। অন্যদিনকার মতো মৃদু মন্দ বাতাস নেই। নেই কোনো পাখির ডানা ঝাপ্টানোর শব্দ। পরিবেশ’টা যেন একেবারে থম ধরে আছে, ঠিক জারাফের মনের মতোন। সিগারেটের শেষাংশ ফেলে দিয়ে ভাবছে,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

–“আজ থেকে সবটা নতুন ভাবে শুরু করতে হবে। যে মেয়েটা ওর জীবনে আজ থেকে সারাজীবনের জন্য জড়ালো তাকে কোনো ভাবেই ঠকাবে না, তার হক নষ্ট করবে না। বাস্তবতা মানতে হবে। রাত্রি নামের এই মেয়েইটা ওর অর্ধাঙ্গিনী, বাকীটা জীবন ওর সাথেই কাটাতে হবে। তাই চেষ্টা করতে হবে নতুন ভাবে নতুন উদ্যমে সবকিছু শুরু করার।”

ফুলে সাজানো বিছানায় মাথায় ঘোমটা টেনে বসে আছে রাত্রি। আজকের এই রাতটা নিয়ে ওর অনেক স্বপ্ন। অবশ্য আজকের এই দিনটা আর রাতটা নিয়ে সবারই কম বেশি স্বপ্ন থাকে, আশা থাকে। তেমনি রাত্রির’ও স্বপ্ন আছে। সাথে মনে ভয় কাজ করছে। মানুষটা কেমন হবে? বুঝবে ওকে? নাকি প্রথম রাতেই হামলে পড়বে কোনো পশুর মতো? এসব ভাবতে ভাবতেই দরজা লাগানোর শব্দে মৃদু কেঁপে উঠে সে। অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। কিছু ভয় কিছুটা ভালো লাগা। এ কেমন মিশ্র অনুভূতি? ভেবে পায় না রাত্রি। জারাফ সরাসরি রাত্রির সামনে এসে বসে। দু’হাতে ঘোমটা সরিয়ে থুতনি ধরে মুখটা উঁচু করে দেখে বলে,

–“মা-শা-আল্লাহ।”
ক্ষানিক লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে রাত্রি। লোকটা দেখতে যেমন সুদর্শন তার ভয়েসটা’ও তেমনি মা-শা-আল্লাহ। জারাফ নিজের পকেট থেকে একটা ছোট্ট বক্স বের করে। খুব সুন্দর কারুকার্য করা সোনার আংটি বের করে পড়িয়ে দেয় রাত্রির আঙুলে। রাত্রিকে প্রশ্ন করে,

–“পছন্দ না হলে বলো, কাল তোমাকে নিয়ে যাবো তারপর নিজে চুজ করে নিয়ে এসো।”
রাত্রি হাত উল্টে পাল্টে আংটি’টা দেখে। সবসময় পড়ে থাকার জন্য একদম পারফেক্ট একটা আংটি। ডিজাইন’টাও বেশ সুন্দর। রাত্রির ভীষণ পছন্দ হয় আংটি’টা। খুশি মনে বলে,
–“ভীষণ সুন্দর, আপনার পছন্দ চমৎকার বলতেই হয়।”
জারাফ মৃদু হেসে বলে,

–“চেঞ্জ করে এসো, একসাথে নামায পড়বো।”
রাত্রি সম্মতি জানিয়ে সুতি একটা শাড়ি নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। ততক্ষণে জারাফ রুমের মধ্যেই চেঞ্জ করে নেয়। রাত্রি একেবারে ফ্রেশ হয়ে উযু করে বের হলে জারাফ গিয়ে উযু করে আসে। অতঃপর দুজনে একসাথে দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করে নেয়।

বমি বমি ভাব লাগছে ফারিনের। সবেই খেয়ে শুয়েছিলো। হুড়মুড়িয়ে উঠে ওয়াশরুমে গিয়ে গলগল করে বমি করে দেয় সে। হন্তদন্ত হয়ে ছুঁটে যায় কিয়ান’ও। ফারিনের পিঠে মাথায় আলতো ভাবে হাত বুলায়। বেবি কনসিভ করার পর থেকেই ফারিনের শারীরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছে। খেতে পারছে না, খাবারের গন্ধ সহ্য করতে পারে না। জোরপূর্বক যা-ই একটু খায় সেইটুকু’ও বমি করে উগলে দেয়।

ক্লান্ত হয়ে পড়েছে ফারিন। কিয়ান ওর চোখমুখ ধুয়ে দেয়। কুলি করায়। অতঃপর ফারিনকে ধরে বিছানায় নিয়ে শোয়ায়। তারপর নিজে গিয়ে ওয়াশরুম পরিষ্কার করে ফারিনের পাশে গিয়ে শোয়। সাড়ে পাঁচ মাস চলছে ফারিনের। মেয়েটার এ কয়েক মাসেই বড্ড নাজেহাল অবস্থা। হাল নেই বললেই চলে। আলগোছে হাত বুলায় ফারিনের চুলে। ফারিন কিয়ানকে জাপ্টে ধরে বলে,

–“ভালো লাগছে না কিয়ান, অস্থির অস্থির লাগছে আমার।”
কিয়ান চুলে হাত বুলিয়ে বলে,
–“বেবি’টা নেওয়া বোধহয় ঠিক হয়নি আমাদের। আগে যদি বুঝতে পারতাম তোমার এরকম অবস্থা হবে তাহলে হয়তো___”
ফারিন মৃদু হেসে বলে,
–“ধুর পাগল, কষ্ট সহ্য না করে মা হওয়া যায় নাকি? মা হওয়া এত সহজ? চিন্তা করো না তো, তুমি পাশে থাকলে আমি সব সহ্য করে নিতে পারবো।”
কিয়ান কিছু না বলে আলতো ভাবে চুমু খায় ফারিনের কপালে।

মনমরা হয়ে বসে আছে রুজবা। নুহাশ অফিসে গিয়েছে। আসার সময় হয়ে এসেছে, কিন্তু তবুও কেমন যেন শূণ্য শূণ্য লাগছে। তার উপর মনে পড়ে গেলো ফারিনের মা হওয়ার কথাটা। ইশ্! এ সময়ে যদি ওর একটা বেবি থাকতো তাহলে নিশ্চয়ই তাকে নিয়েই সময় কেটে যেত। এত শূণ্য লাগতো না। দুই হাটুতে মুখ গুজে নিঃশব্দে কাঁদছে ও। সেসময়েই কাঁধে হাতের স্পর্শ পেলো। আঁতকে উঠে রুজবা। নুহাশ হলে নির্ঘাত রক্ষা নেই আজ। দ্রুত ওভাবেই চোখ মুছে মাথা তুলে তাকায়। নুহাশ শান্ত স্বরে প্রশ্ন করে,

–“কাঁদছিলে কেন?”
রুজবা হাসার চেষ্টা করে বলে,
–“কাঁদছি না তো।”
–“মিথ্যে বলা পছন্দ করি না রুজবা।”
–“একা একা লাগছিলো তাই____”

প্রত্যুত্তরে নুহাশ কিছু বললো না। শুধু তাকিয়ে রইলো। ও জানে রুজবা কেন কাঁদছিলো। রুজবা যেহেতু সত্যিটা বলতে চাইছে না তাই ও আর জোর করলো না। চুপচাপ ফ্রেস হতে চলে গেলো। রুজবা’ও আর আগের মতো মনমরা হয়ে বসে নেই। দ্রুত উঠে কিচেনে চলে যায়। ঝটপট কিছু একটা নাস্তা বানাতে হবে নুহাশের জন্য। সেই যে দুপুরে লাঞ্চ করেছে, এরপর আর নিশ্চয়ই কিছু পেটে পড়েনি।

এক চুলোয় চা’য়ের পানি বসালো, নুহাশের আবার কফি’র থেকে চা বেশি পছন্দ। এবং ফ্রিজ থেকে ফ্রোজেন সমুচা আর চিকেন ফ্রাই গুলো বের করে অন্য চুলোয় ভাজার জন্য তেল গরম করছে। সমুচা ভাজা শেষ, চিকেনগুলো ভাজছে। সেসময়ে একজোড়া হাত পেছন থেকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নেয় রুজবাকে। রুজবা মুচকি হাসে। লোকটার স্পর্শ ওর চেনা। এখন আর স্পর্শ পেলে ভয়ে আঁতকে উঠে না বরং ঠোঁটে মৃদু হাসির রেখা ফুঁটে উঠে। এই লোকটা ওর ভীষণ কাছের। সবথেকে বেশি কাছের। এ মানুষটা সবসময় এভাবে ওকে আগলে রাখলে ওর পাশে থাকলে আর কিচ্ছু চাই না ওর।

ক্ষানিক আগেই ফারিনের সাথে কথা বললো রুজবা। ফারিনের সাড়ে আট মাস চলছে বেবি পেটে আসার। ছেলে বাবু হবে ওর। প্রেগন্যান্সির সময়টা ফারিন শারীরিক ভাবে বেশ অসুস্থতার মধ্য দিয়েই কাটাচ্ছে। রুজবার মন ছুঁটে যাচ্ছে দেশে যাওয়ার জন্য কাছ থেকে সবাইকে দেখার জন্য। আর বিশেষ করে যে নতুন অতিথি আসতে চলেছে তাকে ছুঁয়ে দেখার জন্য মন ব্যাকুল হয়ে আছে যেন।

অফিস থেকে ফিরে রুজবাকে বিছানায় চুপচাপ বসে থাকতে দেখে নুহাশ ভ্রু কুঁচকে ফেলে। ফোনটা টি-টেবিলে রেখে ট্রাওজার আর টাওয়াল নিয়ে ওয়াশরুমে যেতে যেতে প্রশ্ন ছুঁড়ে,
–“এত মনোযোগ দিয়ে কি ভাবা হচ্ছে ম্যাডাম?”
–“ফারিন আর কিয়ান ভাইয়ের মেয়ের নাম। কি রাখা যায় বলুন তো?”
–“সে দুনিয়াতে আসতে এখনো তো কয়েকটা দিন বাকী___”
–“তো কি হয়েছে? যে কোনো সময়ে চলে আসবে তো। আমি আগেভাগেই নাম ঠিক করে রাখবো। পরে দেখা যাবে___”

–“আচ্ছা আচ্ছা! আগে শাওয়ার নিয়ে আসছি তারপর দুজনে একসাথে বসে নাম ঠিক করবো ওকে?”
রুজবা মুচকি হেসে মাথা নাড়াতেই নুহাশ ওয়াশরুমের দরজা আটকে দেয়।
মিনিট পনেরো বাদে গোসল সেরে বের হতেই নুহাশের নজরে পড়লো ফাঁকা বিছানা। রুজবা নেই, তাই নুহাশ ভাবলো প্রতিদিনকার মতো হয়তো বা কিচেনে নাস্তা বানাচ্ছে। নুহাশ নিশ্চিন্ত মনে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল ঝেড়ে জেল লাগাতে শুরু করলো।

গায়ে টি-শার্ট জড়িয়ে পেছনে ঘুরতেই ফ্লোরে নজর যায় নুহাশের। রুজবা পড়ে আছে ফ্লোরে। এক মূহুর্তের জন্য নুহাশ নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না। সেকেন্ড তিনেক থম মেরে দাঁড়িয়ে থেকে হুঁশ ফিরতেই দ্রুত কদমে রুজবার কাছে গিয়ে বসে। কোলে তুলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয় আলগোছে।

অনেক সাধনার পরে পর্ব ৪৭

চোখমুখে পানির ছিঁটা দিয়ে গালে হালকা চা/প/ড় মেরে ডাকতে থাকে। কিন্তু কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। নুহাশ আর দেরী না করে দ্রুত ওকে কোলে তুলে নিয়ে বেরিয়ে যায় বাসা থেকে। উদ্দেশ্য রুজবাকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া।

অনেক সাধনার পরে শেষ পর্ব