অনেক সাধনার পরে পর্ব ৪৬

অনেক সাধনার পরে পর্ব ৪৬
অরনিশা সাথী

আসাদ সাহেব নিজে রোমান সাহেবের কাছে ফোন দিয়ে ওদের থাকার জন্য অনুমতি নেয়। সকলেই ভীষণ খুশি আসাদ সাহেব ওদের মেনে নেওয়াতে। সকালে বাবা-মেয়ের মিলনের পরেই আসাদ সাহেব দ্রুত বাজারে যান। মেয়ে জামাই এই প্রথম বাড়িতে এসেছে। বাজার সদাইয়ের একটা ব্যাপার স্যাপার আছে না?

ভালো মন্দ রেঁধে বেড়ে খাওয়াতে হবে তো। তাই তিনি আর দেরি করেনি বাজারে যেতে। ফাহিমা বেগমও তৎক্ষনাৎ রান্না বসিয়ে দেয়।
খাবার টেবিলে একসাথে খেতে বসেছে আসাদ সাহেবের পরিবার। পরিবার বলতে উনার স্ত্রী, দুই মেয়ে, আর মেয়ের জামাই অর্থাৎ কিয়ান। টেবিলের প্রায় সব খাবারই কিয়ানের হাতের কাছে, প্লেটের আশেপাশে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

অনেক পদ রান্না করেছে ফাহিমা বেগম। এলাহি আয়োজন করে ফেলেছে কিছু মূহুর্তেই। সকলেই খাওয়া শুরু করেছে। আসাদ সাহেব এটা ওটা উঠিয়ে দিচ্ছে কিয়ানের প্লেটে। ফাহিমা বেগম আর ফারিনকে’ও বলছে দিতে। কিয়ান খাওয়া বাদ দিয়ে শুকনো ঢোক গিলে ফারিনের দিকে তাকায়। ফারিন মুখ টিপে হেসে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে খাওয়ায় মনোযোগ দেয়৷ ফাহিমা বেগম বড় মাছের মাথা কিয়ানের প্লেটে দিতে যেতেই কিয়ান অসহায় স্বরে বলে,

–“আর না প্লিজ। অলরেডি আমার প্লেট মাছ মাংসে ভর্তি, এগুলো শেষ করতে পারি কিনা সন্দেহ। আর দিয়েন না, লাগলে আমি নিয়ে নেবো।”
ফাহিমা বেগম তবুও দিতে চাইলেন মাছের মাথাটা। ফারিন তখন বারণ করে। হাঁফ ছেড়ে বাঁচে কিয়ান। অতঃপর সকলে মিলে বেশ তৃপ্তি সহকারে খাওয়া দাওয়া শেষ করে।

নিদ্রা’র বিয়ে আজ। জারাফের সাথে নয়। কয়েক মাস আগে হওয়া বিএফ রাহাতের সাথে। ঘরোয়া ভাবেই আয়োজন সারবে জহির সাহেব। জারাফ’রা স্ব-পরিবারে উপস্থিত। জারাফের আসার কোনো ইচ্ছে ছিলো না, জারাফের মা একপ্রকার জোর-জবরদস্তি করেই নিয়ে এসেছে। জহির সাহেবের জন্যই আজ এই অবস্থানে আছে জারাফ৷ বেশ সচ্ছল ভাবে নিজের পরিবার চালাচ্ছে।

হ্যাঁ জারাফের মায়ের’ও খারাপ লাগছে। নিদ্রা’র সাথে বিয়ে ঠিক, আংটি পড়ানো অব্দি ছিলো শুধুমাত্র ডেট দেওয়াটা ছাড়া। অথচ এই মেয়ে কিনা উনার ছেলে’কে ঠকিয়ে অন্য ছেলের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে আজ তাকে বিয়ে করছে? জারাফের কাছে বেশ অপমানের বিষয় এটা। জারাফের মায়ের কাছেও তাই। তবুও আসতে বাধ্য হয়েছে উনারা। জহির সাহেব বেশ লজ্জিত, ক্ষমা’ও চেয়েছেন বারবার।

উনার মুখের দিকে তাকিয়েই আসা৷ রাহাত আর নিদ্রা পাশাপাশি বসে আছে। দুজনের মুখেই প্রিয়জনকে সারাজীবনের জন্য নিজের করে পাওয়ার খুশি উপচে পড়ছে। মানিয়েছে দুজনকে বেশ। বিয়ে পড়ানো শুরু হলো, জারাফের লজ্জায়, অপমানে মুখটা ফ্যাঁকাসে হয়ে আছে। তাই সেখান থেকে উঠে নিদ্রা’দের বাসার ছাদে উঠে যায়। জারাফের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে নিদ্রা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে বলে,

–“আই এম স্যরি জারাফ। আমার আর কিছু করার ছিলো না। তোমাকে ভীষণ পছন্দ ছিলো আমার। পছন্দটা ততদিন অব্দি ছিলো যতদিন অব্দি রুজবা নামের ওই মিষ্টি মেয়েটা আমার অজানা ছিলো৷ তোমার ক্যারিয়ার আর টাকার জন্য তুমি রুজবাকে ছেড়ে আমাকে চুজ করেছিলে, ভালোবেসে চুজ করোনি। কিভাবে থাকতাম তোমার সাথে আমি?

টাকার জন্য রুজবাকে ছেড়ে আমায় চুজ করেছো, দুদিন বাদে টাকার পেছনে ছুটতে গিয়ে আমাকেও যে ছুঁড়ে ফেলবে না তার কোনো গ্যারান্টি ছিলো না তো। রুজবাকে ভালোবেসেও টাকার জন্য ছেড়েছো, আর সেখানে তুমি আমাকে চুজ’ই করেছিলে টাকার জন্য। তোমার চোখে আজও মাঝে মাঝে রুজবার জন্য যে ভালোবাসাটা দেখা যায় সেটা আমার জন্য কখনোই দেখিনি আমি। তাই রিস্ক নিলাম না তোমায় বিয়ে করার।

রুজবা তো লাইফে বেস্ট পারসোন পেয়েছে, যে রুজবাকে প্রতিনিয়ত ভালো রাখছে, অনেক অনেক ভালোবাসা দিচ্ছে। আমি যে নিঃস্ব হয়ে যেতাম একেবারে, তাই তো সরে এসেছি। হ্যাঁ আমার সরে আসার ধরণটা ভূল ছিলো, আমি তোমাকে ঠকিয়েছি। কিন্তু আমি এরকমটা না করলে যে তুমি রুজবার কষ্ট’টা কোনো কালেই বুঝতে না৷ পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও। আল্লাহ’র কাছে দোয়া করি তুমিও লাইফে বেস্ট একজনকেই পাও যাতে।”

ছাদে দাঁড়িয়ে একাধারে সিগারেট টানছে জারাফ। জারাফের যখন প্রচন্ড রাগ হয় বা কষ্ট লাগে, তখনই ও মাত্রাতিরিক্ত সিগারেট টানে। এটা ওর ব্যাড হ্যাবিট বলা যায়। একদিকে সিগারেটের ধোঁয়া শূণ্যে ছাড়ছে অন্যদিকে চোখ দিয়ে টপটপ করে অশ্রু ঝড়ছে। জারাফ নিদ্রা’কে ভালোবাসে না তবুও ওর থেকে ঠকে গিয়ে এতটা কষ্ট হচ্ছে ওর। আর রুজবা ওকে ভালোবেসে ঠকেছিলো তাহলে সেই মূহুর্তে রুজবার মনের অবস্থা কেমন ছিলো আজ বেশ ভালো ভাবেই বুঝতে পারছে সে।

সে কাঁদছে আজ, সেদিন রুজবার ভালোবাসা পায়ে ঠেলে দূর দূর করার জন্যই আজ কাঁদছে সে। নিদ্রা’র জন্য না। নিদ্রা’র জন্য ভালোবাসা ছিলো না তো। ভালোবেসেছিলো নিদ্রা’র বাবার টাকাকে। আর রুজবাকে ভালোবেসেছিলো সে মন থেকে। দুজন দুজনকে ভালোবেসেছে। তবুও টাকার মোহে আটকে সেই ভালোবাসা নিজের ভুলে হারিয়ে ফেলেছে। এসব ভাবছে আর কষ্টে বুক চিনচিন করছে তার। পরমূহুর্তে কষ্ট’টা আরো মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো নুহাশের কথা মনে হতেই। ছেলেটা রুজবাকে প্রতিনিয়ত স্পর্শ করে। রুজবার স্বামী নুহাশ, যা এই মূহুর্তে এসে মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে জারাফের। কাঁধে হাতের স্পর্শ পেতেই চোখের পানি মুছে পেছন ফিরে তাকায়। জুহিকে দেখে হাতের সিগারেট ফেলে দিয়ে পায়ে পিষে। জুহি প্রশ্ন করে,

–“নিদ্রাপুর জন্য কষ্ট হচ্ছে? নিদ্রা’পুকে অনেক ভালোবেসে ফেলেছো তাই না?”
–“নাহ।”
–“কষ্ট না হলে, ভালো না বাসলে কাঁদছো কেন?”
–“তুই সেদিন ঠিকই বলেছিলি, রুজবার চোখের পানির ভার আমি সইতে পারছি না রে আজ। মনে হচ্ছে কয়েকশ টন ওজনের ভারী পাথর আমার বুকে চাপা দিয়ে রেখেছে কেউ। রুজবা’কে ভালোবেসেছিলাম আমি, আর নিজের ভালোবাসার মানুষটাকেই ঠকিয়েছি দিনের পর দিন। একটা সময় তো পায়ে ঠেলে দূরে সরালাম। আজ দেখ তার মতো করেই আমিও কারো পেয়ে ঠেলার জিনিস। নিদ্রা’ও আমাকে পায়ে ঠেলে দূরে সরালো। তফাৎ শুধু রুজবাকে ভালোবেসেছিলাম মন থেকে। আর নিদ্রা’কে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম সফলতার জন্য, টাকার জন্য। দিনশেষে নিদ্রা’কে ভালো না বেসেও আজ আমি ঠকে গেলাম।”

জুহির কষ্টে চোখে পানি চিকচিক করছে। ওর ভাইয়ের কষ্ট ওর কিছুতেই সহ্য হচ্ছে না। হ্যাঁ ওর ভাই রুজবাকে ঠকিয়েছে, প্রেমিক হিসেবে খারাপ ছিলো। কিন্তু ভাই হিসেবে তো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাই সে। সেই ভাইয়ের কষ্ট সহ্য করবে কি করে সে? আচমকা জারাফকে জড়িয়ে ধরে হুঁ হুঁ করে কেঁদে দেয়। জারাফ বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে মেকি হেসে বলে,

–“কাঁদছিস কেন পাগলি?”
জুহি কাঁদতে কাঁদতে বলে,
–“তুমি একদম কষ্ট পেও না ভাইয়া। লাল টুকটুকে বউ এনে দেবো তোমায়। যে তোমাকে নিদ্রা’পুর প্রতারণার কথা আর রুজবা’পুর ভালোবাসার কথা কখনোই মনে পড়তে দেবে না আর। যে তোমাকে তার সবটুকু ভালোবাসা দিয়ে নিদ্রা’পু আর রুজবা’পুকে ভুলিয়ে দেবে।”
বোনের কথায় এত কষ্টের মাঝেও একগাল হাসে জারাফ।

ঘড়ির কাটায় ঠিক রাত নয়টা বেজে পঞ্চাশ মিনিট৷ নুহাশ বেরিয়েছে বিকেলে। যাওয়ার আগে বলেছে যে সাইটে ওদের নিউ প্রজেক্টের কাজ চলছে সেখানে যাচ্ছে একটু। সবকিছু ঠিকঠাক চলছে কিনা সেটাই দেখতে যাবে। এটা’ও বলেছিলো, সাতটা সাড়ে-সাতটা নাগাদ ফিরবে সে। অথচ এখন দশটা বাজতে আর মাত্র দশ মিনিট বাকী আছে। রুজবা সারা বাড়িতে পায়চারি করছে। ওর একা একা ভালো লাগছে না।

একটু ভয় ভয় লাগছে। পুরো বাড়িতে ও একা। ভয় তো লাগবেই। নুহাশের উপর রাগ হচ্ছে ওর, ভীষণ রকমের রাগ যাকে বলে। এজন্যই ও নিজের পরিবার ছেড়ে এত দূরে আসতে চায়নি। কিন্তু নুহাশ তা শুনলে তো। দশটা বেজে পাঁচ মিনিটে কলিং বেল বেজে উঠে। রুজবা ওঠে গিয়ে দরজা খুলে দেয়। নুহাশকে দেখেই অভিমানে গাল ফুলিয়ে বেডরুমের দিকে হাঁটা দেয়। নুহাশ দরজা আটকে দ্রুত বউয়ের পেছনে যায়।

তার বউ যে আজ রেগে বোম হয়ে আছে এটা সে হান্ড্রেড পার্সেন্ট সিয়র। চাদড় মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েছে রুজবা। নুহাশ আর বিছানায় গেলো না। কাবার্ড থেকে টাওজার আর টাওয়াল নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে যায়। মিনিট দশেক বাদে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে আসে সে। শুধু টাওজার পড়া আর গলায় টাওয়াল ঝুলানো। টাওয়ালটা সোফায় রেখে বিছানায় চলে আসে। চাদড়ের ভেতর ঢুকে গিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে রুজবাকে। রুজবার চুলে নাক ঘঁষে বলে,

–“রেগে আছো রুজবা?”
–“না তো, মহা আনন্দে আছি।”
–“আচ্ছা? মহা আনন্দে থাকলে তো এতক্ষণে এদিকে ঘুরে আমার গলা জড়িয়ে ধরে আমার ঠোঁটে ঠাস করে দুটো চুমু খাওয়ার কথা ছিলো। চুমু না খেয়ে উলটো ঘুরে আছো কেন?”

রুজবা তৎক্ষনাৎ ঘুরে যায় নুহাশের দিকে। নুহাশের গলা জড়িয়ে ধরে দাঁত দিয়ে শক্ত করে কামড়ে ধরে নুহাশের নিচের ঠোঁট। তীব্র ব্যথা’টাও হজম করে নেয় নুহাশ হাসিমুখে। রুজবাকে জড়িয়ে ধরে ওভাবেই শুয়ে থাকে৷ রুজবা ক্ষানিক বাদেই ছেড়ে দেয় নুহাশকে৷ ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে দেখে ওর দাঁতের দাগ বসে গেছে একেবারে। ফুলে উঠেছে ঠোঁট। তৎক্ষনাৎ দু’চোখ জলে ভরে উঠে। রুজবা কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে,

–“কেমন মানুষ তুমি? এত জোরে কামড়ে ধরেছি তবুও ব্যথায় কোনো টু-শব্দ করলে না।”
–“রাগ কমেছে?”
নুহাশের ঠোঁটে কামড়ে দেওয়া স্থানে রুজবা ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয় প্রথমে। তারপর নুহাশের কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে বলে,

অনেক সাধনার পরে পর্ব ৪৫

–“তোমাকে এভাবে কষ্ট দিয়ে আমি রাগ কমাতে চাই না।”
নুহাশ রুজবার কপালে চুমু দিয়ে ফিসফিস কন্ঠে বলে,
–“তোমার জন্য সব কষ্ট সইতে প্রস্তুত আমি।”

অনেক সাধনার পরে পর্ব ৪৭