প্রেয়সী পর্ব ৬৭

প্রেয়সী পর্ব ৬৭
নন্দিনী নীলা

মধু কে জোর করেও ফুয়াদ হসপিটালে নিতে পারল না। মধুর এক কথা একজায়গায় ঘুরতে এসেছি এখন হসপিটালে গিয়ে আর মন খারাপ করতে চাই না‌‌। সবাইকে টেনশনে ও ফেলতে চাই না। তাই ফুয়াদ রাগে শক্ত হয়ে বসে আছে। মধু শুয়ে ফুয়াদের রাগী মুখের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে।
মধু অনেক কষ্টে হাসি চেপে রাখলো‌। কখন না জানি হাসির শব্দ ফুয়াদের কানে চলে যায়। মধু নিজের হাসি নিয়ন্ত্রণ করে ফুয়াদ কে ডাকল।

” এই যে শুনছেন? একটু তাকান না আমার দিকে!” আকুতি ভরা কন্ঠে বলল মধু।
ফুয়াদ আগের ন্যায় ই বসে আছে তাকাচ্ছে না মধুর দিকে। রাগে ও গজগজ করছে বসে।
মধু ফুয়াদের বাহু ধরে টেনে বলল,,” এতো রাগ করছেন কেন? আমার সত্যি তেমন কিছু হয়নি। গ্যাস্ট্রিকের জন্য হয়তো বমি হচ্ছে। গ্যাসের ট্যাবলেট খেলেই ঠিক হয়ে যাবে।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ফুয়াদ তাও ওর দিকে তাকাচ্ছে না। মধু উঠে ফুয়াদের গলা জড়িয়ে ধরে বলল,,” আপনার কি আমার জন্য চিন্তা হচ্ছে! নাকি সমুদ্র ভাইয়া কারো সাথে দেখা না করেই চলে গেল তাই রাগ হচ্ছে?”
ফুয়াদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,,” ভাইয়া তোমাকে কিছু বলেছে?”

মধু বলল,,” বলতে চেয়েছিল কিন্তু আমি শুনিনি। আমার কাছে অদ্ভুত লেগেছে, তার কথা শুনতে ইচ্ছে করেনি। আল্লাহ ও চায়নি আমি তার কথা শুনি তখনি আমার বমি হয়ে গেছে আর কথা থেমে গেছে।”
ফুয়াদ মধু কে কাঁধ থেকে টেনে ওর মুখটা দুহাতের মুঠিতে নিয়ে বলল,,” কেমন অদ্ভুত লেগেছে?”
মধু ফুয়াদের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারছে না‌। ওর কথা কি ফুয়াদ বিলিভ করবে?
” মধু বলো আমি শুনতে চাই।”

মধু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাঁপা কন্ঠে বলল,,” আমি বলতে পারব না। কিন্তু সমুদ্র ভাইয়ার কাছাকাছি থাকতে আমি আন‌ইজি ফিল করি। তার তাকানো, তার চোখের দিকে তাকালে আমার ভালো লাগে না‌। তার মুখ থেকে আমি ওমন কিছু শুনতে চাই না যেটা আমি উনার চোখের ভাষায় পড়তে পারি।”
ফুয়াদ মধুর গাল থেকে হাত সরিয়ে বলল,,” তোমার এখন ভালো লাগছে?”
মধু বলল,,” হুম।”

ফুয়াদ মধু কে বলল,,” তাহলে ওই ল্যাকেজে থেকে লাল ডায়েরি টা নিয়ে আসো।”
মধু চমকে তাকাল ফুয়াদের দিকে। ফুয়াদ অন্যদিকে তাকিয়ে আছে।
” সত্যি আমি আনব ওটা?”
” হুম।”

মধু লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নেমে ডায়েরিটা নিয়ে আসলো। ফুয়াদ মধুর হাত থেকে ডায়েরি নিল না ওর দিকে তাকিয়ে বলল,,” মধু তুমি চাইলে এই ডায়েরি টা পড়তে পারো।”
মধু অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে আছে ফুয়াদের দিকে। উত্তেজনায় ওর হাত পা কাঁপছে। ওদিন ফুয়াদ যে ধমক দিয়েছিল আজ নিজ থেকেই পড়তে দিচ্ছে‌। ও বিস্মিত নয়নে ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে বলল,,” আপনি না বললেন অন্যের পার্সোনাল কিছু পড়তে হয়না।”

” হ্যাঁ বলেছিলাম কিন্তু আমি চাইনা তুমি তার মুখ থেকে কিছু শোনো। জানতে চাইলে এটা পড়েই জানো।”
মধু আর ফুয়াদের কথায় কান দিল না ও ডায়েরিটা খুলল। প্রথম পেজে তাকাতেই ও চমকে উঠল ওর ছবি আঁকা পেন্সিলের কালি দিয়ে। ও ঢোক গিলে তাকিয়ে আছে। ওর ছবির নিচে লেখা “প্রেয়সী” মধু হতবিহ্বল চক্ষে তাকাল ফুয়াদের দিকে ফুয়াদ মাথা নিচু করে বসে আছে।
ওর মুখের ভঙ্গি দেখে মধু বুঝতে পারছে না মনের খবর।

মধু কথা বলার জন্য ঠোঁট নাড়ানোর আগেই ফুয়াদ বলল,,” কোন প্রশ্ন করবে না‌। আগে এটা কমপ্লিট করো উত্তর এখানেই আছে।”
মধু সব কথা গিলে পেজ উল্টালো। ওর বুকের ভেতরটা ধুকপুক করছে। এটা ফুয়াদের ডায়েরি না তাহলে কে ওকে নিয়ে এই রোমাঞ্চিত ডায়েরি লিখেছে? আর এটা ফুয়াদ কোথায় পেল? এজন্য বলে জার্নালিস্টের চোখে ফাঁকি দেওয়া কষ্ট কর। ফুয়াদ এসব দেখেই কি ওকে ভুল বুঝে ওর সাথে খারাপ আচরণ করছে? কিন্তু ও তো এসব কিছুই জানে না‌। মধু পরের পেজে দেখল লেখা,,

“ মধু, তুমি আমার কাছে আমার হৃদয়ের প্রেয়সী। ভালোবেসে আমি তোমায় চেয়েছি। তোমাকে দেখলে আমার বুকের ভেতরটা কাঁপে। কাছে পাবার জন্য পাগল হয়ে থাকি। মন চায় একটু ছুঁয়ে দেই। কিন্তু পারি না তুমি যে আমার কাছে আমার হৃদয়ের প্রেয়সী। তোমার ভালোবাসা নিয়েই তোমাকে কাছে চাই।”

মধু আর পড়তে মন চাইছে না। ও রাগে গজগজ করছে কার এতো বড়ো সাহস ওকে নিয়ে এসব লিখে।
মধু পর পর আর কোন পেইজের লেখা পড়ল না। ও শুধু দেখে গেল বেশি লেখা নাই‌। কিন্তু যতটুকু আছে তাতেই কাউকে বশ করার ক্ষমতা আছে। এতো গভীর লেখা কেউ ওকে নিয়ে লিখেছে সেটা ফুয়াদ দেখেছে তার কেমন লেগেছে? নিজের ওয়াইফ কে নিয়ে অন্য পুরুষের লেখা অনুভূতি তাকে কতটা কষ্ট দিয়েছে। মধুর রাগে মাথা খারাপ হয়ে গেল এই লোকটাকে পেলে তাকে ও কি করতো নিজেও জানে না। লোকটা হয়ত ছবি আঁকায় উস্তাদ‌। ওর বিভিন্ন রকমের ছবি এঁকে ভরিয়ে রেখেছে। আর নিচে লেখা,,“ আমার প্রেয়সী”

দাঁতে দাঁত চেপে মধু সব পেজ হজম করতে পারলেও লাস্টের দিকে এসে ও আর সহ্য করতে পারল না‌। কারণ সমুদ্র আর ওর একটা ছবি আঁকা। তার নিচে লেখা,,“ মধু তুমি শুধু সমুদ্রের প্রেয়সী ”
মধুর হাত মুখে চলে গেল। ও দুহাতে মুখ সেপে ধরে অবাক চোখে তাকাল ফুয়াদের দিকে। এমন কিছু ওর জন্য অপেক্ষা করছিল ও কল্পনাতে ও ভাবে নি। ও ঢোক গিলল। ওর বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটা হচ্ছে। যে ভয়টা পাচ্ছিল সেটাই হয়েছে। ফুয়াদ সব জেনে গেছে কিন্তু কীভাবে? ফুয়াদ এখনো আগের ন্যায় বসে আছে। মধু ডায়েরি ছুড়ে ফেলে দিল তারপর ফুয়াদের বাহু খামচে ধরে বলল,,” আপনি এটা কোথায় পেয়েছেন?”

” ভাইয়ার রুমে।”
” আপনি ভাইয়ার রুম সার্চ কেন করতে গেলেন? এসব বুঝলেন কিভাবে?”
ফুয়াদ বলতে লাগল,,” আমি সেইদিন থানায় গিয়ে ওই নার্সের সাথে দেখা করি। তার কাছে থেকেই জানতে পারি সমুদ্র ভাইয়া তাকে টাকা দিয়ে আমাকে মারতে পাঠিয়ে ছিল।”

বলতে বলতে ফুয়াদের চোখের কোনায় পানি জমতে লাগল। মধু বলল,,” আমি আগে থেকেই জানি এসব কিন্তু আপনাকে বলতে পারিনি। আপনি অনেক বেশি ভালোবাসেন ভাইকে। আপনাকে আমি কষ্ট দিতে চাই নি। কিন্তু এসব অনেক পড়ে জেনেছি যখন থেকে বুঝেছি তখন থেকে আমি সমুদ্র ভাইয়ার থেকে দূরত্ব বজায় রাখি।”

ফুয়াদের গলা কাঁপছে ও তাও বলল,,” যে ভাই আমাকে কোলে পিঠে করে মানুষ করল। আমার একটু আঘাত লাগলে ভাইয়া কেঁদে দিতো জানো মধু। সেই ভাই আমাকে মারতে লোক পাঠিয়েছে এটা আমি বিলিভ করতে পারি নি। আমি ভাইয়াকে খুঁজতে পাগল হয়ে গেলাম তখন আমার সাথে দেখা করল মিতুল। তার মাধ্যমে জানতে পারলাম আসল রহস্য। ভাইয়া, তোমার ভাই, মিতুল তিনজন মিলে আমাকে কিডন্যাপ করেছিল। কিন্তু আমি সমুদ্র ভাইয়ার নাম জানতে পারিনি শুধু ওদের দুজনের নাম জেনেছিলাম।

মিতুল আমাকে জানালো সব আর এটাও বলল সমুদ্র ভাইয়া এসব কেন করেছে সে নাকি তোমাকে চায়। তোমার জন্য এতো কিছু করেছে। আমি নিজের কান কেও বিলিভ করিনি। মিতুল কে থাপ্পড় মেরে চলে এসেছি মিতুল বলেছিল প্রমাণ নাকি ভাইয়া রুমেই আছে। আমি নিজের যন্ত্রণায় ছটফট করেছি। কাতরেছি তোমাদের কাউকে আমি আমার যন্ত্রণা বলতে পারি নি। আমি নিজের মনকে শান্ত করতেই ভাইয়ার রুম সার্চ করি‌। আর এই ডায়েরিটা পাই। বিলিভ করো মধু এটা দেখে আমার মরে যেতে ইচ্ছা করেছে। ভাইয়া আমার দেহে মারতে না পারলেও হৃদয় এ মেরে দিয়েছে। আমার নিজের ভাই আমাকে মারতে চায় একটা মেয়ের জন্য!”

মধু ফুয়াদ কে বলার মতো কোনো শব্দ পেল না খোঁজে। ফুয়াদের মুখটার দিকে ও অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ফুয়াদের বাম চোখের কোনায় জল চিকচিক করছে। কতটা কষ্ট পেয়েছে ফুয়াদ সব জেনে?
ফুয়াদ আবার বলল,,” ভাইয়া তোমাকে ভালোবাসে এটার জানার থেকে ও যন্ত্রণা পেয়েছি সে আমাকে মারতে চায় এটা জানার পর।”
” আপনাকে আমি কি বলে সান্ত্বনা দেব আমার জানা নাই‌।”

বলে মধু ফুয়াদের বাহু জড়িয়ে ধরে মাথা রাখল। ফুয়াদ মধু একটা হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,,” ভাইয়ার কি একবার ও আমার জন্য বুক কেঁপে উঠে নি? সে প্রতি পদে আমাকে মারতে চায়? অথচ ভাইয়া চাইলে আমি নিজেই তার জন্য এই জীবন টা শেষ করে দিতাম। সে কেন আমার সামনে আসছে না? সে ভয় পাচ্ছে আমাকে আমি আমার ভাইকে কিছু বলব না মধু শুধু একবার তাকে সামনে এসে দাঁড়াতে বলো। তার কাছে আমার একটাই প্রশ্ন, আমি জানতে চাই সে কি আর তার ছোটো ভাইকে ভালোবাসে না। আমি মরে গেলে কি সে বিন্দু পরিমাণ কষ্ট ও পাবে না? সে আমার থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে কেন?”

” আপনার কিছু হলে আমার কি হবে? আপনি নিজের ভাইকে ভালোবাসেন ঠিক আছে কিন্তু নিজের জীবনের মায়া আপনার না থাকলেও আমার স্বামীর জীবন আমার সব। আপনি না থাকলে আমি তো ভালো থাকব না‌। আপনার কিছু হতে আমি দেব না উনাকে আমি পুলিশে দেব।” ক্রোধের সাথে বলল মধু।

” আমি আমার ভাইকে পুলিশের হাতে দিতে পারব না মধু।”
” পুলিশে দিতে পারবেন না কিন্তু নিজে মরতে পারবেন তাই তো?”
” হুম।”

প্রেয়সী পর্ব ৬৬

মধু কঠিন মুখ করে বলল,,” আপনার ভাইকে আমি আরেকবার হাতের কাছে পেলে নিজেই খুন করে জেলে যাব।”
রাগে মধুর নাক লাল হয়ে উঠল।

প্রেয়সী পর্ব ৬৮