প্রেয়সী পর্ব ৭৬

প্রেয়সী পর্ব ৭৬
নন্দিনী নীলা

দুইদিন হয়ে গেল মধু সমুদ্রের কাছে বন্দী। এই দুইদিন এক ফোঁটা পানিও পান করেনি মধু। সমুদ্র খাবার এনে মধুর পাশে বসল।
মধু ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। সমুদ্র ফারাহর দিকে তাকিয়ে বলল,, “মেয়েটার জন্য অন্তত খাও। তুমি না খেলে ও কিভাবে খাবে? ঠিকমতো খেতে না পেয়ে ও মেয়েটা দেখো কি সুন্দর ঘুমাচ্ছে।”
মধু অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালো সমুদ্রের দিকে। তারপর রাগে ফেটে পড়ে বলল,,”আমি মরে যাব না খেয়ে তবুও কিছু মুখে তুলবো না।”

“তোমার না হয় নিজে চিন্তা নাই মেয়ের চিন্তাও কি নাই?”
“না আমার কারো চিন্তা নাই। আপনার কাছে থাকার থেকে আমাদের মরে যাওয়া ভালো।”
সমুদ্র হাত উঁচু করেছিল মধুর গালে থাপ্পর মারার জন্য। কিন্তু মারতে পারল না সমুদ্র আবার হাত গুটিয়ে নিয়েছে।
সমুদ্র রুম থেকে বেরিয়ে এলো। কি করবে ও নিজেও বুঝতে পারছে না। এভাবে চলতে থাকলে মধু মরে যাবে।
যাকে ভালোবাসা তাকে তিলে তিলে মরতে কিভাবে দেখবে? সমুদ্র একজন কে কল করল। ওপাশে থেকে ফোন রিসিভ করেই বললেন,, “তোমরা দেশ ছাড়ছো কবে? এদিকে ফুয়াদ তো পাগল হয়ে গেছে, হন্যে হয়ে খোঁজে যাচ্ছে তোমাদের একবার হাতের কাছে পেলে ভাই বলেও হয়তো আর ছাড় পাবে না।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সমুদ্র বলে উঠল,,”আমি মধুকে ছেড়ে দেবো ভেবেছি আজকে। ও আমার কাছে থাকবে না ওর মনের কোথাও আমি নেই। ও মৃত্যুকে বরণ করে নিবে কিন্তু আমাকে গ্রহণ করবে না।”
মাহতিম হোসেন হুংকার দিয়ে বললেন,,,”তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে? এতো দূরে এসে এখন মধুকে ছেড়ে দেবে। ও আমার মেয়ে আমার মেয়ের সব দায়িত্ব আমি তোমাকে দিয়েছি। মধুকে নিয়ে তুমি দেশের বাইরে চলে যাও। কয়েকদিন গেলে এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে।”

“কিছু ঠিক হবে না। আমি মধুকে ভালোবাসি। আমি ওর সাথে জোর জবরদস্তি করতে পারবো না। ওর কষ্ট আমি সহ্য করতে পারছিনা। দুই দিন ধরে ওকে আমি এক ফোঁটা পানি ও পান করাতে পারি নি। এভাবে থাকলে ও মরে যাবে। আমি ওকে নিঃশেষ হতে দেখতে পারবো না।”

মাহতিম হোসেন বললেন,,”এবার মধু কে হারালে তুমি কিন্তু আর কোনদিন মধুকে পাবে না কথাটা মাথায় রেখো।”
মধুর আওয়াজ পেয়ে সমুদ্র তাড়াতাড়ি কল কেটে দেয়। মধু রাগান্বিত স্বরে বলল,,”আপনি কার সাথে কথা বলছিলেন? কে আছে আপনার পেছনে যে কলকাঠি নাড়ছে?”
সমুদ্র থতমত খেয়ে বলল,,”তুমি এখানে কি করছো?”
“আমার প্রশ্নের জবাব দিন!”

” মধু তুমি কি সত্যি আমার সাথে থাকতে চাও না?”
“এতদিনে বুঝতে পারেন নাই আমি আপনাকে ঘৃণা করি?”
সমুদ্র মধুকে রেখে ফারাহর কাছে এসে বসল। ফারাহ দেখতে একদম মধুর কার্বন কপি একদম মায়ের মতো হয়েছে দেখতে।

সমুদ্রের পিছু পিছু মধুও রুমে এসেছে। সমুদ্র মধুর দিকে তাকিয়ে বলল,,”একদম তোমার মতো দেখতে হয়েছে।”
মধু রাগে মুখ ফিরিয়ে নিল। সমুদ্র নিচু হয়ে ফারাহর কপালে চুমু খেয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
মধু মেয়েকে কোলে নিয়ে কাঁদতে লাগল।
এদিকে মাহতিম হোসেন রাগে দেয়ালে ঘুসি মারল। এতো কষ্ট করে এতো প্ল্যান করে সমুদ্রকে দিয়ে মধুকে কিডন্যাপ করালাম। আর এখন সে নাকি মধু কে ফুয়াদের কাছে পাঠাই দেবে। এটা তো আমি হতে দেব না। ফুয়াদের জন্য সব কিছু ভেস্তে গেছে

আমার। নিজের কলিজার টুকরো ছেলেটা এখনো জেলে বসে আছে। আমার মেয়েটাকে ও কেড়ে নিয়েছে। ওকে তো আমি শান্তিতে আমার মেয়ের সাথে আমি সংসার করতে দেব না। যাই হয়ে যাক না কেন।
সমুদ্র ভাইয়ের প্রতি অনেক বেশিই দূর্বল কিন্তু মধুকে ও খুব বেশি ভালোবাসে। মধুকে ঢাল বানিয়ে মাহতিম হোসেন সমুদ্রের সাথে অনেক ডিল করেছে। মেয়েকে সমুদ্রের কাছে বিয়ে দিবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। মেয়েকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করতে চেয়েছিল কিন্তু মাঝখানে থেকে ফুয়াদ চলে আসলো। আর সব কিছু লন্ডভন্ড করে দিল।

সমুদ্র নিজের ভালোবাসা কথা জানানোর আগেই ফুয়াদ নিজের অনুভূতি প্রকাশ করে ফেলল নিজের প্রাণপ্রিয় ভাইয়ের কাছে। তারপরে সমুদ্র ছোটো ভাইয়ের জন্য নিজের ভালোবাসা জলাঞ্জলি দিতে চাইল। মাহতিম কোনভাবেই সমুদ্রকে আটকাতে পারেনি। সমুদ্রের খারাপ জগতের সবকিছু ফুয়াদ এর সামনে চলে আসছিল। তখন সমুদ্র কে বুঝাতে লাগল বাপ ছেলে মিলে,,” তোমার ভাইয়ের জন্য তুমি নিজের ভালোবাসা বিসর্জন দিতে চাইলে। আর এখন সে তোমার কাজের মধ্যে বাধা হয়ে আসছে এবার তো তাকে থামাও। তোমার সব কিছু কেড়ে নিবে ও।”

তখন সমুদ্রকে রাজি করানো গেল ফুয়াদকে কিডন্যাপ করার জন্য। আর সমুদ্র তখন বারবার করে বলেছিল,,” ফুয়াদ কে শুধু কিডন্যাপি করবে জানে মারবে না। ওর যেন কোন ক্ষতি না হয়।”
কিন্তু মামুন সেটা মানতে পারছিল না। ফুয়াদের জন্য ওদের অনেক কাজ বন্ধ হয়েছে ও ফুয়াদের উপর ক্ষেপে ছিল। হাতে পেয়ে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। সমুদ্র মধুর বিশ্বাস অটুট রাখতে বিয়ের মিথ্যা রেজিষ্ট্রি করে । যাতে এটা জেনে মধু ওকে ভরসা করে। কিন্তু সব‌কিছু ঘেটে যায় ফুয়াদ কীভাবে যেন নিজেকে মুক্ত করে ফেলে আর মধু কে বিয়ে করে নিয়ে আসে।

তারপর সব কিছুই উল্টো হয়ে যায়।মাথায় আগুন চেপে বসে তখন মাহতিম হোসেনের। ছেলেকে জেলে পাঠায় ফুয়াদ। তখনি সমুদ্র কে বলে মিথ্যা কথা বলতে যে ওদের বিয়েটা সত্যি কিন্তু সমুদ্র বলতে পারে না। আর ফুয়াদের নিজের ভাইয়ের প্রতি এতোটাই বিশ্বাস যে ও কনফিডেন্স এর সাথে বলে বিয়েটা নকল। সমুদ্র মধুকে অনেক ভালোবাসে আর নিজের ভালোবাসার মানুষকে তার বাসায় ছোটো ভাইয়ের সাথে সহ্য করতে পারছিল না তাই বাসা থেকে চলে যায় আর পালিয়ে পালিয়ে বেড়ায়।

মাহতিম হোসেন কিভাবে ফুয়াদের থেকে প্রতিশোধ তুলবে বুঝতে পারছিল না। অনেক ভাবে ফুয়াদের উপর হামলা চালাতে শুরু করে কিন্তু কোন ভাবে সফল হয় না। আর এদিকে সমুদ্র এতো কিছুর পরও হাত-পা গুটিয়ে নিজের দুঃখ বিলাস করছিল। সমুদ্রের এই ঠান্ডা মেজাজ তিনি মানতে পারছিল না তারা কোন ভুল করলে সমুদ্র যেভাবে তাদের সাথে রুড বিহেভ করে যা সব শাস্তি দেয়। নিজের ভাইয়ের ক্ষেত্রে তার কিছুই করছিল না। মাহতিম হোসেন ফুয়াদের কাছে সমুদ্রের ব্যাপারটা খোলাসা করে দেয়। এদিকে সমুদ্রের কাছে ভালো হতে চায়।

ওদিকে ফুয়াদের কাছে ও কিন্তু আসলে ধ্বংস দুজনেরই চায়। সমুদ্রের সাথে দেখা করে আর সমুদ্রকে অনেক ভাবে উসকাতে লাগে নিজের ভাইয়ের বিরুদ্ধে। মধুকে নিজের করার কথা বলে অনেক ভাবে। ফুয়াদকে তিনি কোনভাবে শান্তিতে থাকতে দেবে না তার ছেলেকে জেলে দিয়েছে তার মান সম্মান ডুবিয়েছে। এর শোধ একমাত্র সমুদ্রে তুলতে পারে। অবশেষে সমুদ্র কে রাজি করাতে পারে কক্সবাজারে সমুদ্র কে পাঠিয়ে দেয়।

সেখানে গিয়ে আরেক বিপদ সবকিছু ঠিকভাবে চলছিল মধুকে সমুদ্র কিডন্যাপ করে দূরে কোথাও চলে যাবে ভেবেছিল। সমুদ্র একা ভাবেনি ওকে ভাবানো হয়েছিল। কিন্তু মধু প্রেগনেন্ট জানার পর আবার বিষয়টা ঘেটে গেল। কিন্তু এবার সমুদ্র মধু কে ছাড়বে ভাবেনি নিজে থেকেই বলল,,”আমি এখন দেশের বাইরে চলে যাব। কিন্তু বেবি হতেই আমি চলে আসব আর বেবি সহ আমি মধু কে নিয়ে চলে যাব। এখন দেশে থাকলে আমাকে জেলে যেতে হবে।”

সমুদ্রকে দেশের বাইরে পাঠানোর জন্য সাহায্য করতে চায় মাহতিম হোসেন কিন্তু সমুদ্র মাহতিম হোসেন কে না জানিয়ে কোথায় যেন চলে যায়। এদিকে মাহতিম হোসেন জানে সমুদ্রে এসে কিছু না কিছু করবে। তাই নিজেকে ফুয়াদের সামনে খারাপ রাখতে চায় না। ফুয়াদের যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে কালারে উনি পড়বে তাই উনি সামনে সামনে ভালো মানুষের মুখোশ পরে ফেলে। সমুদ্র তখন দেশের বাইরে মাহতিম হোসেন তখনো অনেক ভাবে ফুয়াদ কে মারতে চেয়েছে কিন্তু পারেনি। ফুয়াদের সামনে ভালো শশুরের অভিনয় করেছে। কিন্তু তলে তলে সেই ফুয়াদের সবচেয়ে বড় শত্রু যেটা ফুয়াদ জানে না। ওর সামনে এখন শুধু সমুদ্র কে দাড় করিয়ে রেখেছে।

সমুদ্র মধুর হাতে ফোন দিয়ে বলল,,” ছোটো কে ফোন দাও এখানে এসে তোমাদের নিয়ে যেতে বলো।”
মধু ফোন হাতে নিয়ে সমুদ্র দিকে অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে আছে। সমুদ্রের কথা ও বুঝতে পারছে না। ফুয়াদ কে সমুদ্র নিজে ফোন করতে ওকে ফোন বারিয়ে দিয়েছে? এটা কি বিশ্বাসযোগ্য?

মধু আশ্চর্য কন্ঠে বলল,,,”আপনার মাথায় কি চলছে? আপনি ফুয়াদের কোন ক্ষতি করতে চাইছেন না তো? না আমি ফুয়াদকে এখানে ডাকবো না। আমি আপনাকে একটু ও বিশ্বাস করি না।”
“বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর।”
মধুর মনে নানান ধরনের ভয় থাকলেও সমুদ্রের কথায় ভরসা পেয়ে ফুয়াদকে কল দিল।
“হ্যালো কে?”

দুইদিন পর ফুয়াদের কণ্ঠস্বর শুনে মধু কথা বলতে পারল না। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। ফুয়াদ নিঃশ্বাসের শব্দ পেয়ে চিনে ফেলল ও আকুল কণ্ঠে বলল,,”মধু কোথায় তুমি?”
“আমাকে আর ফারাহকে সমুদ্র ভাইয়া কিডন্যাপ করেছে। আমরা এখন তার সাথেই আছি। আপনি এসে আমাদের নিয়ে যান।”

ফুয়াদ উত্তেজিত কন্ঠে বলল,,” তোমরা কোথায় আছো?”
মধু মেয়েকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ফোন কানে ধরেই বেলকনিতে চলে গেল। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে জায়গাটা কোথায় চেনার চেষ্টা করছে। মধু জায়গা চিনে ঠিকানা বলতে লাগল। ফুয়াদ ওকে কান্না করতে মানা করে সাবধানে থাকতে বলল। মধু বলল,” আপনি তাড়াতাড়ি আসেন। খুব মিস করছি আপনাকে।”

” আমি এক্ষুনি আসছি জান। তুমি ভয় পাবে না মেয়েকে দেখে রেখো।”
মধু ফুয়াদের কল কেটে চোখ মুছে রুমে এসে চমকে উঠল। বিছানায় ফারাহ নেই। একটা চিরকুট কলম দিয়ে চাপ দিয়ে রাখা। মধু চমকে উঠে দৌড় গেল চিরকুট হাতে নিতেই ওর পায়ের নিচে থেকে মাটি সরে গেল‌।
চিরকুটে লেখা,,
আমার হৃদয়ের প্রেয়সী মধু,

তোমাকেই কতটা ভালোবাসি হয়তো কখনোই তুমি বুঝবে না। কারণ আমার আগে তোমার মনে জায়গা করে নিয়েছে ফুয়াদ। ফুয়াদের আগে যদি আমি তোমায় এই ভালোবাসা দিতে পারতাম তুমি নিশ্চিত এমন বেসামাল ভাবে আমাকেই ভালোবাসতে। তখন আমি তোমার জীবনে হতাম হিরো আর ফুয়াদ হতো ভিলেন। কিন্তু আজ তুমি ফুয়াদকে ভালোবাসো ও তোমার জীবনের নায়ক আমি ভিলেন। এই গল্পে আমি হিরো হতে পারি নি কিন্তু আমি একজন বাবা হতে চাই।

তোমার পরে আমি কাউকে ভালোবাসতে পারব না আমি আসলে ভালো আর কাউকে বাসতেই চাই না। তুমি আমার জীবনে প্রথম ও শেষ নারী। শখের নারীর উপর জোরজবরদস্তি করা যায় না। আমি যখন দূরে থাকি মন চায় তোকে জোর করে নিজের বুকে মিশিয়ে রাখি কিন্তু কাছে আসলেই হাত কাঁপে, বুক কাঁপে, তোমার কাছে এসে হয়ে যায় আমি একজন ভীতু পুরুষ। তোমার সামনে আমার সমস্ত সাহস হারিয়ে যায় আমি অসহায় হয়ে পরি। আমি তোমার সাথে জোর করতে পারি।

তোমার মুখে যখন ফুয়াদ কে নিয়ে ভালোবাসার কথা শুনি যখন ওই দুটো আঁখি তে নিজের জন্য শুধুই ঘৃণা দেখতে পাই। তখন আমি ভেঙে চুরমার হয়ে যাই। তোমাকে আমি জোর করে নিজের কাছে নিয়ে যেতে পারতাম কিন্তু তারপর তোমার ওই চোখে আমি ঘৃণা ভরা দৃষ্টি সহ্য করতে পারতাম না। আমি তখন নিঃশেষ হয়ে যেতাম ভালোবাসার জায়গায় এক বুক ঘৃণা পেয়ে।

তাই তোমাকে আর ফুয়াদের জীবন থেকে আমি চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেলাম। আমার ভাইকে বলো আমি ওকে মারতে চাই নি কখনো। ওকে আমি কোলে পিঠে করে মানুষ করেছি ওকে ফুলের টোকা দিতেও আমার হাত কাঁপে। আমি তোমাদের এই ফুলের মতো কন্যাকে নিয়ে গেলাম। তুমি হীনা জীবনে ওই আমার বাঁচার আশা হয়ে থাকবে। ওকে আমি অনেক যত্ন করে মানুষ করব। ও বড় হয়ে আমাকে পাপা বলে ডাকবে। তোমার মেয়ে আমি নিয়ে গেলাম মধু। আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমার প্রেয়সী।
ইতি
মেয়ের বাবা

ফুয়াদ যখন আসলো দেখল মধু অজ্ঞান হয়ে নিচে পড়ে আছে। ফুয়াদ পুলিশ সহ এসেছে কিন্তু সমুদ্র কে কোথাও পায়নি এমনকি নিজের মেয়েকেও না। মধু কে পাঁজকোলে নিয়ে ফুয়াদ হসপিটালে যায়। দুইদিন ধরে না খেয়ে তার উপর মেয়ে হারানোর শক পেয়ে মধুর অবস্থা খারাপ। ওকে সেলাইন দেওয়া হলো। ফুয়াদ তাড়াহুড়োর সময় চিরকুট পকেটে করে এনেছিল কিন্তু পড়ার সময় পায়নি। নিজের ভাইয়ের প্রতি একরাশ ঘৃণা সৃষ্টি হয়েছে ওর।

মধুর জ্ঞান ফিরতেই পাগলের মতো করতে লাগল মেয়ের জন্য। মাহতিম হোসেন হসপিটালে এসে রাগে লাল হয়ে গেছে। মেয়ে নিয়েছে কেন শুধু? তিনি ভেবেছিলাম মধু কেও সাথে করে নিয়ে যাবে মধুর শূন্যতা ফুয়াদ কে এমনিতেই ভেঙে নিঃশেষ করে দেবে। ফুয়াদের দিকে তাকালেই তার বুকের ভেতর জ্বলে উঠে। ওর সর্বনাশ না করে তিনি থামবে না।

মধু কে সামলাতে না পেরে ডাক্তার ঘুমের ইনজেকশন দিল। ফুয়াদ বাসার সবাইকে ফোন করে খবর দিয়েছে সবাই হসপিটালে এসে ভীড় জমালো।
ফুয়াদ মধুর পাশে বসবে নাকি মেয়েকে খুঁজতে যাবে দিশেহারা হয়ে পড়ছে।
দুইদিন পরের কথা। মধুকে নিয়ে হসপিটালে থেকে মানিকগঞ্জে এসেছিল। মধুর বাবা জোর করেই নিয়ে গিয়েছিল।
তার বক্তব্য ছিল,” তোমরা আমার নাতনি টাকে দেখে রাখতে পারলে না। নিয়ে চলে গেল হারামি টা। আমার মেয়েকে আমি এই অবস্থায় ওখানে যেতে দেব না।”

ফুয়াদ যেতে পারেনি। সমুদ্র কে ধরতে ও উন্মাদের মতো ঘুরেছে কিন্তু তার টিকিটি ও খোঁজে পায়নি। দুইদিন পর ফুয়াদ মানিকগঞ্জে আসে মধুর কাছে। মধু দুইদিন পর ফুয়াদ কে দেখে ওর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ফুয়াদের গায়ে এখনো দুই দিনের নোংরা শার্ট। এক টানা পরে আছে? লোকটা কি আর খাওয়া দাওয়া করেছে? আর না গোসল করেছে। মধু নিজেকেই সামলাতে পারছে না ফুয়াদকে কি ভাবে সামলাবে?

ফুয়াদ চলে আসবে মধু ওর পিছু ধরে।
মাহতিম হোসেন অনেক বাধা দেয় মধুকে যেতে না দিতে।
কিন্তু মধুর এক কথা,,”আমি ওনাকে ছাড়া থাকবো না এখানে পাপা। আমাকে জোর করো না‌। আমাকে যেতে দাও উনার সাথে। খারাপ ভালো পরিস্থিতি যেমনি হোক না কেন আমরা একসাথেই থাকতে চাই।”
মধুর মা মেয়ের হাত ধরে বললেন,,”আজকে থেকে যা না তোরা। আমার মনটা খুব অশান্ত লাগছে। এতো রাতে না গেলে হয় না বাবা?”

ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে বললেন তিনি। ফুয়াদ কোন কথার জবাব দিতে পারল না ওর বুকের ভেতরটা হাহাকার করছে মেয়ের জন্য এই হাহাকার কীভাবে দূর করবে ওর জানা নেই।
নয়টার সময় দুজনে বাসা থেকে বেরিয়ে এলো। মাহতিম হোসেন ওদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করলেন,,” শত্রুর জন্য নিজের মেয়ের মায়া ও কাটাতে হলো।”

মাহতিম হোসেন চোখ বুজে সোফায় হেলান দিলেন। তার চোখের সামনে ছোটো একটা পরীর দৃশ্য ভেসে উঠল। পরীটার নাম মেহেরিমা মধু। মধুর তখন ছয় বছর। দিনটা ছিল মধুর জন্মদিনের। মধুর পরনে ছিল লাল ফ্রক। মাথায় চুল দুই জুটি করা দোলাতে দোলাতে দৌড়ে মাহতিম হোসেনের কোলে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে মধু।

মুখে ছিল হাসি আর চিৎকার করে বলেছিল,,” পাপা আমার পাপা। আজকে আমার বার্থডে। ঘুরতে নিয়ে যাবে?”
মাহতিম হোসেন মেয়েকে কোলে থেকে নামিয়ে এক ধমক দিয়েছিল। ছোটো মধু বাবার ধমক খেয়ে কেঁদে ভাসিয়ে ছিল। মাহতিম হোসেন দ্বিতীয় সন্তান ও ছেলে চেয়েছিল। তার কাজে সহযোগী বাড়াতে কিন্তু মেয়ে হয়েছিল আর ডক্টর বলেছিল আর কোন সন্তানের জন্ম দিতে পারবে না সানজিদাহ বেগম। নাহলে তার জীবন সংশয় হবে।

এরপর থেকে মাহতিম হোসেনের মেয়ের প্রতি আস্তে আস্তে অবহেলা বাড়তে থাকে। কখনো সেভাবে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে আদর করেনি। আজকে কেন এতো আফসোস লাগছে উনার। মেয়ের পাপা ডাকটা আর শুনতে পাবে না বলেই কি এতো হাহাকার লাগছে উনার। মাহতিম হোসেন চমকে তাকালো। মেয়ের বুক খালি করার শাস্তি হিসেবে কি নিজের মেয়েকে বলি দিলাম তাও নিজের হাতে? উনি তাড়াতাড়ি ফুয়াদের নাম্বারে কল দিতে লাগল। কেন কল দিল বাঁচাতে? কিন্তু হাতে বোধহয় আর সময় নেই কল কেউ রিসিভ করল না। ফোনটাও সুইচ অফ বলছে।

সারারাত মাহতিম হোসেন ঘুমাতে পারল না। কাউকে কল করে খোঁজ ও নিতে পারছি না ভয়ে ধার পরার ভয়ে।
সকালের নিউজ দেখছে মাহতিম হোসেন।নিউজে দেখাচ্ছে,,” বিশিষ্ট সাংবাদিক আবরার ফুয়াদের গাড়ি গতকাল রাত দশটা নাগাদ মানিকগঞ্জের রোডে একটা বড় এক্সিডেন্ট হয়েছে। সঙ্গে ছিল তার স্ত্রী। রাত থেকে ভাঙা চোরা ও আশেপাশের ডুবাতে তাদের দুজনের দেহের খোঁজ চলছে। কিন্তু তাদের দেহ পাওয়া যায়নি। গাড়িতে তাদের দুজনের ভাঙা ফোন পাওয়া গেছে।”

মধুর মা স্বামীর জন্য চা করে এনে দাঁড়িয়েছিল নিউজ টা শুনতেই তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। মাহতিম হোসেনের হাত থেকে রিমোট নিচে পড়ে গেল। তার কপাল ঘেমে গেছে।
ওর কানে বাজছে,” পাপা এতোটাই ঘৃণা করতে যে আমাকে এভাবে মেরে ফেললে তোমার কি একটুও বুক কাঁপল না।”

জোকের মাথায় নেওয়া ডিসিশন টা কি ভুল ছিল? মেয়েটা থাকতে এতো ভালোবাসা তো অনুভব করিনি। শেষ মুহুর্তে কেন আফসোস হচ্ছে? মেয়েটা তার রক্ত ছিল তার সন্তান সে মেরে দিল শুধু মাত্র নিজের স্বার্থে?
‘এই পৃথিবীতে মনে হয় সেই একমাত্র বাবা যে সজ্ঞানে নিজের মেয়েটাকে শেষ করে দিল। জীবনে এতো পাপ করেছি কখনো এতো কষ্ট আফসোস হয়নি কিন্তু এই আফসোস আর পাপের বোধহয় কোন নিস্তার নেই।”

প্রেয়সী পর্ব ৭৫

মধু আর ফুয়াদ কি মাহতিম হোসেনের ফাঁদে মারা গেল? নাকি বেঁচে আছে জানতে হলে অবশ্যই দ্বিতীয় অধ্যায় পড়তে হবে। কবে কখন প্রকাশ করব জানি না। কিন্তু সেখানে জানতে পারবেন মধু আর ফুয়াদের পরিণতি। সাথে সমুদ্রের সাথে থাকা ফারাহর জীবন যাপন। সমুদ্র কি পেরেছে মেয়ের বাবা হতে? সমুদ্র কি পারবে? ও জীবন টা শুধু মেয়ের বাবা হতেই কাটবে! নাকি কেউ আসবে ওর জীবনটা রঙিন করতে। সাজাতে ভালোবাসা দিয়ে পরিবর্তন করতে।

প্রেয়সী শেষ পর্ব