প্রেয়সী শেষ পর্ব 

প্রেয়সী শেষ পর্ব 
নন্দিনী নীলা

মধু আর ফুয়াদ দুজনেই গাড়িতে নিশ্চুপ বসে আছে। ফুয়াদ এক ধ্যানে গাড়ি চাচ্ছে মধু এক দৃষ্টিতে ফুয়াদের ক্লান্তি ভরা মুখশ্রীর পানে তাকিয়ে আছে।
ফুয়াদ ড্রাইভিং এর ফাঁকে একবার তাকাল মধুর দিকে। দেখল মধু পলকহীন চোখে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। ফুয়াদ বলল,,” খারাপ লাগছে?”

মধু বলল,,” যখন আমি ওই চিরকুট পড়লাম আমার মনে হচ্ছিল এটা বোধহয় মৃত্যু যন্ত্রণার থেকে ও বেশি কঠিন মুহূর্ত। এই জন্যেই আমার মনটা সবসময় অশান্ত হয়ে থাকত। মায়েদের আল্লাহ এক অদ্ভুত শক্তি দিয়েছে। আমার বারবার মনে হচ্ছিল কিছু একটা হবে সব কিছু ধ্বংস করে দিবে।”
ফুয়াদ চমকে উঠে বলল,,” কোন চিরকুট?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” অজ্ঞান হবার আগে একটা চিরকুট পড়েছিলাম। সেটা সমুদ্রের ছিল আমার কলিজা আমার মেয়েকে চিরদিনের জন্য নিয়ে চলে গেছে সেটা বলা ছিল।”
ফুয়াদ হঠাৎ করেই গাড়িটা থামিয়ে নিল। তারপর পকেট হাতড়ে চিরকুট খুঁজতে লাগল ও তো এখানেই রেখেছিল কোথায় গেল?
মধু বলল,,” কি খুঁজছেন?”

” চিঠি তো আমার কাছেই ছিল। তোমাকে অজ্ঞান অবস্থায় আনার সময় পকেটে রেখেছিলাম।”
” হয়তো কোথাও পড়ে গেছে কম দৌড়াদৌড়ি করেননি।”
ফুয়াদ মধুর হাত ধরে বলল,,” আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি ভাইয়ার প্রতি সহানুভূতি না দেখালে এসব কিছুই হতে পারত না।”

মধু ফুয়াদের হাতে কপাল ঠেকিয়ে বলল,,” কেন আমাদের কোল খালি করল? আমরা এখন কি নিয়ে বাঁচব বলেন?”
ফুয়াদ মধুর গাল মুছে বলল,,” শান্ত হ‌ও।”
মধু বলল,,” একটু নিচে নামুন না। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে গাড়িতে বসে থাকতে।”
ফুয়াদ মধু কে নিয়ে নিচে নামল। মধু ফুয়াদের বাহুতে মাথা ঠেকিয়ে বলল,,” আমাদের সুখ শান্তি কেড়ে নিয়ে গেল। এই ফাঁকা বুক‌ নিয়ে কীভাবে থাকব আমি। আমার মেয়েকে এনে দিন ওকে ছাড়া আমি থাকতে পারব না। আমার ছোট মেয়েটা কীভাবে আমাকে ছাড়া থাকবে?”

ফুয়াদ মধুর মতো বিলুপ করতে পারছে না। কান্না করতে পারছে না শব্দ করে। কিন্তু ওর বুকের ভেতরটা যে সন্তান হারিয়ে হাহাকার করছে।
মধু বলল,,” কত স্বপ্ন দেখেছিলাম আমরা তিনজন ঘুরব ফিরব‌। আমার ছোটো ফারাহ আমাকে মা বলে ডাকবে, কি সুন্দর অনুভূতি। সব শেষ করে দিল।”
ফুয়াদ মধুর মাথাটা বুকে চেপে ধরে বলল,,” শান্ত হ‌ও।”

“কীভাবে শান্ত হবো?”
” আমার জানা নেই কিন্তু তুমি প্লিজ শান্ত হ‌ও।”
ফুয়াদ মধু কে নিয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে যাবে। গাড়ি থেকে একটু দূরে চলে আসছিল ওরা। গাড়ির কাছাকাছি আসতেই কেউ গাড়ি নিয়ে চলে যায়।‌ হতভম্ব ফুয়াদ মধু অবাক হয়ে চলে যাওয়া গাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে।
” আমাদের গাড়ি নিয়ে কে চলে গেল?”

ফুয়াদ খেয়ার করল ও চাবি ফেলেই বেরিয়ে এসেছিল। ও শিট বলে কপাল চাপড়াতে লাগে।
” ডাকাতি হলো।”
” কি বলছেন?”
“দাঁড়াও আমি পুলিশে খবর দিচ্ছি।”
ফুয়াদ ফোন বের করতে গিয়ে দেখল ফোনটা গাড়িতেই রয়ে গেছে। গাড়িটা একটা চোর নিয়েছে। আনন্দে তার মুখে হাসি ছোটো খাটো চোর সে এই প্রথম এতো বড়ো গাড়ি চুরি করেছে। মুখে তার তৃপ্তির হাসি। এতো বড়ো গাড়ি নিয়ে সে বিক্রি করে অনেক টাকা পাবে‌‌।

এদিকে মধু আর ফুয়াদ কোন গাড়ি পায় না। এতো রাতে কিসে যাবে। কোথায় যাবে মাথা নষ্ট। তখন একটা ট্রাক এসে ওদের সামনে থামে।
ফুয়াদ কে ডেকে জিজ্ঞেস করে কোন সাহায্য লাগবে নাকি?
ফুয়াদ মধুর দিকে তাকিয়ে বলল,,” সাহায্য তো দরকার। আমাদের গাড়িটা চুরি হয়ে গেছে।”

” বলেন কি? এই জায়গা ভালো না চুরি ডাকাতি হয়েই থাকে। সাবধানে চলবেন না?”
” এখন আর সাবধান হয়ে লাভ কি?”
” আপনারা চাইলে আমার সাথে যেতে পারেন।”
মধুর দিকে তাকায় ফুয়াদ।
” আপনার ইচ্ছা হলে চলুন। এখানে দাঁড়িয়ে ই বা কত সময় থাকবেন।”

গাড়িটার সামনে হঠাৎ একটা বড়ো ট্রাক চলে আসে লোকটা গাড়ি ব্রেক করতে চায় কিন্তু কিছুই কাজ করছে না। ব্রেক ফেল দেখাচ্ছে। লোকটা এক্সিডেন্ট এর আগে বলে। চুরি করার অপরাধে আজ কি মরতে হবে? যে ট্রাক এর সাথে এক্সিডেন্ট হয়েছে সেটা আর অন্য কোন ট্রাক নয় যেটাতে ফুয়াদ মধু উঠেছিল। চোরের বাসা মানিকগঞ্জ তাই সে অনেকটা সামনে গিয়ে আবার গাড়ি ঘুরিয়ে এদিকেই আসতে লাগে একটু সময় করে যাতে ফুয়াদ মধু চলে যায়। এদিকে ফুয়াদ অন্ধকার হলেও ট্রাকে বসে নিজের গাড়ি চিনতে ভুল করেনি। ও গাড়িতে বসেই দূর থেকে বলেছে,,” ওইতো আমার গাড়িটা।”

ট্রাক ড্রাইভার ফুয়াদের কথা শুনে গাড়ির সামনে নিয়ে ট্রাক দাঁড় করায়। যাতে চোর গাড়ি থামিয়ে নেয়। কিন্তু চোর গাড়ি থামাবে কীভাবে? গাড়ির তো ব্রেক ফেল করানো। তাই চোর শত চেষ্টা করেও গাড়ি থামাতে পারে না।
এদিকে মধু আতংকিত কন্ঠে বলে উঠে,,” গাড়ি তো শো শো করে এগিয়ে আসছে।”
ফুয়াদ নিজেও ভয় পেয়ে যায়। ট্রাক ড্রাইভার গাড়ি সরানোর আগেই দ্রুত বেগে ছুটে আসে গাড়িটা‌। আর ট্রাকের সাথে জোরে এক ধাক্কা লাগে। মধু ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে বলে,,” আমার মনে হচ্ছে আমি মরে যাব। মেয়েকে বুঝি আর দেখা হবে না।”

ফুয়াদ মধুকে আগলাতে চায় কিন্তু ও নিজেকেই বাঁচাতে পারে না। দুটো গাড়ির বড়োসড়ো একটা ধাক্কা লাগে কারন ট্রাক ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট করেছিল তাই দুটো একসাথে লেগেছে ভেতরে থাকা সবার মরণা পর্ণ অবস্থা। মধু কিনারে ছিল ট্রাক অনেক উঁচু আর দরজা খুলে মধু পাশের নদীতে পড়ে যায়। পড়ার আগে ও মাথায় আঘাত পেয়েছে। ফুয়াদ নিজেও মাথায় আঘাত পেয়েছে কিন্তু মধু কে পড়ে যেতে দেখে ও নিজেই লাফিয়ে পড়ে মধু কে ধরতে।

পানিতে পরেই ফুয়াদ মধু কে টেনে ধরে। মধুর গালে থাপ্পড় দিয়ে কয়েকবার ডেকে ও রেসপন্স পায় না ও দেখতে পায় মধুর মাথা বেয়ে গলগলিয়ে রক্ত পড়েছে। ফুয়াদ যখন বুঝতে পারে মধুর আর শ্বাস চলছে না ও এক চিৎকার দিয়ে উঠে। নিজেকে আর পানি থেকে তোলার চেষ্টা করে না। শরীরের সমস্ত শক্তি ছেড়ে নিজেকেও ছেড়ে দেয়। তখনো মধুর দেহটা ওর বুকেই ছিল। আস্তে আস্তে ওর বাঁধন খুলে যায় দুজনেই স্রোতে ভেসে অতলে হারিয়ে যায়।

এদিকে সমুদ্র অনেক মিথ্যাচার করে প্লেনে বসে আছে। নিজের নাম অরুণ চৌধুরী বলেছে। সমুদ্র ফারাহ কে চুমু খেয়ে মধু কে কল্পনা করছে। কল্পনা করছে পরিবারের সবাইকে। ও আর কোনদিন এই দেশে ফিরবে না সবাই ভালো থাকুন। ও আসলেই আবার মধুর জীবনে ঝামেলা সৃষ্টি করবে তার থেকে আর কখনো আসবে না। ওরা ভালো থাকুন। সমুদ্রের চোখে অজান্তেই জল চিকচিক করে উঠল। বুকের ভেতর টা না চাইতেও কাঁপছে আর কখনো আসবে সেটা বলতে কি?

প্রেয়সী পর্ব ৭৬

সমুদ্র মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,,” তোকে আমি কখনো এসব জানতে দেব না। তুমি শুধু বাবার মেয়ে হয়ে থাকবি। তোর জীবনে আমি ছাড়া আর কেউ থাকবে না। তেমনি আমার জীবনে শুধুই তুই থাকবি।”
এতো ছোট্ট বেবিকে মা ছাড়া নিয়ে যাওয়াতে অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে‌ সমুদ্র তখন ও বলেছে মা মৃত্যু। এই কথাটা বলার সময় ওর গলা কেঁপেছে। বলার পর আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছে ও চাপে পড়ে বলেছে এটা সত্যি নয়। সত্যি না হোক কখনো। মধু ফুয়াদের সাথে সুখে শান্তিতে থাকুক। এটাই ও চায় ভালোবাসার মানুষটির সুখ চায়।

সমাপ্ত