প্রেয়সী পর্ব ৭৫

প্রেয়সী পর্ব ৭৫
নন্দিনী নীলা

একমাস পরের কথা,
মধু মেয়ের পাশে বসে আছে গালে হাত দিয়ে। এখন মধু সম্পুর্ণ সুস্থ আল্লাহর রহমতে। মেয়ে এখন ঘুমিয়ে আছে। ঘুমের মধ্যে মেয়েটা ঠোঁট নাড়াচ্ছে, হাত নাড়াচ্ছে। মধু বসে বসে ঘুমন্ত মেয়েকে দেখছে আর একটু পর পর মেয়ের গালে হাত দিচ্ছে তো চুমু খাচ্ছে। মধুর দিন রাত কাটে মেয়েকে নিয়েই। এখন ফুয়াদ মধুর পাত্তা পায় না। সেদিন তো বলেই উঠল,,” মা মেয়ে দেখি আমাকে পাত্তাই দিচ্ছ না। আমাকে এখন আর কারো দরকার নেই।”

মধু ফুয়াদের কথা শুনে খিলখিলিয়ে হেসে উঠে। মায়ের হাসি দেখে ছোটো ফারাহ ও না বুঝেই হাসে।
মধু মেয়েকে চুমু খেয়ে বলল,,” আমাদেরকে মেয়েটা দেখেন কত শান্ত একটুও কান্না করে না। প্রস্রাব করেও মেয়ে কান্না করে না ওভাবেই শুয়ে থাকে কেউ কাছে গিয়ে চেক না করলে ও ওভাবেই থাকবে। এতো শান্ত কেন ও বলেন তো। সবাই বলতো ছোট বেবি রা নাকি অনেক জ্বালাতন করে কান্না করে। কিন্তু আমাদের ফারাহ কত শান্ত, কত লক্ষী। ও অনেক বোঝধার মা বাবাকে কষ্ট দিতে চায় না।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

নাফিসা বেগম রুমে এসে মধুর ধ্যান ভেঙ্গে দিল। নাফিসা বেগম নাতনির পাশে বসে বললেন,,” তোমাকে বলেছি না ওমন হা করে মুগ্ধ চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকবে না‌। নজর লাগলে ক্ষতি হয় বুঝো না কেন?”
মধু গাল থেকে হাত সরিয়ে সোজা হয়ে বসে বলল,,” আম্মু এটা কেমন কথা? আমার মেয়ের দিকে আমি তাকালে কেন নজর লাগবে? আমার মেয়ে আমি তো তাকিয়ে থাকবোই।”

নাফিসা বেগম রাগী চোখে তাকালো মধুর দিকে। মধু মাথা নিচু করে বসে র‌ইল। মনে মনে বলছে,, আমার কত কষ্টের মেয়ে আমি তার দিকে তাকিয়ে থাকলে নাকি নজর লাগবে যত্তসব ফালতু কথা।
নাফিসা বেগম ফারাহ কে কোলে নিয়ে বললেন,,” আমি ওকে নিয়ে বাইরে যাচ্ছি।”
মধু আঁতকে উঠল,,” ওতো ঘুমাচ্ছে। পরে নিয়েন।”

” না আমি এখনি নেব।”
মধুর কথা না শুনেই নাফিসা বেগম বেরিয়ে গেল রুম থেকে। মধু মুখ কালো করে বসে র‌ইল। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকলে কত শান্তি লাগে ওর সেটা যদি এদের ও বুঝাতে পারত। মধু ফোন হাতে নিয়ে দেখল ফুয়াদের মিসকল। মধু ফুয়াদের নাম্বারে কল দিল ফুয়াদ কল কেটে দিল। ও কপাল কুঁচকে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে।
“এতো বড় সাহস আমার কল কেটে দেয় আজ বাসায় আসুক।” রাগে বলল মধু।
তখনি ফুয়াদ দরজা খুলে রুমে প্রবেশ করে উত্তর দিল,,” এসেছি কি করবে? একটু আদরে করবে নাকি?”
মধু চমকে উঠে তাকাল ফুয়াদের দিকে।

” আপনি কখন আসলেন?”
” যখন তুমি কল দিয়েছ তখন আমি নিচে ফারাহ কে আদর করছিলাম।”
মধু বিছানা থেকে নেমে বলল,,” তাহলে ফারাহ কে রেখে আসলেন কেন? যান নিয়ে আসুন আমি গেলে আম্মু দেবে না। আপনি যান।”

ফুয়াদ মধুর হাত ধরে হেঁচকা টান দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে বলল,,” থাক ফারাহ আম্মুর কাছেই থাক। তুমি এখন একটু ফারাহ বাবা কে সময় দাও।”
বলেই ফুয়াদ মধু কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। মধু ছটফট করে নিজেকে ছাড়িয়ে বলল,,” পারব না আমি শুধু আমার মেয়েকে সময় দেব।”

ফুয়াদ মধুকে টেনে পেছনে থেকে জড়িয়ে ধরে বলল,,” মেয়ে পেয়ে স্বামী কে ভুলে গেলা।তুমি এতো নিষ্ঠুর?”
মধু ফুয়াদের মুখে নিষ্ঠুর কথা শুনে হেঁসে উঠল।
মধু ছটফট থামিয়ে শান্ত হয়ে গেলে ফুয়াদ মধুর কাঁধে চুমু খেয়ে বলল,,” আচ্ছা যাও ছেড়ে দিলাম।”

এবার মধু ফুয়াদ কে জড়িয়ে ধরে বলল,,” রাগ করেন কেন? আমার মেয়েকে ছেড়ে একটু দূরে থাকলে বুকের ভেতরটা ধক করে উঠে। মনে হয় যদি ওকে কেউ আমার থেকে ছিনিয়ে নেয়।”
ফুয়াদ মধুর কপালে চুমু খেয়ে বলল,,” আজেবাজে চিন্তা করো না তো। শরীরে হাল দেখেছ?”
” আমার মেয়ে ভালো থাকলেই আমি হ্যাপি আমার নিজের শরীরের চিন্তা নেই। সে চিন্তা করার জন্য তো আপনি আছেন।”

“সব দায়িত্ব আমার উপর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে!”
” হুম।‌ এবার যান ফ্রেশ হয়ে আসেন খাবার খাবেন না?”
” হুম যাও তোমার মেয়ে কাছে যাও। আমি আসছি নিচে।”
মধু ফুয়াদকে ছেড়ে নিচে আসলো। তিন্নি ফারাহ কে কোলে তুলে বসে আছে। ফারাহ ড্যাবড্যাব করে ফুপির দিকে তাকিয়ে আছে। মধু এসে তিন্নির পাশে বসল। তিন্নি মধু কে দেখেই বলল,,” জানিস কি হয়েছে?”

মধু কপাল কুঁচকে বলল,,” না বললে জানব কি করে?”
তিন্নি ফিসফিস করে বলল,,” ও আমাকে জ্বালাতন করছে। কি বলে জানিস বলে একদিন আগে পরে তুমি তো আমার ঘরেই আসবে তখন এই অবহেলার প্রতিশোধ নেব।”

” ঠিকি তো বলেছে।”
” কিভাবে থ্রেট দিল দেখছিস আর তুই ঠিক বলছে বলছিস? এই তুই আমার বান্ধবী হয়ে ওর সাপোর্ট নিচ্ছিস কেন?”
” সাপোর্ট কোথায় করলাম? আমি তো কথাটা সত্যি তাই বললাম।”
” তুই ও ধরেই আছিস ওর সাথেই আমার বিয়ে হবে? আমি ওকে বিয়ে করব না বলেছি না।”

মধু তিন্নির গাল টেনে দিয়ে বলল,,” আর ঝামেলা না করে রাজি হয়ে যা অনেক দিন কারো বিয়ে খাই না। ওই দেখ আমার মেয়েটাও আসায় আছে তার ফুপির বিয়ে খাবে। দেখ ও তোর দিকে কেমন করে তাকিয়ে আছে।”
তিন্নি রেগে মধুর কোলে ফারাহ কে দিয়ে বলল,,” তোরা মা মেয়ে আমার বিয়ের পিছনে পরলি কেন! আমি ওই অসভ্য টাকে বিয়ে করব না।”

রাগে গজগজ করে তিন্নি চলে গেল ফুয়াদ নিচে এসে তিন্নি কে রেগে যেতে দেখে মধু কে জিজ্ঞেস করল কি হয়েছে।
মধু সব বলতেই ফুয়াদ হাসতে লাগল বোনের কাহিনী শুনে।
গভীর রাত মধু ফুয়াদের বুকে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে আছে। ওর চোখে ঘুম নাই‌। হঠাৎ করেই ও একটি বাজে স্বপ্ন দেখে জেগে গেছে। আগের থেকে মধু অনেকটাই শক্ত হয়েছে এখন আগের মতো ভয় পায় না।

এই যে এখন বাজে স্বপ্ন টা দেখে ও চিৎকার চেঁচামেচি না করে ড্রিম লাইটের আলোয় মেয়েকে দেখে ফুয়াদের বুকের সাথে মিশে আছে। নিজের স্বপ্ন টা শুধুই স্বপ্ন ভেবে ভয় কে দূর করতে চাইছে। এতো দিন হয়েছে সমুদ্রের খোঁজখবর নেই তাই মনে হচ্ছে সমুদ্র আসলেই আর ওদের জীবন অভিশাপ হয়ে আসবে না। ওর গলা শুকিয়ে এলো ও আস্তে করে উঠে বসল। নিঃশ্বাস বন্ধ করে বিছানা থেকে নামল কেমন জানি অশান্তি লাগছে। এই অশান্তি কয়েকদিন ধরেই লাগছে। মনটা খালি কু ডাকছে মন বলছে সামনে কোন বড় ঝড় আসছে। সব কিছু তছনছ করে দেবে সেই ঝড়। মধু নিজের ভয় কে নিছকই ভয় ভেবে সব সময় নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছে।

মধু উঠে পানি খেয়ে কেন জানি বেলকনিতে আসলো এটাই ওর জন্য কাল হয়ে দাঁড়াল ও বেলকনিতে দাড়াতেই কেউ ওর মুখ চেপে ধরে টিস্যু দিয়ে। মধু চিল্লাতে ও পারে না অজ্ঞান হয়ে যায়। নিস্তেজ শরীর নিয়ে মধু ঢলে পরলো অপরিচিত মানুষটার উপর।

মধুর যখন জ্ঞান ফিরল ও নিজেকে একটা সুন্দর রুমে শোয়া অবস্থায় পেল। ও চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে আশেপাশে তাকাচ্ছে। ঘুমের রেশ কাটতেই ও চমকে উঠল। ধরফরিয়ে উঠে বসল। পাশে তাকাতেই দেখল মেয়ে পাশেই আছে কিন্তু ফুয়াদ কে আশেপাশে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। রুমটা অপরিচিত। ও এটা কোথায় আছে? ফুয়াদ কোথায়?

মধু বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল দরজা খুলে বেরুতেই দেখল একটা অপরিচিত বাসা। কাউকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। শুনশান নীরবতা বিরাজ করেছে বাসার আনাতে কানাচে। ওর বুক ধক করে উঠল। ও ফেরত রুমে চলে আসলো মেয়েকে কোলে নেবার জন্য। কিন্তু রুমে আসতেই ওর পা জমে গেল। হাত পা কাঁপতে লাগল। ও চোখ দুটো রসগোল্লার মতো বড়ো বড়ো করে বিছানার দিকে তাকিয়ে আছে।

সমুদ্র ফারাহ কে কোলে নিয়ে বসে আছে। ওকে দেখতেই হাসি দিয়ে সমুদ্র বলল,,” কেমন আছো মধু?”
মধু কাঁপা কন্ঠে বলল,,” আপনি এখানে কি করছেন? আমি এটা কোথায়?”
” উফফ মধু এতো ভয় পাচ্ছ কেন? আমাকে কি দেখতে খারাপ তুমি ভয়ে কাঁপছ কেন যে। এদিকে আসো দেখো বাবাকে মেয়ে কি সুন্দর আপন করে নিয়েছে। দেখো আমার দিকে কেমন করে তাকিয়ে আছে।”
“কি সব আজেবাজে কথা বলছেন? বাবা মেয়ে মানে কি? আমার মেয়েকে আমার কোলে দিন বলছি।”
সমুদ্র ফারাহ দিকে তাকিয়ে বলল,,” ওর নাম আমি কি রেখেছি জানো?”

” আপনি আমার মেয়ের নাম রাখবেন কেন?আপনি রাতে আমাদের কিডন্যাপ করেছেন তাই না।”
” মধু তোমার তো অনেক বুদ্ধি। একদম ঠিক ধরেছ। কতদিন ধরে এই কাজ করছি জানো। দেশে ফিরেই তোমাদের নিজের কাছে আনার জন্য পথ খুঁজছিলাম কিন্তু পারছিলাম না। গতকাল পারলাম বেলকনিতে গিয়ে তুমি তোমাকে আর মেয়েকে আমার কাছে আনার পথ করে দিলে। আমার চালাক ভাইটাকে ঘুমের ঔষধ খাওয়াতে না পারলে তো কিছুই করতে পারতাম না। জার্নালিস্ট বলে কথা মাথায় প্রখর বুদ্ধি।”

” আপনি উনাকে ঘুমের ঔষধ কীভাবে খাওয়ালেন?” অবাক স্বরে বলল মধু।
সমুদ্র শয়তানি হাসি দিয়ে বলল,,” বেলকনি দিয়ে আমি রুমে ঢুকে ছিলাম তারপর গ্লাসে ঘুমের ঔষধ মিশিয়ে দিয়েছিলাম। সেটা ফুয়াদ খেলো আর ঘুমিয়ে গেল‌।”

মধু কল্পনা করল। ঘুমানোর আগে যখন ফুয়াদ পানি চেয়েছিল মধু দেখেছিল পানি আগে থেকেই গ্লাসে ঢেলে রাখা ও তখন ওতো কিছু ভাবেনি ফুয়াদ কে গ্লাস দিয়েছিল খাওয়ার পর শুয়ে মেয়েকে ঘুম পারিয়ে যখন মধু ফুয়াদ কে জড়িয়ে ধরেছিল দেখল ফুয়াদ ঘুমে তাকাতে পারছে না। প্রতিদিন শোয়ার পর ফুয়াদ অনেক দুষ্টুমি করে ওর সাথে দুজনের প্রেম আলাপ করে কিন্তু গতকাল ফুয়াদের ঘুমের জন্য কিছু করেনি। মধু সমুদ্র দিকে রেগে এগিয়ে গেল। সমুদ্র ফারাহ কে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল।

মধু ওর কলার চেপে ধরে বলল,,” আপনাকে আমি খুন করে ফেলব‌। আপনি আমার সামনে এসে ঠিক করেন নি এবার আপনাকে আমার হাত থেকে কেউ বাঁচাতে পারবে না।”
বলেই মধু সমুদ্র কে ছেড়ে আশেপাশে কিছু খুঁজতে লাগল কি দিয়ে ওকে আঘাত করা যায়।
মধু হাতের কাছে কিছু না পেয়ে পাগলের মতো ঘুরতে লাগল। রাগে ওর শরীর কাঁপছে উনার কত বড় সাহস ওদের কিডন্যাপ করে।

সমুদ্র ওর হাত ধরে টেনে কোমর জড়িয়ে ধরে বলল,,” মধু তুমি শুধু আমার প্রেয়সী হবে?”
মধু রাগে লাল হয়ে চিৎকার করে বলল,,” ছোট ভাইয়ের ব‌উ এর শরীর স্পর্শ করতে লজ্জা করে না ছাড়ুন আমাকে‌।”
” বলো না মধু তুমি আমার হবে। আমাদের একটা সুন্দর ঘর হবে। যে ঘরে আমরা সুখে শান্তিতে সংসার করব। আমাদের ছোট মেয়েটা হাঁটি হাঁটি পা করে হাঁটবে‌। বলো না মধু হবে আমার হৃদয়ের প্রেয়সী?”

মধু রাগে ঘৃণা সমুদ্রের মুখে থুথু দিয়ে বলল,,” তোর সাথে আমি করব সংসার মরে গেলেও না দরকার পরলে বিষ খেয়ে মরে যাব তাও আমি তোর সাথে থাকব না। আমার জীবনে একজন পুরুষকে আমি ভালোবাসি সে আমার স্বামী আমার সব কিছু। সে আমার মেয়ে বাবা।”

প্রেয়সী পর্ব ৭৪

সমুদ্র রাগ নিয়ন্ত্রণ করে বলল,,,” জন্ম না দিলে কি বাবা হওয়া যায় না আমি ওকে ফুয়াদের থেকেও বেশি ভালোবাসা দেব।”
” বাবার ভালোবাসার কাছে আপনার ভালোবাসা ওর কাছে তুচ্ছ।”

প্রেয়সী পর্ব ৭৬