প্রেয়সী পর্ব ৬৮

প্রেয়সী পর্ব ৬৮
নন্দিনী নীলা

সকালে সবাই সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে গেল। রাতে এতো এতো শক খেয়েছে মধু সকালে আর কোথাও যাওয়ার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু ফুয়াদ কে দেখল পরিবারের সামনে কি সুন্দর মনের কষ্ট মনেই চেপে রেখে হাসি মুখে পরিস্তিতি সামাল দিচ্ছে। মধু শুধু অবাক হয়ে ফুয়াদ কে দেখছিল! সমস্ত কষ্ট ফুয়াদ নিজের মধ্যে রেখেছে। আগে ফুয়াদের ব্যবহারে মধুর ক্ষণে ক্ষণে অভিমান জন্মাতো মনে হতো ফুয়াদ পরিবর্তন হয়ে গেছে কিন্তু এখন ফুয়াদের জন্য কষ্টে বুকের ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে। কীভাবে পারছে?

তিন্নি এসে মধুর হাত ধরে কি জানি বলল, কিন্তু মধুর সেসব কোন কথাই ওর কানে যায়নি। ও আছে অন্য ধ্যানে মগ্ন।
তিন্নি ওর রেসপন্স না পেয়ে চলে গেল গাল ফুলিয়ে। মধু ফুয়াদের থেকে চোখ সরিয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে ওর মন বলছে সমুদ্র ওর আশে পাশেই আছে। কিন্তু ওর নজরের পড়ছে না ও একাই দাঁড়িয়ে পড়েছে সবাই সমুদ্রের কাছাকাছি চলে গেছে। মধু একাই দাঁড়িয়ে আছে থমকে। হটাৎ ফুয়াদ পিছু ঘুরে দেখে মধু একা পিছু দাঁড়িয়ে আছে ও মধু কে দুইবার ডাক দেয় মধু সারা শব্দ না করায় ফুয়াদ ওর দিকে এগিয়ে আসে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” কি হলো এখানে দাঁড়িয়ে পড়লে যে?” ফুয়াদ কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করল।
মধু বলল,,” আমার মন বলছে সমুদ্র ভাইয়া আমাদের আশেপাশেই আছে। আমাদের নজরে নজরে রাখছে কিন্তু সামনে আসবে না।”

” হয়তো।”
” এটাই সত্যি। তিনি আপনার চোখে চোখ মিলাতে পারবে না তাই সামনে আসবেনা। কিন্তু নজরের আড়াল ও করতে পারছে না। আপনি প্লিজ আমার সাথে থাকেন উনাকে দিয়ে আমার বিশ্বাস নাই কখন কি করে বসে।”
” যেটা ভাগ্যে আছে সেটা তুমি আমি কেউ আটকাতে পারব না। জীবন কতক্ষন আছে তার গ্যারান্টি কেউ দিতে পারে না তাই যতটুকু আছি আতঙ্ক সরিয়ে একটু শান্তিতে বাঁচি কি বলো?”

মধু অগ্নি দৃষ্টিতে তাকাল ফুয়াদের দিকে তারপর রাগে গমগম করে বলল,,” দেখুন আমার মেজাজ গরম করবেন না। জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে আমরা বেঁচে থাকি। কিন্তু আপনার ভাইয়ের মতো সবার ভাই তার ছোটো ভাইকে মারা জন্য পিছু পরে থাকে না। তাই এখানে ভাগ্য টানবেন না। নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করেন আপনার কিছু হলে আমি কিন্তু নিজেকে ও শেষ করে দেব ভাইয়ের প্রতি দয়া দেখিয়ে শুধু নিজেকে না আমাকে বলি দিতে হবে আপনার। কথাটা মাথায় রাইখেন।”

মধু কথাটা বলে সামনে হাঁটতে লাগল। কয়েক কদম এগিয়ে দেখল ফুয়াদ সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে তাই আবার ফিরে এসে ওর হাত ধরে বলল,,” আমাকে ডাকতে এসে নিজেই দাঁড়িয়ে পড়লেন যে। চলুন।”
টেনেই ফুয়াদকে নিয়ে হাঁটতে লাগল মধু। ফুয়াদ মধুর হাত টেনে ধরে চুমু দিয়ে বলল,,” তুমি এখন ঠিক আছো?”
” আমার আবার কি হয়েছে?”

” গতকাল এতো বমি করলে যে সকালেও তো বেশি কিছু খেলে না। এইভাবে চলতে থাকলে তো অসুস্থ হয়ে যাবে।”
” শরীরের অসুস্থতা তো দেখতে পারবেন কিন্তু মনের টেনশন কমাবেন কীভাবে? ভেতরে ভেতরে আমি দুশ্চিন্তায় গুড়িয়ে যাচ্ছি।”
” কিচ্ছু হবে না আমার। টেনশন করো না।”

মধু ফুয়াদের কাঁধে মাথা রেখে দাঁড়িয়ে আছে। দূর থেকে এক জোড়া চোখ ওদের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার চোখে দিয়ে যেন আগুন ঝড়ছে।
মধু ইচ্ছে করেই ফুয়াদের কাছাকাছি আছে সমুদ্র দেখে যেন বুঝতে পারে মধু ওকে চায়না। ওর জীবনে একজনকেই ও ভালোবাসে একজন কেই চায় সে শুধুমাত্র‌ই ফুয়াদ।

সমুদ্র সত্যি পাশ দিয়ে ঘুরছিল। মধু আর ফুয়াদ কে এতো ঘনিষ্ঠ ভাবে দেখে ও আর এখানে থাকতে পারলো না। রিসোর্ট এ চলে আসলো। ও ছদ্মনাম এ রিসোর্ট এ উঠেছে যাতে ফুয়াদ ওকে খোঁজে না পায়। ও চায়না ফুয়াদ ওকে খোঁজে পায়। যে নিজে থেকে লুকিয়ে থাকতে চায় তাকে পাওয়া যে এতো সহজ না! সেটা হয়তো ফুয়াদ ভুলে গেছে।
সমুদ্র বাসা থেকে পালিয়ে এসে সবার থেকে আড়ালে থাকছে শুধু মাত্র একটা কারণেই।

নিজের ভালোবাসার মানুষকে ও আরেকজনের পাশে সহ্য করতে পারবে না তাই লুকিয়ে আছে‌। ফুয়াদ যাতে সব জানতে পারে এজন্য সমুদ্র ইচ্ছে করে নিজের লেখা ডায়েরি পরে গিয়ে লুকিয়ে রেখে এসেছে। যাতে ফুয়াদের কাছে সব পরিষ্কার হয়। ও চেয়েছিল ফুয়াদ কে সব জানাতে। ফুয়াদ ওর জন্য সব করতে পারে। তাহলে সব জানার পর ও কেন এতো মাখামাখি ওদের। কেন ফুয়াদ মধুর থেকে আলাদা হচ্ছে না। সমুদ্র ভেবেছিল সব জানার পর ফুয়াদ মধু কে ছেড়ে দিবে আর সমুদ্রের হাতে তুলে দিবে। আর বলবে,,” মধু তোমার ‌ই আছে।”

কিন্তু তেমন কিছু হয়নি‌। সমুদ্র চাইলেই মধুকে জোর করতে পারতো‌। কিন্তু সমুদ্র পারেনি শখের নারীর সামনে পুরুষ দূর্বল। ও পারেনি মধু কে জোর করতে। ও চেয়েছিল মধু ওকে নিজে থেকেই ভালোবাসবে‌‌। ফুয়াদ মারা গেছে জানতে পারলে মধু ওকেই ভালোবাসবে। এজন্য ফুয়াদ কে কিডন্যাপ করে সমুদ্র। আর মধুর সব বিপদ আপদে ওর সঙ্গ দেয়। বিয়েটা ও নকল করে কারণ মধুর বিশ্বাস অর্জন করার জন্য।

সত্যি বিয়ে করলে মধুর চোখে ও খারাপ হতো কারণ ছোটো ভাইয়ের প্রেমিকা কে বিয়ে করেছে তকমা লাগতো। সমুদ্রের সব কিছুই ঠিক যাচ্ছিল বিয়েটা নকল বলার আগেই মধু কিডন্যাপ হয়ে গেল আর ফুয়াদ নিজেকে মুক্ত করে ফেলল। তারপর ওর প্লান সব ভেস্তে গেল। মধু কে নিজের করে পাবার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াল ফুয়াদ। পাগলের মতো সমুদ্র মধু কে খুঁজেছে। ও প্রথমেই বুঝে গিয়েছিল ফুয়াদ পালিয়েছে মানে মধু ওর সাথেই। কিন্তু দুজনের কাউকেই ও খুঁজে পায়নি কোন গুহায় লুকিয়ে ছিল আল্লাহ তাআলা জানেন।

যেদিন ওরা ফিরে আসলো সমুদ্র ভেবেছিল মধু কে মিথ্যে বিয়ের কথা না বলেই ওকে পাবার চেষ্টা করবে। কিন্তু যখন শুনে ফুয়াদ আর মধু বিয়ে করে একেবারে হানিমুন করে ফিরে এসেছে তখন পায়ের তলায় থেকে মাটি সরে যায়। দুজন কে এক সঙ্গে আর এক মুহূর্তও ও দেখতে পারছিল না। বুকের ভেতরটা দুমরে মুচড়ে যাচ্ছিল।

সেই প্রথম নিজের রক্তের আদরের ছোটো ভাইকে ওর আর সহ্য হচ্ছিল না। মাথায় খুন চেপে গিয়েছিল। মন চাইছিল খুন করে ফেলতে। অনেক কষ্টে নিজেকে শান্ত রেখেছিল। তারপর ওসব সহ্য করতে না পেরে পালিয়ে এসেছিল বাসা থেকে। যাকে নিজের করার স্বপ্ন দেখেছে তাকে কীভাবে ছোটো ভাইয়ের সঙ্গে দেখবে ও? ওর চোখের সামনে ওরা রঙডঙ করবে ও কীভাবে তা সহ্য করবে?

বিয়ের দিন কমিউনিটি সেন্টারের সমুদ্র ছিল ওদের এতো ভালোবাসা মাখামাখি ও সহ্য করতে পারছিল না। নিজেকে কন্ট্রোল করতে না পেরে একা ফুয়াদ কে বাইরে পেয়ে কোন দিক না তাকিয়ে পেছনে থেকে মাথায় আঘাত করে বসে। যখন ভাইকে রক্তাক্ত অবস্থায় নিচে পড়তে দেখে ওর বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠে। অনেক আদরে ফুয়াদ কে ছোটো থেকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে তাকেই আঘাত করতে হবে কখনো ওর জানা ছিল না।

ওর হাত কাঁপতে থাকে ও কোন রকম সি সি ক্যামেরা থেকে কাঙ্খিত ফুটেজ ডিলিট করে পালিয়ে আসে। তারপর হসপিটালে গিয়ে ও যখন দেখে ফুয়াদের বাঁচার আসা নিশ্চিত ও নার্সের সাহায্য নেয়। কিন্তু ফুয়াদের কৈ মাছের জান এতো কিছু করেও ওকে মারতে ব্যর্থ সমুদ্র। তারপর লুকিয়ে ও বাসায় যায় আর নিজের ডায়েরি টা রেখে আসে। মারতে ব্যর্থ হয়ে সব জানানোর প্রয়োজন মনে করে কিন্তু নিজের মুখে বলার সাহস নাই ওর। নার্স সব জানিয়ে দেয় ফুয়াদ কে তখন ও চায় ওর ভালোবাসার কথা ফুয়াদ কে জানাতে। ভাইয়ের জন্য এখনো ভালোবাসা আছে কিন্তু সেটা মধুর থেকে কম।

সমুদ্র ফুয়াদ আর মধু কে এক সেকেন্ড ও একা থাকতে দিবে না তাই আবার রিসোর্ট থেকে বেরিয়ে পড়ল। ও নিজের বেশ পরিবর্তন করে আছে যার জন্য সবাই ওকে দেখলে ও চিনছে না।
ফুয়াদ সবাইকে রেখে মধু কে একা নিয়ে কোথায় জানি যাচ্ছে। মধু অবাক হয়ে বারবার জিজ্ঞেস করছে ওকে নিয়ে ফুয়াদ যাচ্ছে কোথায়। ফুয়াদ কিছুতেই বলছে না কোথায় যাচ্ছে ওকে নিয়ে‌। হসপিটালের সামনে এসে মধু রাগী চোখে তাকাল ফুয়াদের দিকে তারপর বলল,,” এসব কি? বলছিলাম না আমার তেমন কিছু হয়নি। তাও আপনার হসপিটালে আসা লাগল?”

” হুম ভাইয়ার চিন্তা করতে করতে আমার তোমার প্রতি অবহেলা করা হয়েছে। এজন্য তোমার এই অবস্থা। এখন চুপচাপ চলো ডক্টরকে সব সমস্যা বলবে।”
মধু ফুয়াদের হাত ছেড়ে দিয়ে উল্টো হাঁটা ধরে বলল,,” আমি যাব না ভেতরে। আমার কিছু হয়নি।”
ফুয়াদ মধুর হাত ধরে গালে স্পর্শ করে বলল,,” আচ্ছা এই কথাটা ডক্টর বললেই আমি মেনে নেব। চলো এবার জান প্লিজ।”

মধু গাল ফুলিয়ে ফুয়াদের সাথে ভেতরে আসলো। ফুয়াদ গতকাল রাতেই কল করে এখানে সিরিয়াল দিয়ে রেখেছিল। সেটা শুনে মধু আরো অবাক হলো। ও ভেবেছিল ও ফুয়াদ কে বুঝতে পারে কিন্তু এই লোকটাকে চেনা আসলেই মুশকিল। গতকাল এমন বিহেভ করল যেন সত্যি মেনে নিয়েছে। কিন্তু পরিকল্পনা তো গতকাল থেকেই।
ডক্টর সব শুনে মধু কে কয়েকটা পরিক্ষা দিল। মধু ডক্টরের কেবিনে থেকে বেরিয়ে ফুয়াদ কে বলল,,” আমার কিছু হয়নি উনি কেন এতো গুলো টেস্ট দিল? উনি ভালো ডক্টর না। দেখেন তো আমাকে কি কোন দিক দিয়ে অসুস্থ মনে হয়?”

” চেক করলে সমস্যা কোথায়?”
দাঁতে দাঁত চেপে মধু নার্সের সাথে চলে গেল। রক্ত নেওয়ার সময় মধু চিল্লাচিল্লি করে হসপিটাল মাথায় নিল। এদিকে সমুদ্র ও ফুয়াদ আর মধুর পিছু পিছু ঘুরছে। সমুদ্রের ও বুকের ভেতরটা কাঁপছে। মধুর বড়ো কোনো অসুখ হলো না তো? ডক্টরের কাছে কেন এসেছে ওরা। ভয় সমুদ্র ও পাচ্ছে। ডক্টর বলল রিপোর্ট কালকে দিবে। বা ফোন করে জানবে যদি ইমার্জেন্সি কিছু হয়ে থাকে।

ফুয়াদ আর বসে থেকে রিপোর্ট নিল না আগামীকাল নিয়ে যাবে। ওরা চলে আসার পর ও সমুদ্র হসপিটালে থেকে গেল। দুই ঘন্টা পর রিপোর্ট রেডি হলো তখন সমুদ্র সেই রিপোর্ট নার্সের মাধ্যমে চেক করার কথা ভাবল। ও নার্সের কাছে গিয়ে টাকা দিয়ে ম্যানেজ করল। ও ভাবল ছবি তুলে ওর এক ফ্রেন্ড ডক্টর তাকে পাঠাবে আর জানবে মধুর কি হয়েছে। ও তাড়াহুড়ো করে ছবি তুলল। নিজে একটু ভালো করে চেক করলেই ও নিজেই বুঝতে পারতো। কিন্তু তা করেনি ও ছবি তুলেই তাড়াতাড়ি হসপিটাল ত্যাগ করল।

হোয়াটসঅ্যাপ এ ছবি পাঠিয়ে ওর সেই বন্ধুকে জিজ্ঞেস করল কি আছে রিপোর্ট এ।
বন্ধু তখন এক্টিভ ছিল না। তাই রিপ্লাই আসলো আধঘন্টা পর। সমুদ্র তখন নিজের রিসোর্ট এ চলে এসেছে। বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই নোটিফিকেশন আসে।
” দোস্ত এটা কার রিপোর্ট রে?”
সমুদ্র বলে,,” কেন কি হয়েছে সিরিয়াস কিছু?”

ওপাশ থেকে বলে,” হ্যাঁ সিরিয়াস তো বটেই। এবার বল কার রিপোর্ট খুশির খবর আছে।”
সমুদ্র সিরিয়াস শুনে ভয় পেয়ে শোয়া থেকে বসে গেছিল। নিচে আবার খুশির খবর শুনে কপাল কুঁচকায়।
” সোজাসুজি বলতে পারিস না?”

প্রেয়সী পর্ব ৬৭

” যার রিপোর্ট দিয়েছিস তিনি তো প্রেগন্যান্ট। তাই বলেছি খুশির খবর। এটা কার রিপোর্ট রে? তুই কি বিয়ে করেছিস? দোস্ত একা একা বিয়ে, বাচ্চা পয়দা করে ফেললি? ডক্টর না হলে তো এখনো জানতে পারতাম না। তাড়াতাড়ি দাওয়াত করে বিয়ে ও বাচ্চা দুই কারণে ট্রিট দিবি।”
প্রেগন্যান্ট মেসেজ টা দেখতেই সমুদ্রের হাতের বাঁধন খুলে যায়। মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল।

প্রেয়সী পর্ব ৬৯