প্রেয়সী পর্ব ৬৯

প্রেয়সী পর্ব ৬৯
নন্দিনী নীলা

মধু প্রেগন্যান্ট জানার পর বাসার সবাই যতটা খুশি ততটাই অখুশি ফুয়াদ। এই নিউজ পাওয়ার পর থেকেই লাপাত্তা হয়ে গেছে ফুয়াদ। আর এদিকে মধু ফুয়াদ কে না পেয়ে ভয়ে ভীত হয়ে আছে। ফুয়াদ চোখের আড়াল হলেই ও আতঙ্কিত হয়ে যায়। এই বুঝি আবার কোন অঘটন ঘটলো। সেই দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে থাকে। মধু ভাবছে এভাবে ভয় নিয়ে কি থাকা যায়? এই ভয় কীভাবে দূর করা যাবে ওর জানা নাই। ও নিজে প্রেগন্যান্ট জানার পর থেকেই ওর মধ্যে এক অদ্ভুত অনুভূতি প্রকাশ পেয়েছে। অদ্ভুত ভাবেই এখন সিঁড়ি ভাঙতে গেলে অজান্তেই হাত পেটে চলে যায়। ছুটে দৌড় দিতে গেলেই মনে হয় আমার সঙ্গে আরেকজন আছে তার কষ্ট হবে না তো?

নিজের চঞ্চল মনটা কেমন বেবির চিন্তায় অস্থির হয়ে থাকে। ওর কি আর এক চিন্তা? স্বামী সন্তান দু’জনকে নিয়েই চিন্তায় অস্থির থাকে। খবরটা জানার পর‌ই ওর শশুর এক গাদা মিষ্টি এনে রিসোর্ট এর সবাইকে খাইয়েছে। তিন্নি তো ওকে জাপ্টে ধরে বলেছে,,” দোস্ত আমার যে কি খুশি লাগছে। আমি ফুপি হবো।”
বাসার সবাই খুশি কিন্তু যার সবচেয়ে বেশি খুশি হবার কথা সে কোথায়?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সন্ধ্যায় ফুয়াদ রিসোর্ট এ ফিরল। ফুয়াদ রুমে ঢুকতেই মধু রাগী চোখে তাকাল ওর দিকে। ফুয়াদ আড়চোখে বিছানায় পলক ফেলে দেখল মধু আগুন চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।‌
ফুয়াদ মনে মনে বলল,, খুব ক্ষেপে আছে।

ফুয়াদ সোজা ওয়াশরুমে চলে গেল। ফ্রেশ হয়ে এসেও দেখল মধু আগের মতোই বসে আছে আর দৃষ্টি ওর দিকে।
ফুয়াদ তোয়ালে দিয়ে হাত মুখ মুছে নিল তারপর মধুর কাছে এসে বসল।
মধু ফুয়াদকে হাতের নাগালে পেতেই দুহাতে ওর শার্ট খামচে ধরে ওর কাঁধে কামড়ে ধরল। ফুয়াদ দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথা সহ্য করার চেষ্টা করছে। মধু কাঁধ ছেড়ে চেঁচিয়ে উঠল,,” আপনি কোথায় গিয়েছিলেন? বাবা হবার খবর পেয়ে আপনি এতোটাই অসন্তুষ্ট যে লাপাত্তা হয়ে গেলেন! আপনার কি বাচ্চার ভরণপোষণ করার ক্ষমতা নাই? এতো কেন অখুশি আপনি?”

কলার দুহাতে ধরে ঝাকাতে ঝাকাতে বলল মধু।
ফুয়াদ ঠোঁট চোকা করে মধুর ঠোঁটে চুমু খেয়ে ওকে থামিয়ে বলল,,” এতো উত্তেজিত হচ্ছ কেন? এই সময় কি এতো উত্তেজিত হ‌ওয়া ঠিক? তোমার ধমক শুনে আমাদের বেবি ভয় পাচ্ছে।দেখি শান্ত হ ও।”
বলেই ফুয়াদ মধুর পেটের কাছে মুখ নিয়ে জামার উপর দিয়ে চুমু এঁকে দিল। মধু ধাক্কা দিয়ে ফুয়াদ কে সরিয়ে দিয়ে বলল,,” আদ্যিখেতা চলছে? সারাদিন ক‌ই ছিলেন আপনি এখন ভালোবাসা দেখাচ্ছেন! লাগবে না এসব আদ্যিখেতা।”

ফুয়াদ মধুর দুই গালে হাত রেখে কপালে চুমু খেয়ে বলল,,” আমি খুব ডিপ্রেশনে ছিলাম মধু। ভাইয়া যা সব শুরু করেছে তার উপর তুমি প্রেগন্যান্ট এসব শুনে আমি টেনশনে পরে গিয়েছিলাম। ভয় পাচ্ছিলাম কি করব ভাইয়ার সাথে আমি লড়াই করতে পারব না মধু। কিন্তু আমার সন্তানের জন্য আমাকে সুস্থ থাকতে হবে তোমাকে আর আমার অনাগত সন্তানের হেফাজত করতে হবে। এসব নিয়ে আমি খুব ডিপ্রেশনে ছিলাম। তাই নিজেকে একটু একাকিত্বের মধ্যে রেখেছি এখন আমার একটাই চাওয়া আল্লাহর কাছে তিনি যেন তোমাদের হেফাজত করে।”
মধু ফুয়াদের কথা শুনে খুশি হয়ে গেল‌। ফুয়াদ কে জড়িয়ে ধরে বলল,,” আমি কত টেনশনে ছিলাম জানেন আমাকে একা রেখে এভাবে কখনো কোথাও যাবেন না।”

” ওকে জান।”
মান অভিমানের পাল্লা মিটিয়ে ফুয়াদ মধু একেঅপর কে জড়িয়ে ধরল।
পরদিন ওরা সবাই বাসায় ফিরে আসলো। বাসায় ফেরার এক দিন পর‌ই মধুর বাবা মা এসে হাজির হলো। হঠাৎ তাদের আগমনে বাসার প্রত্যেক এ অবাক হয়ে যায়। মধু নিজেও হতভম্ব হয়ে যায় বাবা মা একত্রে এখানে কেন এসেছে? মধুর মা মধু কে জড়িয়ে ধরে জানায় মধু প্রেগন্যান্ট এটা তারা শুনতেই ছুটে এসেছে। মধু কপাল কুঁচকে বলল,” তোমরা জানলে কীভাবে?”

মধুর মা বললেন,,” তোর বাপি জানালো।”
মধু বলল,,” বাপি কীভাবে জানলো আমি তো কাউকে জানাই নাই।”
” আমি সেইসব জানি না। তোর বাপি এই খবর দিয়েই আমাকে বলল রেডি হতে তোকে দেখতে যাবে। এতো দিন পর তোকে দেখব এমন খুশির খবর শুনে আর কিছুই মাথায় আনি নাই।”
মধু বাবার মাথায় কি চলছে সেটাই বুঝার চেষ্টা করছে।

ফুয়াদ তখন বাসায় ছিল না। আর মধু বাবা মাকে দেখেই ফুয়াদ কে কল করে খবরটা জানিয়ে দিয়েছে। ফুয়াদ তাড়াতাড়িই বাসায় চলে আসলো। আসার পর মধুর বাবা কারো সাথেই খারাপ আচরণ করেনি। সবার সাথেই সুন্দর করে কথা বলেছে। জিনিসটা দেখে মধুর শক খাচ্ছে। বাবার মতিগতি কিছুই ও বুজতে পারছে না। ফুয়াদ আসতেই তিনি ফুয়াদের ভালোমন্দের খোঁজ খবর ও নিল। ফুয়াদ ও বিস্মিত কন্ঠে উত্তর দিয়েছে।

লাঞ্চের পর মধু নিজের মাকে নিজের রুমে নিয়ে এসে গল্প করছে। এদিকে খাওয়া দাওয়া শেষ করেই ছাদে বসে আছে ফুয়াদ আর মধুর বাবা। মধুর বাবা বলেছে ফুয়াদের সাথে জরুরি কিছু কথা বলবে।
মধু মায়ের সাথে গল্প করলেও টেনশনে আছে বাবা ফুয়াদের সাথে আবার কি কথা বলছে?
” কি এমন জরুরি কথা বলবেন? আপনি আমার সাথে এতো শান্ত স্বরে কথা বলবেন আশা করিনি। কিন্তু এই মধুর স্বরের কারণটা আমি হয়তো ধরতে পারছি।”

মাহতিম হোসেন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,,” আমার ছেলের বিরুদ্ধে যে সব প্রমাণ তোমার কাছে আমি তা নিতে এসেছি। দেখো আমরা এখন আত্নীয় হয়ে উঠেছি তুমি আমার ছেলেকে জেলে থেকে বের হতে দাও। ও আর এসব করবে না আমি কথা দিচ্ছি।”
” অসম্ভব। একজন দাগী আসামি কে আমি ছাড়ানোর জন্য কিছুই করতে পারব না। আমি জানতাম আপনি এসব বলতেই এসেছেন। বাট আই এ্যাম সরি।”

মাহতিম হোসেন বললেন,,” দেখো তুমি সবকিছুর জন্য শুধু আমার ছেলেকেই দায়ী ভাবছো। ভাবছো এসবের পেছনে একমাত্র ওই আছে। কিন্তু তোমার জানার বাইরেও আরো অনেক কিছু আছে। সেসব তুমি জানো না আমি এতো দিন চাইনি এসব তোমাকে জানাতে কারণ আমি চাইনি সব তোমার সামনে খোলাসা হোক। কিন্তু এখন আমার ছেলেই যদি বছরের পর বছর জেলে থাকে তাহলে আমি এসব আড়ালে রেখে কি করব? আমার দুইটাই সন্তান একটা কে তুমি কেড়ে নিয়েছ। যত‌ই হোক মেহেরিমা আমার মেয়ে ও প্রেগন্যান্ট ওর ক্ষতি আমি চাই না। মেয়ে তোমার কাছেই থাকবে কিন্তু সেখানে সেভ থাকে যেন আর আমার ছেলেকে ফিরে পেতে চাই এজন্য আমি তোমাকে সব জানাতে চাই।”

” আপনি আর কি জানাতে চান আমি সব জানি তাই আমাকে আর কোন বানানো কাহিনী শোনাতে আসবেন না।”
মাহতিম বললেন,,” তুমি কিছুই জানো না। তুমি অনেক কম জানো। তোমার জানার বাইরে অনেক কিছু আছে। তোমার মতে তুমি আমার ছেলেকে জেলে পাঠিয়েছ মানে আসলো অপরাধী কে থামিয়ে দিয়েছ কিন্তু সবটাই ভুল। এই জগতের আসল মাস্টার মাইন্ড যে তিনি এখনো সবার আড়ালেই ঘুরে বেড়াচ্ছে যাকে কেউ বিন্দুমাত্র সন্দেহ করেনি। তুমি ভেবেছ আমার ছেলে জেলে আছে সব আটকে গেছে সম্পূর্ণ টাই তোমার ভুল ধারণা এখনো অনেক কিছু চলছে তুমি সংসারে মনোযোগী হয়ে সব কিছু থেকেই আলাদা পড়ে গেছ।”

” নাম কি তার নাম বলুন! আপনি যেহেতু সব জানেন বলছেন না কেন? তাঁকে ধরিয়ে দিন আর নিজের ছেলেকে ছাড়িয়ে নেন এখানে আমার কি কাজ?”
” নাম বললে তুমি বিলিভ করবে না।”
” দেখুন বানোয়াট কাহিনী বলা শেষ হলে এবার আসতে পারেন। আর যেই হোক তাকে পুলিশ খোঁজে বের করবে এখানে আমার কোন কাজ নাই।”

” তুমি ভাবো তোমাকে মারার পেছনে শুধু আমার ছেলে আছে কিন্তু তোমার ভাই ও যে আছে এসব তুমি জানো না।”
ফুয়াদ ঠোঁটের কোনে হাসি এনে বলল,,” আমি এসব জানি।”
মাহতিম হোসেন বিস্মিত কন্ঠে বললেন,” তুমি এসব জানো?”
” হ্যাঁ।”
” তাহলে তো জানোই তোমার আসল শত্রু আমি না তোমার প্রাণের ভাই ই তোমাকে মারতে চায়।”
” হ্যাঁ জানি।”
” সব জানার পর ও এতোটা শান্ত কিভাবে আছো?”
” আপনার কথা শেষ হলে কি এবার আমি উঠতে পারি?”

” সব জানো সব জানার পর ও কেন আমার ছেলেকে একা জেলে রেখেছো যেখানে আমার ছেলের থেকেও বড়ো ক্রিমিনাল তোমার নিজের আপন ভাই।”
” আমার ভাই আমাকে মারতে চেয়েছে তাই আমি তাকে ছেড়ে দিয়েছি কারণ সে আমাকে আদর যত্নে বড় করেছে মারার অধিকার আছে। কিন্তু আপনার ছেলে সাধারণ জনগণ মারতে চেয়েছে মেরেছে।”
মাহতিম হোসেন হেসে উঠল।

” তুমি এখনো সবটা জানো না তাহলে। তুমি হয়তো জানো না এই কাজের আসল বস সমুদ্র।”
ফুয়াদ উঠে চলে যাবে ভেবেছিল। কিন্তু এমন শক পেলে কি আর যাওয়া যায়।
” তার হয়েই আমার ছেলে কাজ করেছে। তোমার ভাইয়ের সাথে আমাদের কাজের সূত্রেই পরিচয়। কাজের সূত্রে আমাদের বাসায় সমুদ্র অনেকবার গিয়েছে। সেখানেই সমুদ্র মেহেরিমা কে দেখে পছন্দ করে। আর বিয়ের প্রস্তাব দেয়। বিনিময়ে অনেক টাকা দিবে বলে। আমরা রাজি হয়ে যাই।

কারণ টাকা ছাড়া আমি আর আমার ছেলে কিছুই বুঝি না এমন। আমার যে কম আছে তা না কিন্তু ওই যে লোভ তাই রাজি হয়ে যাই। সমুদ্রের সাথে বিয়ে ঠিক হবার পর পর বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে আমার বন্ধুর ছেলে। সমুদ্র খবর পেয়ে আমাকে জানান রাজি হতে। আমি অবাক হ‌ই নিজেই বিয়ে করতে পাগল হলো আবার আরেক জায়গায় রাজি হতে বলে কেন তাদের কথা মতো বিয়ের দিন তারিখ ঠিক হয় তারপর শুনি মেহেরিমা পালিয়ে গেছে। মেয়ে বিয়েতে রাজি না অনেকবার বলেছে কিন্তু পালিয়ে যাবার সাহস করবে ভাবিনি।

তারপর সমুদ্র কে সব জানানোর পর শুনলাম সে নাকি জানতোই মেহেরিমা পালিয়ে যাবে। তাই বিয়েতে রাজি হতে বলেছিল। আর সমুদ্রের প্লান ছিল মেহেরিমা পালালে সমুদ্র ওকে বাঁচানোর জন্য আশ্রয় দিবে। কিন্তু ওর আগেই তোমাদের সাথে নাকি মেহেরিমার দেখা হয়ে যায়। আর ওর কাজটা সহজ হয়ে যায় তোমরা ওকে বাসায় নিয়ে যাও। তারপর নিজের ফিলিংস জানানোর আগেই সমুদ্র জানতে পারে তোমরা দুজন দুজনকে ভালোবাসো।”
মাহতিম হোসেন থেমে আবার বলতে লাগে,” সমুদ্র আগে থেকেই তোমাকে মারতে চাইতো। তুমি সমুদ্রের কাজে বারবার বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছ। মনে আছে পুলিশ অফিসার রমেশচন্দ্রের কথা?”
চোখ ভরা এক রাশ বিষ্ময় নিয়ে তাকাল ফুয়াদ মাহতিমের দিকে।

” রমেশচন্দ্র ও তোমার ভাইয়ের লোক ছিল। তাকে যখন সবার সামনে তুলে ধরলে নিজেকে সবার আড়ালে রাখতে নিজেকে বাঁচাতে সমুদ্র তাকে মেরেছে। আমার ছেলেকে আমাকে ও ভয় দেখিয়েছে সমুদ্র যদি তার নাম বলি আমাদের কেউ মেরে ফেলবে। তুমি যেই ভয় আমার ছেলেকে দেখাও সমুদ্র ও সেই ভয় দেখায়।

প্রেয়সী পর্ব ৬৮

সমুদ্র যাকে দিয়েই নিজের কার্য সিদ্ধি করায় তার সব কুকর্মের প্রমাণ রেখে দেয় তাই ধরা পরলেও কেউ সমুদ্রের নাম বলতে পারে না নাম বললেও সে বাঁচবে না কারণ সমুদ্র তাকে বাঁচতে দিবে না। আমার ছেলেকে কবে সমুদ্র মেরে দেয় আমি সেই ভয়ে থাকি। আবার কখন তুমি সব প্রমাণ পুলিশের হাতে দাও আমার ছেলে এখন শুধু একজন কিডন্যাপ কারী হয়ে গেছে তুমি সব প্রমাণ দিলে ওর ফাঁসি হবে আমার ছেলেকে আমি হারাতে চাই না। তোমার পায়ে পড়ছি আমার ছেলেকে বাঁচাও।”

প্রেয়সী পর্ব ৭০