অনেক সাধনার পরে শেষ পর্ব 

অনেক সাধনার পরে শেষ পর্ব 
অরনিশা সাথী

–“স্ট্রেস এবং খাবার-দাবারে অনিয়মিত হওয়ার জন্য’ই সেন্স হারিয়েছেন উনি। এমনিতে আর কোনো চিন্তার কারণ নেই, আপনি উনাকে বাসায় নিয়ে যেতে পারেন।”
গড়গড় করে উপরোক্ত কথাগুলো ইংরেজিতে বলে নুহাশের পানে তাকালো ডক্টর ফ্যান্সি। নুহাশ সৌজন্য হেসে বলে,
–“থ্যাঙ্কিউ ম্যাম।”
–“নট মেনশন, ইট’স মাই ডিউটি।”

কথাটা বলে চমৎকার হেসে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলেন ফ্যান্সি। নুহাশ রুজবার হাত ধরতেই রুজবা চোখ মেলে তাকায়। নুহাশ গম্ভীর স্বরে বলে,
–“খাবারে অনিয়ম করছো কেন রুজবা? কিভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছো দেখলে তো?”
রুজবা এক গাল হাসার চেষ্টা করে বললো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

–“স্যরি, আর হবে না।”
নুহাশ কিছু না বলে রুজবাকে ধরে বসালো। মাত্রই স্যালাইন শেষ হয়েছে। এখন বাসায় নিয়ে যাবে ওকে। ধরে ধরে বিছানা থেকে নামিয়ে বললো,
–“আগে বাসায় যাই, তারপর এ বিষয়ে কথা বলছি।”

কেটেছে আরো দেড় মাস। রুজবা কিচেনে রান্না করছে দুপুরর জন্য। এমন সময় ফোন বেজে উঠে। ফোন সবসময় কাছেই রাখে। নুহাশ কড়াকড়ি ভাবে বলেছে ফোন সবসময় সাথে সাথে রাখতে। নুহাশ ফোন দিলেই যাতে সঙ্গে সঙ্গে রিসিভ করতে পারে। তাই আজও ফোন কাছেই ছিলো। ফোন হাতে নিয়ে দেখে কিয়ানের হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বার থেকে ফোন এসেছে। রুজবা ভ্রু কুঁচকে ফেলে। এ সময়ে তো বাংলাদেশে অনেক রাত। এখন ফোন দিলো যে? কোনো কিছু হলো না তো আবার? দ্রুত ফোন রিসিভ করতেই স্ক্রিনে ভেসে উঠলো সদ্য জন্ম নেওয়া ফুটফুটে এক বাচ্চার মুখ। কিয়ান বেশ উৎফুল্ল মনে বলছে,

–“রুজবা আমি ছেলের বাবা হয়েছি।”
–“যাক আলহামদুলিল্লাহ। ফারিন কেমন আছে? ও কোথায়?”
–“ওকে অবজারভেশনে রাখা হয়েছে। ঘন্টা খানেক বাদেই বেডে দিয়ে দেবে। বাচ্চা আর বাচ্চার মা দুজনেই আল্লাহ’র রহমতে সুস্থ আছে।”

–“ওকে বেডে দিলে ওর সাথে কথা বলিয়ে দিয়েন।”
–“আচ্ছা, তুমি নুহাশকে জানিয়ে দিও। আমি বেশ ক’বার ফোন দিলাম কিন্তু ও রিসিভ করেনি।”
–“অফিসে আছেন উনি, আচ্ছা জানাবো সমস্যা নেই।”
–“একটা ফোন এসেছে রুজবা, পড়ে কথা বলছি তোমার সাথে।”
–“আচ্ছা।”
কিয়ান ফোন রেখে দেয়৷ রুজবার চোখে শুধু ফারিন আর কিয়ানের সদ্য জন্ম নেওয়া বাচ্চাটার মুখ’টাই ভাসছে। কি নিষ্পাপ, স্নিগ্ধ বাচ্চাটা। মা-শা-আল্লাহ! মা-শা-আল্লাহ!

টেবিলের সবকিছু গোছগাছ করছে রাত্রি। জারাফ ক্ষানিকটা আগেই বন্ধুদের সাথে বেরিয়েছে নাস্তা শেষ করে। জুহি হাতে হাতে টেবিল গোছাতে সাহায্য করছে। আর ওর শ্বাশুড়ি দুপুরের জন্য রান্না করছে। এ বাড়িতে এসেছে মাস দুয়েক হলো। রাত্রির মনে হয় খুব ভাগ্য করে শ্বাশুড়ি আর ননদ পেয়েছে ও। জীবনসঙ্গী হিসেবে যাকে পেয়েছে সে’ও মন্দ না। তবে ওর কেন জানি মনে হয় জারাফ পরিপূর্ণ ভাবে ভালোবাসতে এখনো সক্ষম হয়নি। কিছুটা ফারাক তো অবশ্যই আছে। এ নিয়ে মাঝে মাঝে বেশ মন খারাপ হয় রাত্রির। তবে সেটা নিয়ে ও ভাবতে চায় না। জারাফের থেকে যতটা ভালোবাসা পেয়েছে ততটা ভালোবাসা নিয়েই ওর দিব্যি চলে যাবে। পরিপূর্ণ না হোক, কিছুটা হলেও তো মানুষটা ওকে ভালোবাসে। এতেই হবে। রাত্রি’কে অন্যমনস্ক দেখে জুহি বলে,

–“কিছু হয়েছে ভাবী? অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে তোমায়।”
রাত্রি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
–“তোমার থেকে কিছু জানার আছে আমার। বলবে সত্যিটা?”
জুহি কোনো কিছু না ভেবেই বললো,
–“বলবো না কেন? অবশ্যই বলবো, বলো কি জানতে চাও?”
–“তুমি আমার ঘরে যাও, আমি হাতের কাজ’টা গুছিয়ে আসছি।”

জুহি গেল না। বরং দুজনে একসাথে মিলে সব কাজ গোছগাছ করে একই সঙ্গে জারাফের ঘরে যায়। বিছানায় বসে দুজনে। রাত্রি সরাসরি প্রশ্ন করে,
–“উনার কি আগে কোনো সম্পর্ক ছিলো?
চমকে তাকায় জুহি। জারাফ কি তবে রাত্রিকে মেনে নেয়নি? মূহুর্তের মাঝেই প্রশ্ন’টা উঁকি মারলো জুহির মনে। জুহি ধীর স্বরে প্রশ্ন করে,

–“হঠাৎ এই প্রশ্ন ভাবী? ভাইয়ার সাথে সব ঠিকঠাক আছে তো?”
–“হ্যাঁ সব ঠিক আছে।”
–“তাহলে হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন করলে ভাবী? ভাইয়া তোমার সাথে বাজে বিহেভিয়ার করছে? তোমাকে কি___”
–“এই না না, এরকম কিছু না। আসলে আমার কেন জানি মনে হচ্ছে___”

–“একটা কথা বলি ভাবী? অতীত সবার জীবনেই আছে। কেউ চেষ্টা করে সেই অতীতকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যেতে আর কেউ সেই অতীতকে আকঁড়ে ধরেই দুমড়ে মুচড়ে মরে প্রতিনিয়ত। মিথ্যে বলবো না, আমার ভাইয়ার জীবনেও অতীত আছে। কিন্তু আমি যতটা দেখেছি আমার যতটা মনে হয় ভাইয়া অতীত’টা পেছনে ফেলে বর্তমান’কে সাথে নিয়ে বাঁচতে চায়। নতুন করে শুরু করতে চায় সবটা। আচ্ছা তুমিই বলো, ভাইয়া কি তোমার অধিকার থেকে তোমায় বঞ্চিত করেছে? কখনো ভাইয়ার আচরণে এমন কিছুর আভাস পেয়েছো যাতে মনে হয় ভাইয়া তোমাকে মেনে নেয়নি, তোমার জন্য তার মনে কোনো অনূভুতি নেই?”

–“নাহ, এমন কিছু না। তোমার ভাইয়া আমাকে আমার প্রাপ্য’টা দেয় সবসময়। কোনো কিছু থেকে বঞ্চিত করেনি কিন্তু___”
–“কিন্তু?”
–“আচ্ছা ছাড়ো সেসব কথা। আমি তো বর্তমান, আমি তোমার ভাইয়ার ভবিষ্যৎ’ও হতে চাই।”
–“আমার ভাইয়া’টা না প্রথমে অন্যায় করেছিলো একজনের সাথে, পরবর্তীতে তাকে হারিয়েই আমার ভাই উম্মাদের মতো আচরণ করেছে। মা যার সাথে বিয়ে ঠিক করেছিলো সে’ও ভাইয়াকে ঠকিয়েছে জানোই তো সব। এখন তোমার মাঝে ভাইয়া সুখ খুঁজে। তোমাকে নিয়ে ভালো আছে। অতীতের সেই কালো অধ্যায়ের জন্য আমার ভাইয়া’কে ছেড়ে যেও না প্লিজ।”

রাত্রি জুহিকে জাপ্টে ধরে বলে,
–“ধুর পাগলি! কি বলছো? উনি তো আমার সবকিছু উনাকে ছেড়ে আমি বাঁচি কি করে? আল্লাহ তো উনার সাথে আমার জুড়ি লিখে রেখেছে। আমি চেষ্টা করবো ইহকালেও যেন আমাদের এই পবিত্র বন্ধন কখনো ছুঁটে না যায়।”
–“এজন্যই তো তোমাকে এত্তগুলা ভালোবাসি ভাবী। তোমার মতো করে আমার ভাইয়াকে কেউ বুঝবে না আর।”
কথাগুলো বলে রাত্রির কাঁধে মুখ গুজে রাখলো জুহি। চোখ বন্ধ রেখে মনে মনে ভাবছে,

–“আর একজন ছিলো ভাবী, যাকে আমার ভাই হেলায় হারিয়েছে। যে আমার ভাইয়াকে খুব ভালো বুঝতো, খুব ভালোবাসতো। কিন্তু আমার ভাই সেই রুজবা আপুকেই ঠকিয়েছে চরম ভাবে। তাই তো শেষে নিজেও ঠকেছে, উম্মাদের মতো আচরণ করেছে রুজবা আপু’র বিয়ের সময়। রুজবা আপুর পরে একমাত্র তুমি যে আমার ভাইয়াকে এতটা ভালোবাসো। তোমরা আজীবন একসাথে থাকো, ভালো থাকো এই দোয়া রইলো আমার তরফ থেকে।”

কিয়ান আর ফারিনের ছেলে হয়েছে আজ সাতদিন। ছেলের নাম রাখবে আজ ওরা। ফারিনের ইচ্ছে রুজবা রাখবে নাম। সে অনুযায়ী ওরা কেউ-ই তেমন একটা নাম ঠিক করে রাখেনি। রুজবার অপেক্ষায় আছে সকলে। মেয়েটা বলেছে সকাল সকাল ভিডিও কলে ফোন করে বাবুকে দেখবে আর কি নাম ঠিক করেছে সেটাও জানাবে। বাংলাদেশ সময়ে বেলা এগারোটা বাজে এখন। রুজবা বলেছিলো দশটা নাগাদ নাম জানিয়ে দিবে। কিন্তু রুজবা বা নুহাশ কেউ-ই অনলাইনে নেই।কিয়ান বললো,

–“ওদের ওখানে তো এখন রাত। হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। এখন আর ফোন-টোন দেওয়ার দরকার নেই। সময় বুঝে ওরা’ই ফোন দেবে দেখবা।”
হসপিটাল থেকে কিয়ান সরাসরি নিজেদের বাসায় নিয়ে এসেছে বউ-বাচ্চাকে। বাবার বাড়ি যেতে দেয়নি। আসাদ সাহেব মেয়ে আর নাতীকে নিজের বাসায় নিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু কিয়ান রিকুয়েষ্ট করে বলেছে,
–“দিন পনেরো আমাদের বাসায় থাকুক, তারপর না হয় আপনাদের ওখানে যাবে সমস্যা নেই।”
আসাদ সাহেব আর না করতে পারেনি।

ফারিনের ছেলেটা খুবই শান্তশিষ্ট হয়েছে। কিন্তু ক্ষুধা লাগলে যেন পুরো তল্লাটে বাচ্চার কান্নার শব্দে বুঝতে পারে এই বাড়িতে বাবু আছে। নয়তো বুঝার কোনো সুযোগ নেই। ছেলে’কে কোলে নিয়ে দরজার দিকে পিঠ করে বসে ছিলো ফারিন। এমন সময় এক জোড়া হাত শক্ত করে চেপে ধরে ফারিনের দুই চোখ। আচমকা ফারিন ভয় পেয়ে যায়। কে হতে পারে? হাত অনুসরণ করে কিয়ান পাশে তাকাতেই রুজবা আর নুহাশকে দেখে খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠে। চেঁচিয়ে কিছু বলতে গেলে নুহাশ ইশারায় চুপ থাকতে বলে। কিয়ান বিছানা ছেড়ে উঠে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নুহাশকে। ছেড়ে দিলেই যেন হারিয়ে যাবে। রুজবা তখনো ফারিনের চোখ চেপে ধরে আছে। ফারিন বুঝতে না পেরে বলে,

–“এই কিয়ান? কে চোখ ধরেছে বলো না, আমি বুঝতে পারছি না তো।”
–“গেস করো কে হতে পারে।”
কিয়ানের কথায় ফারিন মুখ কালো করে বলে,
–“বুঝতে পারছি না তো।”
রুজবা চোখ ধরে রেখেই বললো,
–“কন্ঠ শুনলে বুঝতে পারবি তো?”
ফারিন কিয়ানকে বললো,
–“ছেলে’কে একটু ধরো তো।”

কিয়ান চট করে ছেলেকে কোলে তুলে নিলো। ফারিন রুজবার হাতের উপর হাত রেখে বললো,
–“রুজবা, রুজবা তুই___”
রুজবা ফারিনের চোখ ছেড়ে দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ফারিনকে। ফারিন’ও দীর্ঘসময় বাদে প্রিয় বান্ধবীকে পেয়ে সুখের অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে। নুহাশ বাবুকে কোলে নিয়েছে ততক্ষণে। রুজবা কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে,
–“বছর তিনেক দূরে ছিলাম তাতেই আমার স্পর্শ, উপস্থিতি সব ভুলে গেলি? আর কিছুদিন পর আসলে তো আমার কন্ঠ শুনেও চিনতে পারতি না।”

–“এরকম না, আসলে একটু___”
–“হইছে, বুঝতে পারছি। এবার আমার বাবাটাকে আমার কোলে দিন তো কিয়ান ভাই।”
কথাটা বলে কিয়ানের দিকে তাকাতেই দেখে কিয়ানের কোল শুণ্য। বাবু নুহাশের কোলে। রুজবা কপাট রাগ দেখিয়ে বলে,

–“ওকে আমার কোলে দাও, কথা ছিলো আগে আমি কোলে নেবো, তাহলে তুমি কেন নিলে?”
রুজবা হাত বাড়াতেই নুহাশ বাবুকে রুজবার কোলে দেয়। হই হুল্লোড় শুনে জান্নাত ওরা এতক্ষণে কিয়ানের ঘরে এসে ভীর জমিয়েছে। জান্নাত আর রাশেদা বেগম কিচেনে রান্না করছিলো। এসেই রুজবা আর নুহাশকে দেখে উনারা’ও খুশিতে আটখানা হয়ে যায়। আলাপসালাপ করে ওরা দুজনে আবার কিচেনে দৌড় লাগায়। ফারিন আর কিয়ান একে অপরের দিকে তাকিয়ে আবার নুহাশ রুজবার দিকে তাকায়। সমস্বরে বলে,
–“তুমি? বাহ কত্ত উন্নতি হয়েছে দেখছি।”

রুজবা লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেলে। ও জানতো সবাই মজা উড়াবে তাই তুমি বলতে চাইছিলো না। কিন্তু ওর বর মহাশয় তো আবার এখন আপনি শুনলে রেগে যায় তাই আর কি করা? নুহাশ ভ্রু কুঁচকে বললো,
–“তোর বউ তোরে বিয়ের আগে থেকে তুমি বলে, আর আমার বউ আমায় বিয়ের এতদিন বাদে থেকে তুমি বলছে তা’ও আবার তোরা লজ্জা দিচ্ছিস? দিস ইজ নট ডান।”
কিয়ান প্রসঙ্গ পাল্টে বলে,

–“বাসায় দেখা করে এসেছিস নাকি সরাসরি?”
–“বাসায় দেখা করে লাগেজ রেখেই এসেছি।”
নুহাশের কথায় কিয়ান মুচকি হাসে। রুজবা বলে,
–“চেনটা?”

নুহাশ মুচকি হেসে পকেট থেকে চেনের বক্স বের করে রুজবার হাতে দেয়। রুজবা বাবুর গলায় চেন পড়িয়ে কপালে আলতো করে চুমু খেয়ে বলে,
–“ফাহাদ, ফাহাদ ফারদিন। কেমন হবে নামটা?”
–“খুব সুন্দর, আমার সাথে আমার শালীকার পছন্দটা মিলে গেলো তো। আমিও ভেবেছিলাম ফারিনের নামের সাথে মিলিয়েই রাখতে।”
রুজবা প্রত্যুত্তরে কিছু না বলে শুধু হাসলো।

শাহানা বেগম পরম যত্নে ছেলে আর ছেলের বউকে খাওয়াচ্ছেন। কত্তদিন বাদে তারা দেশে ফিরেছে। ওখানে কি খেয়েছে না খেয়েছে তার ঠিক আছে নাকি? শাহানা বেগম রুজবার খাওয়া দাওয়ার দিকে বিশেষ ভাবে নজর দিচ্ছে। তা দেখে নুহাশ বলে,
–“মায়ের কাছে এবার তার ছেলের থেকে ছেলের বউ বেশি প্রায়োরিটি পাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে?”
–“একদম ঠিক মনে হচ্ছে তোর। মেয়েটাকে সাথে করে নিয়ে গিয়েছিলি কেমন আর নিয়ে এসেছিস কেমন দেখ ভালো করে। পার্থক্য’টা কি চোখে পড়ছে না?”

নুহাশ মাথা ঝাকালো। যার অর্থাৎ চোখে পড়ে পার্থক্য’টা। নুহাশ নিজেও মানে মেয়েটা আগের থেকে বেশ শুকিয়ে গেছে। এখন যদি বলে খাওয়া দাওয়ায় অনিয়ম আর অতিরিক্ত স্ট্রেসের ফলে ম্যাডাম দুই বার সেন্সলেস হয়ে পড়েছে, মাঝে দুদিন হসপিটালে অ্যাডমিট ছিলো শরীর দূর্বলের জন্য তাহলে নুহাশের পিঠের ছাল আর আস্তো থাকবেনা মেবি। একটা বিষয় নুহাশ’কে বেশ ভাবাচ্ছে।

মেয়েটা ইদানীং একটু বেশিই হুটহাট সেন্সলেস হয়ে পড়ে যাচ্ছে। বিডিতে ব্যাক করার আগের দিনও সে সেন্সলেস হয়ে পড়েছিলো। রুজবার হুটহাট এরকম অসুস্থতার কারণ খুঁজে পাচ্ছে না নুহাশ। লাস্ট টাইম ডক্টরের কাছে নেওয়ার আগেই জ্ঞান ফিরে রুজবার। নুহাশ তবুও নিতে চেয়েছিলো রুজবা রাজি হয়নি। বলেছে আগের দুবারের মতো এবারেও নিশ্চয়ই স্ট্রেসের কারণেই হয়েছে এমন। আদিরা নুহাশের কাঁধে হাত রেখে ঝাকাতেই নুহাশের হুশ ফিরে। খাওয়ায় মনোযোগ দেয়। নোমান সাহেব রুজবাকে বলে,

–“বাসায় কথা বলেছো রুজবা মা?”
–“নাহ বাবা। ভেবেছি একেবারে বাসায় গিয়ে চমকে দেবো সবাইকে।”
শাহানা বেগম হেসে বললো,
–“তাহলে কাল সকাল সকাল চলে যেও। সকালের দিকে না গেলে তো আবার বেয়াই সাহেবকে বাসায় পাবা না।”
রুজবা মুচকি হেসে মাথা নাড়ালো। খাওয়া দাওয়া শেষে নুহাশ আর রুজবা লাগেজ খোলে। সবার জন্য আনা গিফট গুলো সবার হাতে দিয়ে একবারে নিজেদের ঘরে যায় শোয়ার জন্য। নুহাশ একটা লাগেজ আলমারির পাশে রেখ বলে,

–“ও বাসায় যাওয়ার সময় এই লাগেজের কথা মনে করিও।”
রুজবা ভ্রু কুঁচকায়। নুহাশ জানায় এই লাগেজে ও বাড়ির সকলের জন্য গিফট আছে। রুজবা মুচকি হাসে। আসলেই ও অনেক লাকি নুহাশকে পেয়ে৷
ঘড়ির কাটায় রাতের সাড়ে নয়টা বাজে। রুজবা ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে চুল আচঁড়াচ্ছে। নুহাশ পেছন থেকে রুজবার দুই কাঁধে হাত রাখতেই রুজবা উঠে দাঁড়ায়। নুহাশ রুজবার দুই গালে হাত রেখে বলে,

–“একটা প্রশ্ন করি?”
–“অনুমতি নেওয়ার কি আছে?”
–“লাস্ট পিরিয়ড হয়েছে কবে তোমার?”
–“দুই মাস আগে, কেন?”
–“দু মাস ধরে তোমার পিরিয়ড অফ তুমি আমাকে আগে জানাবা না?”
কথাটা বলেই আলমারি থেকে জ্যাকেট বের করে গায়ে জড়াতে জড়াতে বলে,
–“আমি একটু আসছি, তুমি শুয়ে পড়ো।”
–“কোথায় যাচ্ছো সেটা তো বলে যাবা।”
–“আসছি দশ মিনিটের মধ্যে।”
কথাটা বলে এক মূহুর্ত দাঁড়ায় না নুহাশ। রুজবা ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থাকে শুধু।

রোজকার মতো সকাল সাতটায় এলার্ম বাজে। আজ রুজবার আগেই নুহাশের ঘুম ভাঙে। নুহাশ রুজবাকে ডেকে তুলে। হাতে একটা কীট ধরিয়ে দিতেই রুজবা ভ্রু কুঁচকে বলে,
–“সকাল সকাল ঘুম থেকে তুলে এভাবে___”
–“আহা! যাও না। হয়তো আল্লাহ ভালো কিছু লিখে রেখেছে আমাদের জন্য।”
রুজবা কথা বাড়ায় না। চুপচাপ উঠে ওয়াশরুমে চলে যায়। নুহাশ বারবার পায়চারী করছে ঘরের মধ্যে। কাল সারা রাত ঘুম হয়নি ওর। রুজবা আসছে না দেখে নুহাশ বলে,

–“আর কতক্ষণ রুজবা? এখনো টেস্ট করা হয়নি?”
কোনো সাড়া নেই। নুহাশ আবারো বলে,
–“তুমি বের হবে? এভাবে চুপ করে আছো কেন? চিন্তা হচ্ছে তো। কি আসলো রেজাল্ট?”
খট করে দরজা খুলে বেরিয়ে আসে রুজবা। ধপ করে বিছানায় বসে। নুহাশ তৎক্ষনাৎ এগিয়ে এসে কীট হাতে নিয়ে দেখে রেজাল্ট পজিটিভ। খুশিতে রুজবাকে জাপ্টে ধরে নুহাশ। রুজবাকে তখনো থম মেরে বসে থাকতে দেখে নুহাশ ওকে ছেড়ে দিয়ে প্রশ্ন করে,

–“তুমি খুশি না?”
রুজবা নুহাশকে জাপ্টে ধরে ডুঁকরে কেঁদে উঠে। হেঁচকি তুলে কাঁদছে মেয়েটা। খুশির কান্না। কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে,
–“এই দিনটার জন্য কতগুলো দিন, কতগুলো মাস, বছর অপেক্ষা করেছি আমি। ফাইনালি আল্লাহ আমাদের এই সময়টা উপহার দিয়েছে নুহাশ।”
বলে নুহাশের বুকে মুখ গুজে কাঁদতে থাকে রুজবা। বাইরে থেকে আদিরা এদিক দিয়েই যাচ্ছিলো। ঘরে কান্নার শব্দ পেয়ে দরজা থাক্কা দিয়ে বলে,

–“এই রুজবা? কাঁদছো কেন? কিছু হলো? নুহাশ___নুহাশ দরজা খোলো, রুজবা কাঁদছে কেন?”
নুহাশ রুজবাকে বিছানায় বসিয়ে দরজা খুলে দেয়। আদিরা থতমত খেয়ে যায় নুহাশের চোখে পানি আর ঠোঁটে হাসি দেখে। আদিরা প্রশ্ন করে,

–“কি হয়েছে?”
নুহাশ আদিরাকে কীট’টা দেখায়। তা দেখে আদিরা’ও ভীষণ খুশি। ভেতরে গিয়ে রুজবাকে জড়িয়ে ধরে। রুজবা আবারো কাঁদে। তা দেখে আদিরা ওর চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে,
–“কাঁদছিস কেন? এটা তো খুশির খবর।”
–“খুশিতেই কাঁদছি ভাবী।”
–“তোরা আয়, আমি গিয়ে সবাইকে খবরটা দিচ্ছি।”
কথাটা বলে ছুঁটে বেরিয়ে যায় আদিরা।

সকালের নাস্তা করতে বসেছে রায়হান সাহেব ও তার পরিবার। সেসময়েই ভেতরে প্রবেশ করে রুজবা আর নুহাশ। সর্বপ্রথম রাফাতের চোখ পড়ে দরজার দিকে। বছর তিনেক বাদে বোন আর বোন জামাইকে দেখে খাবার ছেড়ে দরজায় এগিয়ে আসে। আপু বলে জড়িয়ে ধরে রুজবাকে। তখনই সবার নজরে আসে ওরা দুজনে। অনেকগুলো দিন বাদে সবাই রুজবাকে পেয়ে খুশিতে আত্মহারা। শারমিন বেগম তো কান্না জুড়ে দিয়েছে। খুশিটাকে আরো বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য শাহানা বেগম ফোন করেন। প্রথমে রায়হান সাহেবকে খুশির খবরটা দিয়ে শারমিন বেগমকেও জানান। শারমিন বেগম খুশিতে চুমু খায় মেয়ের কপালে। নুহাশ দাঁড়িয়ে আছে হুশে আসতেই জামাই আদরে লেগে পড়েন তিনি।

বিকেলের দিকে হাঁটতে বেরিয়েছে নুহাশ রুজবা আর রুপশা। জারাফদের এলাকায় আসতেই আগের ন্যায় এখনো রুজবার বুকটা মৃদু কেঁপে উঠলো। সবার আড়ালে বুকের উপর হাত রেখে পরপর কয়েকটা শ্বাস নিলো সে। শুনেছে জারাফ বিয়ে করেছে। তবে সেটা নিদ্রাকে না। অন্য মেয়েকে। আচ্ছা কেমন মানিয়েছে দুজনকে পাশাপাশি? ওদের থেকেও বেশি সুন্দর লাগে দুজনকে একসাথে? নিজের ভাবনায় নিজেই বিরক্ত হলো। এখনো এসব ভাবনা কি করে আসতে পারে? ও তো সব ভুলে গেছে। আগের কিচ্ছু মনে রাখতে চায় না ও। কিন্তু মনে রাখতে না চাইলেও কি তা ভোলা যায়? বুকের বা পাশের ছোট্ট একটা কুঠুরিতে তো তালাবদ্ধ অবস্থায় আগের সেই মানুষটা আমৃত্যু রয়ে যায়৷ খুব গোপনে, যত্নে, অপ্রকাশ্যে।

সাহিল এসে সামনে দাঁড়াতেই রুজবার মুখে হাসি বাড়ে। একগাল হেসে বলে,
–“কেমন আছো সাহিল ভাই?”
–“ভালো তুই? দেশে ফিরলি কবে?”
–“কালকেই। তারপর কি অবস্থা বলো? বিয়ে শাদী করেছো?”
–“হ্যাঁ একটা মেয়েও আছে, ছোট্ট ছয় মাসের।”
–“আনিকা আপুকে নিশ্চয়ই? কি নাম রেখেছো মামনীর?”
–“আমিরা সারা।”
–“আচ্ছা___”
–“সাহিল?”

রুজবা পুরো কথা বলার আগেই জারাফ ডাকে ওকে। জারাফ এখনো দেখেনি রুজবাকে। কেননা রুজবা জারাফের দিকে পিঠ করে দাঁড়ানো। পরিচিত সেই প্রিয় কন্ঠস্বর শুনে এক মূহুর্তের জন্য যেন হার্টবিট থেমে গেলো রুজবার। রুজবা চট করে পেছনে তাকালো। চোখাচোখি হলো চার চোখের। বহু দিন পর পরিচিত মুখটা দেখে স্তব্ধ দুজনেই। রুজবার সামনে এসেই দাঁড়িয়ে পড়ে জারাফ। পলকহীন চোখে দেখছে শুধু। জারাফ নিজে থেকেই প্রশ্ন করে,
–“কেমন আছো?”

রুজবা পাশে নুহাশের দিকে তাকায়৷ নুহাশ আর রুপশা ওদের থেকে ক্ষানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। সাহিলের সাথে কথা বলছিলো বিধায় ওরা দুজনে একটু সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলো। নুহাশ ইশারা করলো জারাফের সাথে কথা বলতে। রুজবা কম্পিত কন্ঠে বললো,
–“ভালো আছি, তুমি?”
–“আলহামদুলিল্লাহ। বরের সাথে পরিচয় করাবা না?”

রুজবা হেসে নুহাশকে ডাকে। নুহাশ পরিচিত হয় জারাফের সাথে। সাহিলের সাথে তো আগে থেকেই পরিচিত। নুহাশ ওদের কথা বলতে বলে আবার রুপশার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। দুজনে ফোন কিছু একটা দেখছে আর হাসছে। জারাফ রুজবার দিকে তাকিয়ে বলে,

–“এত শুকিয়েছো কিভাবে? অসুস্থ তুমি? চোখমুখ ঠিক লাগছে না।”
–“অনেকটা পথ জার্নি করেছি তাই হয়তো এমন লাগছে। তারপর কি খবর? বউ কেমন আছে?”
–“আলহামদুলিল্লাহ ভালো।”

–“এই দোয়া’টাই করি। সবসময় ভালো থেকো, আল্লাহ তোমার বিবাহিত জীবনে অফুরন্ত সুখ শান্তি এনে দিক।”
কথাটা বলে আর দাঁড়ালো না। নুহাশের কাছে চলে গেলো। হাঁটতে শুরু করলো আবার তিনজনে। রুজবা নুহাশের একটা বাহু জড়িয়ে ধরে হাঁটছে৷ অতীত কখনো সামনে টেনে আনতে নেই। অতীতকে সবসময় পেছনেই ফেলে আসতে হয়। হাঁটতে হাঁটতে আবার বাসার দিকে চলে আসে ওরা।

রাতে ব্যালকোনিতে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছে রুজবা। নুহাশ পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। রুজবা নুহাশের উপর পুরো ভর ছেড়ে দিয়ে বলে,
–“একটা কথা বলবো?”
নুহাশ রুজবার মাথায় চুমু খেয়ে বলে,
–“বলেন ম্যাডাম।”
রুজবা চোখ বন্ধ রেখে পরপর কয়েকটা শ্বাস নিয়ে বললো,
–“আমি তোমাকে ভালোবাসি।”

কিছু সেকেন্ডের জন্য থম মেরে যায় নুহাশ। তারপর রুজবাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে কপালে চুমু দিয়ে বলে,
–“ফাইনালি? #অনেক_সাধনার_পর তাহলে আমার ভালোবাসা সার্থক হলো।”
রুজবা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নুহাশকে। নুহাশ আবারো কপালে ঠোঁট ছোঁয়ায়। উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলে,
–“আজকের তারিখটা আমার জন্য বেশ লাকি মনে হচ্ছে। দিন শুরু হচ্ছে বাবা হওয়ার খবর শুনে। আর রাত শেষ হচ্ছে বউয়ের মুখ থেকে ভালোবাসি কথা শুনে। হাউ লাকি আই অ্যাম।”
রুজবা কিছু বললো না। নুহাশ আবারো বলে,

অনেক সাধনার পরে পর্ব ৪৮

–“আর একবার বলবে?”
–“কি?”
–“ভালোবাসি।”
–“আমিও ভালোবাসি।”

সমাপ্ত