বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৩৮

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৩৮
জাওয়াদ জামী

তাহমিদ রাতে বাসায় এসে দেখল আনান, সিক্তা আর কুহু মিলে ওর রুমে আড্ডা দিচ্ছে। আনান আর সিক্তাই বেশি বকবক করছে। আর কুহু গালে হাত দিয়ে ওদের কথা শুনছে।
” কি রে আনান, তুই বাসায় যাসনি? এটা ঠিক নয় বুঝলি? অভ্যাস পাল্টা। নইলে দেখবি ভবিষ্যতে এই বাড়ি ছেড়ে কোথাও যেতে মন চাইবেনা। এই যে আমাকে দেখ, বিয়ের কতদিন পেরিয়ে গেছে অথচ একবারও শ্বশুর বাড়িতে যেতে পারলামনা। আর না পেলাম জামাই আপ্যায়ন। কিন্তু তোর কপাল দেখ! আফসোস আনান আফসোস। ”

তাহমিদের কথা শুনে সিক্তা লজ্জায় পারলে মাটিতে মিশে যায়। ও নিশ্চিত তাহমিদ ওর আর আনানের সম্পর্কের কথা জানে।
” সবই কপালের খেলা, ভাই। সবাইতো আর আনান নয়। আনানের মত হতে গেলে যোগ্যতা লাগে। আনান অনলি ওয়ান পিস। অবশ্য আমার কপালের সাথে কপাল ঘষে দেখতে পার। এতে যদি তোমার ভাগ্য খোলে। ” আনান ভাব নিয়ে বলল।
” তাহলে তুই বলতে চাচ্ছিস আমার যোগ্যতা নেই! তুই আজকাল আমাকে ডিরেক্ট অপমান করছিস। এর ফল খুব ভালো হবে বলে কি তুই মনে করিস? ”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

” যুদ্ধে আমারই জয় নিশ্চিত। তাই আপাতত তোমাকে ভয় পাওয়ার কোন কারন দেখছিনা। এই আনানের বুকে এখন অনেক সাহস। কোন পা’গ’ল ডক্টরকে আনান ভয় পায়না। ”
কুহু ওদের দু’জনের কথা শুনে নিচের মাথার চুল ছিঁড়ছে। এরা একসাথে হলেই তুলকালাম কান্ড বাঁধিয়ে দেয়ন। তবে আজকে ওদের কথা শুনে কিছু একটা আঁচ করতে পেরেছে।
তাহমিদ আনানের কথার জবাব না দিয়ে চুপচাপ ফ্রেশ হতে যায়। ও ভালো করেই জানে, আনান যতই ফাঁপর নিকনা কেন, ও তাহমিদকে প্রচন্ড ভয় পায়, সেই সাথে সম্মানও করে।

রাত বারোটা পঁচিশ। ড্রয়িংরুমে আড্ডার আসর জমেছে। নীরা, কুহু মিলে পাস্তা বানিয়েছে। আনান নিজের ভাগেরটা গলাধঃকরণ করে তাহমিদের প্লেটের দিকে হাত বাড়িয়েছে। যদিও ওর পেট ভরে গেছে, তবুও তাহমিদকে বিরক্ত করার উদ্দেশ্যেই তাহমিদের খাবারে হাত বাড়িয়েছে।
তাহমিদ দাঁতে দাঁত পিষে আনানের দিকে তাকিয়ে আছে। আনান ড্যাম কেয়ার ভাব নিয়ে নিজের কাজে মত্ত।
বারোটা চল্লিশে কলিং বেল বেজে ওঠায়, সবাই সচকিতে চাইল।

তাহমিদ হাতের সফট ড্রিংকসের গ্লাস টেবিলে রেখে দরজার দিকে যায়।
দরজা খুলে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। দরজার বাইরে কাঁচুমাচু মুখে দাঁড়িয়ে আছে তাওহীদ।
তাহমিদ ভাইকে দেখে কিছু না বলে দরজা থেকে একপাশে সরে দাঁড়ায়।
তাওহীদ ড্রয়িংরুমে পা দিয়েই নীরাকে দেখল। মেয়েটা কুহুর পাশে বসে গল্প করছে।
তাওহীদকে দেখে নীরা চমকে উঠল। এই অসময়ে তাকে দেখে নীরার চমকানোরই কথা।
কুহু তাওহীদকে দেখে সালাম দিল। সিক্তা তাওহীদকে দেখে খুশিতে জড়িয়ে ধরল।

” আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া, কেমন আছো? তুমি হঠাৎই এত রাতে আসলে যে? তুমি ঠিক আছতো ভাইয়া? ” আনান তাওহীদের কাছে জানতে চায়।
” ওয়ালাইকুমুসসালাম। আলহামদুলিল্লাহ আমি ভালো আছি। ঘটনা কিরে আনান! তুই হঠাৎ আজ আমাকে সালাম দিচ্ছিস? জীবনে সম্মান দিয়ে যে ছেলে কথা বলেনি, সেই ছেলে আজ সালাম দিচ্ছে! এ যে অবিশ্বাস্য ব্যাপার! ”

” মানুষ পরিবর্তনশীল, ভাইয়া। কখন, কার, কিভাবে হেদায়েত প্রাপ্তি হয়, এটা কেউই বলতে পারেনা। তাছাড়া তুমি সম্মানিত ব্যক্তি। তাই তোমাকে সালাম দিয়ে সওয়াবের খাতা একটু ভারী করতে চাচ্ছি, এই আর কি। ”
” আচ্ছা! এখন থেকে প্রতি ঘন্টায় ঘন্টায় আমাকে সালাম দিবি। এতে অল্পদিনেই তোর সওয়ারের খাতা পূর্ণ হয়ে যাবে। ”
” ঠিক আছে, ভাইয়া। ” আনান বিনয়ের সাথে বলল।
” ভাইয়া, অনেক রাস্তা জার্নি করে এসেছেন। এবার ফ্রেশ হয়ে আসুন। আমি কিছু একটা খাবার বানাচ্ছি। ” কুহু তাওহীদকে তাড়া দেয়।

” তোমাকে কিছুই করতে হবেনা। আমি খেয়ে এসেছি। এই যে ধর। এই ব্যাগে সবার জন্য বিরিয়ানি আছে। এখন যদি এরা খায়, তবে সার্ভ কর। বাকিদের গুলো ফ্রিজে তুলে রাখ। সকালে গরম করে দিও। আমি ফ্রেশ হয়ে একটা ঘুম দেব। আনান, সিক্তা তোরা চাইলে খেতে পারিস। আমি রুমে গেলাম। ”

” ঠিক আছে ভাইয়া। শুভরাত্রী, আসসালামু আলাইকুম। ” আনান আরেকবার তাওহীদকে সালাম দেয়।
তাওহীদ আনানের দিকে তাকিয়ে অপ্রস্তুত হয়ে হাসে।
তাওহীদ রুমের দিকে গেলে কুহু ইশারায় নীরাকে ওপর পাঠিয়ে দেয়।
” ভাইয়া, তুমি বিরিয়ানি খাবে? সিক্তা, তুই খাবি? ”
কুহু আনান আর সিক্তা দুজনকেই জিজ্ঞেস করলে, ওরা দু’জনই না করে দেয়। কুহু বিরিয়ানির প্যাকেটগুলো ফ্রিজে তুলে রেখে নিজের রুমে চলে আসে।

তাওহীদ নীরার হাতদুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বসে আছে। কোন কথা বলছেনা কেউই। দুজনেই নিরবে কাঁদছে।
” আমাকে মাফ করা যায়না, নীরু? আর একটাবার সুযোগ দাও। আমি ভালো স্বামী হয়ে দুনিয়াকে দেখিয়ে দেব। তোমাকে আর কখনোই কোন অভিযোগের সুযোগ দেবনা। ভালো স্বামী হয়েই বাকিটা জীবন কাটিয়ে দেব। ” তাওহীদের গলায় অনুনয় ঝরে পড়ছে। সেই সাথে গলায় দুঃখী ভাব স্পষ্ট।

তাওহীদের অসহায়ত্ব দেখে নীরা আর চুপ থাকতে পারেনা। হু হু করে কেঁদে উঠল। ঘটনার আকস্মিকতায় তাওহীদ হকচকিয়ে যায়। মুহূর্তেই ও জড়িয়ে ধরল ওর প্রানপাখিকে।
পরদিন ভোর তিনটার দিকে জেলেদের ডেকে পুকুর থেকে মাছ তুলে নিয়েছে কায়েস। এরপর বরফ দিয়ে সেগুলো প্রসেসিং করে নিয়েছে। শিউলি রাতেই সব গোছগাছ করে রেখেছিল। শুধু ভোরে ফ্রিজে রাখা মাংসের প্যাকেটগুলো বরফভর্তি বাক্সের ভেতর তুলে নেয়। বিকেলে বানানো পিঠাগুলো প্যাক করে নেয়।

এরপর ভোর পাঁচটায় ওরা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়।
দৃষ্টি, শিহাব ঢাকা যেতে পারছে তাই তাদের আনন্দ ধরছেনা। ফুপুদের বাড়ি দেখবে, বোনের নতুন সংসার দেখবে। সারা ঢাকা শহর ঘুরে দেখবে। ভাবতেই ওদের খুশিতে লাফাতে ইচ্ছে করছে।
রাতেই তাহমিদ জানিয়েছে আজ সকাল সাড়ে দশটায় বাসা থেকে বের হবে। ডক্টর’স এ্যাসোসিয়েশনের একটা কনফারেন্স আছে দুপুর বারোটায়। ও সেখানে যোগ দিবে।

তাই কুহু তাহমিদের ঘুম ভাঙ্গালো না। ও ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে সোজা নিচে যায়।
নীরাও সকাল সকাল রান্নাঘরে হাজির। গত দুই-তিন মাসের তুলনায় আজ ওকে বেশ সতেজ দেখাচ্ছে।
বড় ছেলের আসার কথা শুনে তাহমিনা আক্তার বেশ খুশি। তিনি দুই ছেলের পছন্দের খাবার বানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কিন্তু কুহু আর নীরা তাকে কোনও কাজ করতে দেবেনা। ওরা দু’জনেই শ্বাশুড়ির নির্দেশমত রান্না করতে শুরু করে।
তাওহীদ সকালে মেয়েকে নিয়ে কোথাও বেরিয়েছে।

সানাউল রাশেদিন বেশ কয়েকদিন দেশের বাইরে থাকায় জগিং করতে পারেননি। তিনি ফজরের নামাজ আদায় করতে মসজিদে গিয়েছিলেন। এখনও বাসায় ফেরেননি। আফরোজা নাজনিনকে তিনি ফোন করে জানিয়েছেন তার আসতে একটু দেরি হবে।
সকাল সাড়ে আটটার মধ্যেই তাওহীদ মেয়েকে নিয়ে বাসায় ফিরল। সানাউল রাশেদিনও ফিরেছেন। তবে তাহমিদ এখনও ঘুম থেকে উঠেনি।

এদিকে নীরা আর কুহু মিলে রান্না কমপ্লিট করেছে। সবাই এখন তাহমিদের অপেক্ষা করছে। সানাউল রাশেদিন জানিয়েছেন, তাহমিদ আসলেই তবে তারা একসাথে খেতে বসবেন।
আনান সকালে ঘুম ঘুম উঠে সিক্তার রুমের দরজায় এসে উঁকিঝুঁকি মা’র’ছে। কিন্তু দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। বাধ্য হয়ে ও সিক্তাকে ফোন দেয়। পরপর তিনবার ফোন বেজে কে’টে যায়। চতুর্থবারে সিক্তা ফোন রিসিভ করল।

” এত সকালে ফোন দিয়েছ কেন! তুমি কি এখন চলে যাচ্ছ? ” ঘুম জড়ানো গলায় সিক্তা বলল।
” এখন সকাল সাড়ে আটটার বেশি বাজে। আর আমি কোথাও যাচ্ছিনা। তুই দরজা খোল। কতক্ষণ বাহিরে দাঁড় করিয়ে রাখবি? ”
আনানের কথা শুনে সিক্তা প্রায় দৌড়ে এসে দরজা খুলে দিলে, আনান রুমে ঢুকল।

সিক্তা ঘুমে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছেনা। ঘুমে ওর চোখ বুজে আসছে। আনান ওর সামনে দাঁড়ানো মায়াবী মেয়েটাকে দেখে মৃদু হেসে, টুপ করে চুমু দেয় ওর ডান গালে। ব্যাস এতটুকুই সিক্তার ঘুম কাড়তে যথেষ্ট। সিক্তা হতভম্বের ন্যায় গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

” কি রে, ঐভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন! কোথায় সকাল সকাল একটামাত্র জামাইয়ের সেবা করবি । কিন্তু সেটা না করে তুই পরে পরে ঘুমাচ্ছিস! ইহা অতিব দুঃখজনক ব্যাপারস্যাপার। তুই ডাহা ফেইল। ” আনানের মুখভঙ্গি দেখে সিক্তা হেসে ফেলল।
” এই সকালে আমার রুমে কি হ্যাঁ? যাও নিচে যাও। কেউ দেখলে সম্মান থাকবেনা। ” সিক্তা ঠেলে আনানকে রুম থেকে বের করে দিল।

তাহমিদ একবারে তৈরি হয়ে দশটার কিছুক্ষণ আগে নিচে নামল। ও নাস্তা করেই বেরিয়ে যাবে।
তাহমিদকে নিচে নামতে দেখে আফরোজা নাজনীন টেবিলে খাবার সাজাতে শুরু করলেন।
সবাই যে যার মত চেয়ারে বসল। নীরা, কুহুর জোড়াজুড়িতে আফরোজা নাজনীন আর তাহমিনা আক্তারেও বসতে হল। নীরা আর কুহু মিলে খাবার পরিবেশন করছে।

সানাউল রাশেদিন খেতে খেতে তাওহীদের সাথে টুকটাক কথা বলছেন। হঠাৎই কলিং বেল বেজে ওঠায় সবার চোখ একযোগে দরজার দিকে যায়।
নীরা কুহুকে টেবিলের দ্বায়িত্ব দিয়ে দরজা খুলতে যায়। দরজা খুলে ও আশ্চর্য হয়ে গেছে। বাইরে দাঁড়ানো চারজনের মধ্যে ও শুধু একজনকেই চেনে।
কায়েসকে সালাম দিয়ে ভেতরে আসতে বলল নীরা।
কায়েস সপরিবারে ‘কুঞ্জছায়া’য় প্রবেশ করল।

ড্রয়িং রুমে নিজের পরিবারকে দেখে কুহু হতবিহ্বল হয়ে গেছে। ও দৌড়ে বাবার কাছে যায়।
ভাইয়ের পরিবারকে দেখে আফরোজা নাজনীনের চোখে পানি এসে গেছে। তিনি হাত ধুয়ে ড্রয়িংরুমে আসলেন।
ঐ মুহুর্তে আর কারোই খাওয়া হলোনা। সবাই একে একে কায়েসদের সাথে কুশল বিনিময় করল।
এদিকে দুই ড্রাইভার আর কেয়ারটেকার মিলে একে একে সব প্যাকেট ভেতরে নিয়ে আসল। এতসব জিনিসপত্র দেখে সবার চোখ কপালে উঠে গেছে।

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৩৭

দৃষ্টি সেই যে কুহুকে জড়িয়ে ধরেছে, আর ছাড়ার নামই নেই। শিহাবও বড় আপুর আঁচল ধরে বসে আছে।
আফরোজা নাজনীন শিউলির সাথে একে একে সবার পরিচয় করিয়ে দিলেন।

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৩৯