বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ শেষ পর্ব 

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ শেষ পর্ব 
জাওয়াদ জামী

দৃষ্টি যখন নানান ভাবনায় বিভোর ঠিক তখনই দরজায় মৃদু করাঘাতের শব্দ শোনা যায়। এত রাতে দরজার ওপাশে কে! দৃষ্টি একটু অবাক হয়। তারপর হুট করেই মনে হল, হয়তো নিহান এসেছে। ওর পাশে শোয়া তনয়া আর আরোশির দিকে তাকিয়ে অতি সন্তপর্ণে বিছানা থেকে নামে।

দরজার সামনে কুহুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দৃষ্টির মুখে হাসি ফুটে উঠল।
কুহু দৃষ্টিকে দেখামাত্রই জড়িয়ে ধরল। বেশ কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরে রাখল তার অতি আদরের এই বোনটিকে। এরপর দৃষ্টির হাত ধরে নিয়ে যায় করিডোরের শেষ মাথায় অবস্থিত বেলকনিতে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

দৃষ্টি কুহুর কোলে মাথা রেখে চুপটি করে শুয়ে আছে। দুজনের কারও মুখেই কোন কথা নেই। বোনের মুখের দিকে তাকালেই কুহুর দু-চোখ ভেঙ্গে অশ্রুরা গড়ে পরছে। ওর এই আদরের বোনের সাথে কতকিছু ঘটে গেছে, ভাবলেই কুহুর হাত-পা হিম হয়ে আসছে।

অনেকক্ষণ নিরবতার পর মুখ খুলল কুহু৷।
” তোর কাপড়চোপড় গুছিয়ে নিয়েছিস? নাকি আমাকে গুছিয়ে দিতে হবে? প্রথমবার চিটাগং যাচ্ছিস খুশির ঠেলায় সব গুলিয়ে ফেলিসনা আবার। ”
” প্রয়োজনীয় সব কিছুই নিয়েছি, আপু। তোমাকে কিছুই করতে হবেনা। তুমি নিজের যত্ন নিও। মনে রেখ তোমার বোন আর সেই ছোটটি নেই। ”

” তুই কি সত্যিই মেজো ফুপুর বাসায় থেকে পড়াশোনা করতে চাস? ” কুহু ইতস্তত করে জানতে চায়।
তৎক্ষনাৎ কুহুর কথার কোন উত্তর দেয়না দৃষ্টি। ও কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকে। গভীর মনযোগে কিছু একটা ভেবে নেয়।
” আপু, আমি চাইনা এখনই তোমাদের ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে। আব্বুর এই অবস্থায় তাকে ছেড়ে দূরে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তুমি একটু নিহান ভাইয়াকে বোঝাবে, আপু? তার জেদের কারনেই হয়তো ফুপা এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমি এখনই অন্তত কারও বোঝা হতে চাইনা। আমি আগে নিজের ক্যারিয়ার গড়তে চাই, আপু। মেজো ফুপুর বাসায় গিয়ে থাকলে হয়তো আমি পড়াশোনায় মনযোগ দিতে পারবনা। ”

দৃষ্টির কথা শুনে কুহু যা বোঝার বুঝে নেয়।
” তুই এত চিন্তা করিসনা। আমি নিহান ভাইয়ার সাথে কথা বলব। ফুপুকেও বোঝাব। তুই আপাতত ফুপুর বাসায় গিয়ে কয়েকদিন বেরিয়ে আয়। ” দৃষ্টির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল কুহু।
বোনের আশ্বাস পেয়ে দৃষ্টি চোখ বুজল।

দৃষ্টি রুমে এসে দেখল তাহমিদ একটা ফাইল মনোযোগ দিয়ে দেখছে। দুনিয়ার কোন কিছু ওর খেয়ালে নেই। কুহু ধীর পায়ে এগিয়ে যায় তাহমিদের দিকে।
তাহমিদের বুকে মাথা রেখে কেঁদেই চলেছে কুহু। ওর কেবলই মনে হচ্ছে, ওর অসচেতনতার জন্যই আজ এসব ঘটেছে। ও একটু সচেতন হলে দৃষ্টির সাথে এমনটা হতোনা। নিজের সন্তানকে হারাতোনা।

তাহমিদের মনটাও ভারি হয়ে আছে। ও কুহুকে কি বলে শান্তনা দেবে সেটা ভেবে পায়না। কুহু যে যন্ত্রণায় ছটফট করছে, তার নিরাময় কি আদতেই শান্তনায় হয়! শান্তনা কি সব ক্ষ’তে প্রলেপ লাগাতে পারে? একজন মা যখন জানতে পারে তার অনাগত সন্তানের জীবন অকুলেই বিনাশ হয়েছে, সেই মা’য়ের নিজেকে কোনোভাবে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা কি এত সহজেই হয়!

কয়েক ফোঁটা অশ্রু ঝরে পরল তাহমিদের দুচোখের কোন বেয়ে।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে কুহু প্রথমেই খোঁজ করল নিহানের।
নিহান আজ খুব সকালেই ঘুম থেকে উঠেছে। ও নিজের ব্যাগ নিয়ে নাজমা পারভিনের রুমে এসেছে। অনেকদিন ধরে ঢাকা থাকায় দুইটা ব্যাগে নিজের পোশাক নিতে হয়েছে। নাজমা পারভিন ছেলের কাপড় ভর্তি ব্যাগ দেখে চোখ কপালে তুললেন।

” নিহান! বাবু, তুই কি তোর সব পোশাক ঢাকায় নিয়ে এসেছিলি! গাড়িতে তোর কাপড়ের ব্যাগ রাখব নাকি আমরা উঠব! ”
” আম্মু, আমার ব্যাগ দুইটাই তোমার শত্রু হয়ে গেল! তুমি আমার আম্মু হয়ে এভাবে বলতে পারলে? কোথায় একটামাত্র ছেলের ব্যাগ বুকে জরিয়ে রাখবে, সেটা না করে দুরছাই করছ! ” ছেলের মুখভঙ্গি দেখে মুচকি হাসলেন নাজমা পারভিন। তার সদাগম্ভীর ছেলের গত আড়াইমাসে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। যে ছেলে সারাদিন তার সাথে হাতেগোনা কয়েকটা কথা বলত, আজ সেই ছেলের মুখে যেন কথার ফুলঝুরি ছুটেছে! সত্যিকারের ভালোবাসা মানুষকে আমূল পাল্টে দেয়, সেটা তিনি তার ছেলেকে দেখেই বুঝতে পারছেন।

” ফুপু, আসব? ” কুহু দরজায় এসে নাজমা পারভিনকে ডাক দিলে, মা-ছেলে দু’জনেই কুহুর দিকে তাকায়।
” আয়, মা। ভেতরে আয়। ”
কুহু ভেতরে আসলে নাজমা পারভিন ওকে জড়িয়ে ধরলেন। পরম মমতায় চুমু দিলেন কুহুর কপালে।
” তোমরা আজকেই চলে যাবে, ফুপু? আর কয়েকটা দিন থাকোনা। ”

” নারে মা, আর থাকতে পারবনা। তুইতো জানিসই তনয়ার পরীক্ষা শুরু হবে সাতদিন পর থেকে। ও এমনিতেই ফাঁকিবাজ। শুধু না পড়ার জন্য অযুহাত খুঁজে বেড়ায়। আজকে না গেলে দেখা যাবে ও পরীক্ষায় পাসই করতে পারবেনা। ওর পরীক্ষা শেষ হলে আমি আবার আসব। তুই এক কাজ কর, দৃষ্টিকে খেয়েদেয়ে তৈরি হতে বল। আর দেরি করা যাবেনা। ”

” দৃষ্টি তৈরিই আছ, ফুপু। এবার তোমরা খেয়ে নিবে চল। ”
কুহু কথা বলা শেষ করেও দাঁড়িয়ে রইল। নাজমা পারভিন সেটা লক্ষ্য করে ওকে জিজ্ঞেস করল,
” কিছু বলবি, কুহুতান? ”
কুহু মাথা নাড়ায়।
আমি তোমার সাথে আর ভাইয়ার সাথে কিছু কথা বলতে চাই। এই মুহূর্তে কথাগুলো বলা খুবই দরকার।

” কি কথা, কুহুতান? যা বলার বলে ফেল। এত সংকোচ করছিস কেন! ”
” ফুপু, আমি সেই রাতের ব্যাপারে সবকিছুই শুনেছি। গতরাতে উনি আমাকে বলেছেন। আমি বড় বোন হয়ে ছোট বোনকে রক্ষা করতে পারিনি, এই অপরাধবোধ আমাকে চিরকাল কুঁড়ে কুঁড়ে খাবে। আমার বোনটা যে কত কষ্টের মধ্যে দিনাতিপাত করছে তা ওর মুখের দিকে তাকিয়েই বুঝতে পেরেছি।

ও যা হারিয়েছে তার তুলনায় আমার কষ্ট খুবই সামান্য। দুনিয়ার সকল শান্তনায়ও ওর কষ্ট একটুও লাঘব হবার নয়। আল্লাহ চাইলে আমি আবারও হয়তো মা হতে পারব, কিন্তু দৃষ্টি? ও কি ওর হারানো সম্ভ্রম ফিরে পাবে? ” কুহু একটু বিরতি নিয়ে চোখের পানি মুছল।
নাজমা পারভিন কাঁদছেন। নিহান মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তারা বলার মত কোন কথা খুঁজে পাচ্ছেনা।
একটু পর কুহু আবার কথা বলল।

” হয়তো দৃষ্টি সবকিছু ভুলতে চাইছে। সেজন্যই নিজেকে ব্যস্ত রাখতে চাইছে। ওর স্বপ্ন একজন ডক্টর হবে। সেই ছোটবেলা থেকেই আমাকে বলত, আপু আমি যতদূর পর্যন্ত পড়তে চাইব, আমাকে পড়াবে। আমি বড় হয়ে ডক্টর হতে চাই। আজ এতকিছুর পরও ও সেই স্বপ্ন এখনও দেখে। আর আমিও চাই, আমার বোন নিজের স্বপ্ন পূরণের পথে একটু একটু করে এগিয়ে যাক।

তোমাকে এই কথাগুলো বলছি এই কারণে, দৃষ্টি ভবিষ্যতে তোমার ছেলের বউ হবে। তোমরা দৃষ্টির বিপদের সময় ওর পাশে ছিলে, নিহান ভাইয়া নিজের সবটা দিয়ে দৃষ্টিকে আগলে রেখেছে। এমনটা খুব কম পেয়েই পায়। দৃষ্টি ভাগ্যবতী তাই তোমার মত ফুপুকে ও পেয়েছে। নিহান ভাইয়ার মত পুরুষ ওকে ভালোবেসেছে। ”
নাজমা পারভিন আর নিহান কুহুর দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করছে সে কি বলতে চায়। কহু তখনো কথা বলেই চলেছে,

” আমি এটাও জানি, দৃষ্টিকে ভালো রাখতে যা যা করা প্রয়োজন সবই তোমরা করবে। সে কারনেই তোমরা চাচ্ছ, দৃষ্টিকে নিজেদের কাছে রাখতে। নিহান ভাইয়া দৃষ্টিকে কোন রিস্ক নিতে চাইছেনা, এটাও বেশ বুঝতে পারছি। কিন্তু ফুপু এখন এই অবস্থায় আমাদের কি উচিত নয়, দৃষ্টিকে সবার মধ্যে রাখা? ও যদি চিটাগং গিয়ে পড়াশোনা করে, তবে ও শুধু তোমাদেরই কাছে পাবে। বাবা-মা’কে নয়। ও কিন্তু বরাবরই বাবা’র ঘেঁষা।

ও কোথাও গিয়ে বাবাকে ছাড়া থাকতে পারেনা। আর এই মুহুর্তে ওর সবার সান্নিধ্যই প্রয়োজন। ও আজ তোমাদের সাথে যাক, যতদিন ইচ্ছে ঘুরে আসুক। তারপর ওকে ঢাকায় কোন স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিই? এরমধ্যে নিহান ভাইয়াও পড়াশোনা কমপ্লিট করুক। তাছাড়া আরও একটা কথা আছে। দৃষ্টির ব্যাপারটা হয়তো চিটাগংয়ের অনেকেই জানে। ও যদি তোমাদের বাসায় থাকতে শুরু করে, অনেকেই অনেক কিছু বলতে পারে।

হাজার হোক আমরা মানুষ। আর আমরা মানুষের দূর্বল জায়গায় আঘাত করতে পটু। এই বিষয়গুলো দৃষ্টির জন্য খুব একটা ভালো ফল আনবেনা। আর তাছাড়া দৃষ্টি এখানে ভর্তি হলে সবার মাঝে থাকতে পারবে। ধীরে ধীরে নিজেকে নতুনভাবে গড়ে তুলতে পারবে। নিহান ভাইয়া তোমার বিষয়টাও আমি বুঝতে পারছি। আমি জানি দৃষ্টিকে দূরে রাখতে তোমার কষ্ট হবে।

তুমি ওর চিন্তায় অস্থির থাকবে। তারপরও এটা করতে হবে। দৃষ্টির ভালো করতে হলে এই বিরহটুকু তোমাকে মানতেই হবে। এটা সাময়িক বিরহ, চিরবিরহ নয়। তুমি যখন চাইবে এখানে আসবে। তাছাড়া তোমার ক্যারিয়ারও গড়তে হবে। আগে তুমি পড়াশোনা শেষ কর। নিজের ক্যারিয়ার গড়। ততদিনে দৃষ্টিও ওর স্বপ্নের পথে একটু একটু হাঁটতে শিখুক। হয়তোবা দৃষ্টিও ভাইয়ার কথা চিন্তা করে চুপচাপ তোমাদের মেনে নিবে। এছাড়া ওর কোন উপায়ও নেই। আমি কি বলতে চাচ্ছি তোমরা নিশ্চয়ই বুঝেছ?

কুহু উত্তরের আশায় তাকিয়ে থাকে ওর ফুপু আর নিহানের দিকে।
নাজমা পারভিন ভাবছেন কুহু যা বলেছে ঠিক কথাই বলেছে। ওর কথায় একবিন্দুও ভুল নেই। তিনি দৃষ্টিকে ছেলের বউ হিসেবে পেতে চান ঠিকই, সেইসাথে দৃষ্টির উজ্জ্বল ভবিষ্যৎও দেখতে চান। তিনি চাননা তাদের কোনও ভুলে দৃষ্টি আর সামান্যতম কষ্ট পাক। আবার তিনি নিজের ছেলের কথাও ভাবছেন। তার ছেলেটা দৃষ্টির জন্য প্রতিনিয়ত চিন্তা করে। দৃষ্টির কঠিন বিপদেও ওর হাত ছাড়েনি। বরং নিজের পড়াশোনা বিসর্জন দিয়েও দৃষ্টির পাশে থেকেছে। কি উত্তর দেবেন তিনি! তিনি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন।

” আমি দৃষ্টিকে ভালোবাসি, কুহু। ওর ভালোর জন্য আমি সবকিছুই করতে পারব। ও দূরে থাকবে এই চিন্তায় অস্থির হয়ে আমি আব্বুকে বলেছিলাম দৃষ্টিকে নিজের কাছে রাখব। তখন আমি একবারও চিন্তা করিনি ওকে এই মুহূর্তে কোথাও ওর ইচ্ছার বিরুদ্ধে রাখা যাবেনা। তুই ভুল কিছুই বলিসনি। ও যেখানে থাকতে চাইবে থাকুক, আমি বাঁধা দেবনা। আমার একটাই চাওয়া, দৃষ্টি ভালো থাকুক। তবে ওকে বলিস, আমাকে যেন ভুলে না যায়। দৃষ্টি ছাড়া আমার পুরো দুনিয়া অন্ধকারে ছেয়ে যাবে। ওকে ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ। ”

ছেলের কথা শুনে নাজমা পারভিন হাঁফ ছাড়লেন। তার ছেলে অবুঝের মত কোন আচরণ না করে, পজিটিভলি নিয়েছে কুহুর কথাগুলো।
” ধন্যবাদ ভাইয়া, আমার কথা বুঝতে পারার জন্য। তুমি এতকিছু চিন্তা না করে আবার নতুনভাবে পড়াশোনা শুরু কর। মনে রেখ, এখানে দৃষ্টির পাশে আমরা সবাই আছি। তুমি পড়াশোনা শেষ কর তারপর একটা জব কর। দৃষ্টিও ততদিনে নিজেকে স্বাভাবিক করুক। এরপর তোমাদের বিয়ের আয়োজন করতে বলব বাবাকে। আমাদের সব আত্মীয় স্বজনরা তোমাদের বিয়েতে থাকবে। বিষয়টা ভালো কেমন হবে বলতো? ”

” তোর কথা শুনে এখনই বিয়ে করতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু সবার কপাল তো আর আনানের মত হয়না। আমি নাহয় বিয়ের ক্ষেত্রে লেইট লতিফই হলাম। ”
নিহানের কথা শুনে নাজমা পারভিন হাসলেন।

সকালে নাস্তার পর নাজমা পারভিন ছেলেমেয়েদের নিয়ে গাড়িতে উঠলেন। দৃষ্টি গাড়িতে উঠার আগে বাবা-মা’য়ের কাছে গিয়ে বিদায় নিল। ওর মেজাজটা বেশ ফুরফুরে হয়ে আছে। নিহান ওর ঢাকায় পড়াশোনা করার সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছে। ও শপথ নিয়েছে পড়াশোনায় আগের থেকে বেশি মনযোগী হবে। কয়েকটা দিন চিটাগং থেকে ঘুরে আসার পর পুরোদমে পড়াশোনায় মনোনিবেশ করবে। অতীত ভেবে নিজেকে আর পেছনে ঠেলে রাখবেনা।
ছয় বছর পর,,

” সিক্ত, এই সিক্ত। তোরা এখনও তৈরি না হয়ে কি করছিস? তোরা দুই মা-মেয়ে হয়েছিস জন্মের অলস। আমার হয়েছে দুর্ভাগ্য। কোথায় মেয়ে হবে বাবার মত চটপটে। তা না হয়ে মেয়ে আমার হয়েছে মায়ের মত অলস! কোথায় আমি ভাবলাম তারাতারি শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে ভালোমন্দ খাব। কিন্তু তুই আমার ইচ্ছেয় এক বালতি পঁচা পানি ঢেলে দিলি! ”

আনান রুমে এসে হায় হায় করে উঠল।
” পাপা, তুমি নিজের কাজ নিজে কখনোই করনা, তবে চটপটে হলে কিভাবে! তোমার সব কাজই তো মাম্মাম করে দেয়। ”
মেয়ের মুখে এমনতর কথা শুনে আনানের চোয়াল ঝুলে পরল।

” হায়রে কপাল আমার! সিক্তরে এই মেয়ে দেখছি তোর হিটলার ভাইয়ের স্বভাব পেয়েছে! মেয়ে আনানের কিন্তু কথাবার্তা, চালচলন হয়েছে ঐ পা’গ’লে’র ডক্টর হিটলারের মত! ভাবা যায়! মেয়ে পেটে থাকতে এজন্যই বলেছিলাম, বেশি বেশি আমার কথা মনে করবি। বাসায় না থাকলে আমার ছবি দেখবি। কিন্তু তুই শুনিসনি আমার কথা। তোর ভুলের জন্যই আজ আমাকে এই দিন দেখতে হচ্ছে। নইলে পাঁচ বছরের একটু পুঁচকে মেয়ে এভাবে কথা বলে! ”

” হয়েছে? এবার লেকচার থামাও। আমার সব কাজ শেষ। এবার শুধু কাপড় পাল্টিয়েই রওনা দেব। এতটুকু সময় তুমি তোমার মেয়েকে সামলাও। ” সিক্তা আনানের কাছে মেয়েকে রেখে ওয়াশরুমে ঢুকল।
আনানও মেয়েকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরল।

” বউ, তুমি দেখেছ আমার প্রিন্সেসের চোখদুটো একদম তোমার মত হয়েছে? আমি ঠিক এমনটাই চেয়েছিলাম। ” তাহমিদের কথা শুনে কুহু বিছানায় শুয়ে মিটমিটিয়ে হাসছে। এই লোককে কে বুঝাবে যে তার প্রিন্সেস দেখতে একবারে তার মত হয়েছে।

তাহমিদ মেয়ের কপালে, চোখে চুমু দেয়। মেয়েও যেন বাবার আদর পেয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল।
” আচ্ছা, আপনি কি মেডিকেলে আর যেতে চাননা? গত বিশ দিন ধরে আপনি ছুটি কাটাচ্ছেন! এটা কোন ভালো ডক্টরের লক্ষ্মণ? ”

” ও বউ, তুমি দিনদিন এমন কাটখোট্টা হচ্ছ কেন বলতো? আমার কি ইচ্ছে করেনা স্ত্রী-সন্তানের সাথে সময় কাটাতে! আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আগামী একমাস কোথাও যাবনা। এই একমাস আমি আমার প্রিন্সেসের সাথে কাটাব। তাই-না প্রিন্সেস? ” বাবার কথার উত্তর দিতেই তাহমিদের প্রিন্সেস বুঝি হেসে উঠল। মেয়ের হাসি দেখে তাহমিদের আনন্দ বাঁধ ভেঙেছে।

কুহু বুঝল এই মানুষটার সাথে কথা বলে কোন লাভ নেই। সে তার সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই কাজ করবে। তাহমিদের দিকে তাকিয়ে আছে কুহু। সে তার মেয়েকে আদর করতে ব্যস্ত। গত পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে চিকিৎসার পর কুহু যেখানে হাল ছেড়ে দিয়েছিল, কিন্তু এই মানুষটা কখনোই নিরাশ হয়নি। দেশে, বিদেশে চিকিৎসা করিয়েছে ওর। প্রতিটা পদক্ষেপে সে কুহুর ছায়া হয়ে থেকেছে।

অবশেষে মানুষটার একাগ্রতা, পরিশ্রম কিংবা ভালোবাসার ফল কুহু পেয়েছে। গত বিশটা দিন ওর যেন ঘোরের মধ্যে কেটেছে। তবে যেদিন ওরা জেনেছিল ঘরে নতুন অতিথি আসতে চলেছে, সেদিন কি পা’গ’লা’মি’ই না করেছিল তাহমিদ! তারপর থেকে গত কয়েকমাস কুহুর ওপর নানা বিধিনিষেধ জারি করেছে। নিজেও যেমন খেয়াল রেখেছে, তেমনি বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষের মাথা নষ্ট করে দিয়েছে।

সেসব কথা মনে পরতেই কুহু হেসে ফেলল। এই মানুষটা ওকে এত ভালোবাসে কেন তার উত্তর আজও জানতে পারেনি কুহু। আজ এতদিন পর সেসব কিছু জানতে চায়না। শুধু জেনেছে, ওর শূন্য জীবনে পূর্ণতার ঝুড়ি নিয়ে এসেছে তাহমিদ নামের মানুষটি। যে মানুষটার জন্য ওর অন্তরীক্ষে জমা হয়েছে অতলস্পর্শী ভালোবাসা। যে মানুষটা ছাড়া কুহু নিঃস্ব। যে মানুষটা একদিন ওর অন্তঃপুরে প্রেমের আলোড়ন তুলেছিল, আজ সেই মানুষটাই তার প্রেম-তরঙ্গ দিয়ে সেই আলোড়নে ভালোবাসার মহল গড়ে তুলেছে। যে মহলের প্রতিটি কোনে তার একান্ত পুরুষের নাম প্রতিধ্বনিত হয় সর্বদাই।

” ভাই, ভেতরে আছ নাকি? ” দরজার বাহিরে থেকে হাঁক ছাড়ল আনান।
আনানের গলা পেয়ে তাহমিদ সোজা হয়ে বসে ওকে ভেতরে ডাকল।
সিক্তা ভেতরে ঢুকেই প্রিন্সেসকে কোলে তুলে নেয়। আনান মেয়েকে নিয়ে ভেতরে এসেই তাহমিদকে দেখিয়ে গা জ্বা’লা’নো হাসি দিল। তাহমিদ ওর হাসি পাত্তা না দিয়ে ভাগ্নিকে কোলে নেয়।
” কোকিলা, সবই কপাল বুঝলি? এই বুইড়া বয়সেও মানুষ বাপ হয়ে কত আদিখ্যেতা করে! দেখলেই কিডনি ফাটানো হাসি আসে। অথচ আমাকে দেখ, কচি বয়সে বাপ হয়েও এত আদিখ্যেতা করিনি। ”

” এই যে কচি বাপ, আমারতো মনে হয় বেশি হাসতে গিয়ে তোর কিডনি দুটোই গেছে। সেই হিসেবে তুই বর্তমানে, এক কথায় যাকে বলে প্র’তি’ব’ন্ধী। আর প্র’তি’ব’ন্ধী কোন ছেলের সাথে নিশ্চয়ই আমার বোনকে সংসার করতে দেবনা? আগামীকালই মেডিকেলে এ্যাডমিট হয়ে চিকিৎসা শুরু করবি। আর আজ থেকে সিক্ত আর আনশাহ্ এখানেই থাকবে। যতদিন তুই সুস্থ না হবি ততদিন ওদের সাথে দেখা করার কোন অনুমতি তুই পাবিনা। মনে থাকবে? ”
তাহমিদের কথা শুনে আনানের মুখ কালো হয়ে যায়। ওর কখনোই তাহমিদের সাথে কথায় পেরে না ওঠার আফসোস আজন্মই থেকে যাবে।

” আপুউউউ। আমাদের প্রিন্সেসকে দেখতে এসে গেছি। ” হুড়মুড়িয়ে রুমে ঢুকল দৃষ্টি। ও গত একমাস যাবৎ দেশে ছিলনা। নিহানের সাথে সুইডেন গিয়েছিল।
দৃষ্টি সিক্তার কাছ থেকে প্রিন্সেসকে কোলে নিয়ে আদর করতে থাকে। নিহান হাসিমুখে তাকিয়ে আছে তার সহধর্মিণীর দিকে। ও ভাবছে এবার এই মেয়ের না আবার বাচ্চা নেয়ার সাধ জাগে।

‘ কুঞ্জছায়া ‘র ড্রয়িং রুমে আড্ডার আসর বসেছে। আজ সবার মধ্যমণি তাহমিদ রাশেদিনের মেয়ে তিয়ানা রাশেদিন।
সানাউল রাশেদিন নাতনিকে কোলে নিয়েছেন। তার চোখ আনন্দে ছলছল করছে। তার সংসার এতদিনে পরিপূর্ণ হয়েছে। তার সন্তানদের দিকে তাকালেও মনটা আনন্দে ভরে যায়। আনান আজ সরকারি কলেজের শিক্ষক। ছেলেটা বিয়ের পরও পড়াশোনা থেকে নিজের মনযোগ সরায়নি। সিক্তা কুহু দুজনেই পড়াশোনা শেষ করেছে। তাওহীদ এখন ঢাকায় থাকে। ওর পোস্টিং ঢাকাতেই। দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে ওরা বেশ আছে।

” বড়মা, সিনিয়র রাশেদিন আমার মেয়ের মুখ দেখেছে কি দিয়ে? সে যা কিপ্টে লোক! আমার মেয়ে বোধহয় বঞ্চিত হয়েছে তাই না, বড়মা? ” সানাউল রাশেদিনের ভাবনার মাঝেই বলে উঠল তাহমিদ।
সানাউল রাশেদিন আজ আর ভাতিজার কথার উত্তর দেয়ার প্রয়োজনবোধ করলেননা। কারন আজকে তিনি তাহমিদের সাথে ঝগড়া করে এই আনন্দটুকু মাটি করতে চাননা।

” বাপ, তোর সিনিয়র রাশেদিন তোর মেয়েকে ডায়মন্ডের নেকলেস দিয়েছে। ভদ্রলোক কিপ্টে হলেও ভালো আছে। আর তাছাড়া তোর মেয়ে তার কলিজা। সে বোধহয় তোর সিনিয়র রাশেদিনের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসা পাবে। ” আফরোজা নাজনীন রান্নাঘর থেকে বললেন।

বড় জায়ের কথা শুনে তাহমিনা আক্তার হাসলেন।
দৃষ্টি গিয়ে বড় ফুপুর সাথে কাজে হাত লাগায়। আফরোজা নাজনীন ভাতিজীকে দেখে হাসলেন।
নিহান শিউলি আক্তারের পাশে বসে সুইডেনের গল্প শোনাচ্ছে। শিউলি মনযোগ দিয়ে সেসব শুনছে। কায়েস তাই দেখে হাসছে।

দৃষ্টি সবার জন্য নাস্তা নিয়ে আসতেই কায়েস মেয়ের দিকে তাকায়। তার মেয়েটা কত বড় হয়ে গেছে! আজ সে ঢাকা মেডিকেলে পড়ছে। একই সাথে নিজের সংসারও সামলাচ্ছে। আবার মাঝেমধ্যেই চিটাগং গিয়ে সেই সংসারও সামলায়! নিহান একজন সরকারি কর্মকর্তা। সে দৃষ্টিকে ভালোবাসা দিয়ে মুড়ে রেখেছে, তা কায়েস বেশ বুঝতে পারে। দিনশেষে তার মেয়েরা সুখী হওয়ায় তার সকল চিন্তা উবে গেছে। শিহাব এবার এসএসসি পরীক্ষা দেবে। সে-ও বাবার বাধ্য ছেলে। তাই কায়েস শিহাবকে নিয়ে খুব একটা চিন্তা করেনা।

নীরা আর দৃষ্টি মিলে সবাইকে নাস্তা দিয়ে নিজেদের জায়গায় গিয়ে বসল।
তাওহীদ অনেকক্ষণ থেকেই চেষ্টা করছে প্রিন্সেসকে কোলে নিতে। কিন্তু সানাউল রাশেদিন ওর আশায় জল ফেলে প্রিন্সেসকে নিয়ে গাঁট হয়ে বসে রইলেন।
রাতে খাবার খেয়ে যে যার মত বিদায় নেয়। যদিও সবাই দৃষ্টিদের থাকতে বলেছিল, কিন্তু আজকে থাকতে রাজি হয়না। অনেকদিন দেশের বাহিরে থাকায় ওর ক্লাস করা হয়নি। তাই কালকে আর ক্লাস মিস দিতে চায়না। ওর কথা শুনে কেউ আর আটকায়ওনা।

মেয়েকে ঘুমিয়ে দিয়ে কুহু কেবলই বালিশে মাথা রেখেছে, তখনই তাহমিদের হ্যাঁচকা টানে ওকে উঠে বসতে হয়।
” আপনার আবার কি হল! আমার ভিষণ ঘুম পেয়েছে। একটু ঘুমাতে দিন না আমাকে। ”
” আমি কি তোমাকে ঘুমাতে নিষেধ করেছি! প্রিন্সেককে একপাশে দিয়ে, তুমি আমার পাশে শোও। কতদিন তোমাকে বুকে জরিয়ে নিয়ে ঘুমাইনা বলতো? ” তাহমিদ কথা বলতে বলতে প্রিন্সেসকে একপাশে শুইয়ে দিয়েছে।
কুহু তাহমিদের কাজকর্ম দেখে মিটিমিটি হাসছে।

” বউ, আজ নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ বলে মনে হয়। আমার পরিবার, পরিজন, স্ত্রী, সন্তান সবাই আমার সামনে আছে। এবং তারা ভালো আছে। এত বছরের সংসারে এই প্রিন্সেসের জায়গাটাই শুধু ফাঁকা ছিল। তা তুমি পূরণ করে দিয়েছ। আমার জীবনের ফাঁকা বৃত্তটা তুমি বিন্দু বিন্দু ভালোবাসা দিয়ে পূরণ করেছ। আজ গলা ফাটিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে, আমি পেয়েছি তাকে পেয়েছি।

যে আমার জীবনে এসেছে শুকতারা হয়ে। যাকে আমি পেয়েছি পুষ্পের সুবাসে, তটিনী তরঙ্গে, কোকিলের কুহুতানে। যে আমার, একান্তই আমার। ” প্রিয় মানুষটির বুকে মাথা রেখে, তার মুখনিঃসৃত প্রেমময় বাক্য শুনে হঠাৎই কুহুর বুকের ভেতর শীতল হাওয়া এসে দোলা দেয়। একরাশ ভালোবাসা এসে জমা হয় বক্ষ পিঞ্জিরায়। যে ভালোবাসা কখনোই কমবার নয়। প্রতিটা ক্ষনে যে ভালোবাসা তার প্রসারতা বাড়িয়েই চলেছে। কুহু মাথা তুলে তাকায় তাহমিদের দিকে। চোখ রাখে তার পুরুষের গভীর চোখে। যে চোখে কুহু আজ-অব্দি নিজের জন্য ভালোবাসা ছাড়া আর কিছুই দেখেনি।

” আমি যদি বলি, আমার শূন্য জীবনে আপনি এসেছেন সুখের বৃষ্টি হয়ে, তবে সেটা কি ভুল হবে? যখন ক্লান্ত-শ্রান্ত এই আমি অবহেলা, অনাদর আর অপমানের নিমজ্জিত ছিলাম, তখন আপনিই আমাকে টেনে তুলেছেন। দিয়েছেন নতুন জীবন। আপনার ভালোবাসায় করেছেন আমাকে গরবিনী। একটা সাধারণ মেয়েকে আপনি নিজ হাত গড়ে তুলেছেন, ঠাঁই দিয়েছেন নিজের বুকে।

তার বিপদে যেমন ছায়া হয়ে থেকেন, তেমনি নিজের সুখের সময়ও বুকে রেখেছেন। যদি আমি বলি আপনার বিন্দু বিন্দু ভালোবাসা দিয়ে আমার এক অন্তরীক্ষ বৃত্ত পূরণ হয়েছে, সেটা কিন্তু মোটেও ভুল নয়। ” কুহু আজ নিজ থেকেই ঠোঁট ছোঁয়াল তাহমিদের ললাটে, ঠোঁটে। আজ নিজ থেকেই সে পরম প্রাপ্তির বার্তা এঁকে দিল তাহমিদের মুখাবয়বে। আজ একটুও লজ্জা পেলনা কুহু।

তাহমিদও তার রমনীকে পরম ভালোবাসায় বুকে জরিয়ে নিল। যে ভালোবাসায় নেই কোন খাঁদ কিংবা ছলনা। যে ভালোবাসার জোয়ারে ও আজীবন ভাসতে চায়, ভাসাতে চায়।

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৬০

বিঃদ্রঃ জানিনা গল্পটি আপনাদের মত কতটুকু ছুঁতে পেরেছে। #বিন্দু_থেকে_বৃত্ত র #সিজন_২ লিখা শুরু করার পরই আমি নানান সমস্যায় পরে যাই। যার দরুন নিয়মিত লিখা সম্ভব হয়ে উঠেনি। অনেক ব্যস্ততার মাঝেও লিখতে চেষ্টা করেছি।কাজের ফাঁকে ফাঁকে দুই-চার লাইন করে লিখেছি প্রায় পর্বই। সেজন্য হয়তো অনেকটাই অগোছালো হয়েছে। বানানেও বেশ সমস্যা ছিল। একবার লিখার পর আর চেইক দেয়ার সময় পাইনি। আমার এই অনিচ্ছাকৃত দেরি, এবং ভুলের জন্য আমি আমার পাঠকদের নিকট ক্ষমাপ্রার্থনা করছি। ইনশাআল্লাহ পরবর্তীতে কোন নতুন গল্প নিয়ে আসব। ততদিন আমার পাঠকমহল আপনারা ভালো থাকবেন। আমার জন্য দোয়া করবেন।

সমাপ্ত