বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৫৮

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৫৮
জাওয়াদ জামী

দৃষ্টি ছাদের এককোণে বসে আকাশ দেখছিল। আজ যেন আকাশ অষ্টাদশী কিশোরীর ন্যায় সেজেছে। সে তার বুকে তারার পসরা সাজিয়ে বসেছে। দৃষ্টির মনে হচ্ছে পুরো আকাশটাই একটা ঝাড়বাতি। একমনে ও আকাশ অবলোকন করছে। একটু পর পর ফুরফুরে ঠান্ডা হাওয়া এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে ওর শরীর। আজ এই ক্ষণে দৃষ্টি ভুলে যেতে চাইছে দুইমাস আগের সেই ভয়ংকর রাত। ওর নজর এখন সম্পূর্ণ নজর আকাশে। আকাশের বিশালতার কাছে ওর কষ্ট যেন নেহাৎই এক শিশু।

সবাই ওকে বারবার বুঝিয়ে দিয়েছে, জীবনে কখনোসখনো এমন ঝড় আসবেই। এবং সেই ঝড়কে পাশ কাটিয়ে যেতে পারাটাই জীবনের স্বার্থকতা। দৃষ্টিও বড়দের উপদেশ অগ্রাহ্য করতে পারছেনা। সবাই ওকে সুখী দেখতে চাইছে। তাই দৃষ্টিও চাচ্ছে সবার চাওয়াকে প্রাধান্য দিতে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

কি মনে করে দৃষ্টি ওর চুলের কাঁটা খুলে চুল ছেড়ে দিল। ফুরফুরে হাওয়ার সাথে তাল মিলিয়ে ওর রেশমী চুলগুলো এলোমেলো হয়ে উড়ছে। দৃষ্টি ওদের একটুও বাঁধা দিলনা। ও ভবিষ্যতের চিন্তায় ব্যস্ত।

” একা একা এখানে কি করছিস! তোকে পুরো বাড়ি খুঁজে খুঁজে আমি হয়রান। ” নিহান এসে দৃষ্টির গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে।
দৃষ্টি নিহানের দিকে চকিতে তাকিয়ে আবারও নজর দেয় মহাশূন্যের দিকে।
” আকাশ দেখছিলাম। ”

” আজকের আকাশটা বোধহয় একটু বেশিই রূপসী। সেজন্যই বুঝি এক রূপসী আরেক রূপসীকে মুগ্ধ হয়ে দেখছে! তবে ঐ আকাশের থেকেও আমার প্রেয়সী অধিক রূপসী। সেটা কি আমার প্রেয়সী জানে? ”
নিহানের কথা শুনে ঠোঁটের কোন প্রসারিত হয় দৃষ্টির। ছেলেটা যে ওর মন ভালো করার জন্য কথাগুলো বলছে, তা দৃষ্টি বেশ বুঝতে পারছে।

আবেগে আরেকবার চোখ ভিজে উঠল দৃষ্টির। এরা সবাই ওকে স্বাভাবিক করার জন্য কতইনা চেষ্টা করছে। ওকে ভালো রাখতে সবাই নিজেদেরকে উজার করে দিচ্ছে। তাদের ভালোবাসার প্রতিদান না দিয়ে কিভাবে থাকবে দৃষ্টি!
” আজকাল তুমি কিন্তু ভালোই কথা বলছ। অথচ আগে হাতেপায়ে ধরতে হত তোমার মুখের দুইটা কথা শোনার জন্য। তখন কিন্তু এতটা অকৃপণ ছিলেনা তুমি। আমি সারাদিন ভেবেই ব্যাকুল হতাম, একটা মানুষ কথা না বলে থাকে কেমন করে। কিন্তু সেই তোমার মুখেই এখন কথার ফুলঝুরি ছোটে। ”

” তখনকার আমি আর এখনকার আমির মধ্যে অনেক পার্থক্য বুঝলি? তোর ভালোবাসা আমাকে পাল্টে দিয়েছে। আমি এভাবেই বারবার পাল্টাতে চাই। দৃষ্টি, আমার একটা কথা রাখবি? “প্রসঙ্গ পাল্টে হঠাৎ করে বলল নিহান।
” কি কথা বল। ”

” কালকে বেড়াতে যাবি? কতদিন তোকে নিয়ে বেড়াতে যাইনা। আনানকে রাজি আছে, এবার তুই রাজি থাকলে আমরা বেড়াতে যাব। ”
” সিক্তা আপু যাবে? ”
” সিক্তা, আরোশি, শিহাব তূর ওরা সবাই যাবে। নীরা ভাবির শরীর ভালো থাকলে সে-ও যেত। প্লিজ, তুইও চলনা। দেখবি ভালো লাগবে। ”

” কখন যাবে? ”
” সকাল ছয়টার মধ্যেই বের হতে হবে। যাবি তুই? ”
” হুম যাব। ” দৃষ্টি রাজি হওয়া মাত্রই নিহান ওকে জড়িয়ে ধরল। আনন্দে ওর বাঁধ মানছেনা।
” শোন, শাড়ি পরবি কিন্তু। আমি দিদুনের কাছে একটা শাড়ি রেখে এসেছি। সিক্তা, আরোশিও শাড়ি পরবে। তুই কিন্তু না করতে পারবিনা। ” নিহানের অধিকারবোধ দেখে দৃষ্টি মুচকি হাসল।

” আমি শাড়ি পরলে তুমি কিন্তু অসন্তুষ্ট হতে, সেকথা মনে আছে? আমার সাথে কেমন রা’গ দেখাতে। আমি কিন্তু ভুলিনি। সিক্তা আপুর বিয়েতে কি করেছিলে মনে আছে? ”
” সে-তো সবাই আমার সম্পদের সবাই নজর দিচ্ছিল, তাই রা’গ করেছিলাম। আমার বারবার মনে হচ্ছিল, শাড়ি পরা দৃষ্টিকে দেখার অধিকার শুধুই আমার আছে। সেসব কথা মনে করিয়ে দিয়ে আমাকে লজ্জা দিসনা। ”

” যেই আমাকে লুকিয়ে রাখার জন্য একসময় কত কিছু করেছিলে, কিন্তু ভাগ্যের কি পরিহাস দেখ, তুমি না চাইলেও দুই ন’র’প’শু আমাকে ঠিকই দেখে নিয়েছে। তুমি কিংবা তোমার ভালোবাসা আমাকে লুকিয়ে রাখার কোন সুযোগই পায়নি। আজও আমার শরীরে দ’গ’দ’গ করছে তাদের দেয়া আঁচড়, কা’ম’ড়ে’র দাগ। সেই দাগগুলো আমাকে প্রতি মুহূর্তে মনে করিয়ে দেয় তোমার আমানত আমি রক্ষা করতে পারিনি। নিজেকে বাঁচাতে ওদের কাছে কত আকুতি করেছি জানো ? আমার আকুতি ওদের মন একটুও গলাতে পারেনি। ওরা আমাকে নিঃশেষ করে দিয়েছে। ” দৃষ্টি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।

দৃষ্টির কান্না দেখে নিহান ওকে বুকে টেনে নেয়। কিন্তু একবারও কান্না থামাতে বললনা। ও চাইছে আজ মেয়েটা প্রাণ ভরে কাঁদুক। আজকের পর থেকে ও দৃষ্টির চোখে এক ফোঁটাও পানি আসতে দেবেনা। নিহানের বুকের মাঝে থেকেই দৃষ্টি বেশ কিছুক্ষণ কাঁদল। একটু ধাতস্থ হতেই, নিহানের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। চোখমুখ মুছে স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করল। এবং সফলও হল।

” ভাইয়া, তুমি যা করছ জেনে-বুঝে করছোতো? ভবিষ্যতে এটা নিয়ে আফসোস করবেনাতো? সব পুরুষই সুস্থ, স্বাভাবিক স্ত্রী নিয়ে সংসার করতে চায়। যেখানে স্ত্রী হয় স্বামীর নয়নের মণি। কিন্তু কোন ধ’র্ষি’তা মেয়েকি আদৌ কারও নয়নের মণি হতে পারে? সমাজ তাদের করুণা করে, ভালোবাসেনা। তুমি আবেগের বশে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজের জীবনকে ন’র’ক বানাও এটা আমি চাইনা। ”

” তোর বলা শেষ? আমাকে কি তোর ক্লাস টেনে পড়ুয়া আবেগী কোন ছেলে মনে হয়? তুই আমার কাছে আগে যেমন ছিলি, এখনও তেমনই আছিস। তুই আমার নয়নের মণি হয়েছিস অনেক আগেই। আর এখন তোকে আমি মাথার মুকুট করে রাখতে চাই। আমি বিবেক দিয়ে কাজ করি, আবেগ দিয়ে নয়। আবেগ আর বিবেকের তফাৎ বুঝিস তুই? যদি বুঝতিস তবে এসব কথা বলতে পারতিসনা। আমার জীবনে ন’র’কে’র কোন ঠাঁই নেই। তোকে নিয়ে আমি জান্নাতে যেতে চাই। জান্নাতে আমার পাশে আমি তোকেই চাই। আর কিছু শুনতে চাস? ”

নিহানের কথা শুনে দৃষ্টি আর কিছুই বলতে পারলনা। এই ছেলেটা ওকে এত ভালোবাসে কেন! এতকিছুর পরও কেন একটিবার মুখ ফিরিয়ে নেয়নি? এতটা ভালো কি আদৌ কেউ বাসতে পারে? দৃষ্টি মুখ তুলে তাকায় নিহানের দিকে। ও নিহানের চোখে কোন ছলনা দেখতে পায়না। নিহানের স্বচ্ছ চোখে ও নিজের জন্য অসীম ভালোবাসা দেখতে পায়। এই ভালোবাসা উপেক্ষা করার সাধ্য ওর নেই। তাই হুট করেই একটা সিদ্ধান্ত নেয় দৃষ্টি। অতীত ভেবে ও আর কষ্ট পাবেনা। আর কখনোই কাঁদবেনা। ওর পাশে নিহান আছে।

যার বুকে দৃষ্টির জন্য এক আকাশ ভালোবাসা রয়েছে। ওর বাবা-মা রয়েছে। যারা তাদের মেয়েকে বুকের মধ্যে আগলে রেখেছে। মায়ের মত ফুপুরা রয়েছে। যারা ওর বিপদে পাশে থেকেছে, ভরসা দিয়েছে। তাহমিনা আন্টি, তাহমিদ ভাইয়া রয়েছে। যারা ওকে প্রতিনিয়ত নতুনভাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখায়। এক জীবনে দৃষ্টি সবকিছু পেয়েছে। এই মানুষগুলোর জন্য হলেও নিজেকে নিয়ে ভাবতে হবে। নিজেকে নতুনভাবে গড়ে তুলতে হবে। ধীরে ধীরে অতীতকে জীবন থেকে মুছে ফেলতে হবে।

” নিচে যাবেনা? আমি অনেকক্ষণ থেকে ছাদে আছি, কাউকে বলে আসিনি। কেউ খোঁজ করছেনাতো? চল নিচে যাই। ”
” এখনই যাবি? আরেকটু থাকতে পারবিনা? ইচ্ছে করছেনা? ”
” তুমিই বললে সকালে উঠতে হবে। আবার তুমিই এখানে থাকতে বলছ! এখানেই যদি রাত পার করি, তবে ঘুমাব কখন? ”

” আচ্ছা যা। তবে ঘুমানোর আগে মামীর সাথে দেখা করিস। সে তোর খোঁজ করছিল। ”
” তুমি যাবেনা? ঘুমাবে কখন? ”
” একটু পরই আসছি। তুই যা। সকালে সময়মত উঠে যাবি কিন্তু। দেরি করা চলবেনা একদম। ”
” আমি ঠিক সময়ে উঠে যাব। তুমি তারাতারি নিচে এস কিন্তু। ” দৃষ্টি আর ছাদে থাকলনা। নিচে নেমে মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল।

শিউলি ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। দৃষ্টিকে দেখে সে একগাল হেসে হাত বাড়িয়ে দেয়। দৃষ্টি হাসিমুখে মায়ের দিকে এগিয়ে যায়।
” আমার আম্মা এতক্ষণ কই আছিল? খুঁইজাই পাইনা তারে। ফুপুর বাড়িতে আইসা মা’য়ের কথা ভুইলাই গেছ? ”
” আমি ছাদে ছিলাম, আম্মু। সবার সাথে আড্ডা দিতে গিয়ে সময় কিভাবে চলে যায় বুঝতেই পারিনা। তাই বলে কি তোমাকে ভুলে গেছি! ”

” আমি জানিতো, আমার মা’য়ে কখনো আমারে ভুলতে পারে! এমনেই কইছি আমি। এখন যাইয়া ঘুমাওগা। কালই নাকি সবাই মিল্লা ঘুরতে যাইবা? এখন না ঘুমাইলে সকালে উঠবার পারবেনা। ”

শিউলি মেয়েকে অনেকক্ষণ ধরে আদর করল। তার মেয়েটা কত কষ্টের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে ভাবলেই তার বুক ভেঙে কান্না আসে। শুধু মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কাঁদতে পারেনা। তবে আড়ালে আবডালে ঠিকই কাঁদে।
রাত দুইটা বাজলেও তাহমিদের চোখে ঘুম নেই। ও আইসিইউর সামনে বসে আছে। যখন ঘুম পাবে তখন সামনের একটা কেবিনে গিয়ে শোবে। আজকাল মেডিকেলই ওর ঘরবাড়ি হয়ে উঠেছে। আড়াইটার দিকে সে কেবিনের দিকে পা বাড়ায়।

কেবিনের বিছানায় কেবলই পিঠ রেখেছে। তখনই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে একজন নার্স। তাকে দেখে তাহমিদ উঠে বসল। ও কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই মুখ খুলল নার্সটি।
” স্যার, গুড নিউজ। একটু আগেই ম্যাম তার ডান হাতের দুইটা আঙুল নাড়িয়েছেন। কয়েক সেকেন্ডের জন্য চোখের পাতাও নাড়তে পেরেছেন। ”

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৫৭

নার্সের কথা শুনে তাহমিদ এক সেকেন্ডও কেবিনে থাকলনা। দৌড়ে বেরিয়ে যায় কেবিন থেকে। গন্তব্য আইসিইউ তে থাকা সহধর্মিণীকে কাছ থেকে পর্যবেক্ষন করা।

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৫৯