আমি মায়াবতী পর্ব ৪০

আমি মায়াবতী পর্ব ৪০
তাহমিনা মিনা

দরজা আঁটকে পুরো ঘর অন্ধকার করে ফ্লোরে বসে আছে মায়া। মাথা নিচু করে কান্না করছে। বাইরে থেকে সাবিহা, আম্মা, রিজা সবাই ডাকাডাকি করছে। সাব্বির কিছুক্ষন পরপর কান্না করছে ভয়ে। তবুও মায়া দরজা খুলছেনা। আজকে তার মন ভেঙে গেছে। নিজেকে কোনোভাবেই মানিয়ে নিতে পারছেনা।

আজকে ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছে। মায়া চান্স পায়নি। সেই কষ্টে কান্না করছে। বিকেল শেষ হয়ে সন্ধ্যাও পার হয়ে গেলো। কিন্তু মায়া এখনও দরজা খুলেনি। তাই সাগরিকা বাধ্য হয়ে রিজভীকে কল করে সবকিছু জানায়। রিজভী ঘন্টাখানেকের মধ্যে এসে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মায়াকে ধীরে ধীরে কয়েকটা ডাক দিতেই মায়া কান্নাভেজা চোখমুখ নিয়ে দরজা খুলে দিয়ে বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। রিজভী মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে স্বান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করে।মায়া ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করতে করতে বলে,” আমি অনেক চেষ্টা করেছি বাবা। কিন্তু পারলাম না।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

রিজভী বুঝতে পারে মায়ার মনের অবস্থা। তাই হেসে বলে,” সরকারি মেডিকেলেই পড়তে হবে এর কোনো মানে আছে মায়া? তোমার বাবার কি কম আছে নাকি কিছু ? সে তোমাকে প্রাইভেট মেডিকেলেও পড়াতে পারবে। তুমি টেনশন কেন করছো?”

“আমি প্রাইভেটে পড়বোনা।”
“কেন?” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে রিজভী।
“টাকার জোরে পড়তে চাইনা, বাবা।”
রিজভী হতভম্ব হয়ে গেল মায়ার কথা শুনে। তারপর বেশ ধীরে ধীরে বললো,”বেশ, ভালো কথা। তুমি যা বলবে তাই হবে। তাহলে এখন কি করবে?” ভার্সিটি ট্রাই করবে? নাকি সামনের বছর আবার পরীক্ষা দিবে?”

“দুটোই করবো বাবা।”
“অনেক খাটতে হবে কিন্তু মায়া।”
“জানি আমি।”
“বেশ, ভালো। তুমি যা বলবে, তাই হবে। কিন্তু তোমাকেও কথা দিতে হবে এখন।”
“কি?”

“মন খারাপ করে কান্নাকাটি করা যাবে না মোটেও। তোমার আম্মা আর ভাই-বোনদের অবস্থা দেখেছো? সাব্বির তো কেঁদে অস্থির হয়ে গেছে। কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে। তোমার এমন করা মোটেও উচিত হয়নি মায়া।”
“হুমম, বুঝেছি আমি।”
“এখন রুম থেকে বের হয়ে ওদের সাথে গিয়ে কথা বলো।”
মায়া মাথা নেড়ে বললো,”ঠিক আছে। তুমি যাও ফ্রেশ হয়ে নাও। আমিও ফ্রেশ হয়ে বের হচ্ছি।”

গুনগুন করে কান্না করছে সাব্বির আর বারবার বলছে,”আমি ভেবেছিলাম তুমি মরে যাবে মায়াপু।”
মায়া ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,”কেন তোমার এমন মনে হচ্ছিল?”
“তুমি দরজা আটকে দিয়েছিলে।সাবিহা আর রিজা আপু দরজা ধাক্কাছিল।মা কান্না করছিল। তাই ভেবেছিলাম তুমি মরে যাচ্ছো।”

“আমি কেন মরবো সাব্বির? আমার তো একটা সাহসী ভাই আছে। তাকে ছেড়ে আমি কেন মরবো?”
“তাহলে আর কখনোই দরজা আঁটকাবে না বলো। প্রমিস করো।”
“ওকে। যাও, প্রমিস।”
“সত্যিই?”
“তিন সত্যি।”

“আমিও অনেক ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম মায়াপু। ভেবেছিলাম তুমি উল্টোপালটা কিছু একটা করে বসবে। আমি তো চিৎকার করাই বাকি রেখেছিলাম শুধু।” গালে হাত দিয়ে বলে সাবিহা।
রিজা মুখ ভেঙচি কেটে বলে,” তুই তো চিল্লাবিই৷ তুই আসলে হয়েছিস আমার মায়ের মতো। শোকর কর যে আমার মা আজ বাসায় নেই তা না হলে চিৎকার আর কান্নাকাটি করে পুরো বিল্ডিংয়ের মানুষ জড়ো করতো।”
রিজার কথা শুনে সবাই হো হো করে হেসে উঠে।

” সরকারি মেডিকেল কলেজ কি তোমার বর যে তাকে না পেয়ে তুমি এইভাবে কান্নাকাটি করছো? আমাকে না পেলেও তো মনে হয় এইভাবে কাঁদতে না। তাইনা?”
কাব্যর নাম্বার থেকে এইরকম একটা মেসেজ দেখে মেজাজটা বিগড়ে গেল মায়ার। শুধু শুধু তাকে না কষ্ট দিলেই কি নয়? মায়া কিছু লিখতেই যাবে তার আগেই কাব্য আবার মেসেজ করে,” কালকে দেখা হবে মায়া। আজকের মতো ঘুমিয়ে পড়ো। আর হ্যাঁ, ভুলেও কাঁদতে পারবে না। তোমার চোখে যেন পানি না থাকে।”

এই মানুষটাকে এখনও বুঝে উঠতে পারে না মায়া। কখন কি বলে মায়া নিজেই বুঝতে পারে না। কিন্তু কাব্যর কথাটা তার ঠিক মনে হয়। এখন তার ঘুমের প্রয়োজন। কিন্তু ঘুমুতে পারছেনা। তার মায়ের যে খুব ইচ্ছে ছিল মেয়ে তার মেডিকেলে পড়বে। সে ইচ্ছেকে বাস্তবে রুপ দিতে পারলো না সে৷ কিন্তু সে তো চেষ্টা কম করেনি৷ মা বেঁচে থাকলে হয়তো আজ মায়ের কোলে মাথা রেখে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়তো৷ কিন্তু মা তো আর নেই৷ তাকে জড়িয়ে আদর করে ঘুম পাড়ানোরও কেউ নেই।

পাশে শুয়ে থাকা সাবিহাকে মায়া বলে,” তুই কাব্য কে কল করে সব জানিয়েছিস?”
সাবিহা কিছু না বলে চোখ বন্ধ করে থাকে।মায়া রেগে গিয়ে বলে,” ঘুমের ভান ধরবিনা সাবিহা। গুতা মারবো কিন্তু। সত্যি কথা বল।”
সাবিহা তড়িৎ গতিতে চোখ খুলে বলে,”হ্যাঁ, বাসার নিচে এসে দাঁড়িয়ে ছিল ভাইয়া।”

“কিহ?”
“হুমম। ”
“তুই বলছোস কোন দুঃখে?”
” আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তাই।”

মায়া চাইলেও আর কিছু বলতে পারেনা। সে তাই লাইট বন্ধ করে ঘুমুনোর প্রস্তুতি নেয়। ঠিক সেই সময় দরজা ঠেলে একটা বালিশ হাতে নিয়ে ভিতরে ঢুকে সাগরিকা। তাকে দেখে মায়া বলে,” এখানে কি করছো আম্মা?”
সাবিহাও চোখ দুটো বড় বড় করে বলে,”বাবাকে রেখে এখানে কি করছো মা?”
সাগরিকা দুই মেয়ের বালিশের মাঝখানে বালিশ রেখে শুতে শুতে বলে,” তোদের বাবার নাকে সমস্যা হয়েছে।সারারাত নাক ডাকে। আমি ঘুমুতে পারিনা। তাই এখানে এসেছি। কেন তোদের সমস্যা হবে?”

“নাহ। কোনো সমস্যা নেই। তুমি ঘুমুও মা।”
“মায়া, তোর কোনো সমস্যা?”
“নাহ, তুমি এখানেই থাকো আম্মা।”
“ভালো। এখন যা লাইট অফ করে দিয়ে আয়। চোখে বেশি আলো লাগে।”

মায়া লাইট বন্ধ করে দিয়ে এসে সাগরিকার পাশে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়ে। সাগরিকা মুখে এককথা বললেও মায়া আর সাবিহা ভালোমতোই জানে, সে মায়ার জন্য এখানে এসেছে। সন্তানের সফলতা আর ব্যর্থতা সবকিছই মায়েদের মেনে নিতে হয়। মায়েদের উপরের খোলসটা শক্ত হলেও ভেতরটা যে নরম। কিছুক্ষণের মধ্যেই সাগরিকা বুঝতে পারে সাবিহা আর মায়া দুজনেই ঘুমিয়ে গেছে। সাগরিকা মায়ার পাশে ফিরে ওর মাথায় আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। তারও প্রায় কিছুটা চোখ লেগে আসে। ঠিক এমন সময় মায়া বলে,” আম্মা।”
সাগরিকা হুট করেই মাথা থেকে তার হাত সরিয়ে নেয়। কিছুটা সময় নিয়ে বলে,” কি মায়া?”

“তুমি কি একটা কথা জানো?”
“কি?”
“তুমি কি জানো তুমি এই পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মা আর সবচেয়ে ভালো মানুষ? ”

সাগরিকা বরফের মতো জমে যায়। মায়ার সাহস বেরে যায়। সে বালিশ ছেড়ে সাগরিকার বুকের কাছে গিয়ে তার মাথা রেখে তাকে জড়িয়ে ধরে। সাগরিকাও তাকে পরম মমতায় নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়। এই প্রথমবার তারা দুজনেই অনুভব করে তারা এখন থেকে নিজেদেরকে মা-মেয়ে হিসেবে মেনে নিয়েছে। সাগরিকা ভাবে তার অনেক আগেই উচিত ছিল মায়াকে এইভাবে ভালোবাসা। হয়তো সে চিরাচরিত সৎ মায়েদের মতো তাকে অবহেলা করেনি।

কিন্তু মাতৃস্নেহে তো নিজের সন্তানের মতো কাছেও টেনে নেয়নি। নিজের কাছেই নিজেকে বেশ ছোট লাগে তার। সে অনুভব করে মায়া কাঁদছে। তার চোখের পানির স্পর্শ সে অনুভব করতে পারছে। কিন্তু তার ইচ্ছে করছেনা তার চোখের পানি মুছে দিতে। লাভ কি হবে তাতে? বরং সব দুঃখ-কষ্ট গুলো ধুয়ে মুছে যাক না হয়। এই মেয়েটি তার স্বামীর বায়োলজিকাল মেয়ে। কিন্তু তার না। তবে এই মেয়েটিকে একটা সময় ব্লাড দিয়েছিল সাগরিকা।

আমি মায়াবতী পর্ব ৩৯

তার নিজের শরীরের রক্ত দিয়ে তাকে বাঁচিয়েছিল সে। তার অবদানই বা কম কিসে? মায়া তারও মেয়ে। একসময় মায়া কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ে। তবে সাগরিকাকে ছাড়ে না। হয়তো ঘুমের ঘোরে নিজের মা ভেবেই এখনও ধরে আছে। সাগরিকা নিজেকে প্রবোধ দেয়। নিজের মা ভেবে কেন ধরবে ? মায়া তো তারই মেয়ে। তাকে ভেবেই ধরেছে।

আমি মায়াবতী পর্ব ৪১