আমি মায়াবতী পর্ব ৩৯

আমি মায়াবতী পর্ব ৩৯
তাহমিনা মিনা

একটা রেস্টুরেন্টে চুপচাপ বসে কাব্য আর মায়া। পিছনের টেবিলে বসে নিজের ইচ্ছেমতো খাবার খেয়েই যাচ্ছে কবিতা। আজই হয়তো তার শেষ খাবার খাওয়া হবে এই দুজন মানুষের তরফ থেকে। মনে মনে একটু আফসোস হচ্ছে তার। খাবারটা মিস হয়ে যাবে এখন থেকে। কি আর করার?

অহেতুক জীবনে সোহাগের মতো ঝামেলা টেনে আনতে চায় না সে। এমনিতেই মায়া জীবনে অনেক কষ্ট ভোগ করেছে। আর কষ্ট পাক, সেটা সে চায় না। কিন্তু এই মানুষ দুটো এসে বসে আছে তো আছেই। কেউ কোনো কথা বলতে পারছেনা। মনে হচ্ছে দুজন মানুষই চাইছে তার বিপরীত পাশে বসে থাকা মানুষটা কথা শুরু করুক। বিরক্ত লাগছে কবিতার দুজনের উপরই। দুজনই বসে বসে ইতস্তত করছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

কবিতার ইচ্ছে করছে কাব্যর মাথায় বাড়ি মারতে। গরুটা জীবনেও মানুষ হবে না। ইডিয়ট একটা। একসময় প্রচুর বিরক্ত হয়ে কবিতা পিছন থেকে বলেই ফেলে,” আমি এইখানে কারো সং সাজা দেখতে আসিনি। আমাকে ফকিন্নি বলবেন না কেউ ভুলেও। আমি খাওয়ার জন্য আসিনি। আপনারাই আমাকে বলেছেন খাবার খেতে। আপনারা কথা বলা শেষ করলে আমি বাসায় যেতাম।”

মায়া আর কাব্য দুজনেই হকচকিয়ে উঠে কবিতার কথা শুনে। এইরকম একটা পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে যে হবে, সেটা কাব্য ভালোভাবেই জানতো, কিন্তু সেটা যে এতো তাড়াতাড়ি, সেটা সে ভুলেও আন্দাজ করতে পারেনি। জড়তা ভেঙে কাব্যই প্রথমে বলে,”মায়া।”

মায়া মাথা নিচু করে বলে,”জ্বি, স্যার।”
“লুক এট মি, মায়া।”
মায়া একবার কাব্যর দিকে তাকিয়েই চোখ নামিয়ে বলে,”বলুন স্যার। ”
কাব্যর ইচ্ছে করছিল মায়া যাতে তারদিকে একটা বারের জন্য তাকিয়ে কথা বলুক। কিন্তু সে মায়ার অবস্থা বুঝতে পারছে। তাই আর ঘাটালো না তাকে। কিছুক্ষন চুপ করে থেকে আবার বললো,”শোনো মায়া, জীবনকে শুধুশুধু জটিল বানানোর কোনো ইচ্ছেই আমার নেই। সোজা কথা সোজা ভাবে বলাই ভালো। তুমি সবটাই জানো। কবিতা তোমাকে সবই বলেছে। জানো তো তুমি?”

মায়া মাথা নিচু করেই মাথা নেড়ে জবাব দেয়,”হুমম।”
“তো, কি করার ইচ্ছে এখন?”
“জানিনা।”
কাব্য হঠাৎ প্রায় অধৈর্য হয়ে বলে,” ঐ সোহাগ তোমাকে আর কতদিন পড়াবে?”
” পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত অবশ্যই। ”

“শোনো, একটা কথা শোনো মায়া। এখন চুপচাপ বাসায় চলে যাবে। কিছুদিন পরেই তোমার পরীক্ষা শুরু হয়ে যাবে। তখন থেকেই সোহাগের চ্যাপ্টার ক্লোজ। ওর কথা ভুলেও আর মাথায় আনবে না। বুঝলে?”
মায়া কিছুই বললো না। কাব্য আবার বললো,”যখন তোমার পরীক্ষা শেষ হয়ে যাবে, তখন আমরা বাইরে দেখা করবো। এর আগে না। এখন আমার কথাও মাথা থেকে মুছে ফেলবে। পরীক্ষা দেওয়ার পর আমার কথা ভাববে। আমার জন্য তোমার পরীক্ষা খারাপ হোক, সেটা আমি চাইনা।”

“হুমম।”
কাব্য উঠে দাঁড়ালো। কবিতার কাছে গিয়ে বললো, ওকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে বাসায় আসবি।”
কবিতা মাথা ঝাঁকিয়ে বলে,” যথাআজ্ঞা, স্যার।”

কাব্য রেস্টুরেন্টের বিল মিটিয়ে বের হয়ে যায়। মায়া মাথা উচু করে কাব্যর চলে যাওয়া দেখে। কবিতা নিজের টেবিল থেকে উঠে এসে মায়ার টেবিলে গিয়ে বলে,” হয়েছে আপনার ? চলেন ম্যাডাম। আপনার স্যার আপনাকে নিয়ে যেতে বলেছে আপনার বাসায়। আপনাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে আমাকে বাসায় যেতে হবে।”
মায়া শুকনো মুখে উঠে এসে কবিতার সাথে রিকশায় চড়ে বাসায় ফিরে আসে। সারা রাস্তা কবিতা ওকে টিটকারি করেছে কিন্তু মায়া কোনো কথারই জবাব দেয়নি।

বাসায় ফিরে মায়ার মনে এক অন্য রকম ভালোলাগা কাজ করছিল। সে এতসব ঘটনার মাঝে থেকে বুঝতে পেরেছে, আজ যে মানুষটার সাথে সে একটা সুন্দর সম্পর্কের সমীকরণ তৈরি করে এসেছে, সেই মানুষটার সাথে সে তার সারাজীবন কাটাতে পারবে তার চোখের দিকে তাকিয়ে। সে তার ফোনটা হাতে নিল। তার ফোনে কাব্যর নাম্বার আছে। মেসেঞ্জারে এড আছে।

মায়ার ইচ্ছে করছে তাকে মেসেজ করতে, কল করতে। কোনোভাবেই সে নিজের ইচ্ছেটাকে দমিয়ে রাখতে পারলোনা। শেষমেষ নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করে কাব্যকে কল দিয়েই বসলো। কিছুসময় পর অপর প্রান্তের মানুষটা কল রিসিভড করতেই তার কণ্ঠস্বর শুনে সে কল কেটে দেয়। ইশশ! কি লজ্জা। কি আদেখলাপনাই না সে করেছে। কি ভাববে তাকে সে?

যদিও কাব্য বলেছিল মায়াকে যে তাদের মধ্যে দূরত্ব রাখতে কিছু সময়ের জন্য, কিন্তু মায়া তার কথা শুনেনি। নিজের জীবনে সবকিছু হারানোর পর আবার কাব্যকে পেয়েও হারাতে চায়না সে মোটেই। কোনোভাবেই না। ক্লাসের মেয়েরা কাব্যকে নিয়ে কথা বললে তার সহ্য হয়না।

কোনোভাবেই সে নিজেকে থামাতে পারেনা। যদিও কাব্যর সেইসব নিয়ে মাথা ব্যথা নেই। কিন্তু মায়া নিজেকে বোঝাতে পারে না। কথায় বলে না, ঘরপুড়া গরু আকাশে সিঁদুরে মেঘ দেখলেও ভয়ে কেঁপে উঠে, মায়ারও হয়েছে সেই দশা। যে মায়া কাব্যর সামনে আসতেও লজ্জা পেতো, সে এখন কাব্যর সামনে দাঁড়িয়ে তাকে উপদেশ দিতেও ছাড়ে না। মায়ার মাঝেমধ্যে নিজেকে দেখেই অবাক লাগে কিভাবে সে এতোকিছু করেছে।

কাব্যও তাকে আগলে আগলে রেখেছে। দুজনের প্রতি দুজনের ভরসা আর বিশ্বাসের জোরেই তারা এতোটা কাছাকাছি আসতে পেরেছে।
“মায়া আপু, এখানেই সারারাত ঘুমিয়েছো নাকি? মশায় তো তোমাকে চু*ম্মা* দিতে দিতে গাল লাল করে ফেলেছে।
ধড়মড়িয়ে উঠে মায়া। কি হচ্ছে বুঝতে পারছে না। কিন্তু দ্রুতই মস্তিষ্ক সচল হয় তার।

চোখ ডলে ভালোভাবে সামনে তাকিয়ে দেখে সাবিহা দাঁড়িয়ে আছে। আর সে বারান্দাতেই শুয়ে আছে। কাল রাতের কথা মনে পড়ে তার। সে তবে অতীতের কথা ভাবতে ভাবতে এখানেই শুয়ে পড়েছিল? ইশশ! কি লজ্জা। সাবিহা এখন কি না কি ভেবে বসবে। সাবিহা আর কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই সে বলে,” আসলে কিভাবে যে এখানে এসে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বুঝতে পারিনি। তুই আম্মা বা বাবাকে বলিস না সাবিহা।।আমাকে মেরেই ফেলবে।”

“বুঝেছি। নতুন নতুন প্রেমে পড়লে এইরকম কত কিছুই হয়। তোমাকে দেখে শিখে রাখছি। আমি প্রেম করলে আগে থেকেই বারান্দায় একটা বালিশ আর কম্বল নিয়ে রাখবো। আমার আবার বালিশ ছাড়া ঘুম আসেনা।” বলেই হাই তুলতে তুলতে সাবিহা চলে যায়।

মায়া ভীষণ লজ্জিত হয়ে রুমে চলে আসে। অনেক পড়া বাকি আছে। আবার কোচিং-এও যেতে হবে। কয়টা বাজে সেটা দেখার জন্য মোবাইলটা হাতে নিতেই দেখে কাব্যর মেসেজ। মুহুর্তেই মনটা ভালো হয়ে যায় তার। একটা মিষ্টি হাসি ফুটে উঠে তার মুখে। এক জীবনে প্রিয় মানুষটার থেকে এতোটা কেয়ার ছাড়া আর কি-ই বা চাইবার আছে?

“পরীক্ষা কেমন হয়েছে মায়া?” গাড়ি চালাতে চালাতে প্রশ্ন করে কাব্য।
“মোটামুটি। ”
“কি মনে হয়? চান্স হবে কোথাও?”
“আশা তো রাখছি। দেখা যাক কি হয়।”
“চান্স না পেলেও মন খারাপ করোনা। কেমন? সামনে আরো পরীক্ষা দিতে হবে।”
“হুমম। ”

“তুমি কি ভাগ্যে বিশ্বাসী মায়া?”
“অবশ্যই। কিন্তু পরিশ্রমও তো করতে হবে। এটাতেও বিশ্বাসী। ”
“গুড।”
মায়া কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। আজ সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে কাব্যকে তার মায়ের ব্যাপারে জানাবে। কিন্তু সাহস পাচ্ছে না। বারবার বলতে চেয়েও সে বলতে পারছেনা। মায়ার এইরকম ভাব দেখে কাব্য নিজে থেকেই বলে,”কিছু কি বলতে চাও মায়া?”

মায়া একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলে,”হ্যাঁ, বলতে চাই।”
“কি বলতে চাও? বলো। কোনো কিছু লুকাবে না কখনোই আমার থেকে।”
“হুমম। ”
“বলো কি বলতে চাও।”

“আসলে কথাটা কিভাবে বলবো বুঝতে পারছিনা। বিষয়টি আমার পরিবারকে নিয়ে। আপনাকে বলা উচিত হবে কি-না আমি জানিনা। কিন্তু আপনাকে জানানোটা জরুরি।”
“তোমার পরিবার আমারও পরিবার মায়া। নির্দ্বিধায় বলো।”
“আগে আমাকে বলুন।।আমাকে আপনি ভুল বুঝবেন না। আমাকে ছেড়েও যাবেন না।”

কাব্য একবার আড়চোখে তাকায় মায়ার দিকে। মেয়েটার চোখে পানি টলমল করছে। কাব্য কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে রাস্তার এক পাশে গাড়ি দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করে,”এবার বলো, মায়া।”
মায়া কিছুক্ষন মাথা নিচু করে থেকে বলে,”বিষয়টা আসলে আমার মা কে নিয়ে।”
মায়া হয়তো আরো কিছুই বলতো কিন্তু তার আগে মায়াকে অবাক করে দিয়ে কাব্য বলে,”তোমার মোহিনী মাকে নিয়ে?’

মায়া হকচকিয়ে গেল। তবে কি কাব্য সব জানে? কবিতা কি সব বলে দিয়েছে? কাঁপাকাপাঁ গলায় মায়া জিজ্ঞেস করে, “আপনি জানেন কিভাবে? ”
“কি মনে হয় তোমার?”
“কবিতা জানে। কিন্তু ওর তো বলার কথা না৷ ও বলেনি। আমি ওকে বিশ্বাস করি। কিভাবে জানেন সব?”
“ভালো লাগলো তুমি আমার বোনকে বিশ্বাস করো জেনে। আমি অনেক আগে থেকেই জানি।”
“কিভাবে জানেন?”

“যেদিন তোমাদের বাসায় প্রথম গিয়েছিলাম। সেদিন জানতে পেরেছি।”
“মানে?”
“তোমার আম্মার নাম সাগরিকা। তোমার বাবার নাম রিজভী। তাইতো?”
“হুমম।”

“সেদিন রাতে বাসায় ফিরে আমার বাবাকে তোমার পরিবার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলাম৷ উনি তোমার বাবা আর আম্মার নামে অনেক সুনাম করেছিলেন। কিন্তু আমি তোমার আইডি কার্ডে তোমার মায়ের নাম দেখেছি মোহিনী। পরে তোমার ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়েছি। বুঝতে পেরেছো কিভাবে জেনেছি? ”

মায়া মাথা নিচু করে রইলো। নিজেকে ভীষণ তুচ্ছ মনে হতে লাগলো তার।।যেন সে একটা পাপ। হঠাৎ ঢুকরে কেঁদে উঠলো সে। কাব্য দুহাতে আগলে নিলো তাকে। মেয়েটার মনের অবস্থা সে বুঝতে পারছে। মায়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,”কারো ভুলের শাস্তি আমি তোমাকে পেতে দিবো না মায়া। খুব তাড়াতাড়িই আমরা একত্র হবো। খুব তাড়াতাড়ি। কথা দিচ্ছি আর কোনো কষ্ট পেতে দিবো না তোমাকে।”

মায়া পরম নির্ভরতায় মাথা রাখে কাব্যের বুকে। সে জানে এই মানুষটা তার। সবরকম বিপদে সে তাকে আগলে রাখবে। কিন্তু ভয় যে তার পিছু ছাড়ে না। যদি মায়ের করা পাপের শাস্তি সে পায়। যদি কাব্য তাকে ছেড়ে অন্য কারো কাছে চলে যায়। না, না সে আর ভাবতে পারছেনা। মায়া ঠিক করে বাবাকে সব জানাবে। কিংবা আম্মাকে। বা নান-নানীকে। তারাই বাবা আর আম্মাকে জানাবে।

আমি মায়াবতী পর্ব ৩৮

সোহাগ নামক কোনো ঝামেলা আসুক সেটা সে চায় না। কিংবা আর কোনো উটকো ঝামেলা। মায়া আজ বাবার কষ্ট বুঝতে পেরেছে। এতোদিন কাব্যর সাথে এতো ভালো সময় কাটিয়েও সে যে কোনো শান্তি পায়নি। মনে হয়েছে কাব্য হয়তো সব জেনে যাবে। তাকে ছেড়ে যাবে। সে তো মাত্র ৬ টা মাস সহ্য করেছে। তাহলে বাবা ১৭ টা বছর কিভাবে সহ্য করেছে?

আমি মায়াবতী পর্ব ৪০