রাজনীতির রংমহল পর্ব ৪২

রাজনীতির রংমহল পর্ব ৪২
সিমরান মিমি

রৌদ্রজ্জ্বল সকাল।শিকদার মঞ্জিলের ড্রয়িংরুম এখন পিনপিনে নিরবতায় বিরাজমান।মিসেস রাজিয়া বেগম বেশ আয়েশ করে স্পর্শীর দিকে তাকিয়ে বসলেন।তার কথায় তাল মেলানো কাউকে পেয়ে ভীষণ উৎসাহী সে।স্পর্শী আলতো হেসে তানিয়ার দিকে তাকালো।মেয়েটা এখনো মুখে লজ্জালু হাসি নিয়ে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে পায়ের নখ খুটছে।এমন ভাব যেন তাকেই দেখতে এসেছে শশুরবাড়ি থেকে।গায়ে জ্বালা ধরে গেল স্পর্শীর।
টান টান হয়ে তানিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো-

তোমার নাম কি?কি করো?কোথায় থাকো?ডিটেইলসে বলো?
চমকে উঠলো উপস্থিত সবাই।পিয়াশা বেগম উত্তেজিত গলায় বললেন-
আহ!এখন এসব থাক না।ভাবি,আমি আপনাকে পড়ে বুঝিয়ে বলবো।বাদ দিন।তাছাড়া আমার দূর সম্পর্কের এক বোনের ছেলে আছে।সেও ডিভোর্সি। কিন্তু খুব ভালো।তানিয়া মামুনির বিয়ে দিতে চাইলে আমি সেখানে কথা বলে দেখতে পারি।সেটা আরো ভালো হবে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মনঃক্ষুন্ন হলো রাজিয়া বেগম।চটপটে স্বরে বললো-
কেন ভাবি?আমার মেয়ে কি দেখতে খারাপ।মাত্র চার মাসের সংসার করেছে।আর আপনার ছেলের বয়স তো বত্রিশ পার হয়ে গেছে।এখনো যে আমি আমার এই যুবতী মেয়ের বিয়ের কথা বলছি এটাই তো অনেক।এমন ভাব করছেন যেন আপনার এই আধবুড়ো ছেলের জন্য অবিবাহিত মেয়ে আনবেন।এতটা অ;কৃতজ্ঞ কেন আপনারা?আপনার সেই ধর্ষিতা মেয়েকে তো আমার অবিবাহিত ছেলেটার সাথে নিচ্ছি।মেয়ে তো আপনার দেখতে আহামরি সুন্দর ও না।নেহাত ছেলেটা পাগলামি করছে নইলে……

আর কিছু বলার আগেই তানিয়া মাকে থামিয়ে দিলো।পিয়াশা বেগম যেন থম মেরে রইলেন।কিছু বলার ভাষাই হারিয়ে ফেলেছেন যেন।
স্পর্শী এখনো নিরব হয়ে সবকিছু দেখছে।আচমকা দাঁড়িয়ে তানিয়ার পাশে গেল।ত্যাড়া কন্ঠে বললো-
আরে আন্টি।আপনি এতো হাইপার হচ্ছেন কেন?আপনি যখন প্রস্তাব রেখেছেন তখন মেয়ের খুটিনাটি আমাকে জানতে হবে না।দেখি তো…..

বলেই তানিয়ার চুল খুলে দিলো। ঝরঝর করে কালার করা চুলগুলো পিঠময় ছড়িয়ে গেল।কোমড়ের উপর পর্যন্ত পড়া চুল গুলো আলতো হাতে ধরে আফসোসের কন্ঠে বললো-
ইশশ!হলো না তো।এত ছোট চুল দিয়ে হবে না তো।
এই যে দেখুন বলেই হাটু সমান চুলগুলো খুলে কাধের সামনে এনে বললো-

রাতে ঘুমানোর সময় তো উনি আমার চুলগুলো দুহাতে পেঁচিয়ে ধরে ঘুমায়।নইলে ওনার ঘুম আসে না।কোথাও যেতে গেলে আলতো হাতে আমার চুল গুলো টেনে কাছে টেনে নেয়।কিন্তু আপনার মেয়ের যে লেজ, এই লেজ ধরে টানলে তো মাথার খুলি সুদ্ধ ওনার হাতে চলে আসবে।না না বাবাহ!আমি আবার এতো রিস্ক নিতে পারবো না।এমনিতেই তিনটা খুন করে এতোগুলো বছর জেলে ছিলো।এখন আবার চার নম্বর খুন।

ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন উপস্থিত সবাই।শুধুমাত্র মুখ টিপে হাসলেন পরশের চাচী।তানিয়া চোখ গুলো বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো স্পর্শীর দিকে।মাথা টা ভনভন করছে।এই মেয়ে পরশ শিকদারের সাথে রাতে ঘুমায়?কেন?কেন?
রাজিয়া বেগম চটপটে কন্ঠে বললেন-

এটা কি ধরনের অভদ্রতা।আর তুমিই বা কে যে পরশ বাবার জন্য বউ ঠিক করবে?ওর মা আছে এখানে।আর….
বলার আগেই উপর থেকে হনহন করে পরশ নেমে এলো।বাম ভ্রু কুচকে স্পর্শীর সামনে এসে বললো-
পাঁচ মিনিট ধরে ওয়েট করছিলাম আমি।আমাকে উপরে পাঠিয়ে এখানে কি করছিলে?
দাত মেলে হেসে দিলো স্পর্শী।পরশের হাত ধরে সোফায় বসিয়ে ত্যাড়া কন্ঠে বললো-

এমা,নেতামশাই। রাগ করছেন কেন?আরে বাবা আপনার জন্য বিয়ের সম্বন্ধ এসেছে।তাই তো উপরে পাঠালাম।আগে কথাগুলো সব ঠিকঠাক ভাবে ভেঙে নিই।তারপর পাত্র কে আনতে যাব।তার আগে এসে বসে থাকলে তো সবাই নির্লজ্জ ভাববে আপনাকে।

পরশ আহাম্মক বনে গেল।কিছু জিজ্ঞেস করার প্রয়াস করতেই স্পর্শী থামিয়ে দিয়ে বললো-
আসলে আমার শাশুড়ী মায়ের আমাকে পছন্দ হয় নি।তাই তো ছেলেকে বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে।
থেমে রাজিয়া বেগমের উদ্দেশ্যে হেসে বললো-

আমি কে জানতে চেয়েছিলেন না।আমি আপনার পছন্দ করা পাত্রর প্রথম পছন্দের পাত্রী।বিগত চার বছর থেকে বর্তমান পর্যন্ত একমাত্র বউ।তাই আমার জামাইয়ের জন্য নতুন পাত্রী খোজা অবশ্যই আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।তাই না আন্টি।

রাজিয়া বেগম এবারে ভীষণ অসস্তিতে পড়লেন।এই মেয়ের সামনে বসেই তার পরিবারের ব্যাপারে বাজে কথা বলেছে তিনি।এভাবে সামনাসামনি সব ব্যাপার’টা বিগড়ে যাবে এটা তার মোটেও কামনা ছিলো না।এরইমধ্যে পেছন থেকে মহীউদ্দীন শিকদার হো হো করে হেসে দিলেন।বাকিরা ও হাসতে হাসতে এসে সোফায় বসলেন।রাজিয়া বেগম বেশ অপমানিত বোধ করলেন।শুরুতে বললেই তো সব মিটে যেত।এভাবে মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব রাখবে আর তাকেই সবাই এভাবে হাস্যকর পাত্রী বানাবে এটা ভীষণ আত্নসম্মানে লেগেছে তার।তাড়াহুড়ো করে ঊঠতে উঠতে বললেন-

আমি সত্যিই দুঃখিত।যাই হোক,সব কিছু তো মিটেই গেল।এখন আমরা আসি।বাড়িতে গিয়ে বড়রা বসে সিদ্ধান্ত নিয়ে বিয়ের তারিখ জানিয়ে দিব।চলো তাহলে।
একপ্রকার তাড়াহুড়ো করে সবাইকে নিয়ে চলে গেলেন রাজিয়া বেগম।সবাই যেতেই স্পর্শী পরশের দিকে নিরব ভাবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো।তারপর তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে হনহন করে রুমের দিকে চলে গেল।পরশ পড়লো বিপাকে।স্পর্শীকে রুমের মধ্যে ঢুকতে দেখেই মায়ের উদ্দেশ্যে ধীর কন্ঠে বললো-

মা,এসব মজা করার দিন কি এখনো আছে?কি সব উদ্ভট কাজ করো তুমি।আমার বিয়ে দেবে আবার।আশ্চর্য সব উদ্ভট মজা।
চোখ গরম করে কিছুক্ষণ ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন পিয়াশা।থমথমে কন্ঠে বললেন-
হ্যাঁ, এখন তো সব আমার দোষ। আমি তো গত সপ্তাহে প্রিতমের মায়ের সাথে কথা বলছিলাম।তোর আর তোর বউয়ের কথা জানতে চাইছিলো বলেই তো কথাগুলো বলেছি।আর স্পর্শী কি লেখাপড়া করতে যায় নি?আর উনি যে এমন হুট করে মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব রাখবে সেটা কি জানতাম আমি।
থেমে,

তাছাড়াও উনি বলার সাথেই সত্যটা বললে কি এমন হতো।শুধু শুধু হাস্যকর পাত্রী বানালো বেয়ান কে।না জানি খুব রাগ করছে।
এরকম’ই অজস্র কথা বিরবির করে বলতে লাগলেন পিয়াশা বেগম।পরশ আমলে নিলো না। চুপচাপ বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। বাইক নিয়ে বাজারের উদ্দেশ্যে আজ এতোদিন পর রওনা হলো।

বাজারের কাছাকাছি আসতেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো।সামনেই একটা বড় গাছের উপর পেরেক দিয়ে গাঁথা মোটা ফ্রেমে বাঁধানো হাস্যোজ্জ্বল ছবি।নির্বাচনকালীন সময়ে অনেক জায়গায়’ই এই ছবি টাঙানো হয়েছিলো।আজ ও আছে। তবে ছবিটার এক তৃতীয়াংশ নষ্ট হয়ে গেছে ইতোমধ্যেই।হায়রে স্বপ্ন।নিজের সমস্ত অনুভূতি, ভালোলাগা,ভালোবাসা সবটাই তো রাজনীতির মধ্যে বিদ্যমান ছিলো।

একধ্যানে পোস্টার টার দিকে তাকিয়ে রইল পরশ।মুহুর্তে’ই ওই হাস্যোজ্জ্বল ছবিটির রঙ পরিবর্তন হয়ে ধীরে ধীরে সেখানে ফুটে উঠেছে এক নির্মম লাশের অবয়ব।তার’ই পাশে ভেসে উঠেছে চৌদ্দ বছরের এক কিশোরীর আর্তনাদের ধ্বনি।ধীরে ধীরে ফুটে উঠলো লাল রক্তের অবয়ব।মুহূর্তে’ই চোখ বন্ধ করে নিলো পরশ।হাত -পা কেঁপে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে।প্রিয় মানুষ গুলোর অনুপস্থিতি’টা যেন প্রতিটা ক্ষণে দুমড়ে মুঁচড়ে দিচ্ছে হৃদয়’টাকে।সহ্যশক্তি যেন চরম সীমায় পৌছে গেছে তার।

সাথে সাথেই নিজের গতি পরিবর্তন করলো।বাইক ঘুরিয়ে পুনরায় বাড়ির দিকে রওনা হলো।নাহ,বাড়ি নয়।এখন সে যাবে ভাইয়ের কাছে।তার পাশে গিয়ে বসবে।হাত বুলিয়ে আদর করবে ওই নরম স্যাঁতসেঁতে মাটির উপর।আলতো করে দুটো চুমু খাবে।ধীর কন্ঠে হাজারো না বলা কথা বলবে ছোট্ট ভাইটার সাথে।তবে সেটা সবার অগোচরে।নিজের দুর্বল ভিত্তিটাকে অন্যের সামনে আর কখনোই প্রকাশ করবে না পরশ।কখনোই না।

ছাঁদে টাঙানো রশিতে ভেজা কাপড়গুলো ত্রস্ত হাতে মেলে দিয়ে তাড়াহুড়ো করে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে লাগলো আর্শি।ইশির ঘুম ভেঙে গেছে।মাত্রই ওকে ঘুম পাড়িয়ে গোসল করে নিয়েছে সে।এরমধ্যেই আবার উঠে গেছে।বিরক্তি তে নাক-মুখ কুচকে ফেললো আর্শি।দ্রুতপায়ে নামতে গিয়েই পড়নের কাপড়ে পা বেধে ঠাস করে নিচে পড়ে গেল।না এখনো পড়ে নি।পড়ার আগেই বলশালী দুটো পুরুষালী হাত তার কোমড় জড়িয়ে নিয়েছে।কিছু বলে ওঠার প্রয়াস করার আগেই দুহাতে শূন্যে তুলে কোলে নিয়ে রুমের ভেতর ঢুকলো।বিছানায় শোয়া ইশির পাশে শুইয়ে দিয়ে গায়ের ঘামে জর্জরিত শার্ট খুলতে খুলতে বললো-

হাহ!আমার কি কপাল?একসাথে দু দুটো বাচ্চা পালতে হচ্ছে।দেখে শুনেও একটু হাটতে পারো না নাকি?আমার ইশিও তো দিনে ওতোবার পড়ে যায় না যতবার তুমি একেক জায়গায় পিছলে পড়ে যাও।
নাকের পাটাতন ফুলিয়ে বিছানায় বসলো আর্শি।গমগমে কন্ঠে বললো-
আমার কি দোষ? আপনার মেয়ে কি একটু শান্তি দেয় আমায়?এই মাত্র ঘুম পড়িয়েছি এর মধ্যেই আবার কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে।একটু শান্তি দেয় না আমায়।ধুর।

রাহুল থমকে গেল।আর্শির দিকে তাকিয়ে চুপচাপ দেখতে লাগলো। আগের সেই বাচ্চা মেয়েটা আর নেই।বেবী হওয়ার পর থেকেই বেশ গুলুমুলু হয়ে গেছে।শরীরে পড়েছে নারীত্বের ছাপ।মুখে পড়েছে মাতৃত্বের মায়া।বয়স টাও বা কত?মাত্র বাইশ চলছে।এর মধ্যেই বাচ্চা নেওয়া উচিত হয় নি তার।কিন্তু সেই বা কি করতে পারে?যে আসবে তাকে কি-ভাবে আটকাবে।এই সাধ্যি কার?

ক্লান্ত চিত্তে আর্শির পাশে বসলো রাহুল।কপালের সামনের চুলগোছা কানের পেছনে সরিয়ে দিয়ে বললো-
খুব জ্বালায় না তোমায়?সত্যিই এতো তাড়াতাড়ি বেবী নেওয়া উচিত হয়নি।তাই না?এর থেকে এবরেশন করা উচিত ছিলো।

চমকে উঠলো আর্শি।মুহুর্তে ‘ই ছোট্ট মেয়েটাকে বুকের সাথে চেপে ধরলো।বাচ্চা নষ্ট করলে তো এই ছোট্ট পাখিটা আজ থাকতো না তাদের মাঝে।কোথায় থাকতো এই পরিটা।মেয়ের দু গালে চুমু খেয়ে ঝাঝালো কন্ঠে বললো-
কেন? ওকি আপনাকে জ্বালাচ্ছে নাকি?খুব বেশী বোঝা হয়ে গেছে আমার মেয়ে?
থেমে করুন কন্ঠে,

একদম বাজে কথা বলবেন না আপনি?ও আমায় একটুও জ্বালায় না।বাচ্চা তো,এই জন্য একটু কাঁদে।বড় হলে ঠিক হয়ে যাবে।আর দোষ টা তো আমার’ই।আমি সামলাতে পারি না।বাড়ির রান্নাবান্না তো মা’ই করে।আমিতো ব্যাস একটু হাতে হাতে কাজগুলো গুছিয়ে দেই।তাছাড়া বিকাল বা রাতেও তো প্রায়’ই ইশি আব্বু-মায়ের কাছে থাকে।ও তো মাঝেমধ্যে বিরক্ত হয়ে বলি আমি।তাই বলে আপনি এসব বলবেন?

ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল রাহুল। গায়ের শার্ট টা বিছানায় ছুড়ে ফেলে বাথরুমে গেল।যাওয়ার আগে দাতে দাত চেপে বললো-
তোমাদের মেয়েদের এই একটাই সমস্যা।ভালো বললেও আমি খারাপ আর খারাপ বললেও আমি খারাপ।যত দোষ সব এই রাহুল ঘোষ।অদ্ভুত বিচার।

প্রাণোচ্ছল বিকেলবেলা।ঘড়ির কাটা’য় তখন মাত্র চারটা বাজে।ফুরফুরে মন নিয়ে বাড়ির আনাচে -কানাচে ঘুরে বেড়াচ্ছে প্রেমা।এযে ফাগুন চলছে।না,ঋতুতে নয়।তার মনে ফাগুন চলছে।চারপাশ থেকে অদৃশ্য মৌমাছিরা যেন মধু শুষতে প্রানপণ চেষ্টা চালাচ্ছে।কিছুক্ষণ পর পর আলতো করেই হেসে দিচ্ছে প্রেমা।নিজের এই চঞ্চল দিকটার সাথে খুব’ই অপরিচিত সে।ড্রয়িংরুমে যেতেই দেখলো মা ফোনে কারো সাথে কথা বলছে।ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করতেই পিয়াশা ইশারায় বললো-

ও বাড়ি থেকে ফোন করেছে।
মুহুর্তেই মনপায়রা টা নেচে উঠলো। ও বাড়ি থেকে ফোন দিয়েছে মানেই বিয়ের ডেট জানানো হবে এখন
।আলতো পায়ে দুরুদুরু বুক নিয়ে মায়ের শরীরের সাথে মিশে রইলো।ফোনের স্পিকার লাউড’এ দিয়ে কান পাতলো ওপাশের বলা রাজিয়া বেগমের কথায়।

–আপনি কিভাবে থাকেন ভাবি এই মেয়ে নিয়া।আদোও একি সংসার করতে জানে?কি চ্যাটাং চ্যাটাং করে কথা বলে।সবার আগে মুখ চলে।দেখলাম তো নাস্তা আনলো। মনে হয় যেন লাফাচ্ছিলো পুরো ফ্লোরে।তার উপর ঘরের বউ, ভালো একটা শাড়ি পড়ো।তা না ছেলেদের মতো একটা জিন্স পইরা সামনে আসছে।যাই বলেন ভাবি,এই মেয়ের জন্য একবার এতোগুলো দিন ছেলে আপনার জেলে, আরেকটা মারা গেছে।না জানি ভবিষ্যতে আরো কি কি হয়।
অসস্তি তে পড়লেন পিয়াশা বেগম। আমতা-আমতা করে বললেন-

আরে না না ভাবি।তেমন কিছু না।আসলে মা ছাড়া বড় হয়েছে তো তাই একটু চটপটে।কেউ শাসন করেনি তো এর আগে।আপনি ওর কথা বাদ দিন।
শুনলেন না রাজিয়া বেগম। পুনরায় হেয়ালি করে বললো-

এসব ব্যাপারে বাদ দিলে কি চলে?দেখবেন আর ক’টা দিন পর।যখন আপনাকে প্রত্যেক কথায় খোটা দিবে,সারাক্ষণ স্টাইল নিয়ে বসে থাকবে।আমার সাথে আবার এমন চলবে না।তার আগেই মুখ ভেঙে দিব।কোথায় ধর্ষিতা ননদ বিয়ে দেবে।সেই জন্য আরো মিষ্টি করে,নরম হয়ে সবার সাথে কথা বলবে তা না আরো গায়ে পড়ে ঝগড়া করছিলো।আমার মেয়ের চুল নিয়ে আবার অপমান ও করছিলো।কি খুঁত আমার মেয়ের?শুধু বিয়েই তো হয়েছে,বিয়ের আগে গায়ে তো কলঙ্ক নিয়ে বসে থাকে নি।

ছলছল করে উঠলো প্রেমার চোখ।মুহুর্তে’ই দাঁড়িয়ে পড়লো সেখানে।মায়ের হাত থেকে ফোন’টা টেনে নিয়ে কেটে দিলো।পিয়াশা বেগম ও হতভম্ব হয়ে গেলেন।আদোও তিনি কথার কোনো প্যাঁচ ধরতে পারলেন না।মহিলা তো এর আগে এভাবে কথায় কথায় খোটা মেরে কথা বলে নি।তাহলে স্পর্শীর জন্য অপমান বোধ করেছেন?আর সেজন্যই কি এভাবে কথা বলে বিয়েটা ভাঙতে চাইছেন।আহারে! মেয়েটা প্রিতমকে কতটাই না ভালোবাসে।এ -কদিন কতই না হাস্যোজ্জ্বল ছিলো।

এরই মধ্যে প্রেমার” হ্যালো” শুনেই ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলেন।কাকে ফোন করেছে জিজ্ঞেস করার প্রয়াস করতেই প্রেমা থামিয়ে দিল।ধীর কন্ঠে ওপাশের ফোনের মালিক’কে বললো-
–আমি প্রেমা বলছি।আপনি শুনতে পাচ্ছেন?
ফোন হাতে নিয়ে প্রিতম অবাকের রেশ ধরে বললো-
বাব্বাহ!এতো প্রেম।এইতো বিশ মিনিট আগেও কথা বললাম।এখন আবার মায়ের ফোন থেকে কল করেছো।কেন?তোমার ফোনের চার্জ শেষ নাকি?হুম।

চোখ বন্ধ করে নিজেকে সামলে নিলো প্রেমা।গলা পরিষ্কার করে কঠিন কন্ঠে বললো-
আমি ধর্ষিতা মেয়ে।পুরো জেলার সবাই জানে প্রেমা শিকদার চৌদ্দ বছর বয়সেই গণধর্ষনের শিকার হয়েছে।নিশ্চয়ই আপনি বা আপনার পরিবারের অজানা ছিলো না।সম্পর্ক শুরুর আগেও আমি অজস্র বার আপনাকে বুঝিয়েছি।বরং এসব কথায় আপনি পাত্তা দেন নি।শেষ পর্যন্ত নিজেই পাগলামি করে সম্পর্কটাকে বিয়ে অবধি নিয়ে যেতে চাইছেন।আমি তো জোর করি নি।করেছি আপনাকে?

অবাক হয়ে গেল প্রিতম।আশ্চর্যের রেশ ধরে বললো-
এসব কি ধরনের কথা বলছো প্রেমা?আমি কি শুনতে চেয়েছি এসব।
ঢুকরে গলার কাছে আসা কান্নাটাকে সামলে নিলো প্রেমা।চেঁচিয়ে বললো-

নাহ,আপনি তো শুনতে চাননি।বরং আপনার মা শুনতে চেয়েছে।আপনার সাথে নিশ্চয়ই সম্পর্ক গড়ার আগে এমন কোনো শর্ত ছিলো না যে আপনার বোনকে আমার বড় ভাইয়ের বিয়ে করতে হবে।আমার ভাই,ভাবি যে রকম’ই হোক না কেন?ওদের মধ্যে যাই হোক না কেন সেটা ওদের আর আমার পরিবারের ব্যাপার।এটা নিয়ে নিশ্চয়ই আমি আপনার মায়ের কোনো কথা শুনবো না।কিন্তু তাও আপনার মা প্রত্যেক’টা কথার ছুরি এমনভাবে ফেলছে যেন আমাদের পরিবার’টা পুনরায় ভেঙে যাক।উনি তো ইঙ্গিত নয়,সরাসরি’ই বলছে কথাগুলো।

আমার শরীরে বিয়ের আগেই অন্য পুরুষের ছোয়া লেগেছে, আমি কলঙ্কিতা মেয়ে,আমাকে তার অবিবাহিত ছেলে বিয়ে করছে।এটা ওনাদের দয়া।আর এই দয়ার ভিত্তিতে তার ডিভোর্সী মেয়েকে আমার বড় ভাইয়ের বিয়ে করতে হবে।আর সেটা না হলেও সারাটা জীবন ওনার সামনে আমার পরিবার’কে মাথা নিচু করে কৃতজ্ঞতাবোধ জানাতে হবে।

সরি মিঃ প্রিতম,আমি এসব কোনোকালেই সহ্য করতে পারবো না।বিয়ের পরে প্রতিটা কথায় আমাকে কলঙ্কিতা বলে অপমান,আমার পরিবার’কে খোটা,এসব একটুও নিতে পারবো না।আমি এতটাও ভালো বউ হতে পারবো না।ক্ষমা করবেন আমায়।
থেমে লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে বললো-
আংটি’টা কার কাছে পাঠাবো কাইন্ডলি বলে দিবেন।রাখছি।

বলেই ফোন কেটে দিলো প্রেমা।পিয়াশা বেগম হায়হায় করে সোফায় বসে পড়লেন।মেয়েকে কড়া গলায় শাসিয়ে বললেন-

তুই কি বুঝিস এই সব সংসারের?এটা কি করলি?আল্লাহ,এবার যদি ওরা বিয়ে ভেঙে দেয়।একটা মেয়েকে কতটা নরম হয়ে চলতে হয়,তা তুই জানিস?কে শিখিয়েছে এমন চটপটে কথা বলা।
প্রেমা কঠিন চোখে মায়ের দিকে তাকালো।কঠিন চোখের মধ্যে টলটল করা পানিটা কারো চক্ষুগোচর হলো না।শান্ত কন্ঠে বললো –

আমাকে নিয়ে খুব বেশী কষ্ট হলে বলে দিও।চলে যাব এখান থেকে।তাও কারো পা ধরে সংসার করার সাধ জাগবে না।
বলেই হনহন করে দোতলায় চলে গেল।রান্নাঘরের দরজার সামনের দেয়ালে হেলান দিয়ে ডান পা নাড়িয়ে নাড়িয়ে আচার খাচ্ছিলো স্পর্শী।মুখে ক্রুর হাসি।এতোক্ষণের যাবতীয় সকল ঘটনাই শুনেছে সে।এমনকি রাজিয়া বেগমের বলা কথাগুলোও স্পিকার লাউডে থাকায় শুনতে পেয়েছে।প্রেমাকে রুমের মধ্যে ঢুকতে দেখেই আলগোছে এসে শাশুড়ীর পাশের সোফায় বসলো।আঙুলে লেগে থাকা বাকি তেতুঁল টুকু চেটে খেয়ে শাশুড়ীর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে দিলো।তারপর ত্যাড়ামি করে বললো-

একটা কথা জানেন তো মা।আমার মা নেই,শিক্ষা-দীক্ষা নেই, আদব-কায়দার তো ক ও নেই।এই কথাগুলো বুঝে যদি আপনি আমাকে ট্রিট করতেন তাহলে বিশ্বাস করুন কিচ্ছু মনে করতাম না।কিন্তু আপনি কি করলেন,অন্য বাড়ির এক কুটনি মহিলা’কে নিজের বাড়ির বউয়ের উপর লেলিয়ে দিলেন।

আপনি সাহস না দিলে মোটেও ওই মহিলা আপনার ছেলের বউ নিয়ে কথা বলার সাহস পেতো না।কিন্তু কি বলুন তো,যে কুটনি মহিলা সম্পর্ক গড়ার আগেই অন্য বাড়ির বউদের দোষ,কুটনামি করে নিজের আন্ডারে রাখতে চায় সে যে পরবর্তীতে নিজের বাড়ির বউকে এমন ট্রিট করবে না বা অন্যের কাছে নিজের বউয়ের দোষ দিবে না এর কি নিশ্চয়তা আছে।

থেমে ছোট্ট করে বললো-
আগে ভাগে’ই সাবধান হোন।আমার শ্বাশুড়ী তো ভালোই আছে, না জানি প্রেমার শাশুড়ী ভবিষ্যতে কেমন হয়।
যাই হোক,আপনার অপছন্দের বউমার চটাংটটাং করার বাতাস একটু হলেও আপনার মেয়ের গায়ে লেগে গেছে শ্বাশুড়ী’মা।দ্রুত স্টেপ নিন।

কথাগুলো বলে স্পর্শী চলে যেতেই কান্নায় ভেঙে পড়লেন পিয়াশা।সে কি স্পর্শী কে খারাপ চোখে দেখে?সে কি তাকে অপছন্দ করে?বিয়ের প্রথম থেকেই তো ভালোবাসতো।কিন্তু এখন যতবার’ই চায় আপন করে নিতে ততবার’ই ছোট সন্তানের লাশের কথা মনে পড়ে।যতই হোক,ওই এক’ই রক্তের তো।

রাজনীতির রংমহল পর্ব ৪১

বাইরের মহিলার দ্বারা সেতো ইচ্ছে করে কথা শুনায় নি।নেহাত মেয়ের শশুর বাড়ির লোক,তাই কিছু বলেনি।যত দোষ এখন তার’ই।

রাজনীতির রংমহল পর্ব ৪৩