প্রেয়সী পর্ব ৪৫

প্রেয়সী পর্ব ৪৫
নন্দিনী নীলা

মধু আর ফুয়াদ ওদের বাসার থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। বাড়ির সামনে আসার আগেই মধু ফুয়াদ কে থামাতে বলেছে। সাবরিনা নেমেই বাড়ির পথে হাঁটা ধরেছে। পিছু রয়ে গেছে মধু। ওর এখন একটুও ফুয়াদ কে রেখে যেতে ইচ্ছে করছে কেমন‌ জানি ভয় করছে মন বলছে চলে গেলেই ফুয়াদ কে ও হারিয়ে ফেলবে। এমন অদ্ভুত ভয়ে মন কু কেন ডাকছে ও জানে না। ফুয়াদ গাড়ি থেকে নেমে ওর দিকেই চেয়ে আছে আর মধু মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

” কি হলো থ মেরে দাঁড়িয়ে আছো কেন? যাও বাড়ি আসার জন্য তো পাগল হয়ে গেছিলে এখন তো তোমার খুশির সময় আমার জ্বালাতন থেকে মুক্তি পাচ্ছ।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মধু অন্ধকারে ছলছল চোখে তাকাল ফুয়াদের দিকে। অন্য ফ্লাটে থেকে আলোর ঝামটায় ফুয়াদের মুখ একটু একটু দেখা যাচ্ছে মধু আহত চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ফুয়াদ ওর টলমল চোখ দেখে ওর হাত ধরে টেনে ওকে কাছে এনে গাল মুছিয়ে দিয়ে বলে,” এমা কাঁদছো কেন? এতো সহজেই আমি তোমাকে মুক্তি দেব ভেবেছ। যতদিন আমার শ্বাস চলবে আমি তোমায় এভাবেই জ্বালাতন করেই যাব। আর তোমাকে তা সহ্য করতেই হবে। আমার হাত থেকে তোমার নিস্তার নেই।”

মধু ওর কথা শুনে হেসে উঠে।
ফুয়াদ বলে,,” রাত বারোটায় ও লাইট অন করা তোমাদের এলাকার মানুষ কি? এরা ডাকাত নাকি।”
মধু ফুয়াদের বুকে মাথা রেখে বলল,,” আমার ভয় করছে।”

” কেন?”
” আপনি পরিবর্তন হয়ে যাবেন না তো। দূরে চলে গেলে যদি ভালোবাসা ও কমে যায়?”
” তাহলে চলো আবার ফিরে যাই‌।”
” সম্ভব হলে তাই করতাম। আমার আপনাকে ছাড়া থাকতে খুব কষ্ট হবে। আপনি কিন্তু মিতুল আপুর থেকে দূরে থাকবেন।”
” এতো ভয় আমি কি স্বপ্ন দেখছি?”

” মজা নিবেন না। কারো ভালোবাসা নিয়ে মজা নেওয়া ভালো কথা নয়।”
” মজা কোথায় নিলাম? আমি তো হতভম্ব হচ্ছি এই ভালোবাসা এতো দিন আড়াল করে এখন দেখিয়ে আমায় লোভ দেখাচ্ছ তুমি তো ভারি দুষ্টু। এখন তোমায় রেখে যেতে আমার কতটা কষ্ট হয়ে জানো?”
মধু ফুয়াদের বুকে লেপ্টে থেকেই বলল,,” আমার ও তো অনেক কষ্ট হবে।”
ফুয়াদ মধু কে নিজের বুকে থেকে উঠিয়ে ওর গাল দুহাতের বন্ধনে আবদ্ধ করে বলল,” এবার যাও তোমার ভাই বা বাবা আমাকে পেলে কি করবেন আল্লাহ জানেন।”

মধু অসহায় মুখ করে বলল,,” আপনার কি মনে হয় তারা আপনার সাথে আমাকে বিয়ে দিবে?”
” দিবে না কেন? আমার মতো যোগ্য, হ্যান্ডসাম মেয়ের জামাই আর একটা কোথায় পাবে?”
মধু ওর কথা শুনে খিলখিলিয়ে হেসে উঠে‌। ফুয়াদ ওর হাসির শব্দ শুনে বলে আবেসিত কন্ঠে,” এমন ভাবে বিদায় দিচ্ছ যেন আর দেখা হবে না। এটাই আমাদের শেষ সাক্ষাৎ।”
মধুর বুক ধক করে উঠল।

ও ফুয়াদের মুখ চেপে ধরে বলল,,” এমন কথা বলবেন না। আমার মনটা এমনিতেই কু ডাকছে। আপনি সাবধানে যাবেন।”
” আচ্ছা যাও খালা শাশুড়ি ডাকছে ওই যে।”
মধু দেখল বাসার সামনে থেকে খালামনি হাত নাড়িয়ে ডাকছে। মধু সেদিকে থেকে অসহায় মুখ করে তাকাল ফুয়াদের দিকে তারপর বলল,,” আপনি যান তারপর আমি চলে যাব।”
ফুয়াদ ওর কপালে চুমু দিয়ে বলে,,” তোমার যাওয়ার দৃশ্য টা মিস দিতে চাই না। তুমি আগে যাও আমি তারপর চলে যাব।”

মধু একটা ব্যথিত শ্বাস ফেলে হাঁটা ধরল। পেছন থেকে ফুয়াদ ওর হাত আটকে ধরল। মধু তাকাল ফিরে ওর দিকে।
বলল,,” কি?’
ফুয়াদ বলল,,” আমার জন্য অপেক্ষা করবে তো?”
মধু বলল,,” করব।”
” থ্যাংকিউ। এন্ড লাভ ইউ। খুব শীঘ্রই আসছি তোমায় একেবারে নিয়ে যাওয়ার জন্য।”
“আই উইল ওয়েটিং ফর ইউ।”

ফুয়াদ মধুর হাতটা ছেড়ে দিল মধু ধীরপায়ে বাসার দিকে এগিয়ে গেল। একটু পর পর পিছু ফিরে দেখছে ফুয়াদ ওর দিকেই চেয়ে আছে। ওর ফুয়াদ কে ছেড়ে যেতে বুকটা ফেটে যাচ্ছিল। ফুয়াদের কাছাকাছি থাকার জন্য কত বাহানা করেছে। সেভাবে থাকা গেলে কত ভালো হতো। ওর হাত পা ভয়ে কাঁপছে ও‌‌। প্রটেক্ট করার জন্য ওর পাশে ফুয়াদ নাই।

বাবা ওকে কি করবে কে জানে। খালামনি বাবার হাত থেকে ওকে বাঁচাতে পারবে তো? ও বাসার সামনে খালামনির পাশে এসে দাঁড়িয়ে আরেকবার ফুয়াদের দিকে তাকাল গভীর দৃষ্টি মেলে ফুয়াদ হাত নাড়িয়ে বাই দিয়ে গাড়ির দরজা খুলছে। ওর চোখ বেয়ে গলগলিয়ে জল পড়ছে। ওর মন চাচ্ছে ছুটে ফুয়াদের বুকে ঝাঁপিয়ে পরে বলতে,, আমাকে একা ফেলে যাবেন না। আমি থাকতে পারব না।

কিন্তু মধু কিছু করতে বলতে পারল না‌। ওর চোখের সামনে ফুয়াদ গাড়িতে উঠে শো করে চলে গেল দৃষ্টির বাইরে। ফুয়াদের গাড়িটা চোখের আড়াল হতেই মধু ডুকরে কেঁদে উঠল। সাবরিনা মধুর কান্নার শব্দে চমকে উঠল,,” মেহেরিমা।”
মধু সাবরিনা কে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠল,,” খালামনি আমার বুকের ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে ও কেন চলে গেল। আমি কীভাবে থাকব!”

” পাগলি ও তো একেবারে চলে যায়নি। আবার আসবে। চল‌ ভেতরে চল।”
মধু ভয়ার্ত কন্ঠে বলল,,” আমার ভয় করছে। দেখো হাত কাঁপছে।”
” আমি আছি না ভয় পাচ্ছিস কেন?”
” জানি না আমার ভয় করছে খুব তুমি সামাল দিতে পারবে তো?”
” অফকোর্স। চল তো।”

টেনেই গেইটের ভেতরে এল সাবরিনা মধু কে নিয়ে। দাড়োয়ান এতো রাতে মধু কে দেখে চমকে উঠল। দীর্ঘ দিন পর বাড়ির মেয়ে বাড়ি ফিরেছে। তিনি চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে রইল। মধু সালাম ও কেমন আছে জিজ্ঞেস করল তাকে। তিনি উত্তর দিতে পারল না বিষ্ময় এ।

এতো রাত হলেও সবাই এখনো সজাগ আছে। মধু আর সাবরিনা কে কষ্ট করে সদর দরজায় নক করতে হলো না দরজা খোলাই ছিল। ওরা ভেতরে ঢুকে গেল। সবাই সজাগ মধুর মা সানজিদাহ মধু কে পেয়েই জাপ্টে ধরে কান্না করে দিল। মধু নিজেও কান্না করল এতো দিন পর মাকে পেয়ে। মায়ের কাছ থেকে ছাড়া পেতেই মধু ভয় ভয় চোখে তাকাল বাবার দিকে। এদিকে ওদিকে চেয়ে ভাইকে খুঁজল নাই ভাই।

ও একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। মধু বাবার ধমক বকা খাওয়ার জন্য নিজেকে সামলাচ্ছে। কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে তিনি বললেন,,” মেহেরিনা নিজের রুমে যাও অনেক রাত হয়েছে।”
মধু হতবুদ্ধি চোখে বাবার দিকে তাকাল। বাবার শান্ত গলার কথা শুনে ও থমকে গেছে। ও নিজের বাবা কে নিজেই যেন চিনতে পারছে না। বিস্মিত নয়নে বাবার গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। মাহতিম হোসেন বলেই নিজের রুমে চলে গেলেন। মধু অবাক স্বরে নিজের মাকে বলল,,” মাম্মা, বাপি আমাকে বকলো না?”

সানজিদাহ বেগম মধুর হাত ধরে বললেন,” চল কিছু খাবি কত শুকিয়ে গেছিস? কেন পালিয়ে গেছি লি কত কষ্টে কেটেছে আমার দিন জানিস?”
মধু বলল,,” আমি তো আগের থেকে মোটা হয়েছি তুমি মিথ্যা বলছো কেন?”
সানজিদাহ বেগম থতমত খেয়ে গেলেন। মেয়ের স্বাস্থ্য ভালো হয়েছে এটা ঠিক কিন্তু তাই বলে মেয়েকে এতো দিন পর পেয়ে একটু আহ্লাদ করে কিছু বলতে ও পারে না।

মধু মায়ের হাত ধরে বলল,,” মাম্মা আজ আমার এনগেজমেন্ট ছিল আমি কি না খেয়ে থাকব? আমি খেয়েই এসেছি এখন রুমে যাই।”
সানজিদাহ বেগম চোখ কপালে তুলে বলল,,” কি বললি তুই।”
মধু লাজুক মুখ করে হাত উঁচু করে হাতের আংটি দেখিয়ে বলল,,” আংটিটা কেমন বলো তো।”
তিনি আতঙ্কিত গলায় বলল,” এটা কিসের আংটি?”

” আমার এনগেজমেন্ট রিং মাম্মা সুন্দর না?”
সানজিদাহ বেগমের চোখ মুখ রাগে লাল হয়ে উঠল। তিনি রাগী কন্ঠে সাবরিনা কে বললেন,,” এসব কি বলছে ও? এসব কি সত্য?”
সাবরিনা সানজিদাহ বেগম কে বললেন,,” ওর মাথা খারাপ হয়ে গেছে কী সব বলছে। তোমাকে রাগাতে চাইছে। ওর কথা কানে নিও না তো‌। মেহেরিমা রুমে যা তো ফাজলামো বাদ দিয়ে‌।”

মধু কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। ও নিজের রুমে এল অনেক দিন পর। যেমন রেখে গিয়েছিল তেমনি আছে। পুরোনো ফোনটা হাতে পেল কত দিন পর। ও ফোনটা হাতে নিল। ওয়ালপেপার এ ফুয়াদের হাসিমাখা একটা ছবি ভেসে উঠল।
মধু ফুয়াদের নাম্বারে বাসায় ঢুকেই কল দিতে চেয়েছিল কিন্তু ফুয়াদ তো ড্রাইভিং এ আছে তাই কল দেওয়া থেকে বিরত ছিল‌। ক্লান্ত শরীরে শুয়ে পড়তেই ঘুমিয়ে যায়।

সকাল হতেই ও কল লাগায় ফুয়াদের নাম্বারে কিন্তু কল ডুকছে না নাম্বার বন্ধ বলে। ও দুই তিন বার কল দিয়ে ফেলে। তখনি বাইরে থেকে ভাইয়ের চিৎকার আওয়াজ ভেসে আসে। ওর নাম ধরেই ডাকছে।‌ মধুর পিল চমকে উঠে। ফোন বিছানায় ফেলে দৌড়ে বাইরে আসে। ওর বুকের ভেতর ধুকপুক করছে ভয়ে। ভাইয়ের সামনে দাঁড়ানো সাহস নাই। কিন্তু না বের হয়েও উপায় নাই।

মধু মামুনের সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। মামুন ঠাস করে মধুর গালে থাপ্পড় মারল। এতো জোরে থাপ্পর মেরেছে যে মধু পাশেই ওর মা দাঁড়িয়ে ছিল‌ তার উপর গিয়ে পড়ল। মামুন এগিয়ে এসে মধুর চুলের মুঠি ধরে রাগে হিসহিসিয়ে বলল,,” প্রেমিকের বাড়ি গিয়ে ছিলি। আমাদের সবার মান সম্মান নষ্ট করে প্রেমিকের বাড়ি থেকে আসলি। আনতে গেলাম তখন ও আসলি না কত বড়ো কলিজা তোর। আজ তোর কলিজা টেনে ছিড়ব আমি।”

বলেই মামুন আরেকটা থাপ্পড় মারতে চাইল মধুকে। মাহতিম হোসেন এগিয়ে এসে ছেলেকে আটকে টেনে সরিয়ে আনে মেয়ের কাছ থেকে। মামুন চিৎকার চেঁচামেচি করে বাসা মাথায় তুলে নিয়েছে। সাবরিনা এখনো ঘুমে সে জানেই না বাসায় কি ঝড় বয়ে যাচ্ছে।

প্রেয়সী পর্ব ৪৪

মধু কে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে সানজিদাহ বেগম। মধু শব্দ করে কাঁদতে পারছে না ওর চোখ দিয়ে অধরে অশ্রু ঝরছে।
মাথা ভনভন করছে এতো জোরে থাপ্পর দিয়েছে যে ওর গালের অবস্থা শেষ। তার উপর চুলের টানে মাথা ঘুরাচ্ছে ভনভন করে। ও মায়ের কাঁধে চোখ বন্ধ করে মাথা ঠেকিয়ে চোখের জল ফেলছে।

প্রেয়সী পর্ব ৪৫(২)