প্রেয়সী পর্ব ৪৫ (২)

প্রেয়সী পর্ব ৪৫ (২)
নন্দিনী নীলা

তিন্নি নিজের ভাই বোন সবার সাথে বেরাতে যাওয়া বা রেস্টুরেন্টে খেতে যাওয়া নিয়ে অনেক পোস্ট করতো। এক পোস্টে ফুয়াদকে দেখে প্রথম দেখায় মধু ক্রাশ খেয়ে যায়। পোস্ট এ ট্যাগ করা থাকে সবার আইডি সেখানে থেকে মধু ফুয়াদের আইডি ক্রল করে। তিন্নি কে জিজ্ঞেস করতে চেয়ে ও করে না।

করলেই ওকে আবার পচানো শুরু করতে পারে। কারণ মধু কে সব সময় নিজের ভাই নিয়ে অনেক কথা বলত তিন্নি গর্ব করে মধু তখন ডোন্ট কেয়ার ভাব নিতো। এখন ওর ভাইয়ের উপর ক্রাশ খেয়েছে জানলে সর্বনাশ হবে। তাই সরাসরি এসব না জিজ্ঞেস করলেও এনিয়ে বিনিয়ে অনেক কথাই জিজ্ঞেস করে। ও বাসা থেকে পালানোর মাসখানিক আগে ঘটনা এটা। মধু প্রতিদিন ফুয়াদের আইডি চেক করত।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

পালানোর তিনদিন আগে ফুয়াদের ঘুরতে যাওয়ার কয়েকটা ছবি সামনে আসে সেখানে থেকে একটা ব্লাক শার্ট পরা ছবি ওর খুব পছন্দ হয়। একটু পর পর ছবিটা ও দেখতে থাকে ওর আইডিতে ঢুকে। সেটা সেভ করে ওয়ালপেপার এ দিয়ে রাখে বিরক্ত হয়ে। যাতে ফোন ধরলে বিনা কষ্টে দেখা যায়। পালিয়ে যাবার পর যখন বাস থেকে নেমে ও সাহায্যের জন্য গাড়ির কাছে ভূতে ভয় নিয়ে ভীত হয়ে গিয়ে ফুয়াদ কে দেখে বিষ্ময় এ হতভম্ব হয়ে যায়‌।

ও ফুয়াদ কে দেখে ভেবেছিল হয়তো তিন্নি সাথে আছে কিন্তু আশেপাশে তিন্নি কে না পেয়ে তখন একমাত্র ভরসার মানুষ ফুয়াদ কে বুঝেছিল। ফুয়াদের প্রতি ওর একটা দূর্বলতা এসে গিয়েছিল সেটা ভালোবাসা না হলেও পছন্দের মানুষ বলে ধরা যায়। তার সাথে প্রথম দেখায় এক মেয়েকে ক্রাশের সাথে লেপ্টে থাকতে দেখবে কল্পনাও করেনি। এই পালানোর টেনশনের মাঝেও মধুর ঈর্ষা হতে লাগে। ওর সামনে একটা অপরিচিত ছেলে এসে দাঁড়ায়।

ওকে কিছু জিজ্ঞেস করে ও তার দিকে খেয়াল না দিয়ে ফুয়াদের দিকে এগিয়ে যায়। ফুয়াদ আর মিতুলের ধরা হাতের দিকে রাগী দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। ফুয়াদ কে সরাসরি জিজ্ঞাসা করতে চেয়েও করে না। ও ফুয়াদ কে চিনে সেটা মধু গোপন রাখে আর তিন্নির কথাও গোপন রাখে ইচ্ছাকৃত ভাবেই‌ কিন্তু ওর উদ্দেশ্য থাকে সেভাবেই হোক ওদের সাথে বাসায় যাওয়া। তাই হয় ও ফুয়াদের দিকে চেয়ে মিতুলের সাথে কথা বলে। কিন্তু মিতুলের পাত্তা পায় না। কেমন অহংকারী গলায় কথা বলে। ও বাসায় যাওয়ার পর থেকে ফুয়াদের মনোযোগ চেয়েছে অনেকবার কিন্তু পায়নি।

তারপর যখন ফুয়াদ আর মিতুলের বিয়ের কথা শুনে ওর ছোটো মনটা ঠাস করে ভেঙে যায়। খুব কষ্ট হয় পছন্দের মানুষটির সাথে আরেকজনের বিয়ে কথা শুনে। কার না খারাপ লাগবে?
মধু ফোনের রিংটোন এ চিন্তার জগত থেকে বেরিয়ে আসে। দেখে ওর ফোন টা বেজে চলেছে ও ভাবে ফুয়াদের কল দিয়েছে কিন্তু কাছে গিয়ে হতাশ হয় সমুদ্রের‌ নাম্বার দেখে। ও ফোন রিসিভ করে কানে নেয়।

” হ্যালো, মধু কেমন আছো?” ওপাশ থেকে বলে উঠে।
মধু বলে,,” এইতো ভালো। আপনি কেমন আছেন?”
” ছোটো এখনো বাসায় ফিরে নাই ও কি তোমাদের ওখানে আছে নাকি? এতো বার কল দিলাম বন্ধ বলছে নাম্বার। ওর সাথে একটু কথা বলিয়ে দিতে পারবে? মা ঝামেলা করছিল ওর জন্য।”
মধুর বুক ধক করে উঠে আতংকে। ফুয়াদ বাসায় ফিরে নাই মানে কি নয়টা বেজে গেছে রাতেই তো ফিরে যাওয়ার কথা। মধুর শরীর কাটা দিয়ে উঠল ভয়ে।

ও ভয়ার্ত কন্ঠে বলল,,” কি বলছেন এখনো ফিরে নাই মানে কি? উনি তো আমাদের পৌঁছে দিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন। আমার সাথে আর যোগাযোগ হয়নি সকাল থেকে আমি ও তার নাম্বার বন্ধ পাচ্ছি।”
” হোয়াট? ছোটো তাহলে গেল কোথায়?” চিন্তিত গলায় বলল সমুদ্র।
মধু ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল ওর ভয় লাগছে ফুয়াদের কোন বিপদ আপদ হলো না তো। গতকাল থেকেই ও নানান দুশ্চিন্তায় মনটা বার বার কু ডাকছিল। তাহলে কি সেটাই সত্য হলো?

মধু কান্না দমকায় কথা বলতে পারছে না। সমুদ্র নিজেই আবার বলল,,” আরে আরে কাঁদছ কেন? ছোটো হয়ত জরুরি কাছে কোথাও আটকা পরে গেছে। ও কি কাজ করে জানোই তো কখন কোন কাজে কোথায় চলে যায় কাউকেই জানায় না। ফোনটাও হয়তো এজন্য বন্ধ টেনশন করো না। ছোটো একদম ঠিক আছে আমার বিশ্বাস।”
মধু ফুপাতে ফুপাতে বলল,,” সত্যি?”

” একদমই তাই। রাখছি এখন আর একদম টেনশন করে চোখের জল ফেলবে না।”
সমুদ্র ফোন কেটে দিল। মধু একেরপর এক কল দিতে লাগল ফুয়াদের নাম্বারে। কিন্তু বারবার ফোন সুইচ অফ বলছে। ও কল দিল তিন্নি কে। তিন্নি ও ওকে সান্ত্বনা দিল। কিন্তু মধু শান্ত হতে পারল না। ফুয়াদের সাথে কথা না বলা পর্যন্ত ও শান্ত হতে পারবে না।

দরজা ধাক্কার শব্দে মধু চমকে চোখ মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করে দরজা খুলল।
সাবরিনা মধুর দিকে চেয়ে চিন্তিত কন্ঠে বলল,,” মামুন তোমার গায়ে হাত তুলেছে?”
মধু সাবরিনাকে জড়িয়ে ধরে বলল,,” খালামনি ফুয়াদের সাথে যোগাযোগ করতে পারছি না।”
” বিজি হয়তো।”

” ও বাসায় ও যায়নি। উনার কোন বিপদ হলো না তো? আমার খুব ভয় করছে। বাপি, ভাই কোন ভাবে তার আসার খবর পায়নি তো?” কন্ঠ কাঁপছে ভয়ে মধুর। মুখে বললেও ও চাইছে ওর দুশ্চিন্তা যেন মিথ্যা হয়। ভাইয়া যে পরিমাণ রেগে আছে ফুয়াদ কে কাছে পেলে জানি কি করে বসে। আল্লাহ রক্ষা করো।
” তুমি অযথাই টেনশন করছো। এমন‌ কিছুই হয়তো হয়নি। পজিটিভলি ভাবো। নেগেটিভ চিন্তা বাদ দিয়ে।‌”

মধু চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। সাবরিনা ওর গালে হাত দিয়ে বলল,,” ইশ পাঁচ আঙুলের দাগ পরে গেছে‌। আমার এতো বেলা করে ঘুমানো উচিত হয়নি। তোমাকে সেভ করব বলে মার খাওয়ালাম।”
” ইটস ওকে খালামনি। বাপি আমায় সেভ করেছে যেটা আমার জন্য অনেক বেশিই অবাকের। বাবার এতো শান্ত, স্বাভাবিক আচরণ দেখে আমি চিন্তিত হয়ে পরেছি। তিনি গতকাল থেকে আমাকে বিস্মিত করে তুলছে ক্ষণে ক্ষণে। তার তো এতোটা শান্ত থাকার কথা নয়।”

” মেয়ে অন্ত প্রাণ এতো দিন পর মেয়েকে পেয়ে হয়ত রাগ ভুলে ইমোশনাল হয়ে পরেছে।”
মধু ব্যঙ্গতুক সুর তুলে বলল,,” বাপি কখনোই মেয়ে অন্ত প্রাণ ছিল না। তার প্রিয় সন্তান ভাইয়া।”
” এতো রাগ আমার সোনা টার। দুলাভাই তোকে খুব ভালোবাসে।”
” খালামনি তুমি এখন যাও আমার ভালো লাগছে না কথা বলতে।”
” আচ্ছা যাচ্ছি। তুই কি ওই বাসায় কথা বলছিস?”
” কোন বাসায়?”

” আরে ফুয়াদের বাসার কারো সাথে!”
” হুম সমুদ্র ভাইয়া কল দিয়েছিল। আর তিন্নির সাথে।”
” ওহ আচ্ছা টেনশন করিস না খেয়েছিস কিছু?”
” হুম মাম্মা জোর করে খাইয়ে দিয়েছি। তুমি ও খেয়ে নাও।”
সাবরিনা চলে গেল‌।

দুই দিন পর মধু ওর হাতের আংটির দিকে চেয়ে ফুয়াদের কথা ভাবছে আর বিড়বিড় করে কথা বলছে,,
” আপনি কোথায় চলে গেলেন? আমাকে কি একটুও মিস করছেন না? চোখের আড়াল হতেই হারিয়ে গেলেন এমনটা তো কথা ছিল না। আমাকে অপেক্ষায় রেখে কোথায় চলে গেলেন?”

এই দুইদিন মামুন ওর সাথে খুব ভালো আচরণ করেছে। সেদিন মার দেওয়ার জন্য এসে সরি বলেছে। এক গাদা চকলেট এনে ক্ষমা চেয়েছে‌। মধু ভাইয়ের আচরণে ও হতবাক। বাপি তো রাগ দেখায় ই নাই। আর ভাই যাও দেখিয়েছিল এখন একদম শান্ত আর রঙ পরিবর্তন করে ফেলেছে। এতো ভালো হয়েছে ও হজম করতে পারছে না। এদিকে ফুয়াদের কোন খোঁজ পায়নি। প্রতিদিন সমুদ্র আর তিন্নির সাথে ওর কথা হয়। সমুদ্র দুইদিন ফুয়াদের খোঁজখবর না পেয়ে ভয়ে আছে থানায় মিসিং ডায়েরি দেওয়া হয়েছে। সমুদ্র ও মধুর বাপ ভাই কে সন্দেহ করছে। আজ তো বলল ও,,” মধু তোমার ভাই আর বাপ আমার ছোটোর কোন ক্ষতি করে থাকলে আমি তাদের ছাড়বনা মাথায় রেখো।”

মধু নিজেও ভাই আর বাপির আচরণে সন্দেহ প্রকাশ পেয়েছে‌। ফুয়াদ কে রাস্তা থেকে সরিয়ে দেওয়ার খুশিতেই কি তারা এতোটা ভালো হয়ে গেছে। তারা কি নিশ্চিত করে ফেলেছে মধু আর ফুয়াদের কাছে ফিরতে পারবে না। মধু তাদের জিজ্ঞাসাবাদ ও করতে পারছে না আবার সহ্য ও করতে পারছে না। কারো মিষ্টি কথাই ও আর ভালো লাগছে না।
মধুর চিন্তার সুতা ছিড়ল কারো চিৎকার এ। ও তাকিয়ে দেখল ওর কলেজ ফ্রেন্ড সবাই এসে জড়ো হয়েছে‌। দৌড়ে এসে সবাই ওকে জড়িয়ে ধরে এটা ওটা জিজ্ঞেস করছে। ও এতো দিন পর ফ্রেন্ডদের পেয়েও আনন্দিত হতে পারল না মনে দুশ্চিন্তা ভয় ওকে ঘাট করে রেখেছে।

সবাই চলে যাওয়ার পর মধু বেরিয়ে মাম্মার রুমে দিকে হাঁটা ধরল। মাম্মার রুমের কাছে আসতেই ও কিছু কথা শুনে থমকে দাঁড়িয়ে পরল। ভেতরে থেকে বাপি আর মাম্মার তর্কবিতর্ক কানে এল। কথা ওকে নিয়েই হচ্ছে। ওর পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেল। কারণ কথা মূল টপিকস হচ্ছে ওর বিয়ে নিয়ে। দুজনেই বিয়ে নিয়ে তর্ক করছে। বাপি ওর বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে। এটা নিয়ে মাম্মা বিরোধীতা করছে তার সাথে।

” মেয়ে এতো দিন পর বাড়ি ফিরেছে। বিয়ের জন্য ওভাবে চলে গিয়েছিল কোন বিপদ হয়নি এটাই আল্লাহর কাছে শুকরিয়া। তাই বলে ফিরে আসতেই তুমি আবার তাকে বিয়ে নিয়ে পেশার দিবে। আমার মেয়ের মতের বিরুদ্ধে আমি কোন কিছু করতে দেব না তোমাকে।”
” মুখে খুব কথা ফুটেছে।”

” যাই ভাবো না কেন তুমি। এভাবে আর বিয়ে নিয়ে পেশার দিবে না মেয়েকে। আমি আর মেয়েকে হারাতে চাই না।”
মধু আর কিছু শুনতে পারল না দৌড়ে খালামনির রুমের দিকে এগিয়ে গেল।‌ খালামনি তো বলেছিল বিয়ে নিয়ে আর জোর করবে না তাহলে এসব কি? রাগে মধুর কান্না পাচ্ছে।
” খালামনি!”

” কি হয়েছে কাঁদছিল কেন?” সাবরিনা অবাক হয়ে বলল।
মধু সব খুলে বলল। সাবরিনা চমকে উঠল সে নিজেও জানত না এসব।
” আমি তো এসব কিছুই জানতাম না। তোকে নিয়ে আসার আগে আমি তো দুলাভাইয়ের কথা নিয়েছিলাম তোর বিয়ে নিয়ে যেন ঝামেলা না করে।”

প্রেয়সী পর্ব ৪৫

” এসব কী হচ্ছে এই পরিকল্পনা করেছে বলেই বাপি এতো ঠান্ডা ছিল। আর ভাই ও তাই এতো সুন্দর ব্যবহার করছিল।”
” আমি আছি তো দুই টেনশন করিস না। তোর খালা আছে সাথে তোর মতের বিরুদ্ধে কিচ্ছু করতে আমি দেব না।”
” খালামনি আমি ফুয়াদ কে ভালোবাসি ওকে ছাড়া আমি কাউকে বিয়ে করতে পারব না।”
সাবরিনা মধুর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,,” তুই যা চাস তাই হবে।”

প্রেয়সী পর্ব ৪৬