প্রেয়সী পর্ব ৪৬

প্রেয়সী পর্ব ৪৬
নন্দিনী নীলা

মধু গতবারের মতো এবারও ভাবছে পালিয়ে যাবে‌‌। ফুয়াদ নিখোঁজ হওয়ার এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। আজ মধুর বিয়ে ও জানেও না কার সাথে বিয়ে‌। ও ভাবছে সাফিন শয়তান টাই হবে। ওর বিয়ের শখ আমি ঘুচিয়ে দেব ভাবছে মধু। ফুয়াদ কে পাওয়া যায়নি কিন্তু ওর গাড়িটা পাওয়া গিয়েছে নদীর পাড়ে।

তাতে সবাই সন্দেহ করতাছে ফুয়াদ গাড়ি সহ এই নদীতে পড়েছিল। তারপর ফুয়াদ উঠতে পেরেছিল কিনা কেউ জানে না। কারণ ফুয়াদের দেহ পাওয়া যায়নি অনেক খোঁজে ও। গাড়িটা পুলিশ উদ্ধার করেছে। সেই খবর পেয়ে নাফিসা বেগম স্টক করে বিছানায় পড়েছে। মধু ফুয়াদের খবর পাওয়ার পর নিজের বাপি ভাইয়ের সাথে চিৎকার চেঁচামেচি করেছিল। কারণ ওর মনে হয় এর পেছনে এরাই দায়ী। ফুয়াদ এই রাস্তায় এসেই বিপদে পড়েছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ওর কথা কেউ কানেই নেয়নি উল্টো বিয়ের আয়োজন করছে। মধুর মা বিরোধীতা করেছিল বলে তাকে বন্দি করে রেখেছে। সাবরিনা কে ও বাসা থেকে বের করে দিয়েছে মাহতিম হোসেন। কারণ সাবরিনা বিয়ে নিয়ে ঝামেলা করছিল কোন ভাবেই মধুর মতের‌ বিরুদ্ধে বিয়ে হতে দিবেন না তিনি।

বাপি কখনো খালামনির সাথে খারাপ আচরণ করেনি সব সময় নরম আচরণ করত। এই প্রথম মধু খালামনির সাথে বাপির কঠিন রুপ দেখেছে তারপর দেখে ওর জীবনটা নরকে পরিণত হয়েছে। সমুদ্র এর মাঝে পুলিশ নিয়ে বাসায় এসেছিল বাপি ভাইয়াকে কিছুই করতে পারে নি। যথার্থ প্রমাণ ছাড়া তাদের পুলিশ থানায় নেবেন না। কারণ আমার বাপি ভাইয়ের ক্ষমতার জোর অনেক বেশি।

মধু এখনো বিশ্বাস করে না ফুয়াদের কিছু হতে পারে ওর মন বলে ফুয়াদ একদমই ঠিক আছে। দেহ পাওয়া যায়নি বলে ওর মনে আরো আশার আলো জ্বলেছে। মধুর বাপি এবার আর রিস্ক নেয় নি। একজন মহিলা ধরে এনে মধুর রুমে রেখেছে যিনি মধুর পাহারা দেয় চব্বিশ ঘন্টা। মধু তার সামনেই সমুদ্র কে কল দেয়। এখন একমাত্র ভরসা সমুদ্র। বিয়ের খবর তাকে জানানো হয়েছে। মধু সমুদ্রের কাছে সাহায্য চেয়েছে এই বিয়ে থেকে ওকে বাঁচাতে। ও ফুয়াদকে ভালোবাসে। ফুয়াদের দেওয়া আংটি এখনো ওর হাতে জ্বলজ্বল করছে ও ফুয়াদ কে ছাড়া অন্য কাউকে স্বামী হিসেবে মানতে পারবে না‌। সেরকম হলে আত্মহত্যা করবে তবুও বিয়ে করবে না।

সব শুনে সমুদ্র ওকে আশ্বস্ত করে ফলে বলেছে,,” তুমি ভয় পেয়ো না‌। আমি আছি ফুয়াদের অনুপস্থিতি তোমার দায়িত্ব আমার।”
সমুদ্রের কথার উপর ভরসা করে মধু নিশ্চিন্তে আছে কিছুটা।‌ সমুদ্র ঠিক ওকে বাঁচিয়ে নিবে। মধু নিজেকে সান্ত্বনা অনেক ভাবে দিলেও ভয় দূর হচ্ছে না। ফুয়াদ থাকলে ঠিক ওর ভয় কেটে যেত। দুনিয়া উল্টে পাল্টে হলেও ফুয়াদ ওর বিয়ে হতে দিত না। সমুদ্র কি পারবে বিয়ে আটকাতে। ও চিন্তায় বিছানায় শুয়ে পড়ল। রুমে থাকা মহিলাটা ওকে শুতে দেখে নিশ্চিন্ত মনে সোফায় বসল। মধু তার দিকে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আবার চোখ বন্ধ করে র‌ইল।

মধু চোখ খুলে নিজের পাশে দারুণ এক পোশাক দেখতে পেল। ও চোখ ঢলে উঠে বসতেই রুমে থাকা মহিলাটা ওর দিকে ড্রেসটা দিয়ে বলল,,” ম্যাম শাওয়ার নিয়ে এই ড্রেস পরে আসেন।”
মধু উল্টে পাল্টে দেখল খুব সুন্দর একটা লেহেঙ্গা রেড কালারের। ও কপাল কুঁচকে বলল,” এমন গর্জিয়াস ড্রেস পরব কেন আমি। আপনার মাথা ঠিক আছে?”

মধুর মনেই ছিল না আজ ওর বিয়ে। মহিলাটা ওকে মনে করিয়ে দিতেই ও চিৎকার করে উঠল। বিছানা সয়ে সয়ে নেকলেস সাজানো ডায়মন্ডের ও দেখে রাগে চোখ ফিরিয়ে নিল। ফোন হাতে নিতেই ওর ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠল সমুদ্র মেসেজ করেছে। সে নাকি নিজে আসছে ওকে নিতে। সমুদ্র লুকিয়ে এসে ওকে নিয়ে পালিয়ে যাবে সবার চোখে ধুলো দিয়ে। এবার বাসা থেকে বের হতে পারলেই ফুয়াদ কে খুঁজতে পারবে।

মধু ফুয়াদের মুখটা মনে করে ওয়াশরুমে গিয়ে গোসল করল তারপর লেহেঙ্গা পরে এল। ওকে রেড পুতুল লাগছে যেন। ফুয়াদের সাথে বিয়েটা হলে এই ড্রেসটা পরে ওর আনন্দের সীমা থাকত না। নিজেই হয়তো সাজতে বসে যেত। কিন্তু এখন এই ড্রেসটা ওর কাছে কাটার মতো লাগছে। কিন্তু সমুদ্র কিছু একটা করবে সেই আশায় ও দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করছে সব।
পার্লারে থেকে আসা দুইজন মেয়ে মধু কে সাজাতে বসে গেল।
মধু সেজে গুজে ফোন নিয়ে কল করছে সমুদ্রের নাম্বারে।

” হ্যালো, কোথায় আপনি? আমাকে এখানে থেকে নিয়ে যাবেন বলেছিলেন!” বলল মধু
” আমি আসছি। তুমি নিশ্চিন্তে থাকো।”
” বিয়ের সময় হয়ে এসেছে। এতো গার্ড লোকের চোখ এড়িয়ে আপনি আসবেন কি করে? ফুয়াদ থাকলে খুব ভালো হতো। উনার তো অনেক সাহস ঠিক আমাকে নিয়ে পালিয়ে যেতো। আমার খুব ভয় করছে ভয়ে হাত পা কাঁপছে।” ভয় জড়ানো কন্ঠে বলল মধু।

সমুদ্র ওকে বলল,” আমি কিন্তু ভীতু ন‌ই মধু।’
” আমি আপনাকে ভীতু বলিনি। কিন্তু ফুয়াদের মতো সাহসী তো আপনি নন তাই না।”
” হুম।”

মধু কল কেটে মায়ের সাথে একবার দেখা করার ট্রাই করছে। এবার চলে গেলে ও আর কোনদিন ফিরে আসবে না। মায়ের মুখটা কি শেষ বার না দেখেই চলে যাবে। ও বাইরে দেখে আত্নীয় স্বজন বলতে বাবার সব বড়লোক বন্ধু বিজনেস এর লোক গুলো এসে জড়ো হয়েছে দেখল। মধু এক নজর নিচে তাকিয়ে মায়ের রুমের দিকে হাঁটা ধরল। দুই হাতে লম্বা লেহেঙ্গা উঁচু করে ধরে। ও দেখল ওর পিছনে ওকে নজরে রাখা মহিলাটা আসছে।
ও রাগী কন্ঠ স্বরে মহিলাটিকে বলল,,” আপনি আমার পিছু আসছেন কেন?”

মহিলাটি থতমত খেয়ে বলল,,” আপনার কোন কিছুর প্রয়োজন পরে নাকি তাই।”
” রুমে যান আমি আমার মাম্মার কাছে যাচ্ছি‌। মা মেয়ের মাঝে আপনি তৃতীয় ব্যক্তি হয়ে আসবেন না।”
মহিলাটি মুখ কালো করে ওর পিছু দাঁড়িয়ে র‌ইল। মধু রাগে ফ্লোরে লাথি মেরে হাঁটতে লাগল। ফাজিল মহিলা ওর পিছু পিছু এসে রুমের সামনে দাঁড়াল। ও সিটকারি খুলে মহিলা টির দিকে চেয়ে বলল,,” দয়া করে ভেতরে আসবেন না। আমি মায়ের সাথে একটু একাকি সময় কাটাতে চাই।”

হাত জোড় করে অনুরোধ করল মধু‌ দাঁতে দাঁত খিচে। মহিলাটি মাথা দুলিয়ে আচ্ছা বলে দরজার সামনে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।
মধু ভেতরে প্রবেশ করে দরজা লক করে দিল। মহিলাটি সঙ্গে সঙ্গে দরজা ধাক্কা দিতে লাগল অনবরত ভাবছে আমি এই রুমের ভেতর থেকে হয়ত পালিয়ে যাব গাঁধী।
মধু মহিলাটি কে গালি দিয়ে মায়ের কাছে গিয়ে বসল।
ওকে রুমে দেখে সানজিদাহ বেগম ও চমকে উঠেছে।

” তুই রুমে আসলি কিভাবে?” অবাক গলায় বলল সানজিদাহ বেগম।
মধু মায়ের বুকে মাথা রেখে বলল,,”মাম্মা আমি আবার পালিয়ে যাব।”
সানজিদাহ বেগম আঁতকে উঠা গলায় বলে,,” কি বলছিস এসব? পালিয়ে তো গিয়েছিলি ফিরে এসেছিলি কেন?”
” ফুয়াদ বলেছিল বাবার সামনে আমাকে বিয়ে করে নিয়ে যাবে।” নিচু স্বরে বলল মধু।
” ফুয়াদ কে?”
” আমি ফুয়াদকে ভালোবাসি মাম্মা। তিন্নির ভাই ফুয়াদ। আমি যে বাসায় গিয়ে উঠেছিলাম সেই বাসার ছেলে। ফুয়াদ ও আমাকে অনেক ভালোবাসে মাম্মা।”

বলতে বলতে মধু প্রথম দিনের মতো হাত উঁচু করে অনামিকা আঙুলের আংটিটা সানজিদাহ বেগম কে দেখিয়ে বলল,,” আমার এনগেজমেন্ট রিং মাম্মা। ও পড়িয়ে দিয়েছিল।” বলেই লাজুক হাসল মধু।
সানজিদাহ বেগম চোখ ভরা বিষ্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে মধুর দিকে।
মধু একে একে সব খুলে বলল তাকে। তিনি সব শুনে কথা বলতে পারলেন না কিছুক্ষণের মধ্যে। যখন বললেন তখন তার কন্ঠে এলো এক রাশ ভয়,,

” তোর বাপি জানলে তোকে মেরেই ফেলবে।”
“বাপি জানবে না।”
” তুই পালাতে পারবি না। কিন্তু যদি পারিস আর ফিরে আসিস না।”
” পারব মাম্মা সমুদ্র ভাইয়া আসছে আমাকে নিতে। ফুয়াদের সাথে বিয়ে পর উনি আবার ভাসুর হবে।”
” ফুয়াদ কি বেঁচে আছে? অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে যাচ্ছিস।”
” বেঁচে আছে মাম্মা এভাবে বলো না। আমি খুব আশা নিয়ে আছি ও বেঁচে আছে দেখো। হঠাৎ করেই ফিরে এসে সবাইকে চমকে দিবে।”

মধু মায়ের সাথে কথা শেষ করে বেরিয়ে এল। দেখল মহিলাটি এখনো থ মেরে দরজার‌ মুখেই দাঁড়িয়ে আছে। মধু বের হয়ে রুমের দিকে হাঁটা ধরল মহিলাটি আবার ওর পিছু নিল। ও বুঝতে পারছে না এই মহিলাটিকে নিজের কাছ থেকে সরাবে কি করে? এই মহিলা এইভাবে আঠার মতো ওর পিছু লেগে থাকলে ও পালাবে কি করে? উফফ কিছুই মাথায় আসছে না কিন্তু যেভাবেই হোক না কেন উনার মনোযোগ সরাতেই হবে। না হলে আমার পালানো এই মহিলাই বানচাল করে ছাড়বে। এমন খাটাশ মহিলা বাপি কোথায় থেকে ধরে আনছে আল্লাহ তাআলা জানেন।

মধু বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে আছে। হঠাৎ দুজনে মেয়ে আসলো রুমে এদের ও চিনে বাপির ক্লোজ ফ্রেন্ডের মেয়ে। তারা এসে মধুর দুহাত দুজনে ধরে নিচে নিয়ে যাবে বলল।
মধু আঁতকে উঠে দাঁড়াল। সবার মাঝে চলে গেলেও পালিয়ে যাবে কি করে। ওর চোখেমুখে ভয় প্রকাশ পেল। মধু কি করবে কি করবে ভেবে বলল,,” আমি একটু ওয়াশরুমে যাব।”

দুজনেই হাত ছেড়ে দিল। মধু ওয়াশরুমে এসে ফোন করল সমুদ্র কে। কিন্তু সমুদ্র ফোন রিসিভ করছে না। মধুর এখন গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে কান্না করতে ইচ্ছে করছে। ও চোখে জলে ভিজে উঠল। বারবার সমুদ্রের নাম্বারে কল করতে লাগল কিন্তু ফোন রিসিভ করছে না সমুদ্র। এবার ফোন বন্ধ বলল ওর নিজেকে এবার খুব অসহায় লাগতে শুরু করল। বাইরে থেকে দরজার শব্দ আসছে। ও দরজা খুলছে না। ও বের হবে না। বের হলেই আরেকজনের নামে কবুল পড়তে হবে ভাবতেই ওর কেমন শরীর কাঁটা দিয়ে উঠে।

“মেহেরিমা দরজা খোল।” বাবার কর্কশ আওয়াজ কানে আসতেই মধুর পিল কেঁপে উঠল।
মধু কত সময় ধরে ওয়াশরুমের দরজা আটকে আছে জানে না জানতেও চায় না‌।
” মেহেরিমা দরজা খোল। দরজা ভেঙে ঢুকতে বেশি সমস্যা আমাদের হবে না। কিন্তু আমি শান্তি বজায় রাখতে চাইছি।”

মধু চোখ ভর্তি অশ্রু নিয়ে দরজা খুলে দিল। কান্না করে সাজ নষ্ট হয়ে বিচ্ছিরি অবস্থা হয়ে গেছে। নতুন করে ওকে সাজাতে বলে মাহতিম হোসেন চলে গেলেন। একটু পর মেয়ে দুটোর সাথে মধু কে নিচে আসতে হলো। জোরজবরদস্তি করেই ওকে নিচে নিয়ে এসেছে।

প্রেয়সী পর্ব ৪৫(২)

নিচে এসে মধুর চোখ আটকে গেল বাপি ভাইয়ের সাথে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার উপর। ও চোখ কচলে সামনে তাকাচ্ছে এভাবে কীভাবে দাঁড়িয়ে আছে উনি? বাপি আর ভাইয়া উনার সাথে হেসে হেসে কি কথা বলছে? মধুর চোখ দুটো বিষ্ময় এ বড়ো বড়ো হয়ে উঠল।

প্রেয়সী পর্ব ৪৭